আপনার কলমে


রঙের রাজ্য ভায়ান্দার ভ্যালি
অনুপম মল্লিক
রও এক বার হিমালয় দর্শন। তবে এ বার শুধু পাহাড় নয়, পরীদের সন্ধানে যাওয়া হবে উত্তরাঞ্চলের ফুলের দেশ ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস’-এও।

উত্তর কলকাতা ও শহরতলির কয়েক জন বাসিন্দা মিলিয়ে বেশ বড় দল— এক দিকে ৬৩ বছরের দাসবাবু, অন্য দিকে ২৭ বছরের ছোটকা। এ ছাড়া দেবুদা, অরুণাভদা, অশ্বিনীদা, প্রতাপদা, হাবলদা, সুদাম, লাল্টু, মানিকতলার চড়াই, বিধাননগরের শালিক আর সঙ্গে অবশ্যই আমি। হাওড়া থেকে দুপুর ১:১০-এর উপাসনা এক্সপ্রেসে পর দিন বিকেল চারটে নাগাদ হরিদ্বার পৌঁছে, রাতে সেখানকার এক হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা ছিল। পর দিন যেতে হবে ২৭৬ কিলোমিটার পথ। গন্তব্য গোবিন্দঘাট। হৃষিকেশ-দেবপ্রয়াগ-রুদ্রপ্রয়াগ-কর্ণপ্রয়াগ-চামোলি-জোশিমঠের প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে গোবিন্দঘাট পৌঁছতে সন্ধে সাড়ে সাতটা হয়ে গিয়েছিল। চোদ্দ-সিটার ট্রাভেলার গাড়িতে প্রায় বারো ঘণ্টার সফর। উত্তরাখণ্ডের বাঁকে বাঁকে নদী, যার সঙ্গমস্থলে গড়ে উঠেছে পাহাড়ি শহরগুলি— দেবপ্রয়াগে অলকানন্দা-ভাগিরথী, রুদ্রপ্রয়াগে অলকানন্দা-মন্দাকিনী, কর্ণপ্রয়াগে অলকানন্দা-পিণ্ডার। তেমনই অলকানন্দা-লক্ষ্মণগঙ্গার সঙ্গমস্থলে প্রায় ৬০০০ ফুট উচ্চতায় চামোলি জেলার একটি ছোট্ট শহর গোবিন্দঘাট। এখান থেকে দু’টি রাস্তা চলে গিয়েছে দু’দিকে— বদ্রিনাথধাম ও হেমকুণ্ড সাহিব। বদ্রিনাথের রাস্তায় গাড়ি চললেও, হেমকুণ্ড হেঁটেই যেতে হয়। এ হেন প্রকৃতির দরবারেই রয়েছে ফুলের রাজত্ব, কাকভূশন্ডি সরোবর, তীর্থস্থান হেমকুণ্ড সাহিব ও লক্ষ্মণ মন্দির।

২০১২, জুলাই মাসের প্রায় শেষ। ভরা বর্ষাতেও পর্যটকের ঢল গোবিন্দঘাটে। তবে এদের বেশির ভাগই তীর্থযাত্রী, যাঁরা হেমকুণ্ড সাহিব যাবেন। বেশ কিছু হোটেল থাকলেও তীর্থযাত্রীদের অনেকে এখানকার গুরুদ্বারে ওঠেন। আমরা হোটেলেই ছিলাম যার ‘ডাবল-বেড’ ঘরের ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকা। হরিদ্বার থেকেই বৃষ্টি সঙ্গ নিয়েছিল। তাই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ট্রেকিং শুরু হল সকাল সাতটায়। লাঠি আগেই কেনা ছিল। আমাদের অনেকেই অবশ্য ঘোড়া ভাড়া করলেন। বাকিরা পিট্টুদের ঘাড়ে স্যাক চাপিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম রঙিন ভায়ান্দার উপত্যকায়।

আজ যেতে হবে গোবিন্দঘাট থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে, প্রায় দশ হাজার ফুট উঁচুতে, ঘাগারিয়া— হেমকুণ্ডের পথে ভায়ান্দার গঙ্গা ও পুষ্পবতী নদীর সঙ্গমস্থলে একটি ছোট গ্রাম। গ্রামটি এই উপত্যকার শেষ জনবসতিও বটে। দুই নদীর মিলনে সৃষ্ট লক্ষ্মণগঙ্গা এর পর অলকানন্দায় গিয়ে মিশেছে গোবিন্দঘাটে। ঘাগারিয়ার রাস্তা পুরোটাই প্রায় চড়াই। পথে তিন কিলোমিটার অন্তর অস্থায়ী চা-জলখাবারের দোকান— এক কাপ চায়ের দাম ২০ টাকা! ডান হাতে লক্ষ্মণগঙ্গাকে সঙ্গী করে একে একে পেরোলাম ছবির মতো সাজানো দু’টি গ্রাম পুলনা ও ভায়ান্দার। বিকেল প্রায় পাঁচটা নাগাদ গন্তব্যে পৌঁছলাম। যারা ঘোড়ায় এসেছিল, তারা হোটেল ঠিক করে রেখেছিল, ‘ডাবল-বেড’ ঘরের ভাড়া ৫০০ টাকার মধ্যে। এখানেও গুরুদ্বার আছে। শুধু তাই নয় সেখানকার লঙ্গরখানায় চার বেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। আমাদের দলের বেশ কয়েক জন রাতের খাওয়া সেখানেই সারল, আর বাকিরা হোটেলে।

পর দিন যাওয়া হবে স্বপ্নের সেই রাজ্যে। ৩১ জুলাই, সকাল সাতটায় চা ও সামান্য জলখাবার খেয়ে যাত্রা শুরু হল আমাদের। গত কাল যে পথে ঘাগারিয়া এসেছিলাম তার উল্টো পথ ধরে কিছুটা যাওয়ার পরই দর্শন হল লক্ষ্মণগঙ্গার। হেমকুণ্ড সরোবর থেকে বয়ে আসা এই নদীর উপর একটি অস্থায়ী সেতু পেরিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের দল। খানিকটা গিয়েই রাস্তাটা ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গিয়েছে— একটি, ১৩ হাজার ফুট উচ্চতার ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারসের দিকে, অন্যটি, ১৪ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতার হেমকুণ্ডের দিকে। চেকপোস্টে নাম-ঠিকানা লিখে, ১৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে আমরা প্রবেশ করলাম ফুলের দুনিয়ায়। একই টিকিট তিন দিনের জন্য বৈধ। এখানে রাতে থাকার কোনও ব্যবস্থা নেই। ঘোড়ার প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও ডুলির ব্যবস্থা আছে।

ভায়ান্দার উপত্যকা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত জায়গা হলেও বহির্বিশ্বে তার নামডাক হয় ১৯৩১ সালে। জুন থেকে অক্টোবর, এই পাঁচ মাস বাদ দিলে বছরের বাকি সময়টা বরফেই মোড়া থাকে এই অঞ্চল। কামেট পর্বতারোহী ফ্র্যাঙ্ক স্মিথ ও তাঁর দুই সহ-অভিযাত্রী ফেরার পথে রাস্তা হারিয়ে এই উপত্যকা আবিষ্কার করেন। বর্ণময় ফুলের বাহার দেখে স্মিথই ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস’ নাম দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি আবারও ফিরে আসেন ভারতে এবং প্রায় চার মাস এখানে থেকে একই নামের একটি বই লেখেন। এর পর ১৯৩৯ সালে উদ্ভিদবিদ্ জোয়ান মারগারেট লেগি এখানে আসেন গবেষণার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফুল সংগ্রহ করতে গিয়ে পাহাড়ি পথে পা পিছলে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। পরবর্তী কালে লেগ-এর বোন সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। এর পর ভারতীয় বন্যপ্রাণ বিভাগ থেকে অধ্যাপক চন্দ্রপ্রকাশ কলা গবেষণার কাজ শুরু করেন। তাঁর লেখা বেশ কয়েকটি বইয়ের মধ্যে দু’টি বই উল্লেখযোগ্য— ‘দ্য ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস— মিথ অ্যান্ড রিয়ালিটি’ ও ‘ইকোলজি অ্যান্ড কনজারভেশন অফ দ্য ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস ন্যাশনাল পার্ক, গঢ়বাল হিমালয়’। তাঁর বইয়ে ৫২০ রকমের অ্যালপাইন গাছের তালিকা আছে, যা কেবলমাত্র এই অঞ্চলেই পাওয়া যায়।
ট্রেক ট্রেল অস্থায়ী কাঠের সেতু ঝরনা
১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে, নন্দা দেবী জাতীয় উদ্যান ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইটের তালিকাভুক্ত হয়। প্রচলিত নাম হান্ডা দেবী স্যাঙ্কচুয়ারির নাম এক সময় পরিবর্তন করে সঞ্জয় গাঁধী জাতীয় উদ্যান করা হয়েছিল। তবে, তা বেশি দিনের জন্য নয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের বিক্ষোভে ফের তার নামকরণ করা হয় হান্ডা দেবী জাতীয় উদ্যান— ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে। পশ্চিম হিমালয়ের এই উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পায় ১৯৮২ সালে। এই উদ্যানে বসবাসকারী বেশ কিছু প্রাণী বর্তমানে লুপ্তপ্রায়। যেমন, এশিয়াটিক ব্ল্যাক বেয়ার, স্নো লেপার্ড, ব্রাউন বেয়ার, ব্লু শিপ ও হিমালয়ান মাস্ক ডিয়ার ইত্যাদি। জাসকর ও হিমালয়ের মধ্যবর্তী বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে এই দুই জাতীয় উদ্যানের বিস্তার তৈরি করেছে নন্দা দেবী বায়োস্ফিয়ার রিসার্ভ–এর কোর অঞ্চল। উল্লেখ্য, ভায়ান্দার ভ্যালি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বে আছে বন বিভাগের অধীনস্ত একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইডিসি ভায়ান্দার।

চেকপোস্ট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বইছে পুষ্পবতী নদী। ফুলের রাজ্য থেকে আসছে বলেই হয়তো এই নাম। কথিত, বনবাস কালে পঞ্চপাণ্ডব এই নদীতে নানা ধরনের ফুল ভেসে যাচ্ছে দেখে এই নামকরণ করেন। নদীর উপর লোহার সেতু পেরোলেই চড়াই শুরু। নাম না-জানা হরেক ফুল ফুটে আছে পাহাড়ের গায়ে। প্রথমেই নজরে এল ব্লু পপি। চারপাশের রঙের ছটা দেখতে দেখতে প্রায় তিন কিলোমিটার চড়াই পথ কখন যে পেরিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারিনি। উপত্যকাটাকে দূর থেকে দেখে মনে হয় কেউ আপন খেয়ালে যেন লাল-হলুদ-বেগুনি-নীল রঙের আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। একটা ছোট সাঁকো পেরিয়ে আসল উপত্যকার শুরু। পাশ দিয়ে ঝরনা নেমে গিয়েছে। তেষ্টা মেটালাম বিশুদ্ধ ‘মিনারেল ওয়াটার’-এ। ‘পাখির চোখ’-এ সমগ্র উপত্যকা দেখতে অনেকেই একটা বড় পাথরের চূড়ায় উঠেছে। আমরা আরও দু’ কিলোমিটার হাঁটলাম। অচেনা জগতে কিছু পরিচিত ফুলের দেখাও পেয়ে গেলাম— কোবরা লিলি, হিমালয়ান হগউইড, হোর্ল ফ্লাওয়ার, এডেসউইস, বিভিন্ন রঙের জারমেনিয়াম, লাল ও নীল রঙের বেরি। আর সঙ্গে নানা ধরনের পাখি। এক জায়গায় একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল— মেরি লেগির সমাধিস্থল। তাঁর সমাধিতে লেখা ‘I will lift mine eyes unto the Hills from whence cometh my help’। ভ্যালির একটু নীচের দিকে আরও একটা ছোট সেতু পেরিয়ে খানিকটা গিয়েই দেখা পেলাম ডোনা গেয়ার ঝরনার। তার চার পাশে ফুটে আছে এপিলোবিয়াম ল্যাটি ফোলিয়া, যা সাধারণত ঝরনার পাশেই দেখা যায়। বেগুনি রঙের হিমালয়ান থাইম, গোলাপি রঙের জারমেনিয়াম, ভোজপত্র গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গজিয়ে উঠেছে বাকি এলাকা জুড়ে। আগেকার দিনে এই ভোজপত্রেই লেখা হতো। মন বলছিল, উপত্যকার সব থেকে সুন্দর জায়গা এটাই।

পাহাড়ে না-বলেই বৃষ্টি নামে। এ দিকে দুপুরও হয়ে গিয়েছে। ঘাগারিয়া ফেরার তোড়জোড় শুরু হল। প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে, বিকেল পাঁচটা নাগাদ ফিরে এলাম। ফুল-পাখি সবই দেখা হল, শুধু পরীদের দেখা পাওয়া গেল না!

পঞ্চম দিন আরও এক ধাপ এগিয়ে, ১৪ হাজার ২০০ ফুট চড়াই অতিক্রম করতে হবে আমাদের। গন্তব্য ছয় কিলোমিটার দূরত্বে হেমকুণ্ড সাহিব ও লক্ষ্মণ মন্দির। কথিত আছে, শিখ ধর্মগুরু গোবিন্দ সিংহ, তাঁর পূর্বজন্মে এই জায়গায় ধ্যান করেন। প্রতি বছর এখানকার গুরুদ্বার দর্শন ও কুণ্ড বা সরোবরে স্নান করতে আসেন শিখ সম্প্রদায়ের হাজার হাজার ভক্ত। তবে প্রকৃতিপ্রেমীর সমাগমও নেহাত কম হয় না।! এই উচ্চতায় ব্রহ্মকমল পাওয়া যায়। আমরাও দেখা পেলাম সেই দুর্লভ ফুলের, তবে না-ফোটা অবস্থায়। এর পর, লক্ষ্মণ মন্দির দেখে চার ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে সন্ধে ছ’টা নাগাদ ফিরে এলাম ঘাগারিয়া। এর পর আরও পাঁচ দিন গঢ়বাল হিমালয়ের আরও কিছু জায়গা ঘুরে অবশেষে কলকাতা ফেরা।

হিমালয়ের বুকে কয়েকটা দিন ছিল আমাদের একান্ত আপন। এ যাত্রায় কাকভূশন্ডি লেক দেখা বাকি রয়ে গেল। তাই ইচ্ছা রইল আবার আসার।
হোর্ল ফ্লাওয়ার ব্লু পপি কোবরা লিলি ‘বেগুনির বাহার’ ‘সবুজের সমাহার’
 
হিমালয়ান হগউইড লাল জারমেনিয়াম ‘মধুকর’ ব্রহ্মকমল কুঁড়ি

এক কথায়: হিমালয়ের বুকে কয়েকটা দিন ছিল আমাদের একান্ত আপন।
 
কলকাতার বিধাননগরের বাসিন্দা। পেশায় ব্যবসায়ী। সুযোগ পেলেই পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে বেরিয়ে পড়েন হিমালয়ের উদ্দেশে। ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এবং হিমবাহ গলে যাচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে— এই দুই উদ্বিগ্নতা নিয়েই তাঁর গভীর সংশয়, হিমালয়ের টান কি অনুভব করবে পরের প্রজন্ম!
ছবি: লেখক

লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• শিবলোকের পথে

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ