আপনার কলমে


‘সীমান্ত শহর’ সান আন্তোনিও
জ্যোতির্ময় দালাল
লকাতা থেকে সুদূর মার্কিন মুলুকের টেক্সাস— কলেজ স্টেশন নামের একটি ছোট্ট শহরে সস্ত্রীক স্বেচ্ছানির্বাসনে এসেছি প্রায় বছর চারেক। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন এ দেশে ড্রাইভিং না জানার পরিণতি। কাজেই টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই মফস্সলে প্রায় গৃহবন্দি হয়েই প্রথম সেমিস্টার কাটানোর পর ‘গৃহমন্ত্রী’ বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন! তাই, শীতের এক মাসের ছুটিতে যখন এই ছোট্ট শহর ফাঁকা হয়ে যাবে, তখন আমাদের যেতেই হবে কোথাও একটা, বেড়াতে। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন যে কোনও জায়গায় যাওয়ার আগে সেখানকার পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নেওয়াটা প্রায় জলভাত। ঠিকানা দিলেই গুগল ম্যাপ যে কোনও শহরের রাস্তার ছবি পলকে হাজির করবে আপনার কম্পিউটারের পর্দায়। অনলাইনে বিস্তর ট্রাভেল গাইড ঘেঁটে, দূরপাল্লার বাসরুট নিয়ে গবেষণা করে, পকেটের অবস্থা বুঝে, এক গুচ্ছ হোটেল-মোটেলের তালিকা থেকে একটাকে বেছে নিয়ে অবশেষে ঠিক হল— তিন দিনের ঝটিকা সফরে আমরা যাব সান আন্তোনিও।

লিসবনের এক ধনী পরিবারে জন্ম হয় অ্যান্টনির। পরবর্তী কালে ক্যাথলিক ধর্ম প্রচার করার সূত্রে তিনিই পরিচিত হন পাড়ুয়ার সেন্ট অ্যান্টনি নামে। তাঁর মৃত্যু হয় এই পাড়ুয়াতেই। এই সন্ন্যাসীর নামানুসারে শহরের নাম সেন্ট আন্তোনিও, ছোট করে সান আন্তোনিও— টেক্সাসের অতি প্রাচীন শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। অতীত ও বর্তমানের নিদর্শন এখানে পাশাপাশি রয়েছে বলে ঐতিহ্যমণ্ডিত এ শহরকে বলা হয় ‘সীমান্ত শহর’। ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে এক দল স্প্যানিস মিশনারি ‘টেক্সাস হিল কানট্রি’র দক্ষিণে ‘মিশন সান আন্তোনিও ডি ভ্যালেরো’ স্থাপন করেন। ১৮৩৬ সালে মেক্সিকোর অধীনতা মুক্ত হওয়ার সময় এই সান আন্তোনিওই ছিল টেক্সাসের এক মাত্র গুরুত্বপূর্ণ শহর। এখানে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে— ঐতিহাসিক মিশন অ্যালামো, মার্কেট স্কোয়্যার, স্প্যানিশ গভর্নরের প্রাসাদ, রিভার ওয়াক, টাওয়ার অব আমেরিকাস, টর্চ অব ফ্রেন্ডশিপ— তালিকা অতি দীর্ঘ।

‘গ্রে হাউন্ড’ নামে আমেরিকায় দূরপাল্লার এক বাস পরিষেবা চালু আছে। ভাড়া গাড়ির চেয়ে খরচ কম, তবে সময় নেয় অনেক বেশি। আর মাঝে কোথাও একটা ‘কানেকটিং’ বাস ধরতে হবে গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য। ডিসেম্বরের এক সকালে কলেজ স্টেশন থেকে বেরিয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ ‘ওয়েকো’ নামে একটা ছোট্ট শহরে পৌঁছে, সান আন্তোনিওগামী বাস ধরতে পাক্কা তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হল টার্মিনাসে! মার্কিন মুলুকে এসে দূরপাল্লার বাস-ভ্রমণের প্রথম অভিজ্ঞতা। ‘ফ্রি বে’ ধরে অতি দ্রুত ছুটে চলেছি একের পর এক ছোট-বড় শহর পেরিয়ে। মাঝে মাঝে একেবারে জনহীন ধুধু প্রান্তর অথবা শীতের পাতাঝরা গাছের সারি। ‘ফ্রি বে’র দু’ধারে চোখে পড়ছে নানা মাপের হোটেল বা মোটেল। অবশেষে সন্ধে ৭টা নাগাদ পৌঁছলাম সান আন্তোনিওতে— পর দিন সকালে হবে নগরদর্শন, তাই আজকের মতো হোটেলে বিশ্রাম।

টেক্সাসের বৈশিষ্ট্য অনেক। তবে তার মধ্যে অন্যতম এখানকার আবহাওয়া। লোকজন সকালে উঠে প্রথমেই অনলাইন, টিভি বা রেডিওয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নেয়। কাজটি অত্যন্ত জরুরি। কেননা, সকালে ঝকঝকে রোদ, তো পরের ঘণ্টাতেই ঝেঁপে বৃষ্টি নামতে পারে! আবার তার পরের ঘণ্টাতে আপনাকে সোয়েটারও খুঁজতে হতে পারে! সে জন্য ঘর থেকেই ইন্টারনেটে পরবর্তী সাত দিনের পূর্বাভাস দেখে, ঝকঝকে শীতের সকালেও ‘ছত্রপতি’ হয়ে রওনা দিয়েছিলাম। পর দিন সকালেই যে আমাদের আশঙ্কা সত্যি করে এমন ঝেঁপে বৃষ্টি আর সঙ্গে হাড় কাঁপানো হাওয়া বইবে কে জানত! কনকনে শীতে টুপি-গ্নাভস-জুতো-মোজা ভিজে একশা। তার মধ্যেই লোকাল বাসে চেপে পৌঁছলাম শহরের প্রাণকেন্দ্র ‘ডাউনটাউন’-এ।

স্ট্রিট কার
সান আন্তোনিওর পরিবহণ ব্যবস্থা দেখার মতো! কলেজ স্টেশন থেকে আমাদের ধারণা হয়েছিল আমেরিকার সর্বত্রই জন পরিবহণের হাল খারাপ। কিন্তু এই ছোট্ট সান আন্তোনিওতে দেখলাম বাস রুটের ছড়াছড়ি। রাস্তার ধারে ‘শেড’ দেওয়া নির্দিষ্ট স্টপেজে দেওয়া রয়েছে শহরের ম্যাপ। তাতে ওই বাস স্টপের অবস্থান পর্যন্ত চিহ্নিত আছে। বাসের মধ্যেই দেওয়া রয়েছে বিভিন্ন রুটের ছাপানো সময়সূচি, তাতেও রুট ম্যাপ আঁকা। এটা যদিও অনলাইনে পাওয়া যায়। বিশেষ বিশেষ গন্তব্যস্থল এলে রেকর্ড করা বার্তা শোনানো হয়, কিংবা চালক মাইক্রোফোনে ঘোষণা করেন। হুইলচেয়ার সমেত প্রতিবন্ধী যাত্রীকে ওঠানো নামানোর যান্ত্রিক ব্যবস্থাও রয়েছে। সব মিলিয়ে, যাত্রী সাধারণের জন্য এমন পরিপাটি আয়োজন দেখে কলকাতার এই হতভাগ্য নিত্যযাত্রীর চক্ষু চড়কগাছ!

শহরের দর্শনীয় স্থানগুলি ঘোরার জন্য আছে অনেক ব্যবস্থা। নিয়মিত বাস, ট্যাক্সি ছাড়াও আছে বিশেষ ট্রলি, ঘোড়ার গাড়ি আর ‘স্ট্রিট কার’, একে কি বিশেষ মিনিবাস বলা যেতে পারে? ব্লু, ইয়েলো আর রেড— এই তিনটি রুটে ‘ডাউনটাউন’-এর জায়গাগুলি ঘোরার পক্ষে আদর্শ। ভিতরে সুন্দর কাঠের বেঞ্চ, পুরনো ডিজাইনের আলো— বেশ একটা ‘ভিন্টেজ লুক’। তবে দেখতেই পুরনো। ড্রাইভারের পাশে রয়েছে কম্পিউটার টার্মিনাল। তাতে বাসটি নির্ধারিত সময়ের কত আগে বা পরে চলছে তার নিয়মিত হিসেব হয়ে যাচ্ছে।

আমরা প্রথম গেলাম অ্যালামো। টেক্সাসের স্বাধীনতা-ইতিহাসে স্থানটির বিশেষ মাহাত্ম্য আছে। একাধারে দুর্গ ও মিশন এই অ্যালামো বা ‘মিশন সান আন্তোনিও ডি ভ্যালেরো’। মেক্সিকান জেনারেল সান্তা অ্যানার পাঁচ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে দু’শোরও কম স্বাধীনতাপ্রেমী বীর মরণপণ সংগ্রাম করে প্রাণ দিয়েছিলেন এখানে। দিনটা ছিল ৬ই মার্চ, ১৮৩৬। এখনও প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ নানা দেশ থেকে এই পবিত্র সৌধটি দেখতে আসেন। মূল দুর্গটির অবশেষ রূপে গির্জাটি ছাড়া এখন আছে লম্বা ব্যারাক, ভাঙা দেওয়াল, বিভিন্ন কোণে সাজিয়ে রাখা অ্যালামো যুদ্ধে ব্যবহৃত অনেকগুলি কামান। অ্যালামোর গির্জা প্রাঙ্গনে তৈরি হয়েছে মিউজিয়াম। ফটো পোস্টকার্ড, চাবির রিং, টি-শার্ট, টুপি থেকে শুরু করে সে যুগের পিস্তলের মডেল পর্যন্ত দর্শনার্থীরা স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ কিনতে পারেন।

অ্যালামো মিউজিয়াম আর ডটার্স অব দ্য রিপাবলিক অব টেক্সাস (ডিআরটি) লাইব্রেরির দরজা ইতিহাসের গবেষণায় আগ্রহী জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। অ্যালামো যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও আছে প্রত্যেক শহিদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
অ্যালামোর গির্জা অ্যালামো যুদ্ধের নিদর্শন


অ্যালামোর ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার অপর পারে রয়েছে ‘গিনেস ওয়ার্লড রেকর্ডস মিউজিয়াম’ আর বিখ্যাত ‘রিপলিস হন্টেড অ্যাডভেঞ্চার’। প্রথমটিতে নানা দ্রষ্টব্য নিদর্শন ছাড়াও রয়েছে আধুনিক ‘টাচ স্ক্রিন’ কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য পরিবেশনের প্রচেষ্টা। প্রায় দশ হাজার বর্গ ফুট জায়গা জুড়ে ১৪টি থিম গ্যালারি নিয়ে তৈরি এই মিউজিয়াম। ‘রিপলিস হন্টেড অ্যাডভেঞ্চার’-এ আছে জীবন্ত অভিনেতা, লাইট, সাউন্ড আর স্পেশাল এফেক্টের সাহায্যে পিলে চমকানোর বন্দোবস্ত।

ছোটদের বিনোদনের রকমারি পসরাও রয়েছে সান আন্তোনিওতে। আছে চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, চিল্ড্রেন মিউজিয়াম, সি ওয়ার্লড আর ওয়াটার পার্ক ‘স্প্ল্যাশ টাউন’। আমাদের ঝটিকা সফরে এগুলোকে দুর্ভাগ্যক্রমে বাদ দিতে হলেও ‘টাওয়ার অব আমেরিকাস’-এ উঠে ৭৫০ ফুট উপর থেকে শহরটাকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। নীচে থেকে কাচের দেওয়ালযুক্ত লিফটে চড়ে উপরের ‘অবজারভেশন ডেক’ পৌঁছতে লাগে প্রায় দেড় মিনিট। লিফট ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড করা ধারাভাষ্য শুরু হয় শহরের বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলিকে উঁচু থেকে চিনিয়ে দিতে। উপরে অবজারভেশন ডেক-এ আছে অনেকগুলি টেলিস্কোপ। আছে সান আন্তোনিওর ৩৬০ ডিগ্রি প্যানারমিক ফটোগ্রাফ, বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন দশকের ঐতিহাসিক সাদাকালো ছবি। আর আছে টেক্সাসের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত ‘অডিও ট্যুর’। আগের দিনের বৃষ্টির পর শীতের দুপুরের মিঠে রোদ যেন বাড়িয়ে দিয়েছিল ছুটির আমেজ।

‘টাওয়ার অব আমেরিকাস’ দেখে আবার চেপে বসলাম স্ট্রিট কারে। এ বার গন্তব্য বিখ্যাত ‘রিভার ওয়াক’। বহিরাগত পর্যটক আর স্থানীয় মানুষজন— উভয়ের কাছেই এর আকর্ষণ অমোঘ। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদীর দু’ধার অতি সুন্দর ভাবে কংক্রিটে বাঁধিয়ে হাঁটাপথ তৈরি করা হয়েছে। আঁকে-বাঁকে বয়ে চলা ছোট্ট নদীটির দুই তীরে সার দিয়ে গড়ে উঠেছে অজস্র কাফে, রেস্তোরাঁ, বার। জলে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত চলছে মোটরবোটে করে পর্যটকদের নগর ভ্রমণের এলাহি আয়োজন। কাতারে কাতারে লোক লাইন দিয়েছে টিকিট কাউন্টারে। একের পর এক বোট ভর্তি হয়ে ভেসে পড়ছে জলে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের বিরাম নেই। লক্ষ আলোর মায়াবী রোশনাইতে ‘রিভার ওয়াক’ প্রতি সন্ধ্যায় যেন হয়ে ওঠে এক স্বপ্নের জগৎ। বাস্তবে ফিরে এলাম এক জন লোক পিছনে এসে আমাকেই কিছু বলছেন শুনে। ভাল বুঝতে না পেরে তার দিকে ঝুঁকতে তিনি বললেন, “ইউ হ্যাভ আ প্লেস টু ইট অ্যান্ড স্লিপ টুনাইট, লুক, আই হ্যাভ নাথিং। ক্যান ইউ হেল্প মি?” এও এক অভিজ্ঞতা বটে!
রিভার ওয়াক
রিভার সেন্টার মল


রিভার ওয়াক ধরে হেঁটে পৌঁছনো যায় ‘রিভার সেন্টার মল’ এ— বিশাল ঝাঁ চকচকে বহুতল বিপণি কেন্দ্র। এখানে দেখি নদীর ধারেই বেশ চওড়া একটা জায়গায় কিছু স্প্যানিশ গায়ক ‘টাইটানিক’ সিনেমার বিখ্যাত গানটি গেয়ে চলেছে। অনেক লোক ভিড় জমিয়েছে তা শোনার জন্য। গান শেষ হতেই হাততালির শব্দে মুখর চতুর্দিক। রিভার সেন্টারে এক জায়গায় এত দেশের রেস্তোরাঁ পাশাপাশি দেখে মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়। ইতালি, জার্মান, মেক্সিকো, তাই, চাইনিজ, জাপানি, ফরাসি, গ্রিক, লাতিন আমেরিকা— শুধু চোখে পড়ল না ভারতীয় রেস্তোরাঁ।

সে দুঃখ অবশ্য পর দিনই দূর হল। ইন্টারনেট ঘেঁটে ভারতীয় রেস্তোরাঁর সুলুকসন্ধান বের করা হল। আছে, তবে ডাউনটাউন থেকে কিছু দূরে। পর দিন দুপুরেই গৃহিনী-সহ হাজির হলাম ‘ইন্ডিয়া প্যালেস’-এ মধ্যাহ্নভোজ সারতে। অতঃপর? আমেরিকা আসার পর গত ছ’মাসে এই প্রথম পেট এবং প্রাণ ভরে দু’জনে একশো শতাংশ দেশীয় ভোজপর্ব সারলাম। মেনুর ডিটেলস না হয় উহ্যই থাক!

এক কথায়: সান আন্তোনিওর পরিবহণ ব্যবস্থায় যাত্রী সাধারণের জন্য এমন
পরিপাটি আয়োজন দেখে কলকাতার এক হতভাগ্য নিত্যযাত্রীর চক্ষু চড়কগাছ!
 
টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি-তে যোগ দেওয়ার আগে যাদবপুর ও খড়্গপুর আইআইটি থেকে যথাক্রমে বিই ও এমটেক করা। আছে বেশ কয়েক বছরের ‘সফটওয়্যার’-এর কাজের অভিজ্ঞতা। নেশা ফটোগ্রাফি ও খুচরো লেখালিখি।
ছবি: লেখক

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ