আপনার কলমে


চেনা-অচেনার জড়তা ছেড়ে জড়িয়ে ধরেই বর্ষবরণ
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
(মন্ট্রিয়াল, কানাডা)
মাউন্ট রয়্যাল থেকে শহরের নাম মন্ট্রিয়াল। পাহাড় বললেই মন কী রকম একটা রোম্যান্টিক মুডে চলে যায়! তার সঙ্গে আবার সেন্ট লরেন্স নদীর সহাবস্থান, মারাত্মক ভাবে জমিয়ে দিয়েছে ব্যপারটাকে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে অবশ্য মন্ট্রিয়াল তার নিজস্বতায় গুণে গুণে অন্তত চার গোল দিতে পারবে বিশ্বের তাবড় সব নামজাদা শহরকে।


উৎসবের রোশনাই
‘লিটল্ ফ্রান্স অফ কানাডা’ বলে পরিচিত কিউবেকের জনপ্রিয় শহর মন্ট্রিয়াল, এখন ইংরেজিভাষীদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে সামান্য কোণঠাসা অবস্থাতেও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ফরাসি শিকড়টুকু ধরে রাখার। প্যারিসের পর, ফরাসি ভাষায় দক্ষ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনতার দেখা মেলে এই মন্ট্রিয়ালেই। তথ্যটি সম্যক জানা না থাকায়, প্রথম এখানে এসে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু ধাক্কাটা ধীরে ধীরে সামলে নিয়েছি। তাতেও কি আর শান্তি আছে? ফরাসির আ, বে, সে, দে... শিখতে শিখতেই ঘাড়ের উপর শীতকালের হিমশীতল নিঃশ্বাস!

কানাডায় ঠান্ডা হবে না তো কি সাহারায় হবে? হক্ কথা। কিন্তু ঠান্ডা যে এ রকম ভয়ঙ্কর হতে পারে, জানা ছিল না! দিনের পর দিন মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি সইতে ‘জান’ বেরিয়ে যায়! যে দিকে তাকাও, শুধু বরফ আর বরফ। তুষারঝড় হলে তো কোনও কথা হবে না— একেবারে সোনায় সোহাগা। ডিসেম্বর মাসে কমলালেবু নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া কলকাতার বাঙালির কল্পনাতীত এই ‘সিনারিও’। এ রকম সময়ে কী ভয়ানক বিষাদময় হয়ে যায় জীবনটা, কলকাতার ‘জনতা’ যদি বুঝত! বরফ নিয়ে আদিখ্যেতা ওই প্রথম ক’দিনই ভাল লাগে। একটু রোদ্দুরের জন্য হাপিত্যেস করে বসে থাকার আকুতি আমিই কি আর এ দেশে আসার আগে বুঝতাম ছাই! কোনও ধারণাই ছিল না— কী বিষণ্ণতা বয়ে আনে এই অসহনীয় ঠান্ডা। ভেঙে যায় কত কত সম্পর্ক! ভাগ্যিস ময়ূখ আর আমি এক সঙ্গে এসেছিলাম পিএইচডি করতে। একা থাকতে হলে কোন কালে পাগল হয়ে কেটে পড়তে হত!

কিন্তু এই শীতকালটাই সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগে ‘বড়দিন’ আর ‘নিউ ইয়ার’-এর সময়। ল্যাবের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট লরা যে দিন টানতে টানতে ‘ক্রিসমাস ট্রি’টাকে বের করে আনল লাগোয়া ডাইনিং হলে, মনটা লাফিয়ে উঠল আনন্দে। এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে আর ভাবতে পারছি না সামনের কয়েকটা দিন। তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি, মন দিয়ে নোটিস বোর্ডটা নজর করা— একটাও ডিপার্টমেন্টাল পার্টি যেন মিস না হয়ে যায়। আগের বছর লুসির ল্যাবের পোস্ট ডক মাইক যা দারুণ এগনগ বানিয়েছিল না! এ বার কী করবে সেটা এখনও যদিও বলেনি! এ রকমই একটা সকালে সবার টেবলে উঁকি মারে চকোলেট-কুকিস ভর্তি এক একটা মিষ্টিমুখের প্যাকেট। আরে, কাল সন্ধেবেলাতেও তো ছিল না কিছু! বেচারা বস! সবাই চলে যাওয়ার পরে কত রাতে ল্যাব খালি পেয়েছেন এগুলো লুকিয়ে রাখতে, কে জানে! আর অপেক্ষা থাকে অফিসিয়াল পার্টিটার জন্য। বছরভর গোমড়ামুখো বিজ্ঞানীগুলোর জগৎ বিস্মৃত উত্তাল নাচের দৃশ্য দেখবার সুযোগ তো এই একবারই মেলে! আর এখানে সব সময় ‘পার্টনার’দের নেমন্তন্ন থাকে বলে ময়ূখ আর আমার ‘ডাবল মস্তি’।

ডিসেম্বর পড়তে না পড়তে চারপাশের রাস্তাঘাট, শপিং মলগুলো আলোয় আলো হয়ে যায়। দোকানপাট এমন লোভনীয় রকমের সাজানো থাকে যে সারা ক্ষণই মনে হয় কিছু কিনে ফেলি। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা চালাই পকেটটা সামলে রাখতে। এখনই যদি সব খরচ করে ফেলি ২৬ তারিখ করব কী! ওই দিনই তো ‘বক্সিং ডে’। মার্কিন যুক্তরাষ্টর ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র মতো সারা কানাডায় ওই দিন ‘মেগা সেল’। নামীদামি দোকানগুলোতে লাইন পড়ে যায় রাত থাকতে থাকতেই। আমাদের মতো আরও অনেকেই এই সময়টায় দেশে ফেরার আগে কেনাকাটি করার আদর্শ ক্ষণ বলে মনে করেন।

বড়দিনের সকালে আমাদের প্রধান গন্তব্য হল সেন্ট জোসেফস ওরেটরি। সাদা বরফের চাদরে ঢাকা পড়ে যাওয়া শহরের ভেতরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা অপূর্ব সুন্দর চার্চটা সমবেত প্রার্থনায়, শ্রদ্ধায়, ভালবাসায় অদ্ভুত রঙিন আর বাঙময় হয়ে ওঠে এই দিনে। উৎসবমুখর কোলাহলের মাঝে এই গাম্ভীর্য কী রকম যেন চমক লাগিয়ে দেয় মনের গভীরে! আর তার টানেই ছুটে যাওয়া, অধরাকে ছুঁতে চাওয়ার নীরব ইচ্ছে।

সেন্ট জোসেফস ওরেটরি

প্রার্থনায় নতজানু
মিষ্টির পোকা আমি। তাই জম্পেশ করে কেক ‘সাঁটাতে’ না পারলে বড়দিন বৃথা। ময়ূখকে পাকড়াও করে হাঁটা লাগাই ‘দ্য রুবেন্স’-এর উদ্দেশে। দারুণ ডেসার্ট বানায় ওরা। তার পরেও আত্মার শান্তি না হলে ময়ূখের ঘ্যানঘ্যানকে পাত্তা না দিয়ে চলে যাই সেন্ট ক্যাথরিন স্ট্রিটের উপর আর একটা জায়গায়, দুর্দান্ত ক্রেপ পাওয়া যায় সেখানে। ঠান্ডায় নীল হয়ে গিয়েছে ঠোঁট, কিন্তু তাও যাওয়া চাই! পিএইচডি-র অস্বাভাবিক চাপে দু’জনেই পরিশ্রান্ত থাকি। তাই এই দিনগুলোতে যতটা পারি এক সঙ্গে থেকে অজস্র খুনসুটি করে নিজেদের জীবনীশক্তি বাড়িয়ে নেই বহুগুণে।

এ সবের মাঝেই চলে আসে বছরের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বর। সকাল থেকে বন্ধুবান্ধবদের অবিরাম ফোনের পর্ব শেষে ঠিক হয়ে যায়, সারাদিন যার যেখানে যে ‘প্রোগ্রাম’ই থাক না কেন, সব শেষ করে ঠিক পৌনে বারোটায় জড়ো হবে ওল্ডপোর্টে। প্রতি বার কাঁটায় কাঁটায় বারোটার সময় সেন্ট লরেন্সের আকাশে অপরূপ আলোর খেলার ঝলকানিতে মন্ট্রিয়াল বিদায়ী-হাত নাড়ে, আর একই সঙ্গে স্বাগত জানায় নতুনের পদধ্বনিকে।

মন্ট্রিয়ালে এটা আমাদের তৃতীয় বছর। কিন্তু এখনও প্রথম বারের অভিজ্ঞতা মনে পড়লে ঝলকে ঝলকে হাসি উঠে আসে বুকের ভেতর থেকে। তিন প্রস্থ জামাকাপড় চাপিয়ে হি-হি ঠান্ডায় অনভ্যস্ত পায়ে বরফ ভাঙছি দু’জনে। পা পিছলে আলুর দম হতে হতেও একে অপরকে ধরে কোনও মতে রক্ষা পেয়েছি

বরফে ঢাকা সেন্ট লরেন্স নদী
বার কয়েক। ওল্ডপোর্টে পৌঁছে বড় বড় চোখে দেখছি চারপাশ। চেনা–অচেনার বালাই নেই কোনও, তবুও সবাই সবাইকে দেখে একগাল হেসে জড়িয়ে ধরে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলছে। আর ‘জলপথে’ বিচরণ করা মানুষজন তো আরও এক কাঠি উপরে। কথা নেই বার্তা নেই, এ রকম ‘চুমু’ দিয়ে শুভকামনা জাহির করার দৌলতে ময়ূখ আর আমি দু’জনেই খানিক ক্ষণের জন্য কেমন ভেবলে গিয়েছিলাম। আসলে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে একটু সময় লেগেছিল। তার পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে জড়াজড়ির পালা সাঙ্গ করেই আমি ফের স্বমহিমায়! নিজে গ্লাভস থেকে হাত বার করতে পারছি না, ময়ূখকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছি এক ভাবে, ‘‘ছবি তোল না! ফেসবুকে পোস্ট করতে হবে না!’’ বেচারা ছেলেটা কাঁপছে ঠকঠক করে। ভাল করে ফোকাসও করতে পারছে না ক্যামেরা! ওমা, সেটা যদি বা করল, দেখি নড়েও না, চড়েও না! দাঁড়িয়ে আছে স্থির। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছি, কি রে বাবা, ঠান্ডায় কোলাপ্স করে গেল নাকি? তা হলেই হয়েছে! ওকে নিয়ে একা আমি বাড়ি ফিরব কী করে! তখন সবে এসেছি, অত বন্ধুও হয়নি। সাহস করে এক ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী হল?’’ সেই মুহূর্তেও সম্মোহিত সে,আপন মনে বিড়বিড় করে চলেছে, ‘‘আস্ত একটা নদী এ রকম জমে যেতে পারে বাবার জন্মে দেখিনি তো কখনও! আগে ভাল করে দেখতে দাও, তার পর তো ছবি তোলা!’’ দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে, তার ভেতর এ রকম কাব্যি করা দেখে রাগে হাড় জ্বলে গেল আমার!

তিন বছর পরে সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, উন্মুখ হয়ে প্রতীক্ষা করছি কখন শুরু হবে আলোর সেই অমোঘ সম্মোহন। সাড়ে দশ ঘণ্টা এগিয়ে থাকা কলকাতায় নতুন বছর শুরু হয়ে গিয়েছে এত ক্ষণে। বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছি একটু আগে, জানিয়েছি নববর্ষের শুভেচ্ছা। আলোকিত বর্ণময় আকাশটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে হঠাৎ ভীষণ আপন মনে হয় এই শহরকে। কলকাতার শোকে অবিরত হু হু করা মনটা এক পলকের জন্য হলেও ভুলে যায় সব কিছু— শুষে নিতে চায় এই উল্লাসধ্বনি। মনে হয় আমিও তো ওদেরই এক জন।

সম্বিত ফেরে যখন বুঝতে পারি নিজের অজান্তে কখন ময়ূখের হাত আঁকড়ে ধরেছে আমাকে— নতুন আশা, শুদ্ধ প্রতিজ্ঞা আর অফুরন্ত জীবনের আশ্বাসে। ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে হাতে হাত রেখে এগোতে থাকি আমরা। কিছু স্বপ্ন, চাওয়া, পাওয়া আর হারানোর টুকরো টুকরো গল্প নিয়ে এ ভাবেই হয়তো এক দিন সত্যিকারের বন্ধু হয়ে যাবে মন্ট্রিয়াল!

তোমাকে স্বাগত নববর্ষ

জন্ম কলকাতায়। উচ্চমাধ্যমিকের পর ভেলোর ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ‘বায়ো ফিজিক্স’-এ পিএইচডি করতে গিয়ে দেশ-বদল। লেখালেখিটা এক কথায় ‘প্যাশন’। কিছু আন্তর্জাতিক পত্রিকাতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। রোজ সকালে দিন শুরু হয় আনন্দবাজার পড়ে। ঘুরে বেড়ানো আর নতুন নতুন জায়গা খোঁজাটা আর এক নেশা।

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ