ঝাড়খণ্ডে পূর্ণ ভ্রমণ
রাঁচি
যখন ঝাড়খণ্ড রাজ্য তৈরি হয়নি তার অনেক আগে থেকেই রাঁচি বিহারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। রাঁচিকে কেন্দ্র করে অনেক কিছু দেখার আছে। মূল শহরের কেন্দ্রেই রাঁচি হিল। এই পাহাড়ের উপরে একটা শিব মন্দির আছে। শহরের প্রায় সব দিক থেকেই সে মন্দির চোখে পড়ে। এখান থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই কাঁকে জলাধার। এখান থেকেই পুরো রাঁচি শহরে জল সরবরাহ করা হয়। এই জলাধারের পাশেই উঁচু পাথুরে টিলার উপর সাজানোগোছানো ‘রক গার্ডেন’— বিনোদনের এক অসামান্য জায়গা। শহরের কোলাহলের বাইরে এমন নিভৃত জায়গায় প্রচুর মানুষ রোজই আসেন। ঠাকুর পরিবারের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৮ সালে রাঁচিতে বেড়াতে এসেছিলেন। শহরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নির্জন ‘মোরাবাদী হিল’-এর উপর তিনি এক বাড়ি বানিয়েছিলেন। জায়গাটার নাম তখন থেকেই হয়ে গিয়েছে ‘টেগোর হিল’। কাঁকেতে রয়েছে ভারত বিখ্যাত ‘সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি’। এ ছাড়া রাজভবন, বিধানসভা এমনকী ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বাড়িও রাঁচির ‘এ গ্রেড’ দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পড়ে। রাঁচিতে অন্যতম আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যস্থানের তালিকায় আছে বিরসা মুন্ডা চিড়িয়াখানাও।

এতো গেল শহরের ভিতরের কথা। রাঁচি গেলে তিনটে জলপ্রপাত আপনাকে দেখতেই হবে— সব ক’টিই শহরের বাইরে।
• দশম জলপ্রপাত: শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে কাঞ্চি নদীকে ঘিরে এই জলপ্রপাত। ১৪৪ ফুট উঁচু থেকে কাঞ্চির জল দশ-ধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে সুবর্ণরেখার বুকে। জঙ্গল-পাহাড় মিলিয়ে ‘দশম ফলস’ অনন্যসুন্দর। জলের বুকে সূর্যের ছটায় রামধনু দেখা যায়। দশমে যাতায়াতের গ্রামীণ পথও চমত্কার।
• হুড্রু জলপ্রপাত: রাঁচি থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে। সুবর্ণরেখা নদী ৩২০ ফুট উপর থেকে ঝরনা হয়ে নেমে এসেছে নীচে। এখানেও সোজা-ঘোরানো প্রচুর সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যায় প্রপাতের কাছে। যাওয়ার পথে বেতলসুদ ড্যাম পড়ে। বাঁধের ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতাই অন্য রকম।
• জোনহা জলপ্রপাত: এর আরও এক নাম গৌতম ধারা— গৌতম বুদ্ধের নামানুসারে। রাঁচি থেকে দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। অনেক উপর থেকে পাহাড়গাত্রকে অবলম্বন করে নদী-জল এখানে ঝরনা ধারায় নেমে এসেছে। প্রায় ছ’শো সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে যাওয়া যায় জলের কাছে। জলধারার শব্দে নৈঃশব্দ্য ভেঙে খানখান, আর তার মাঝে অবিরাম এক জলপ্রপাত এই জোনহা।

ঘাটশিলা-গালুডি
জামশেদপুর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ঘাটশিলা। এক কালে বাঙালি স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এ সব জায়গায় আসত। ঘাটশিলা থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের গালুডিও প্রাকৃতিক বৈচিত্রের কারণেই বিখ্যাত। সুবর্ণরেখা নদীকে দু’টি জায়গা থেকেই অসাধারণ দেখা যায়। ঘাটশিলা স্টেশন থেকে কাছেই সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি— গৌরীকুঞ্জ। স্টেশন থেকে অটোয় করে চলে যাওয়া যায় ফুলডুংরি টিলার এক্কেবারে চুড়োয়। ফুলডুংরি ও সুবর্ণরেখার চর ছাড়া ঘাটশিলার প্রকৃতির সম্ভার উপচে পড়েছে আরও দশ কিলোমিটার দূরের বুরুডিতে। চার দিকে পাহাড়, আর তার মাঝে এক অপরূপ জলাধার। ১৯৮৪ সালে স্থানীয় গ্রামগুলির কৃষিকার্যের প্রয়োজনে বাঁধ গড়তে গিয়েই হ্রদটির জন্ম। জাতীয় সড়কের ধারে কাশিডা মোড় থেকে যে রাস্তাটা ডাইনে বেঁকে হুল্লুম হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের কাঁকড়াঝোড়ের দিকে চলে গিয়েছে, সেটা ধরেই সামান্য এগোতে হবে। পাহাড়ি পথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ধারাগিরি প্রপাতে যাওয়ার আগেই বুরুডি হ্রদের দেখা মিলবে। বুরুডি হ্রদের টলটলে জলে হাত না-ছুঁইয়ে ফিরে আসা যায় না। ঘাটশিলা থেকেই ঘুরে আসা যায় ধলভূমগড়, চান্ডিল ড্যাম ও দলমা পাহাড়।

নেতারহাট
পলামুর পাহাড়ি জনপদ নেতারহাটের খ্যাতি সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য। পাহাড়ি এই বসতিকে ‘ছোটনাগপুরের রানি’ বলা হয়। নেতারহাট রাঁচি থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে। বেতলা থেকেও নেতারহাটে আসা যায়। তবে একটা রাত্তির না থাকলে নেতারহাটকে উপভোগ করা যাবে না। এখান থেকে দশ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে খানিকটা নীচে নামলেই ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট। সূর্যাস্তের সময় বিন্ধ্য পর্বতের শরীর থেকে ধীরে ধীরে সূর্য নেমে যায় উপত্যকায়। পাহাড়ের বাঁকে দেখা যায় কোয়েল নদীকে। আছে নেতারহাট ড্যামও। ছয় কিলোমিটার দূরে রয়েছে আপার ঘাঘরি জলপ্রপাত। নেতারহাট থেকে ট্রেক করে যাওয়া যায় লোয়ার ঘাঘরি। ৩২০ ফিট উঁচু থেকে নেমে এসেছে পাহাড়ি এই ঝরনা। সময় থাকলে ঘুরে নেওয়া যায় হনুমানের জন্মস্থান অঞ্জন গ্রাম। নেতারহাট থেকে ৬১ কিলোমিটার দূরে দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে ৪৬৮ ফুট উঁচু লোধ জলপ্রপাতও যাওয়া যেতে পারে।

হাজারিবাগ
রাঁচি থেকে অথবা সরাসরি ট্রেনে ও সড়কপথে হাজারিবাগ পৌঁছানো যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মনোরম জলবায়ু ও নির্জনতাই এখানকার সম্পদ। মূল দর্শনীয় জায়গা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরের হাজারিবাগ জাতীয় উদ্যান। বিভিন্ন উদ্ভিদ-প্রাণীর সমাহারে সমৃদ্ধ এই উদ্যানে আছে গোটা দশেক অবজার্ভেশন টাওয়ার, নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার ও তৃণভোজী প্রাণী পুনর্বাসন কেন্দ্র। নদী-বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছে সুন্দর জলাশয়। ও পারে আদিম অরণ্য। কাছাকাছি রয়েছে নজরমিনার। তার উপর থেকে উদ্যানের অনেকটাই দৃশ্যমান হয়। শহরের মধ্যে আছে হাজারিবাগ লেক। তার শান্ত সুন্দর পাড় ধরে হাঁটতে খুবই ভাল লাগে। এখানে বোটিংয়ের ব্যবস্থাও আছে। উল্টো দিকেই স্বর্ণজয়ন্তী উদ্যান। কানহেরি হিল নামে একটি ছোট পাহাড় রয়েছে শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। হাজারিবাগকে কেন্দ্র করে কোনার ও তিলাইয়া ড্যাম দেখে নেওয়া যায়।

রাঁচি-হাজারিবাগ রোডের মাঝামাঝি রামগড় থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে রাজারাপ্পা জলপ্রপাত ও ছিন্নমস্তার মন্দির পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। সতীপীঠের অন্যতম এটি— দেবী এখানে ছিন্নমস্তা। ভৈরবী নদী ও দামোদরের সঙ্গমে টিলার উপর এই মন্দির।

জামশেদপুর
ভারতের অন্যতম শিল্প গোষ্ঠী টাটাদের ইস্পাত শিল্পের প্রাণকেন্দ্র এই জামশেদপুরে। এটাই গোটা শহরের আর্থ-সামাজিক অবস্তান সুনিশ্চিত করেছে। ভারতে একমাত্র জামশেদপুর শহরেই কোনও পৌরসভা নেই। নাগরিক সুবিধা দেয় এখানে টাটা গোষ্ঠীর— জুসকো (জামশেদপুর ইউটিলিটি সার্ভিসেস কোম্পানি)। জামশেদপুরের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল দলমা পাহাড়, ডিমনা লেক ও জুবিলি উদ্যান। কাছাকাছির দলমা পাহাড় বিখ্যাত তার ‘দামাল’ হাতিদের জন্য। ডিমনা হ্রদ দলমা পাহাড়ের দক্ষিণপ্রান্তে তিনটি ছোট পাহাড়ের মধ্যে নির্মিত কৃত্রিম এক জলাধার। এখান থেকে পুরো শহরের জল সরবরাহ করা হয়। মূলত বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হয় ডিমনায়। এ ছাড়া সুবর্ণরেখা ও খড়কাই নদীর জলও খাল দিয়ে নিয়ে আসা হয় এখানে। লেকটি শহর থেকে একটু দূরে শহরের উত্তর-পশ্চিম কোণে। শহরের কেন্দ্রস্থলেই রয়েছে জুবিলি উদ্যান। এটি জামশেদজি টাটার জন্মশতবর্ষে বানানো হয়েছিল। রয়েছে চিড়িয়াখানাও।

দেওঘর
ঝাড়খণ্ডের স্বাস্থ্যকর জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম দেওঘর। নামটা শুনলেই প্রথমে মনে আসে বৈদ্যনাথ ধাম বা বাবা ধাম ও সত্সঙ্গ আশ্রমের কথা। জেলার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান হিসাবে এ দু’টি জায়গার নাম সর্বাগ্রে আসে। জসিডি জংশন থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ‘বাবা ধাম’-এ বছরভর পুণ্যার্থীদের আনাগোনা। দেওঘর গেলে ঘুরে আসা যাবে ত্রিকূট পাহাড়, নন্দন পাহাড়, তপোবন।
এই সংক্রান্ত ভ্রমণ কাহিনি: দেওঘরে তিনদিন


রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদলআপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ