শাসক এবং বিরোধী পক্ষ বদলেছে। রাজনীতির বাকি ঘটনাপ্রবাহের ধারা যে একই আছে, বুধবার ফের তার নমুনা মিলল!
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)-সহ ২১টি গণ সংগঠনের অনশন-অবস্থান মঞ্চে এ দিন হাজির হন কাকদ্বীপের দুই ‘ঘরছাড়া’ সিপিএম সমর্থক। যে ভাবে সিপিএম শাসক থাকার সময়ে তৎকালীন বিরোধী শিবিরের অনেকে মানবাধিকার সংগঠনগুলির দ্বারস্থ হতেন।
আবার মেট্রো চ্যানেলে দাঁড়িয়ে মাওবাদীদের বিভিন্ন ভাবে ‘সমর্থনে’র জন্য নাম না-করে বিশিষ্টদের একাংশকে এক হাত নিলেন তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মাওবাদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ‘মদত’ দেওয়ার জন্য যে ভাবে মানবাধিকার সংগঠন-সহ বিশিষ্টদের একাংশকে অতীতে ‘আক্রমণ’ করত শাসক সিপিএম।
এপিডিআর-সহ ওই সংগঠনগুলির সঙ্গে যখন সরকারের বিরোধ বেধেছে, তখনই তাদের অবস্থান মঞ্চে সিপিএমের ‘ঘরছাড়া’ সমর্থকদের উপস্থিতি ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। এপিডিআর-এর নেতা তাপস চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘পরিবর্তনের পরে শাসক দলের চেহারাটা একই রয়ে গিয়েছে! আগে সিপিএমের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ ঘরছাড়া হত। এখন তৃণমূলের অত্যাচারে হচ্ছে। পরিবর্তনের পরে আমরা কিন্তু ভাল কিছু আশা করেছিলাম।”
যেখানে এপিডিআর-এর সভা করার অনুমতি ‘প্রত্যাহার’ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিশিষ্ট জনেদের একাংশের ‘সংঘাত’ হয়েছে, ধর্মতলার সেই এক ফালি ফুটপাথেই এ দিন বুধবার তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র সমাবেশে পার্থবাবু বলেছেন, “কলকাতায় বসে কেউ কেউ জঙ্গলমহলে পুলিশ ঢুকলে বিবৃতি দেন। কিন্তু সেখানে পুলিশকে মারলে (খুন) বা গরিব মানুষকে মারলে তাঁদের তো বিবৃতি দিতে দেখি না!” তাঁর আরও বক্তব্য, “যে কোনও মূল্যে রাজ্যে খুন (মাওবাদীদের হাতে) বন্ধ করতে হবে।” পার্থবাবুর ‘হুঁশিয়ারি’, “জঙ্গলমহলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে উন্নয়নের কর্মসূচি নিয়েছেন, তা ব্যাহত করতে কয়েক জন চক্রান্ত করছে। কিন্তু সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হবে!”
যাদের কর্মসূচি ঘিরে বিশিষ্টদের সঙ্গে সরকারের ‘সংঘাত’, ছেড়ে কথা বলেনি তারাও! মেট্রো চ্যানেলে অনুমতি না-পেয়ে এ দিন থেকেই বৌবাজারে অনশন-অবস্থান শুরু করেছে এপিডিআর-সহ ২১টি গণসংগঠন। আর সেই মঞ্চে উপস্থিত হয়ে উপস্থিত হয়ে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের সমর্থক এবং কাকদ্বীপের বাপুজি এলাকার বাসিন্দা দক্ষিণারঞ্জন ময়রা বলেছেন, “ভোটের ফল বেরনোর পর থেকেই আমরা তৃণমূলের অত্যাচারে ঘরছাড়া। আমাদের অপরাধ, আমরা সিপিএম সমর্থক ছিলাম! তৃণমূলের বাহিনী আমাদের জমি জোর করে দখল করে নিয়েছে। যারা ধান রুইয়েছিল, তাদের ধান কেটে নিয়ে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত আমাদের গ্রামে ১৪টি পরিবার ঘরছাড়া।” আর এক সিপিএম সমর্থক নিমাই হালদার বলেন, “ওখানে সিপিএমের আর কোনও অস্তিত্বই নেই। পুলিশও সাহায্য করছে না। তাই এপিডিআর-এর কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি।”
মেট্রো চ্যানেলে আইএনটিটিইউসি-র দু’দিনের সমাবেশের জন্যই এপিডিআর-কে অন্যত্র সভা করতে বলেছিল পুলিশ। সেই ঘটনাকে ঘিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে ‘ফ্যাসিস্ত’ বলতেও দ্বিধা করেননি মহাশ্বেতা দেবীর মতো বিশিষ্ট জন। কিন্তু সমাবেশের প্রথম দিনে ‘পরিবর্তনপন্থী’ এক বিশিষ্ট অমিয় চৌধুরীও মানবধিকার সংগঠনের সমালোচনা করে বলেন, “মেট্রো চ্যানেলে একটা সভা করতে না-পেরেই একটা সরকারকে ফ্যাসিস্ত বলা ঠিক নয়। আসলে এখানে মানবধিকারের কাজকে পেশায় পরিণত করা হয়েছে।”
মেট্রো চ্যানেলে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টে পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান-সমাবেশ কেন, তা ব্যাখ্যা করে আইটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেন বলেন, “আমরা এ দিন জঙ্গলমহলে শান্তি ও উন্নয়নের প্রশ্নে সভা করছি। কারণ, গত ৩৪ বছরে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গ আর্থিক দিক থেকে তো বটেই, সার্বিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে। আমরা আর পিছিয়ে যেতে চাই না।” আজ, বৃহস্পতিবার তাঁদের দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচির বিষয় নন্দীগ্রাম, নেতাইয়ে ‘গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের’ বিচারের দাবি। সমাবেশে যোগ দিতে এ দিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রমিক-কর্মীরা এসেছিলেন। পার্থবাবু দাবি করেন, “এই শ্রমিক-কর্মীরা কিন্তু কাজ বন্ধ করে আসেননি। এঁদের কল-কারখানায় কিন্তু উৎপাদন চলছে। আসলে আমাদের নেত্রী স্পষ্ট বলেছেন, কাজ বন্ধ করে কোনও আন্দোলন করা নয়। রুজি-রোজগারের জায়গা চালু রাখতেই হবে।” সভামঞ্চে জঙ্গলমহল ও নেতাইয়ের ‘শহিদ’ পরিবারের কয়েক জন উপস্থিত ছিলেন। |