আপনার কলমে


এক ছুটে লেকের কিনারে
রিমা বন্দ্যোপাধ্যায়
(গুয়াদালাজারা, মেক্সিকো)
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ, শীত প্রায় যাই যাই করছে। এমনই এক শনিবার সকালে বেরিয়ে পড়লাম শাপালা লেকের উদ্দেশে। লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় শহরগুলির মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে মেক্সিকোর জালিস্কো রাজ্যের রাজধানী-শহর গুয়াদালাজারা। সেখানেই আপাতত আমার বসবাস। এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্বে ৪৫ কিলোমিটার দূরেই দেশের সবচেয়ে বড় মিষ্টি জলের হ্রদ ‘শাপালা’। জালিস্কো ও মিতোয়াকান রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫০০০ ফুট উচ্চতায় এই অগভীর হ্রদই এ বারে আমাদের ‘উইকএন্ড ডেস্টিনেশন’। শুনেছি লেকের চারপাশ ঘিরে হোটেল-রিসর্টের রমরমা। শুধু পর্যটন শিল্পই নয় বহু মার্কিন এবং কানাডিয়ান প্রবীণ নাগরিকদের অবসরকালীন পরিকল্পনাও বটে এই রিসর্টগুলি। নিজের দেশের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ছেড়ে ওঁরা আসেন প্রতিবেশী এই দেশে, মেক্সিকানদের সবুজ সরল বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে জীবনের চার অধ্যায়ের একটি কাটাতে।

সামান্য কিছু জিনিসপত্তর নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম আমরা চার জন— বাবা, মা আর আমরা কর্তা-গিন্নি। লেকের পাড়ে শহরের রোজকার ব্যস্ততার থেকে একটু মুক্তির আশায় চললাম সকলে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর চোখে পড়ল আধা সবুজ আধা ধূসর রঙের পাহাড়ের ফাঁকফোকড় থেকে নীল জলের হাতছানি। পছন্দ মতো একটি হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলের মালিক এক কানাডিয়ান দম্পতি। আমরা ঢুকতেই তাঁদের হাসিমাখা মুখ উষ্ণ আমন্ত্রণ জানাল। টরন্টোর ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে মোকাবিলা করে ক্লান্তি আর একঘেঁয়েমি কাটাতে তাঁদের ‘রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান’ অনুযায়ী এখানে এসে চালাচ্ছেন এই হোটেল ব্যবসা।
ভাল খাবারের সন্ধান থেকে কেনাকাটা ও ঘোরাঘুরির আদর্শ জায়গাগুলির খবর ওঁরাই দিলেন। সেই মতো দুপুরের ভোজ সারতে গেলাম সেন্ট্রো নামের একটি রেস্তোরাঁয়। আমাদের হোটেল থেকে হাঁটা পথে মিনিট তিনেক লাগল। সেখানে মেক্সিকান খাবারের এলাহি সম্ভার। কিন্তু গরু ও শুয়োরের মাংসে আমাদের ‘বিধিনিষেধ’ থাকায় অনেক ‘ডিশ’ই তালিকা থেকে বাদ পড়ল। তা সত্ত্বেও বেশ জমিয়েই অর্ডার দিলাম— চিকেন ফাহিতাস, চিকেন এনশিলাদাস আর সঙ্গে গোলা ভেহাতে হোরশেতা। শেষেরটি একটি জনপ্রিয় মেক্সিকান ঠান্ডা শরবত যার মুখ্য সামগ্রী চাল আর তার সঙ্গে দুধ, চিনি ও দারচিনির পার্থিব মিলন।

ধূসর রঙের পাহাড়ের ফাঁকফোকর
থেকে নীল জলের হাতছানি।
মেলাকনে নানা রঙের
গোলাপের বাহারি শোভা।
ভরপেট খেয়ে আর চলার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু তা বলে তো আর বেড়াতে এসে হোটেলের ঘরে বসে থাকা যায় না! পৌঁছলাম লেকের তীরে। আসাধারণ সৌন্দর্যে চারদিক মোহময়। যত দূর চোখ যায় শুধু নীল রঙের মায়াবি উপলব্ধি। আকাশ, জল— চারিদিকে শুধু নীল রঙের চোখ ধাঁধানো খেলা। লেকের পাড় জুড়ে, বিস্তৃত সিমেন্ট বাঁধানো চওড়া মেলাকন যাতে হাজারো রকমের মনমাতানো রঙের গোলাপ ফুলের বাহারি শোভা। ফুলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসংখ্য প্রজাপতি তাদের রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। শীত কি তা হলে এ বছরের মতো বিদায় নিল? সে চলে যাওয়ার আগে দিয়ে যায় বসন্তের আগমনী বার্তা। প্রকৃতি সেজে ওঠে রঙের নেশায়। সেই বসন্তের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে গাছে গাছে। কচি সবুজ পাতার রঙিন ফুল— গোলাপি, বেগুনী সাজে প্রকৃতি যেন কোনও এক ‘কার্নিভাল’-এ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

লেকের উল্টো দিকে যত দূর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। তারাও শীতের রুক্ষ্মসূক্ষ্ম বাদামি রং ঝেড়ে ফেলে বসন্তকে যেন মনে-প্রাণে আঁকড়ে ধরে সবুজ হওয়ার চেষ্টাতে ব্যস্ত। মেলাকনের ধার ঘেঁষে শুধুই দোকান। গুণে শেষ করা যায় না। খাবার ছাড়াও বিভিন্ন জিনিসের পসরা সেখানে। স্থানীয় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এক মনে ‘স্প্রে রং’ দিয়ে রাঙিয়ে চলেছেন একটার পর একটা ক্যানভাস। খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে ক্যানভাস আর রঙের খেলা দেখে চার পাশটা একটু ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। লেকের জলে পড়ন্ত বেলায় রোদ্দুর পোহাচ্ছে হাজার হাজার হংসরাজ। তাদের সাদা পাখনার ঝটপটানি, বকেদের মাছ শিকার, জলের ছলাত্ ছলাত্ শব্দ, মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া, নীল জলে ছোট ছোট ঢেউ হয়ে মাটিমাখা বালুর ঠোঁটে আলতো করে আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে হঠাত্ই খেয়াল করলাম সূর্য গাঢ় কমলা রঙের থালা হয়ে নীল জলরাশিতে ডুব দিতে ব্যস্ত।
আকাশে তখন কমলা-হলুদ রঙের ছটা।
সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই বইতে শুরু করল কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাদের আড্ডাও বেশ জমে উঠেছে তখন। প্রকৃতি এ বার আলো আঁধারির মায়াবি নেশায় মেতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। খানিক বাদে অন্ধকারকে ভেদ করে আলোকিত হয়ে উঠল চারিদিক। রাতে মেক্সিকান ‘টাকো’ আর ‘টোরটা’ দিয়ে পেট ভরিয়ে হোটেলে ফিরলাম। টাকো হল ভুট্টা বা আটার রুটির ভেতর বিভিন্ন ধরনের মাংসের টুকরো, সি-ফুড, সব্জি, চিজ দিয়ে তৈরি করা রোল। স্যালাড সহযোগে বেশ লোভনীয় ‘ডিশ’ এটি। আর টোরটা হল স্যান্ডউইচের এক রকমফের, দেখতে খানিকটা ‘হটডগ’-এর মতো। সারা দিনের ধকল আর দিনের শেষে এমন পেট ঠেসে খাওয়ার পর হোটেলে ফিরে বিছানায় গা এলাতেই ক্লান্তির ঘুম নেমে এল দু’চোখের পাতায়।

পর দিন সকালে উঠে চা খেয়ে আরও এক বার ছুটলাম নীল জলের পাড়ে। আজ ফিরে যাব রোজকার জীবনে। তাই যত ক্ষণ এখানে থাকা যায়— মুহূর্তগুলো নষ্ট করতে নারাজ সবাই। রোজকার ব্যস্ততার মাঝে সবাই একটু অক্সিজেন খোঁজে। আমরা বাঙালিরা চিরকালই ভ্রমণের মধ্যে খুঁজে পাই মুক্তির স্বাদ। প্রকৃতির বুকে মুখ গুঁজে খানিকটা অক্সিজেন প্রাণপণে নিয়ে হয়ে উঠতে চাই তরতাজা। দেখতে দেখতে কখন যে সোনা রোদমাখা ভোরবেলাটা দুপুরের দিকে ঢলে পড়ল টেরই পেলাম না। দুপুরে আর এক প্রস্থ মেক্সিকান খাবারে ডুব দিলাম সবাই। সহজ ভাবে বললে কচি পাঁঠার ঝোলের সঙ্গে ভুট্টার রুটি আর স্যালাড— ডিশের নাম ‘বিরিয়া দি শিভো’।

হোটেলের কানাডিয়ান দম্পতি স্মিত হেসে আবার আসার কথা বললেন। গাড়ি রওনা হল। পিছন ফিরে তাকাতেই— সবুজ অরণ্য-ঢাকা পাহাড় আর হৃদের নীল রং তখন নতুন পর্যটকদের স্বাগত জানানোর ফাঁকে আমাদের বলছে, তোমাদের আসার অপেক্ষায় এমনি করে এখানেই প্রতীক্ষায় থাকব।

এক কথায়: লেকের চারদিক মোহময় আর যত দূর চোখ যায় শুধু নীল রঙের মায়াবি উপলব্ধি।

আদতে কলকাতার বাসিন্দা, চাকরিসূত্রে বর্তমানে বাস মেক্সিকোয়। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো প্রায় নেশার মতো। ছোটবেলায় সে ইচ্ছেপূরণ হয়েছে বাবা-মায়ের হাত ধরে আর এখন হয় স্বামীর সঙ্গে। এ ছাড়াও, ফুলের বাগান করা, শপিং করা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, আর বেড়ানোর অভিজ্ঞতা কাগজবন্দি করতেও ভাল লাগে।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• ইতিহাস ও স্বপ্ন মেশানো কানকুন

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদলপুরনো সংস্করণ