আপনার কলমে


এক দিনের সফরে ‘কিউ’ সিটি
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
(মন্ট্রিল, কানাডা)
বিদেশে যাঁরা পড়াশোনা করতে আসেন, বিশেষত গবেষণা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপন কিন্তু বেশ কষ্টকর। শিশু বিজ্ঞানী হওয়ার অনন্ত চাপ সামলে জীবন খুঁজে পাওয়াটা খুবই জটিল। আর গুমোট সেই ভাবটা কাটিয়ে উঠতে আমাদের একমাত্র আশ্রয় সামান্যতম সুযোগের সদব্যবহার করে চটজলদি কোথাও ঘুরে আসা— একটু শ্বাস নেওয়ার আশায়।

সাধারণত, এই হঠাত্-ভ্রমণগুলোয় নিজেরাই একটা দল তৈরি করে বেরিয়ে পড়া হয়। তাতে আড্ডাও জমে, খরচও বাঁচে। কিন্তু এ বারেরটা একটু আলাদা। এক শনিবার আচমকাই ময়ূখ আর আমি নর্থ আমেরিকার প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম কিউবেক সিটি ঘুরে আসব বলে ভাবলাম। শুধু দু’জনে! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ফুরফুরে মেজাজে বেড়াব, তাই কোনও দায়িত্ব নিজেরা নিলাম না। একটা ভ্রমণ সংস্থাতে টিকিট বুক করলাম। এটাকে কি কুঁড়েমি বলা যায়! এ বার পুরোপুরি ঝাড়া হাত পা। সব দায় ওদের। মাত্র এক দিনের জন্য যাওয়া, কিন্তু তাতেও উত্তেজনায় ঘুম এল না রাতে!
মন্তমরেন্সি জলপ্রপাত জলপ্রপাতের উপর রোপওয়ে
এক অগস্টের সকালে মন্ট্রিল ডাউনটাউন থেকে বাস ছাড়ল। ঘড়িতে এক্কেবারে কাঁটায় কাঁটায় সাতটা। চারপাশে অচেনা উত্সাহী মুখের সারি, বাচ্চাদের কচি গলার আবদার— সব মিলিয়ে বেশ লাগছিল পরিবেশটা। মন্ট্রিল-কিউবেক সিটি পুরো পথটাই এত অপূর্ব যে ঘুম পেলেও চোখ টানটান করে রাখতে হয়। যে হেতু কানাডার শীতকাল বড়ই কঠোর ও কঠিন তাই গরমকালে প্রকৃতি যতটা পারে পুষিয়ে দিতে চায়। নাম না জানা, অল্প চেনা অজস্র ফুল এই দু’ তিনমাস ধরে যেখানে সেখানে কারণে অকারণে হোলি খেলতে থাকে।

রাস্তায় পুঁচকে অথচ দারুণ রোম্যান্টিক একটা ক্যাফেতে সকালের জলখাবার সেরে সাড়ে দশটার ভেতর পৌঁছে গেলাম কিউবেক সিটি। মন্ট্রিল থেকে ২৫৩ কিলোমিটার দূরে ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট এই ‘কিউ সি’ কিউবেক রাজ্যের রাজধানী।

বাসটা কোথাও না থেমে শহরের বুক চিরে এক মরিয়া ছুটে প্রথমেই চলে এল মন্তমরেন্সি ফলসের সামনে। দুধসাদা ধারায় অবিশ্রান্ত বয়ে চলা এই মন্তমরেন্সির অপরূপ সন্মোহন শক্তি। উচ্চতার বিচারে এটি কানাডার অসীম গর্ব— নায়াগ্রার থেকেও তিরিশ মিটার এগিয়ে রয়েছে যে!

ছোটবেলা থেকে জ্বালিয়ে চলা ভারটিগোকে গুলি মেরে জীবনে প্রথম বার আমার রোপওয়ে চড়া। মন্তমরেন্সিকে আরও নিবিড় ভাবে পাওয়ার জন্য উঁকিঝুঁকি মারছি। খটখটে দিনের বেলা, চাঁদের আলোর অস্তিত্বের কোনও প্রশ্নই নেই। তবুও ‘মরি যদি সেও ভাল— সে মরণ স্বর্গ সমান’ টাইপের একটা অনুভূতি মনের মধ্যে। হঠাত্ ময়ুখের কটমটে চাউনিতে সেটা যারপরনাই হোঁচট খেল। কানাডাতে এসে প্রথম ছ’মাস আমি এই শহরেই ছিলাম। কিন্তু ল্যাব আর হস্টেল ছাড়া কিচ্ছুটি দেখিনি! যাক গে তাতে কী হল! ওই যে ইংরেজিতে একটা কথা আছে না ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’, সেটা তো এই আমার মতো লোকেদের ভরসা দেওয়ার জন্যই!

সাধারণ মানুষ হওয়ার একটা বড় অসুবিধে হচ্ছে চারপাশে দুনিয়া ভোলানো উপকরণ থাকলেও খানিক ক্ষণ পর পরই খিদে পাবে। ভ্রমণ সংস্থার সূচির সঙ্গে আমাদের প্রাণের ইচ্ছেটা দেখলাম একেবারে ঠিক সময় মিলে গিয়েছে।
প্নেনস অফ আব্রাহাম শাতো ফ্রন্তনা
এর পর শুরু হল এ শহরকে ব্যক্তিগত ভাবে ছুঁয়ে দেখবার পালা। ‘অবসরভেতরি দ্য লা ক্যাপিতাল’ থেকে নীচে তাকালেই উন্মুক্ত দিগন্তে গহন সবুজ ‘প্লেনস অফ আব্রাহাম’। ১৭৮৯ সালে ইঙ্গো-ফরাসি যুদ্ধ এখানেই হয়েছিল। কিন্তু ঘোর ইতিহাসবিমুখকেও পলকে থমকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই উপত্যকা।

দিগন্তের শেষ কথা বলে কিউবেক সিটির হোটেল শাতো ফ্রন্তনা। আশ্চর্য গভীর একটা নেশা আছে হোটেলটার সারা শরীর জুড়ে। নাহ্ ‘ভারতীরে ছাড়ি ধরো এই বেলা লক্ষ্মীর উপাসনা’টা শুরু না করলেই আর চলছে না। অন্তত থুত্থুরে বুড়ো হয়ে মরে যাওয়র আগে তো এখানে একটা দিন কাটানো দরকার!

বিকেল হয়ে আসছে। আর একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। তখনই দেখা হয়ে গেল পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে। আরে, বলতেই ভুলে গিয়েছি! মন্ট্রিল ছেড়েছি তো কি, আমার ভীষণ প্রিয় সেন্ট লরেন্স নদীটা কিন্তু এখানেও সমানতালে সঙ্গ দিচ্ছিল এত ক্ষণ। আইসক্রিম হাতে নদীর চোখে চোখ রেখে হাঁটতে হাঁটতে আচমকা মনে হল এ জায়গাটাই বা দিকশূন্যপুরের থেকে খারাপ কী!

এক কথায়: বুড়ো হয়ে মরে যাওয়ার আগে এখানে একটা দিন কাটানো দরকার!
জন্ম কলকাতায়। উচ্চমাধ্যমিকের পর ভেলোর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ‘বায়ো ফিজিক্স’-এ পিএইচডি করতে গিয়ে দেশ বদল। লেখালেখিটা এক কথায় ‘প্যাশন’। কিছু আন্তর্জাতিক পত্রিকাতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ঘুরে বেড়ানো আর নতুন নতুন জায়গা খোঁজাটা আর এক নেশা।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• চেনা-অচেনার জড়তা ছেড়ে জড়িয়ে ধরেই বর্ষবরণ

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ