আপনার কলমে


সাইকেলে দুর্গ দর্শন
দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়
জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে ট্রেনে চেপে চলেছি কোব্লেঞ্জের দিকে। রাইন নদীর পাশ দিয়ে রেললাইন এমন ভাবে এঁকেবেঁকে চলেছে, মনে হয় নদীটাই আমাদের রেলগাড়িটাকে দু’পাশের ঘন সবুজ শৈলশ্রেণির মধ্যে দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটাই সেই স্কুলজীবনে বইয়ে পড়া রাইন নদী! শৈশবে কোনও দিন ভাবিইনি, সুদূর দেশের এই নদীটিকে স্বচক্ষে দেখতে পাব!

প্রায় দু’ঘণ্টা রেলযাত্রার পর কোব্লেঞ্জ পৌঁছলাম। ছোট্ট স্টেশন, কিন্তু অত্যন্ত পরিষ্কার পরিছন্ন। স্টেশন থেকেই ট্যাক্সি করে সোজা পৌঁছলাম হোটেলে। এটা ঠিক হোটেল নয়, একটি গির্জার অতিথিশালা। আশার কথা, গির্জার সন্ন্যাসিনীরা ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন! নইলে এ পরবাসে হয়তো গাছতলায় রাত কাটাতে হত! অতিথিশালার সামনে একটি বিশাল এবং ততধিক সুন্দর বাগান। সযত্নে লালিত নানা রঙের গোলাপ, টিউলিপ, পেটুনিয়া প্রভৃতি ফুলের সমারোহে আমার পথ চলার ক্লান্তি যেন নিমেষে মিলিয়ে গেল!

কোব্লেঞ্জ শহরটি রাইন ও মোসেল নদীর সঙ্গমস্থলে। দু’টি নদীই বেশ চওড়া এখানে। নদীর ধার ধরে হাঁটতে বেরোলাম বিকেলে। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে দেখলাম, মোসেল নদীর বুকে সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য।



সেন্ট ক্যাস্টরের ব্যাসিলিকা রাজা প্রথম উইলিয়ামের অশ্বাসীন মূর্তি লিভফ্রয়েঙ্কির্চ গির্জা
পর দিন গেলাম শহরের কেন্দ্রস্থল সিটি সেন্টারে। বাসে চেপে। কোব্লেঞ্জ বেশ প্রাচীন শহর। ৮৩১ খ্রিস্টাব্দে তৈরি সেন্ট ক্যাস্টরের ব্যাসিলিকা এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো গির্জা। গথিক নির্মাণশৈলীর এই গির্জায় চারটি উঁচু মিনার সম্রাট নেপোলিয়নের রাশিয়া বিজয়ের সাক্ষী। এর কিছুটা দূরে লিভফ্রয়েঙ্কির্চ গির্জা। ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই গির্জার গগনচুম্বী দু’টি মিনার রোমান স্থাপত্যের উৎকর্ষতার নিদর্শন স্বরূপ আজও দাঁড়িয়ে। আরও কিছুটা হেঁটে গেলে সামনে পড়ল রাইন ও মোসেল নদীর সঙ্গমস্থল— জার্মান ভাষায় ‘ডইশ এক’ অর্থাত্ ‘জার্মান কর্নার’। ত্রিভুজাকৃতি এই নদী-সঙ্গমস্থলটির প্রান্তে রাজা প্রথম উইলিয়ামের একটি অশ্বাসীন প্রস্তরমূর্তি রয়েছে। এই মূর্তিটি ইতিহাসের বহু উল্লেখযোগ্য ঘটনার সাক্ষী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এরই পাদদেশে ফ্রান্সের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জার্মানি যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাত্ ১৯৪৫ সালে মার্কিন যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা বোমার আঘাতে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান মূর্তিটি পুরনোটির অনুকরণে বানানো— রেপ্লিকা। ১৯৯২ সালে এটি এখানে বসানো হয়েছে।
আরেনব্রাইটস্টাইন দুর্গ টাউন হল আরেনব্রাইটস্টাইন থেকে রাইন
রাইন নদীর ওপারে একটি সুবিশাল দুর্গ আছে। হাতে ধরা গাইড ম্যাপে চোখ বুলিয়ে দেখলাম নাম তার আরেনব্রাইটস্টাইন। নদী পেরোনোর জন্য রয়েছে রোপওয়ে। তাতে চড়ে ওপারে গিয়ে দেখলাম দুর্গ চত্বরে বিশাল পুষ্প প্রদর্শনী চলছে— গোলাপ, টিউলিপ, অ্যালোভেরা আরও কত কী! দুর্গ দর্শনের থেকে তার আকর্ষণ মোটেই কম নয়! রাইন ও মোসেল নদী-সহ গোটা শহরটাকে অতীব সুন্দর দেখাচ্ছিল দুর্গের প্রাচীর থেকে।

রোপওয়েতে করে ফের শহরে এসে রাইন নদীর ধার বরাবর আরও কিছুটা হেঁটে গেলাম। চোখে পড়ল প্রাসাদসম ‘টাউন হল’। ভ্রমণার্থীদের সুবিধার্থে রাইন নদীর ধারে রয়েছে অজস্র কাফে। সে রকমই একটি কাফের রঙিন ছাতার ঠান্ডা ছায়ায় এসে বসলাম। এখানে অর্থাত্ জার্মানি আসার আগে আমার এক জার্মান সহকর্মীর কাছ থেকে সুস্বাদু খাবারের একটি তালিকা করে এনেছিলাম। সেটা দেখেই অর্ডার দিলাম— জার্মান ওয়াইন আর স্নিৎজেল। স্নিৎজেল আসলে শুয়োরের মাংসের কাটলেট, পরিবেশন করা হয় আলুভাজা, ডিমের পোচ, মাশরুম ও পছন্দসই সসের সঙ্গে। খেতে কেমন? অতুলনীয়!

পর দিন বিকেল চারটে নাগাদ একটা বিলাসবহুল লঞ্চে চেপে বসলাম। গ্রীষ্মকালে এখানে রাত ৯টা অবধি আলো থাকে। রোদমাখা ঝকঝকে সে বিকেলে, শান্ত নীল জলরাশির মধ্যে দিয়ে আমাদের লঞ্চ ভেসে চলল, দক্ষিণ দিকে। নদীর দু’ধারে একের পর এক মধ্যযুগীয় দুর্গ।
রাইন নদী থেকে দেখা বিভিন্ন দুর্গ
স্টোজেনফেলস দুর্গ, কোব্লেঞ্জ কাত্জদুর্গ, সেন্ট গোর মার্ক্স দুর্গ, ব্রাউবাখ রাইনফেলস দুর্গ, সেন্ট গোর
আমাদের লঞ্চের অন্তিম গন্তব্য সেন্ট গোর নামের একটা ছোট্ট শহর। রাইন এখানে একটি বিশাল পাথরের ধার ঘেঁষে সংকীর্ণ ও তীব্র ভাবে বেঁকে

লরিলাই রক
গিয়েছে। এ পাথরটির নাম লরিলাই রক। লোকগাথা অনুসারে এক ‘কুহকিনী দানবী’ সুন্দরী ‘রমণী’ বেশে পাথরটির উপর বসে অজানা এক মায়া বিস্তার করে জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। যদিও সেই ‘কুহকিনী’র সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি!

পর দিন ট্রেনে করে পৌঁছলাম রুদেশাইম নামের একটি জায়গায়। রাইন নদীর ধারে রুদেশাইম একটি ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর শহর। এখানে ইউরোপের অন্যান্য অনেক জায়গার মতো বেশ একটা মধ্যযুগীয় ভাব আছে। হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে,পাথর বাঁধানো পথের দু’পাশে সারিবদ্ধ বর্ণাঢ্য বাড়িগুলির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলে এলাম শহরের কেন্দ্রস্থলে। ঢুকে পড়লাম পঞ্চদশ শতকে স্থাপিত সেন্ট জেমস প্যারিস গির্জায়। গির্জার ভিতরটা অদ্ভুত সুন্দর, শান্ত ও নির্মল।

শহর থেকে পায়ে চলা পথ গিয়েছে আঙুর খেতের মধ্যে দিয়ে, পাহাড়ের উপরের জার্মানিয়াদেবীর কাছে। পায়ে পায়ে পৌঁছলাম সেখানে। দেবীমূর্তির ডান হাতে রাজমুকুট ও বাঁ হাতে তলোয়ার। জার্মানিয়াদেবীর মূর্তি কতকটা নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টির ধাঁচে গড়া। যদিও, এ মূর্তিটি নির্মিত হয় স্ট্যাচু অব লিবার্টিরও আগে, ১৮৭০ সালে, জার্মানরা ফরাসিদের পরাজিত করার সময়ে। দেবীর পাদদেশ অবধি যাওয়ার জন্য রোপওয়েও আছে। মূর্তির সামনের বাঁধানো রেলিং থেকে দূরের রুদেশাইম শহরের দৃশ্য খুবই মনোরম। পাহাড় থেকে নামার পথে, ডান দিকের একটি পায়ে চলা পথ গিয়েছে পরিত্যক্ত দুর্গ আহরেনফেলস-এর দিকে। পথের বাঁ পাশের খাদের ধার বরাবর রাইন নদী বয়ে চলেছে। অপর পারের বিঞ্জেন শহরের গির্জা ও ক্লস দুর্গের সুন্দর দৃশ্য পথ চলার ক্লান্তি কমায়। আহরেনফেলস-এর এখন প্রায় ভগ্নদশা। ইতিহাস অনুযায়ী, দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল ১২১২ খ্রিস্টাব্দে, কালে কালে তার ধ্বংসপ্রাপ্তি হয় ফরাসিদের হাতে। দুর্গের জরাগ্রস্ত প্রাচীরের প্রবেশ দ্বারে কিন্তু বেশ নতুন এবং পোক্ত এক লোহার তালা ঝুলতে দেখলাম। অগত্যা, দুর্গের ভিতরে ঢোকার পরিকল্পনা ছেড়ে, পাহাড়ি পথে নেমে এসে নৌকায় রাইন নদী পেরিয়ে চলে এলাম বিঞ্জেন-এ।
রুদেশাইম আহরেনফেলস দুর্গ ক্লস দুর্গ বিঞ্জেন শহর
এ বার আমার পথের সঙ্গী একটা ভাড়া করা সাইকেল। কারণ আর কিছুই নয়! যেখানে যাব, সেই রাইন্সটাইন দুর্গ এখান থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে। যাওয়ার পথে দুপুরের খাওয়া সারলাম রাস্তার ধারের একটি ‘মোবাইল ফুড ভ্যান’ থেকে কেনা ‘কারি উরটজ’ দিয়ে। জার্মান শব্দ ‘উরটজ’-এর মানে সসেজ। তার সাইজ যেমন অবাক করার মতো, খেতেও তেমনই অপূর্ব! অবশেষে সাইকেল চেপে পৌঁছে গেলাম রাইন্সটাইনে। এটি তৈরি করা হয়েছিল ১৩১৬ সাল নাগাদ। তবে আহরেনফেলস-এর মতো এর এখনও অতটা জরাপ্রাপ্ত দশা হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুনর্নির্মিত করা হয়েছিল যে! ক্যাসলের ভিতরের মিউজিয়ামে বহু মধ্যযুগীয় নিদর্শন— যুদ্ধবর্ম, শিরস্ত্রাণ, কারুকার্যমণ্ডিত মোমদানি, পিয়ানো, হার্প ইত্যাদি— সংরক্ষিত আছে।

সরু গোলগোল ঘোরানো প্রায়ান্ধকার সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠলাম। ভিতরের মধ্যযুগীয় পরিবেশে গা ছমছম করতে বাধ্য। ড্রাকুলা উপ্যনাস পড়া থাকলে হয়তো মনশ্চক্ষে ক্যাসলের গা বেয়ে একটি বিরাট বাদুড় জাতীয় প্রাণীকে অবলীলাক্রমে নামতে দেখা যাবে!

ফের সাইকেলে চেপে ফিরলাম।

পরের দিন ট্রেনে চড়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছে, বিমানের জানালা থেকে এক বার শেষ বারের মতো দেশটাকে দেখলাম!

এক কথায়: দুর্গ চত্বরের বিশাল পুষ্প প্রদর্শনীর আকর্ষণ দুর্গ দর্শনের থেকে কিছু কম নয়!

টুকিটাকি তথ্য
কবে যাবেন: জার্মানি যাওয়ার সব থেকে মনোরম সময় হল মে থেকে অক্টোবর মাস।

কী ভাবে যাবেন: রাইন উপত্যকা দেখতে গেলে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নামতে হবে। তার পর ট্রেনে চেপে রুদেশাইম। রুদেশাইমের নিকটবর্তী অঞ্চলের দুর্গগুলি দেখতে সাইকেল ভাড়া করা ছাড়া উপায় নেই। রুদেশাইম থেকে কোব্লেঞ্জ যেতে হবে ট্রেনে অথবা জলপথে। রিভার ক্রুজ ভাড়া করে নদীপথে লরিলাইরক দেখে কোব্লেঞ্জ যাওয়াটাই সবচেয়ে ভাল।

আনুমানিক খরচ: রুদেশাইম ও কোব্লেঞ্জ টাউন সেন্টারে প্রচুর মধ্যমানের হোটেল রয়েছে। থাকার খরচ মোটামুটি ষাট থেকে আশি ইউরো। রাইন উপত্যকার আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইন কিনতে যেন ভুলবেন না। দাম মোটামুটি তিরিশ থেকে পঞ্চাশ ইউরো।

ডাবলিন সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্চ ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণারত। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে, প্রথমে বেঙ্গালুরু ও তার পর আয়ারল্যান্ডে বসবাসের ফলে আজ প্রায় পাঁচ বছর ঘরছাড়া। গবেষণাসূত্রে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের স্মৃতি একত্রিত করার প্রচেষ্টাতেই ভ্রমণ বিষয়ক প্রবন্ধ লেখার শুরু।
ছবি: লেখক

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ