সকাল ৮টা। হাওড়া স্টেশনের প্রি-পেড ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চালকদের টাকা দেওয়ার বুথ।
সেই বুথের সামনেই দাঁড়িয়ে সারি দিয়ে ট্যাক্সি। সাদা টি-শার্ট পরা এক যুবক কয়েক জন ট্রেনযাত্রীর সঙ্গে স্টেশন থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে তাঁদের তুলে দিতেই বুথের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন নীল জামা ও নীল প্যান্ট পরা আর এক যুবক। তিনি সাদা টি-শার্টের ওই যুবককে কিছু বলতেই আচমকা তাঁর কলার ধরে মারতে শুরু করে ওই যুবক। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছুটে আসেন ট্রাফিক পুলিশের কর্তব্যরত কর্মী। যিনি কিছুক্ষণ আগে নিজেই ওই বেলাইন ট্যাক্সিতে যাত্রী তুলতে সাহায্য করছিলেন।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে নীল জামা পরা ওই যুবককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি প্রি-পেড বুথের কর্মী। নাম শ্যামলাল। যে আমাকে মারল, সে স্টেশনের এক জন দালাল। সকাল থেকে প্রি-পেড বুথে ট্যাক্সি ঢুকতে না-দিয়ে ‘ফাইল ট্যাক্সি’ চালাচ্ছে। তাই আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম।”
দেশের অন্যতম বৃহৎ এই স্টেশন চত্বরের হাল কার্যত এই ঘটনাতেই খানিকটা স্পষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এই অবস্থা? ‘ফাইল ট্যাক্সি’ই বা কী? স্টেশনে এই দালালরাই বা কারা?
হাওড়া স্টেশনে দায়িত্বে থাকা রেল পুলিশ, রেলরক্ষী বাহিনী ও ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ‘ফাইল ট্যাক্সি’ আসলে কোড বা সাঙ্কেতিক নাম। যার অর্থ লাইনের বাইরে থাকা ট্যাক্সি। |
মার খাচ্ছেন প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথের এক কর্মী। হাওড়া স্টেশনের সামনে। ছবি: রণজিৎ নন্দী |
অভিযোগ, এই ‘ফাইল ট্যাক্সি’র জন্যই হাওড়া স্টেশনে ফের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে এক শ্রেণির দালাল ও দালালদের পিছনে থাকা কিছু শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও রেল পুলিশের একাংশের। তৈরি হয়েছে গোপন ‘সিন্ডিকেট’। বেড়ে গিয়েছে ট্যাক্সিচালকদের যাত্রী প্রত্যাখ্যান। এমনকী, অপরাধমূলক কাজও। কারণ, ‘সিন্ডিকেটের’ জন্য দালালদের হাতে মাত্র ১০ টাকা দিলেই চালকেরা পেয়ে যাচ্ছেন যাত্রী প্রত্যাখ্যানের যাবতীয় ক্ষমতা এবং অধিকার।
কোথায় পাওয়া যায় এই সমস্ত বেলাইন ট্যাক্সি?
রেল পুলিশ জানায়, এই ট্যাক্সিগুলি সাধারণত থাকে প্রি-পেড ট্যাক্সি বুথে, ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের বাইরে এবং নতুন কমপ্লেক্সের কাছে জলের ট্যাঙ্কের নীচে। অভিযোগ, সকাল-সন্ধ্যায় কিছুটা লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও সারা রাত ‘খুল্লমখুল্লা’ চলে এই ট্যাক্সি। এমনকী, ক্যাব রোডে ট্যাক্সির প্রবেশ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাতে তাদের প্রবেশ অবাধ হয়ে যায়। রেল পুলিশের মতে, প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার ফাইল ট্যাক্সি চলে হাওড়া স্টেশন চত্বরে। ট্যাক্সি প্রতি ১০ টাকা করে নিলে প্রতিদিন গড়ে আয় হয় ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মাসে ১৫ লাখ টাকা। এই টাকাই ভাগ হয়ে যায় ‘সিন্ডিকেটের’ লোকজনের মধ্যে।
হাওড়া স্টেশনে রয়েছে দু’টি প্রি-পেড বুথ। একটি পুরনো কমপ্লেক্সে, অন্যটি নতুন কমপ্লেক্সে। প্রি-পেড বুথে যাত্রীরা গন্তব্যস্থল অনুযায়ী পূর্ব নির্ধারিত ভাড়া দিলে সেই মতো ট্যাক্সিও পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ, বুথে ১০ টাকা দিলেই ট্যাক্সিচালকেরা পেয়ে যাচ্ছেন ইচ্ছামতো যাত্রী তোলার ক্ষমতা। ফলে সমস্যায় পড়ছেন প্রি-পেড বুথে আসা যাত্রীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়েও ট্যাক্সি মিলছে না। অগত্যা বেশি টাকা দিয়ে ফাইল ট্যাক্সি ধরতে হচ্ছে।
রাজ্য পরিবহণ দফতরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত দু’টি প্রি-পেড বুথের দায়িত্বে রয়েছে হুগলি নদী জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতি। ওই সমিতির সহকারী ম্যানেজার দেবনারায়ণ মহান্তি বলেন, “এটা ঠিকই যে, আমাদের কিছু কর্মী এই অন্যায় কাজ করছেন। এ ব্যাপারে আমরা নজর রাখছি। তা ছাড়া, রেল পুলিশও ফাইল ট্যাক্সি বন্ধ করতে চেষ্টা করছে।”
হাওড়া স্টেশনে ট্যাক্সিচালকদের এই জুলুম ও দালাল-রাজ নিয়ে উদ্বিগ্ন রেল পুলিশের ডিজি দিলীপ মিত্র। তিনি বলেন, “হাওড়া রেল পুলিশ সুপারকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। এডিজি ও ডিআইজি ইতিমধ্যে স্টেশন চত্বরে ঘুরে এসেছেন। সম্প্রতি ১৪ জন দালালকে ধরাও হয়েছে।” ডিজি স্বীকার করেন, রেল পুলিশেরই কয়েক জন ওই দালাল-চক্রের সঙ্গে যুক্ত। তাদের এক জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বসিয়ে দেওয়া হয়েছে এমনই এক জন ট্রাফিক ইনস্পেক্টরকে। |