আপনার কলমে


বর্ণময় বুসানে দেড় দিন
ব্রতী চৌধুরী
প্রতি দিনের চেনা পৃথিবীটা যখন নিত্যকার সাজসজ্জা পরিবর্তন করে আমাদের চোখের সামনে তার রূপের সম্ভার মেলে ধরে, তখন সত্যিই বিস্ময়ের অবধি থাকে না! কখনও সে নিজেই ধরা দেয় আমাদের কাছে! আবার কখনও দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে!

২০১১ সালে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন পৌঁছেছিলাম, সময়টা ছিল শীতের শুরু। সেখানে যাওয়ার পর নতুন দেশের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপের পর্বটুকু মিটতে না-মিটতেই বরফ পড়ার শুরু। অতএব, ওই প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমরা ঘরের উষ্ণ কোণটুকু ছেড়ে বেরোতে পারিনি কোথাও। পরে ঠিক হয় সপ্তাহান্তে শনি-রবির ছুটিতেই বেরোনো হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব উপান্তে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম বন্দর শহর বুসান। সেখানকার উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলি থেকে আরও পুবে ‘সূর্যদয়ের দেশ’ জাপানের কিছু অংশ দেখা যায়। আয়তন ও লোক সংখ্যার বিচারে দেশের রাজধানী সিওলের পর বুসানের স্থান। ঘন জনবসতিপূর্ণ এই শহরটি পাহাড়ের কোলে নাকডং ও সুইয়ং নদী উপত্যকায় গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সমুদ্র, পাহাড় আর নদীর মিলনে গড়ে ওঠা বুসান প্রকৃত অর্থেই প্রাণোচ্ছল ও গতিময়।

জোগাড় করা তথ্যের ভিত্তিতে সাজানো হল ভ্রমণসূচি। পুরো শহরের সমস্ত দ্রষ্টব্য মাত্র দেড় দিনে দেখে ওঠা সম্ভব নয়। তাই পছন্দের তালিকা থেকে বাদ পড়ল অনেক কিছুই। তবুও মনের মধ্যে আনন্দ! বেড়ানো মানে তো আর শুধুই চোখের দেখা বা গন্তব্যে উপস্থিত হওয়া নয়! তার বাইরে আরও অনেক কিছু। সব কিছু সাজিয়ে নিয়েই পরিকল্পনা।
বুসানের পরিবহণ ব্যবস্থা

‘হাঙর’ ট্রেন

সিটি ট্যুর বাস
বুসান যাওয়ার জন্য ‘কোরিয়া ট্রেন এক্সপ্রেস’ (কেটিএক্স)-এর টিকিট কাটা হয়েছিল। দ্রুত গতিসম্পন্ন এই ট্রেনে কোরিয়ার যে কোনও প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে পৌঁছনো যায় খুব তাড়াতাড়ি। কোরিয়ার ঐতিহ্য ও হাঙরের দেহ গঠনের সাযুজ্য মাথায় রেখে কেটিএক্সের এমন নকশা করা হয়েছে, যাতে বাতাসের সঙ্গে ট্রেনের ঘর্ষণের হার অনেক কমে যায়। ভিতরে বসার আসন মোট ৯৩৫টি। তা ছাড়াও প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট আসন। বিমানসেবিকার মতো এই ট্রেনে আছে রেলসেবিকা। ট্রেনের ছাদের সঙ্গে আটকানো ‘ডিজিটাল মনিটর’। সেখানে পরিবেশিত হয় বিনোদনের পাশাপাশি জরুরি তথ্যও। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারা এই ট্রেন পরিষেবা শুরু হয়েছিল ২০০৫ সালে।

বুসানে নেমে স্টেশন সংলগ্ন ‘বুসান সিটি ট্যুর’ বাস স্টপে গেলাম প্রথমে। শহরের বিভিন্ন এলাকার দশর্নীয় স্থানগুলি পাঁচটি ভিন্ন সূচিতে সাজিয়ে সে বাসের শহর পরিক্রমা। পর্যটকদের জন্য বুসানের নিজস্ব পর্যটন সংস্থা এই বাসগুলির ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটি ‘কোর্স’-এর জন্য আলাদা আলাদা বাস পাওয়া যায় বুসান স্টেশন থেকে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং নাগরিক জীবনযাত্রা— এই দুইয়েরই কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে, আমরা নিজেদের সময় ও সুযোগ মতো তেমন তিনটি ‘কোর্স’ বেছে নিয়েছিলাম।

আমাদের প্রথম ‘কোর্স’— টেজনডি। দোতলা বাস, উপর-নীচ মিলিয়ে মোট ৬৫ জন যাত্রী একসঙ্গে ভ্রমণ করতে পারেন। প্রতিটি সিটের পিছনে একটি করে ‘ডিজিটাল মনিটর’— কোরিয়ান, চিনা, জাপানি ও ইংরেজি ভাষায় তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে। যাত্রীরা সেখানে তাঁদের ‘কোর্স’ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারবেন। এক বার টিকিট কেটে পর্যটকরা সারা দিনে যত বার খুশি নিজের পছন্দ মতো জায়গায় নামতে বা উঠতে পারেন। এ ভাবে একটি ‘কোর্স’-এর প্রতিটি জায়গা ঘুরে নেওয়া সম্ভব।
প্রকৃতির রূপ

পাহাড়ঘেরা সমুদ্র

লাইটহাউস যাওয়ার রাস্তা
টেজনডি কোর্সে বাসের প্রথম গন্তব্য আন্তর্জাতিক বন্দর— ‘প্যাসেঞ্জার ফেরি টার্মিনাল’ ও ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রুজ টার্মিনাল’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাহাজের আনাগোনা এখানে। কিন্তু বাইরের আবহাওয়া খারাপ থাকার দরুণ সেখানে নামা গেল না। বাস চলল একেবারে সমুদ্র উপকূলের রাস্তা দিয়ে। ধারের ‘বেড়া’র ওপাশে বিস্তৃত বন্দর এলাকা। সারি দেওয়া ছোট-বড়, সাদা-রঙিন বিভিন্ন জাহাজ, ভিড়ে রয়েছে তীরে। কোনওটি পণ্যবাহী, তো কোনওটি যাত্রীবাহী। জিনিসপত্র তোলা বা নামানোর জন্য রয়েছে সুবিশাল ক্রেন। কোনও জাহাজ তীরে এসেছে হয়তো, তার জন্য চলছে তখন বিপুল তত্পরতা। আবার অনতিদূরে জলের উপর ভেসে রয়েছে এক সাদা জাহাজ, যেন গর্বিত রাজহংস।

বৃষ্টির মধ্যে বাস এগিয়ে চলে। তার ভিতর দৃশ্যমান হতে থাকে পাহাড়ঘেরা সমুদ্রের বিভিন্ন রূপ। মেঘলা আকাশের গভীরতা যেন ঘিরে ধরেছে তাকে। তবু সে আপন খুশিতে উচ্ছ্বল। ক্রমশ বৃষ্টির বেগ কমে আসে। মেঘের ফাঁক থেকে সূর্য উঁকি দেয় অল্পসল্প। টেজনডি প্রধানত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই বিখ্যাত। সবুজ এক পার্কের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলা এক রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে সমুদ্রের ধারে। পার্কে ঢোকার মুখেই একটি মনুমেন্ট— ১৯৫০ সালে কোরিয়ার যুদ্ধে নিহত ডাক্তার-সেনানীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি। সেটি দেখে আমরা পার্কের মূল ফটকের পথে পা বাড়ালাম। পাহাড়ের গায়ে প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা রাস্তা চলে গিয়েছে সমুদ্রের ধারে, যার শেষ প্রান্তে রয়েছে ‘ইয়ংডো লাইটহাউস’। মূল গেটের সামনে থেকে ‘শাট্ল’ বাস ইচ্ছুক যাত্রীদের পৌঁছে দেয় ফেরিঘাটে। সেখান থেকে ফেরিতে চেপেও লাইটহাউসে যাওয়া যায়।

পাহাড়ি হলেও রাস্তাটি সুন্দর করে বাঁধানো ও চওড়া। পথচারীদের জন্য রয়েছে ফুটপাথ, আর তার পরেই কাঠের বেড়া। এর পর পাহাড়ি ঢাল খাড়া নীচে নেমে গিয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাল বরাবর শক্ত জাল লাগানো। তার পর অনেকটা নীচ পর্যন্ত শুধুই জঙ্গল আর গাছপালা। ঢাল শেষে পাথুরে জমি (রকি ক্লিফ্স) খাড়াই নেমে গিয়েছে। সমুদ্রের শুরু সেখান থেকে। যতই উপরে উঠছি মেঘেরা যেন আরও নাগালের ভিতর চলে আসছে, পাহাড়ের গায়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আদরিনীর মতো। চার দিক নিবিড় নিস্তব্ধ। শুধু বনের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মাঝে মিলিয়ে যাওয়া দু’একটা পাখির ডাক। অনভ্যাসের চড়াই-উতরাই পথ, কিছু ক্ষণ চলার পর পা যেন একটু বিশ্রাম চায়। চলার পথে বেশ কয়েকটি ‘ভিউ পয়েন্ট’ রয়েছে। কাঠের চাতালের উপর কয়েকটি দূরবীন বসানো। তার মধ্যে চোখ রেখে বহু দূরের জাহাজ, রকি ক্লিফ্স, সমুদ্রকে আরও কাছ থেকে অনুভব করলাম যেন। একটি ‘ভিউ পয়েন্ট’-এর সামনে ‘মা ও শিশু’র মূর্তি রয়েছে— কথিত আছে ওইখানে বসে শিশুসন্তানকে নিয়ে এক মা দীর্ঘ দিন যুদ্ধে নিযুক্ত থাকা তাঁর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন।
রকি ক্লিফ্স ইয়ংডো লাইটহাউস সি-গালদের উড়ান
সবুজ অরণ্য পেরিয়ে অবশেষে আমরা লাইটহাউসের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম। এ বার পাহাড়ের উপর থেকে ক্রমশ নীচে সমুদ্রের কাছে নামবার পালা। পথ সংকীর্ণ, তবে কাঠের সিঁড়ি থাকায় তা সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত। সিঁড়ি বেয়ে আমরা লাইটহাউসের প্রবেশদ্বারে তত ক্ষণে উপস্থিত হয়েছি। ঘন সবুজ পাহাড়ের কোলে, সমুদ্রের নীল-সবুজ জলের পাশে সাদা রঙের এই লাইটহাউসটি রচনা করেছে এক অপূর্ব মনোহারী মায়া। ভিতরের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে একেবারে উপর পর্যন্ত ওঠা যায়। ‘সি গ্রিন’ রঙের কাচে ঘেরা সেখানকার গোল বারান্দা থেকে দৃশ্যমান সাগর-পাহাড়ের অপূর্ব সখ্য, ভাসমান জলযান রাশি, সি-গালদের দুরন্ত ওড়াউড়ি, জলে-স্থলে ছায়া-রোদের লুকোচুরি খেলা— চুম্বকের মতো আটকে রাখল আমাদের। অগুণতি পর্যটকের ভিড় আর তার কোলাহল। পৃথিবীর সব আলোড়ন যেন মিশে যাচ্ছে ঢেউয়ের দোলায়। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এখান থেকে মাত্র ৫৬ কিলোমিটার দূরে জাপানের সুশিমা ও ডিমা দ্বীপ দেখা যায়। প্রকৃতির এই নীরব সৌন্দর্য মনের মধ্যে থাকল গাঁথা হয়ে। তারই কিছুটা ক্যামেরা-বন্দি করে প্রায় ন’দশ তলা বাড়ির সমান উঁচু লাইটহাউসের উপর থেকে খাড়াই পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে একেবারে সমুদ্রের কাছাকাছি এসে পড়লাম। যতদূর চোখ যায়— জল, শুধু জল। মহাসমুদ্রের জল ছোট ছোট ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ছে পাথরের উপর। হীরের কুচির মতো জল খিলখিল করে হেসে চারিদিকে ছড়িয়ে, পাথরকে ভিজিয়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের ঠিকানায়। জল আর পাথরের খুনসুটি দেখতে দেখতে যে কত ক্ষণ সময় পেরিয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি।

এর পর ফেরিবোটে চড়ে শুরু হল জলবিহার। জলের উপর সহযাত্রীদের ছোঁড়া চিপসের টুকরো ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে এক দল সি-গাল। ফেরিবোট তরতর করে জল কেটে এগিয়ে চলেছে, পিছু নিয়েছে সি-গালের দল। অপূর্ব সে দৃশ্য! ফেরিবোট আমাদের যখন মেন গেটের কাছে পৌঁছে দিল তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। ফেরিঘাটের আশেপাশে প্রচুর খাবারের দোকান। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, ঝিনুক, অক্টোপাস ইত্যাদি কাঁচা পরিবেশিত হয় এখানে, এ সব কোরিয়ায় খুবই জনপ্রিয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়, তাই আমরা নিজেদের খাবারে মন দিলাম। রিসর্ট পার্ক থেকে বেরিয়ে পরবর্তী সিটি ট্যুর বাসে উঠে সংডো বিচের উদ্দেশে রওনা হলাম। বাস থামল সংডো সৈকতে— সাদা মসৃণ বালুতট। ছোট ছোট ঢেউ এসে তাকে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা বালির দুর্গ বানানোর খেলায় মত্ত। কেউ বা জলের মধ্যে হুটোপাটি করছে। আকাশের মুখ ভার, আবহাওয়াও ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে। তাই জলে নেমে একটু পা ভেজানোর পরই উঠে আসতে হল।

গুয়াংগালি ব্রিজ
সন্ধেবেলায় ‘নাইট কোর্স’-এর বাস ছাড়ল বুসান স্টেশন থেকে। রাতের আলোয় মায়াবী বুসান যেন আরও মোহময় হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের উপর আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাস মৃদুমন্দ গতিতে চলেছে। চারিদিকে মণিমুক্তোর মতো ছড়ানো আলোয় সাজানো শহরের রূপটি ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে। বাস থামল গুয়াংগালি বিচে। সমুদ্রের জলে তখন অন্ধকারের রং লেগেছে। কেবল তীরে এসে পড়া ঢেউয়ের ‘ছলাত্ ছল’ শব্দ কানে আসছে। আশেপাশের বহুতলগুলিও আলোয় সাজানো। সমুদ্রের উপর নির্মিত গুয়াংগন বা ডায়মন্ড ব্রিজ— অসামান্য আলোকসজ্জায় সেজে ওঠা এই সেতুটি বুসানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। মিশকালো রাতের অন্ধকারের মাঝে কালো জলের উপর আলোয় উদ্ভাসিত ‘হীরক সেতু’ পরিবেশকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। কোরিয়ায় সমুদ্রের উপর নির্মিত সেতুগুলির মধ্যে এটিই সর্ববৃহত্। দ্বিতল সেতুটির উপরতলায় হলুদ আলোর সঙ্গে নীচের সাদা আলোর মিশেলে রাতের ‘গুয়াংগালি ব্রিজ’ সত্যিই অভিনব। মাঝে মাঝে বাজি পোড়ানো হচ্ছে। রাতের আকাশে আলোর সে রোশনাই বাক্যহারা করে আমাদের। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের শেষে এই সৈকতে বাজির উত্সব— বুসান ফায়ারওয়ার্কস ফেস্টিভ্যাল হয়। অংশ নেয় বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা।

কিছু ক্ষণ সেখানে থাকার পর ফিরে গেলাম বাসে। সমুদ্রের ধারের রাস্তা দিয়ে বাস চলতে লাগল। আঁকাবাঁকা পথে সেতুর সঙ্গে চলল তার লুকোচুরি খেলা। এর পর শহরের মধ্যে বিভিন্ন পথে বাস এগোতে থাকে। রাতের আলোয় অভিনব এক নগর পরিক্রমার সাক্ষী থাকি আমরা। তার পর হোটেলে নিশিযাপন।

আন্ডার ওয়াটার টানেল
পর দিন সকালে তৈরি হয়ে রওনা দিলাম ‘হুন্ডাই কোর্স’-এর বাসে চেপে। গত রাতে দেখা ‘গুয়াংগালি বিচ’ই আমাদের প্রথম গন্তব্য। সকালে রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে তটের সাদা বালি, সবুজাভ জল তাকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। সকালবেলায় সেখানে গুটিকয়েক মানুষজন ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দূর সাগরের উপর একটা দু’টো জাহাজ ভেসে রয়েছে। রবিবারের সকালের আলস্য যেন তখনও জড়িয়ে আছে চারদিকে। আমরাও জলে নেমে পড়লাম। জলের শীতলতা স্পর্শ করল শরীর-মন। শান্ত, প্রায় নির্জন সমুদ্রসৈকত বরাবর হাঁটতে হাঁটতে সূর্যকিরণের জলকেলি উপভোগ করছিলাম। দিগবলয়ের কাছে আকাশ আর সমুদ্র যেন কোলাকুলি করছে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, যাকে শব্দে ধরা আমার অসাধ্য। বিচে বসে রইলাম অনেক ক্ষণ নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে। সাগরপাড়ের ঝিনুকও কিছু সংগ্রহ করা হল স্মারক হিসাবে।

ঘণ্টাখানেক গুয়াংগালি বিচে কাটিয়ে পৌঁছলাম হুন্ডাই বিচের ঠিক পাশেই সমুদ্র তলদেশের বুসান অ্যাকোরিয়ামে। পাঁচতলা অ্যাকোরিয়ামের চারটে তলাই মাটির নীচে। প্রবেশপত্র নিয়ে এক অজানা-অচেনা ‘পৃথিবী’র স্বাদ পেতে ঢুকে পড়লাম সেখানে। এটি কোরিয়া তথা এশিয়ার অন্যতম বৃহত্ অ্যাকোরিয়াম। প্রায় ৩৬ হাজার প্রজাতির সামুদ্রিক জীব প্রদর্শিত হয় এখানে। অ্যাকোরিয়ামটির মূল আকর্ষণ ৫-৬টি প্রজাতির হাঙর। তা ছাড়াও ‘রে ফিশ’, ‘স্টোন ফিশ’, ‘সান ফিশ’— অগুণতি সামুদ্রিক প্রাণীর সম্ভার আছে। সাত মিটার লম্বা একটি ট্যাঙ্কে নানা রঙের ও বিভিন্ন আকৃতির প্রবাল রয়েছে। তার ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় হরেক কিসিমের মাছের খেলা চলছে প্রতি নিয়ত। ৮০ মিটার লম্বা একটি ‘আন্ডার ওয়াটার টানেল’ রয়েছে। টানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় ঠিক যেন সমুদ্রের তলাতেই নেমে পড়েছি। মাথার উপর, ডাইনে, বাঁয়ে হরেক রকমের প্রাণীর যাতায়াত, অনবরত। হাঙরের হাঁ, কচ্ছপের ডানা, বা রে ফিশের লেজ— বিস্ময়ের অবধি নেই কোথাও। পড়ার বইতে আর প্রাক্টিক্যাল ক্লাসের টেবলে বোতল-বন্দি অবস্থায় দেখা পরিচিত কয়েক জনকে এখানে জীবন্ত ঘোরাফেরা করতে দেখে উচ্ছ্বসিত আমি। সমুদ্রের তলার দুনিয়াটা যে সত্যিই কত সুন্দর আর বৈচিত্রময় তা চাক্ষুষ করা গেল! টিভি চ্যানেলগুলির দৌলতে যে ‘পৃথিবী’র সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার সামনে দাঁড়িয়ে অভিভূত আমি।

হুন্ডাই বিচ
অ্যাকোরিয়াম ছেড়ে আসতে মন চায় না কিছুতেই। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা দুপুর নির্দেশ করছে। অন্যান্য জায়গা তখনও ঘোরা বাকি। অগত্যা বেরিয়ে হুন্ডাই বিচে এসে দাঁড়ালাম। যে দিকে তাকাই শুধু মানুষের ভিড়। দেশ বিদেশের পর্যটকরা এসে মিলিত হয়েছে সেখানে। বিচের সৌন্দর্য ঢাকা পড়েছে মানুষের জটলায়। বুসানে যাওয়ার আগে শুনেছিলাম এটিই কোরিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সৈকত, তাই লাখো মানুষের ভিড় এখানে। জলে নেমে তুমুল হুটোপাটি-হুল্লোড় করছে সবাই। তিল ধারণের জায়গা নেই আর। লাল-নীল-সাদা-হলুদ-সবুজ— রংবেরঙের ছাতার মেলা। তার তলায় জায়গা করে নিয়েছে আট থেকে আশি— সব বয়সী মানুষ। গোল-চৌকো, ছোট-বড় টায়ার নিয়ে চলছে সমুদ্রস্নান। যার ফলে সমুদ্রের জল প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। চার দিকে শুধুই শোরগোল। সেখানে কিছু ক্ষণ থেকে আমরা আমাদের শেষ গন্তব্য শিনশিগে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের দিকে পা বাড়ালাম।

বিশ্বের বৃহত্তম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটিকে স্থানীয় লোকেরা শিনশিগে সিটি বলেন। একটিই বাড়ির মধ্যে যেন গোটা একটি শহর ঢুকে পড়েছে। মাটির উপর চোদ্দতলা এবং নীচে তিনতলা— সব মিলিয়ে মোট সতেরোতলার এই মাল্টিস্টোর কমপ্লেক্সের বিভিন্ন তলায় নানা রকম জিনিসের কেনাবেচা চলছে। জিনিসপত্রের বৈচিত্রের কথা লিখে বোঝানো অসম্ভব। এত রকমের জিনিস যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে লাগতে পারে, তা হয়তো এখানে না এলে অজানাই থাকত। মূল প্রবেশদ্বার পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল কোরিয়ার উইন্ডচাইমের আদলে তৈরি প্রকাণ্ড এক কাচের ঝাড়বাতি— যেটি ওই বাড়ির সাততলা থেকে একতলা পর্যন্ত বিস্তৃত। চোখ ধাঁধানো ঝাড়বাতিটি যেন মলটির আভিজাত্যের প্রথম সোপান। প্রথম তলায় দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির প্রসাধনী দ্রব্যের পসরা। এক দিকে রয়েছে লাইভ অনুষ্ঠানের মঞ্চ। গিটার আর ড্রামের আওয়াজে মুখরিত দশদিক। বৈদ্যুতিন সিঁড়ি বেয়ে এর পর এক একটি ফ্লোর দেখতে দেখতে আমরা ক্রমশ উপরের দিকে উঠছি। যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। কত অজানা জিনিসের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। চারতলায় একটি ‘আইস স্কেটিং রিঙ্ক’ আছে। সেখানে ছোটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। প্রায় প্রত্যেকটি ফ্লোরেই কোনও না কোনও রেস্তোরাঁ রয়েছে। তবে দশম ফ্লোরটি বিশেষ ভাবে ‘ফুড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত। এরই এক পাশে রয়েছে ‘স্কাই পার্ক’— ব্যক্তিগত ভাবে আমায় সবচেয়ে আকৃষ্ট করেছে এটি। দশতলার ছাদের উপর পাইন গাছের বাহার, নরম সবুজ ঘাসের লন আর ফুলের কেয়ারি প্রথমে বুঝতেই দেয় না যে খোলা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছি। বেড়ারূপী পাঁচিলের ধারে গেলে বোঝা যায় মাটি থেকে আমাদের পা ঠিক কতখানি উপরে! এর পর এগারো তলার ‘স্পা’ দেখে আমরা বারো তলার গল্ফ কোর্সে গেলাম। বারো থেকে চোদ্দতলা অবধি শুধুই গল্ফ কোর্স, খেলোয়াড় ও শিক্ষানবিশদের অনুশীলনের জায়গা। সব দেখে আমরা একেবারে বেসমেন্টে নেমে এলাম। এর প্রথম দোতলায় কার পার্কিং জোন। তৃতীয় তলায় জেনারেল ফুডমার্ট ঘুরে দেখার পর হাতে খুবই কম সময় রয়েছে দেখে ফিরে এলাম বুসান স্টেশনে।
শহরের বৈচিত্র

শিনশিগে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর

বহুতল

আলোর খেলা
স্টেশনের সামনে বাঁধানো চত্বরে তখন চলছে আলো ও শব্দের খেলা। ফোয়ারার জল, লেজার রশ্মির ছটা ও সঙ্গীতের তালে অসাধারণ সে কারসাজিতে মুখরিত স্টেশন প্রাঙ্গন। এ দিকে ট্রেনের সময় হয়ে আসছে। প্রতি দিনের অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাওয়ার পালা এ বার। কিন্তু তারই মাঝে এক ঝলক টাটকা বাতাস যেন বয়ে গেল মনের উপর দিয়ে, জুড়িয়ে দিল সব। অদেখা, অধরা, অজানা থেকে গেল অনেক কিছুই। তবুও তৃপ্ত মনে ফেরার ট্রেনে চড়ে বসি। কেটিএক্স-এর জানালা দিয়ে আরও এক বার চোখ রাখলাম বাইরের দিকে। রাতের আলোকসজ্জায় বুসান তখন মায়াবী— ট্রেনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোকবৃত্ত বিন্দু হয়ে হারিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। বিদায় বুসান।

এক কথায়: চিরকালের মতো মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিল বুসান।

টুকিটাকি তথ্য
কবে যাবেন: বুসান যাওয়ার আদর্শ সময় হল জুন থেকে অগস্ট মাস অর্থাত্ গ্রীষ্মকাল। এ সময় এখানকার আবহাওয়া আর্দ্র ও নাতিশীতোষ্ণ থাকে। গড় তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

কী ভাবে যাবেন: ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দর থেকে ব্যাঙ্কক অথবা হংকং হয়ে কানেকটিং উড়ানে বুসান আসা যায়। নয়াদিল্লি থেকে সিওলে এসে কেটিএক্স বা অন্য ট্রেনে বুসান পৌঁছনো সম্ভব। তবে তা সময় ও খরচসাপেক্ষ।

প্রয়োজনীয় তথ্য: বুসান ভাল ভাবে ঘুরতে গেলে ৪-৫ দিন সময় হাতে রাখা ভাল। শহরের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার জন্য বাস অথবা মেট্রো সবচেয়ে ভাল উপায়। বুসানের মেট্রো পরিষেবা উল্লেখযোগ্য।

শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক আবহাওয়ায় বড় হয়ে ওঠা। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি সাহিত্য-সঙ্গীত চর্চাও চলেছে আশৈশব। বতর্মানে স্বামীর কর্মসূত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার ডেজান শহরে বসবাস। অখণ্ড অবসরের সঙ্গী গান ও বিভিন্ন বইপত্র। পাঠভবনের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে ‘সাহিত্যসভা’র জন্য ছোটবেলা থেকেই লেখার অভ্যাস, বিশেষত নতুন কোনও জায়গায় বেড়ানোর অভিজ্ঞতা।
ছবি: সুমিত চৌধুরী

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ