আপনার কলমে


হাজার দ্বীপের দর্শনে
পায়েল চক্রবর্তী
(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
হাতে কোনও লম্বা ছুটি ছিল না। কিন্তু পথের টান আটকায় কে! অনেক দিন আগে জনপ্রিয় এক হিন্দি ছবিতে দ্বীপে হারিয়ে যাওয়ার একটি দৃশ্য দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম সুযোগ পেলে এক দিন ঠিক ঘুরতে যাব কোনও এক দ্বীপে। ভাবনা সত্যি করে, বিদায়ী এক বসন্ত-সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য উত্তর আমেরিকার ‘থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড’।
চওড়া-চিকন রাস্তায় চকচকে রোদের আলোয় চটুল ছন্দে ছুটল গাড়ি। আমাদের বাড়ি অর্থাত্ নিউ জার্সির সামারভিল থেকে প্রায় ৪০০ মাইলের পথ থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড। বেরিয়েছিলাম ভোর ৫ টায়। ৮ ঘণ্টার পথে, মিনিট দশেকের দু’বার বিশ্রাম। ধন্যবাদ জিপিএস প্রযুক্তিকে। পথ হারানোর ভয় নেই। সিডি প্লেয়ারে পছন্দের গান শুনতে শুনতে এক সময় পৌঁছে গেলাম দ্বীপরাজ্যে! গাড়ি থেকে নামতেই এত নিষ্কলুষ পরিবেশ দেখে কর্তামশাই বেশ রোম্যান্টিক ভাবে গান ধরলেন, ‘দেখো রে, নয়ন মেলে জগতের বাহার...’। ঝলমলে রোদ আর চারদিকে সবুজের সমারোহ— প্রকৃতি যেন সর্বাঙ্গসুন্দর। আগে থেকে রিজার্ভ করা রিসর্টে লাগেজ রেখে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। একসঙ্গে এত দ্বীপ দেখতে পাওয়ার আনন্দ তখন আমাদের মনে জেঁকে বসেছে।
কানাডার অন্টারিও প্রদেশ ও উত্তর আমেরিকার নিউ ইয়র্ক রাজ্যের বর্ডারে ৪০ বর্গ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১৮৬৪টি দ্বীপ নিয়ে থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড। কানাডা এবং উত্তর আমেরিকার সভ্যতা-সংস্কৃতি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে সেন্ট লরেন্স নদীর জলে। অনেকগুলি দ্বীপে তৈরি হয়েছে বিলাসবহুল রির্সট আর তার সঙ্গে আছে বিনোদনের ভরপুর রসদ। তবে বেশির ভাগ দ্বীপই ব্যক্তিগত। আবার এমন অনেক দ্বীপ আছে, যেখানে শুধু দু’টি গাছ আর একটু নুড়িপাথর দেখা যায়।

দ্বীপ দর্শনে আর দেরি না করে কাউন্টার থেকে তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে ফেরিতে উঠলাম। ডেকে দাঁড়াতেই রোমাঞ্চ ঘিরে ধরল যেন! নদীর জল এত স্বচ্ছ যে চট করে ‘মেকআপ’ সেরে নিতে কোনও অসুবিধা হবে না! হাজার দ্বীপের দেশে সবচেয়ে বড় কানাডার উলফ আইল্যান্ড। আমাদের বোট প্রথম যেখানে এসে থামল তার নাম হার্ট আইল্যান্ড। জীবনে এই প্রথম কোনও দ্বীপে পা রাখা! মনে হচ্ছিল আইল্যান্ডটি তার সবুজ ঘাসের কার্পেট পেতে অতিথি আপ্যায়নে উন্মুখ! মূল যে আকর্ষণের জন্য এখানে আসা, তার নাম ‘বোল্ট ক্যাসল’। ১৯০০ সালের গরমকালে জর্জ বোল্ট ঘুরতে এসে এই আইল্যান্ডটি দেখেছিলেন। এখানে স্বপ্নের ইমারত বানিয়ে তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন। সেই ভাবনার বাস্তব রূপ দেন ৩০০ জন কারিগর। বানানো হয় ১২০টি কক্ষ বিশিষ্ট দুর্গ, তাও আবার সুড়ঙ্গ সমেত। দুর্গ জুড়ে বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে তৈরি হয় পাওয়ার হাউস। মার্বেল, ফুল, গাছগাছালি দিয়ে সাজানো বোল্টের ইটালিয়ান বাগান খুব সুন্দর। খেলার জায়গা, অলস্টার টাওয়ারের সঙ্গে পাখিদের জন্য বার্ড হাউসও জায়গা করে নেয় এই ক্যাসল-এ। নিরাপত্তা সুরক্ষিত করার জন্য মজুত ছিল ড্র-ব্রিজও।

কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! এমন উপহার পাওয়ার আগেই বোল্টের স্ত্রী মারা যান। অর্ধসমাপ্ত থেকে যায় স্বপ্নের ইমারত। বোল্টের নির্দেশ মতো সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ প্রায় ৭৩ বছর পর সেই অর্ধসমাপ্ত কাজ শেষ করে। কিছু জায়গার আধুনিকীকরণ করে বোল্ট ক্যাসল খুলে দেওয়া হয় পর্যটকদের জন্য।

ক্যাসল দেখে মনে হচ্ছিল, ভালবেসে কাউকে না পাওয়ার অতৃপ্ত বাসনার ছোঁয়া লেগে আছে যেন। মনটা একটু ভারী লাগে। কিন্তু, পাশে দেখলাম এক মার্কিন দম্পতির বিবাহবার্ষিকী পালন হচ্ছে মহাসমারোহে। মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। আনন্দ অনুষ্ঠানের জন্য ক্যাসলটি ভাড়া দেওয়া হয় প্রায় ২০০ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে। আড়াই মিলিয়ন ডলারে নির্মিত এই ক্যাসল-এ ঐতিহ্যের পরম্পরার সঙ্গে প্রাচুর্য যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। হাতে খুব একটা সময় ছিল না। তাই পাওয়ার হাউস ও অলস্টার টাওয়ারকে দূর থেকে হাত নেড়েই বিদায় নিলাম।
পাওয়ার হাউস বোল্ট ক্যাসল ক্যাসলের ড্র-ব্রিজ
বোট যখন এগিয়ে চলেছে তখন আরও ছোট ছোট দ্বীপ চোখে পড়ল। বেশ কিছু সুসজ্জিত বাড়িও দেখতে পেলাম একটা দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। দু’জন মহিলা বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাত নাড়ছিলেন। পাশের এক মার্কিন ভদ্রলোক জানালেন, দ্বীপটি এক বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রীর। ছুটি কাটানোর জন্য কোলাহলবর্জিত এই দ্বীপে এসে তিনি থাকেন। অদূরেই আরও একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছিল, নাম ‘ডিয়ার আইল্যান্ড’। সেখানে একটি লাল রঙের বাড়ি চোখ টানছিল। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সেটি রাসেল ট্রাস্ট অ্যাসোসিয়েশনের স্কাল অ্যান্ড বোনস সোসাইটি-র। ইন্টারনেট ঘেঁটে আগে থেকেই একটু তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছিলেন আমার কর্তামশাই। না হলে নামটা হয়তো অজানাই থেকে যেত!

বোটে বেশ অনেকটা পথই পার হয়ে এসেছি। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে মন যেন আনমনা। দূরে দিগন্তরেখা উদ্ভাসিত করে ম্যাপল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শিল্পীর তুলিতে আঁকা রামধনু। বোটের পাশ ঘেঁষে উদ্যম গতিতে স্পিডবোট নদী উত্তাল করে ছুটে চলেছে। প্রায় কানাডার বর্ডার ছুঁই ছুঁই, তবু দৃষ্টি যে বাঁধন মানে না! বার বার লঙ্ঘন করতে চায় সীমানা। হঠাৎ কেউ যেন বলে উঠলেন, ‘দেখ দেখ, জলে কী রকম সীমানা দেওয়া!’ চমকে উঠলাম! বোটের ব্লেড জল কাটিয়ে যখন সামনে এগোচ্ছে, সেখানে সূর্যালোক আর রামধনুর যুগলবন্দির প্রতিচ্ছবিটা এমন ভাবে পড়েছে যে একপলকে দেখলে মনে হয় কেউ যেন জলে সীমারেখা টেনে দিয়েছে!

এত ক্ষণে কতগুলো দ্বীপ যে দেখে ফেলেছি তা গুনতির বাইরে চলে গেছে। ঠান্ডা বাতাসের হাওয়া জানান দিচ্ছে ‘রজনী আসিছে ধীরে দুই বাহু প্রসারিয়া’। আকাশ আর নদীর মধ্যে যেন আবির খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। একটা গান খুব মনে পড়ছিল, ‘আহা কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে আকাশ খেলে হোলি...’
নদীর বুকে স্পিডবোট রামধনুর সীমারেখা
কাজের ব্যস্ততা, শহুরে যান্ত্রিকতা, মাপা কথার ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি পেতেই এখানে ছুটে আসা। এই অমলিন প্রকৃতির নয়নভোলানো সৌন্দর্যে নিজেকে উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করে। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই ভুলে থাকা নয়, অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প, মাছ ধরার আয়োজন, বিলাসবহুল থাকা-খাওয়া— সবই আছে এখানে। পৃথিবীর অন্যতম ডাইভিং স্পট হিসেবে বেশ খ্যাতি এই আইল্যান্ডের। এ ছাড়াও নানা রকম আকর্ষণীয় ইভেন্ট-এর মধ্যে বোট রেস এবং প্যাডলিং রেস অন্যতম।

দ্বীপরাজ্যে এসে দ্বীপবাসীদের খাবার চেখে দেখব না তা কি হয়! মেনুকার্ড দেখে অর্ডার করলাম ‘অথেনটিক থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড ড্রেসিং’। সেদ্ধ ডিমকে সরু করে চারফালি কেটে, ছোট টোম্যাটো, লেটুস, শশা, মেয়োনিজ, মাস্টারড সস, কেচ-আপ দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো সতেজ খাবার। এই খাবারটি বিশ শতকে নিউ ইয়র্কের ক্লেটনের অধিবাসী সোফিয়া তার স্বামীকে ডিনারে প্রথম পরিবেশন করেছিলেন। পরে হলিউড অভিনেত্রী মে আরউইন থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড এ বেড়াতে এসে এই খাবারটি খেয়ে মুগ্ধ হয়ে বন্ধু বোল্টকে তার রেসিপি দেন। তার পর ধীরে ধীরে খাবারটির নাম তার নিজগুণে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

এ বার ফেরার পালা। সেই মায়াবী আবিররাঙা আলোয় মনকে সান্ত্বনা দিয়ে আর এক বার ফিরে তাকাই মোহময়ীর দিকে। পা বুঝি কেউ টেনে ধরে.. শেষ বারের মতো দেখে নেই শান্ত স্তব্ধ দ্বীপগুলিকে।

খুঁটিনাটি
১. প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার আদর্শ সময় সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। তবে জুলাই মাসে নানা ইভেন্ট-এর আয়োজন থাকে।
২. সঙ্গে অল্প শীতের পোশাক রাখলে মন্দ হবে না।
৩. রেন্টাল কার বা ‘গো টু বাস’ সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। বাস ছাড়ে নিউ ইয়র্ক, পারসিপেনি আর এডিসন থেকে।
৪. সব জায়গা ঘুরে দেখার সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের পরিকল্পনা থাকলে দু’দিন-দু’রাতের জন্য হোটেল বুক করতে হবে।
৫. দ্বীপ দর্শনে দিনভর সুলভ সার্ভিস দিতে সিঙ্গল বোট, জেট বোট, স্পিড বোট, ফেরি পরিষেবা সর্বদাই মজুত।
৬. সর্বোপরি এই হৃদয়কাড়া সৌন্দর্যকে ফ্রেমবন্দি করতে সঙ্গে ক্যামেরা রাখতেই হয়।

এক কথায়: এক সঙ্গে এত দ্বীপ, কল্পনারও অতীত!

হাওড়া জেলার মেয়ে। ‘সোশাল ওয়ার্ক’ নিয়ে স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে স্বামীর কর্মসূত্রে আমেরিকায়। গান শোনা, নতুন রান্না করার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ভ্রমণ কাহিনি লেখাও অন্যতম সখ।
আলোকচিত্রী: সুশান্ত চক্রবর্তী।

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ