পল্+অম্ম্+উ=পলামু
লামুর ইতিহাস নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয়েছে বলে মনে হয় না। কেন না সেখানে যাওয়ার আগে যেটুকু যা পড়েছি, সে সব যে খুব তথ্য সমৃদ্ধ এমন নয়। সাহিত্য ঘেঁটে দেখেছি, ঐতিহাসিকরা নাকি বলেন, পলামু শব্দটি একটি দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে। ‘পল্’ মানে দাঁত, ‘অম্ম্’ মানে জল আর ‘উ’ বিশেষ্যের বিশেষণ।

চেরো অধ্যুষিত এই অঞ্চলে বহু সুরক্ষিত দুর্গ ছিল তাদের। দুর্গবহুল গ্রামের নীচ দিয়ে বয়ে যেত ঔরঙ্গা নদী। বর্ষাকালে দূর থেকে ওই নদীর ভাটিতে বড় বড় কালো পাথরগুলো দাঁত বের করে আছে— এমনটাই মনে হত। সেখান থেকেই নাম— (পল্+অম্ম্+উ)পলামু। তবে এর সত্যতা কতটা সে বিষয়ে সন্দেহ করে লাভ নেই। কারণ চেরোদের সেই দুর্গ এখনও আছে— ভাঙাচোরা, আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংসাবশেষ। টিকে থাকা অংশের ছাদে উঠলে সেখান থেকে এখনও ঔরঙ্গাকে দেখা যায়। তবে তাতে দাঁত উঁচু করা কোনও পাথর এখন আর দেখা যায় বলে শুনিনি।
বেতলার চেকনাকা পেরিয়ে কিলোমিটার পাঁচেকের মধ্যেই রয়েছে চেরোদের সেই দুর্গ। একটা সমতলে আর অন্যটি পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের চূড়ায়। পাথর ও ইটের তৈরি এই দু’টি দুর্গের একটি ‘পুরনো কেল্লা’ আর অপরটি ‘নতুন কেল্লা’। দুর্গের চওড়া দেওয়ালের গায়ে কামানের গোলা ও গুলির প্রচুর দাগ লেগে রয়েছে। দুর্গে ঢোকার প্রধান ফটক পেরিয়ে ভাঙাচোরা, প্রায় গলে যাওয়া বিচার কক্ষ, মন্দির, রাজ-ঘরনীদের অন্দরমহল এবং আশ্চর্যজনক দু’টি বন্ধ হয়ে যাওয়া গভীর কুঁয়ো দেখা যায়। যদি দুর্গ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, তা হলে যেন পানীয় জলের সরবরাহ ঠিক থাকে— গুপ্ত কুঁয়ো সে জন্যই বানানো হয়েছিল। খুবই কাছ থেকে বয়ে গিয়েছে ঔরঙ্গা নদী। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দুর্গ দু’টির চতুর্দিকে উঁচু পাহাড়।

এই দুর্গ নিয়ে অনেক ‘গল্প’ আছে। কী ভাবে পলামু মুঘলদের আয়ত্বাধীন হয়ে যায় সে কথাও আছে অনেক জায়গায়। তবে পলামুর সরকারি ওয়েবসাইটে যে কাহিনি বলা হয়েছে তাকে প্রামাণ্য ধরাই যায়। সেখানে আলমগীরনামার উল্লেখ টেনে বলা হয়েছে— পটনা থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরের পলামুতে চেরো রাজাদের রাজধানী ছিল। শহুরে সে অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল ভালই। প্রচুর হাট-বাজার সমৃদ্ধ সেই এলাকা সুরক্ষিত ছিল শক্তপোক্ত দুর্গ দিয়ে। তিনটে বড় দুর্গ ছিল— কোঠি, কুন্ডা আর দেবগণ।
মুঘল সেনাপতি দাউদ খান সৈন্য নিয়ে দুর্গ দখলের জন্য ১৬৬০ সালের এপ্রিল মাসে শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে পটনা ছাড়েন। প্রথমে তিনি দক্ষিণ গয়া জেলার ইমামগঞ্জের ‘কোঠি’তে পৌঁছলেন। ‘শত্রুপক্ষ’ তত ক্ষণে সে দুর্গ পরিত্যক্ত করেছে। দাউদ এর পর ১৪ মাইল দূরের কুন্ডার দিকে এগোলেন। কুন্ডায় একটি শক্তপোক্ত শৈল-দুর্গ ছিল চেরোদের। কিন্তু ওই সামান্য পাহাড়ি পথ পেরোতেই খান সাহেবের সেনার পুরো এক মাস সময় লেগেছিল। জঙ্গল আর হিংস্র প্রাণীই তার অন্যতম কারণ। কিন্তু প্রত্যয়ী দাউদ খান তাঁর বাহিনীকে জঙ্গল পরিষ্কার করে রাস্তা তৈরির নির্দেশ দিলেন, যাতে খুব সহজে যাওয়া যায়। কিছু দিনের মধ্যেই তাঁরা কুন্ডা পৌঁছলেন। সেখানকার দুর্গটিও তত ক্ষণে খালি করে দেওয়া হয়েছে। দাউদ কুন্ডার দুর্গটিকে ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে সেখানে বানালেন সেনাবাহিনীর ‘ক্যাম্প’। তত দিনে বর্ষাকাল এসে গিয়েছে।

বর্ষা শেষে প্রায় সাড়ে ছ’হাজারি মুঘলবাহিনী ফের অগ্রসর হয়— খুবই সন্তর্পণে। বেশ কিছু সৈন্যকে আগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল জঙ্গল পরিষ্কার করে রাস্তা বানানোর কাজে। আমানত নদীর কাছে পৌঁছতে দাউদের কয়েক মাস কেটে যায়। সেখানে কিছু দিন কাটল শত্রুপক্ষের সঙ্গে ফলহীন মীমাংশার চেষ্টায়। তার পর দাউদ খান ঢুকে পড়েন পলামুর দু’মাইলের মধ্যে। চেরোরাও না-পালিয়ে দুর্গ থেকে এ বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে দাউদকে ঠেকাতে।

চেরোদের প্রতি সম্রাটের অন্তিম শর্তাবলী ছিল— বশ্যতা স্বীকার, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং পলামুকে করদরাজ্যে পরিণত করা— দাউদ খান সে সব প্রস্তাব রাজার কাছে পাঠালেন। রাজার কাছ থেকে কোনও উত্তর আসার আগেই মুঘল-সৈন্য দুর্গের বহির্ভাগে হামলা চালায়। কামানের গোলাবর্ষণ হয় চেরোদের উপর। রাত্রিবেলা, চেরোরা দুর্গের ভিতর থেকে দু’টি বিশাল কামান বের করে। দুর্গ প্রাচীরের গায়ে সে দু’টিকে রাখা হয়। পাহাড়ের উপর থেকে নীচে থাকা দাউদ খানের সেনা ছাউনির উপর ওই কামান থেকে গোলা চালায় চেরোরা। কিন্তু দাউদের সেনাবাহিনীও দমবার পাত্র নয় মোটেই। তারাও কাছের একটা পাহাড়ে শত্রুপক্ষের তুলনায় একটু উঁচুতে কামান তুলে নিয়ে যায়। দু’পক্ষের সরাসরি গোলাগুলি চলে।
তিন দিন দীর্ঘায়িত হয়েছিল এই যুদ্ধ। কিন্তু চেরোরা তাদের জায়গা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তারা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পশ্চাদপসরণ করে নদীর কিনারা পর্যন্ত। সেখানে তারা আত্মরক্ষার্থে অস্থায়ী ভিত্তিতে বালির বস্তা ও মাটি দিয়ে তৈরি করে নিচু দেওয়াল— ব্যারিকেড হিসেবে। দাউদ খানও তাঁর শিবির ও শত্রুপক্ষের মধ্যে জঙ্গল কেটে ফেলতে দু’তিন দিন সময় নিলেন। এর পর তিনি এগোলেন শত্রুপক্ষের দিকে। ছ’ঘণ্টার কঠিন এক লড়াই শেষে চেরোরা পালিয়ে যায় দুর্গের ভিতর।

চেরো রাজা
মেদিনী রায়
বন্ধ হয়ে যাওয়া কুয়োয়
অশ্বত্থ গাছের বিস্তার
দাউদের আসল পরিকল্পনা ছিল দুর্গ অবরোধ করা। মুঘল সৈন্য তাই দুর্গ আক্রমণ করে। কিছু ক্ষণ যুদ্ধ হওয়ার পর রাজা তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যান। দাউদ-বাহিনী পুরো দুর্গের দখল নেয়।

কিছু দিন পলামুতে থেকে দাউদ খান সেখানকার প্রশাসন ও সুরক্ষা ব্যবস্থাকে নিশ্চিত করে ফৌজদার মানকালি খানের দায়িত্বে পলামুকে রেখে পটনার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন।

এই ইতিহাস শুনতে যতটা ভাল, দুর্গ দু’টির বর্তমান অবস্থা দেখে সত্যি ততটাই খারাপ লাগে। দু’টি দুর্গই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখন! চেরো রাজাদের মধ্যেখুবই উল্লেখযোগ্য ছিলেন মেদিনী রায়।

খাঁরওয়ার, ওঁরাও বা চেরো— আদিবাসীরা দুর্গের গল্প এক এক রকম করে বলে বটে, কিন্তু কোথাও যেন সেগুলোর মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রোটাসগড় থেকে খাঁরওয়াররা নাকি এগারো বারো খ্রিস্টাব্দের মধ্য পলামুতে এসে বসবাস শুরু করে। ওঁরাওরাও দাবি করে ওরাও রোটাসগড় থেকেই এসেছে। আবার চেরোদের গল্পটাও তেমনই। তাই পলামুর ইতিহাসে সবার ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনও সন্দেহ না রাখাই ভাল।

বাংলা সাহিত্য পলামুকে সামগ্রিক ভাবেই ধরার চেষ্টা করলেও তার মধ্যে কোথাও একটা নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গিয়েছে। পুরনো বিহার হোক বা নতুন ঝাড়খণ্ড— আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় খুব একটা উদ্যোগী, এখনও পর্যন্ত তেমনটা মনে হয় না! আসলে নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরই লিখতে হয়, সে ক্ষেত্রে পলামু যে আক্ষরিক অর্থেই পিছিয়ে।



রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ