আপনার কলমে


হারিয়ে যাওয়া ছোট্টবেলার একটা মস্ত বড়দিন
শুভশ্রী নন্দী
(আটলান্টা)
বাঙালির কাছে শীতের নির্দিষ্ট কিছু অনুষঙ্গ আছে। শীত মানে তাদের কাছে, কুরুশকাঁটা বা নয়-দশ নম্বর উলের কাঁটায় ব্যস্ত হওয়া আঙুল, বইমেলা, পিঠেপুলি, পকোড়া বা কড়াইশুঁটির কচুরির সঙ্গে গরম কফি, মেলায় হস্ত বা চর্মশিল্পের ঝাঁপি, চড়ুইভাতি ও চিড়িয়াখানায় হানা দেওয়া ইত্যাদি। তবে শীতের সন্ধেগুলো কেমন যেন গোমড়ামুখো আর দিনগুলো তার দৈর্ঘ্য কমিয়ে হঠাত্ই খাটো হয়ে যায়, মনে হয়! ক্যালেন্ডারে ডিসেম্বর মাসের চার ভাগের তিন ভাগ পেরোলেই একটা উত্সবের আমেজ আসে, যার চরিত্র ও প্রকৃতি অন্য সব পার্বণের চেয়ে আলাদা। দেশে থাকতে বড়দিন মানেই ছিল, কেকে একটু কামড়, মোম জ্বালানো গির্জাগুলোয় যিশু-দর্শন আর খ্রিস্টান বন্ধুদের বাড়িতে ক্যারল গেয়ে উদযাপনের শরিক হওয়া। আরও ছোটবেলায় মনে পড়ে ট্রাক বোঝাই হয়ে লাউড স্পিকারে ছড়িয়ে পড়া রবীন্দ্র-গান— একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে।

হাওয়াইয়ান পোশাকে স্নো ম্যান দম্পতি

রোভানিয়েমি শহরে সান্তার হেডকোয়ার্টারে
ক্রিসমাসের হাত ধরেই গোয়াতে অন্ধকারের ঢেউ ঝাপটানো সমুদ্রতটের ‘স্যাকে’ বাঁশির মতো সুরে ক্যারল শুনিয়েছিল কয়েকটি কোঙ্কনি বালক। সে সুরের দাগ আজও মনে তরতাজা। আমার বড়দিন কেটেছে, কখনও দেশে, কখনও এই মার্কিন দেশে, আবার কখনও বা উত্তরমেরুর কাছের আপাদমস্তক বরফমোড়া দেশ ফিনল্যান্ডে। এ যেন অনেকটা সেই ভূতের রাজার বর পাওয়ার মতো ব্যাপার! ফিনল্যান্ডে অনেক ফিনিস বন্ধু পেয়েছিলাম। ওই বন্ধুদের সঙ্গে পারিবারিক যোগাযোগের কারণেই জানতে পেরেছিলাম, ওদের জীবনচর্চায় সবচেয়ে বড় উত্সবের নাম ‘ক্রিসমাস’। আরে! এ যে ঠিক আমাদের দুর্গাপুজোর

ফ্রসটি— দ্য স্নো ম্যান
মতোই— ঘরদোর সাফাই করা, নতুন জামাকাপড় কেনা, তিন-চার দিন আগে থেকে ‘রিসি পিরাক্কা’ বানানোর ধুম পড়ে যাওয়া, যেমন আমরা নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু করে রাখি, তেমনই। আর যতই উত্সব হাতের নাগালে আসে, ততই মানুষ আরও পারিবারিক, আরও স্বভাব-শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে। ফিনল্যান্ডে আমরা ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’-এর সাক্ষী থেকেছি পাঁচ বছর। সেখানে উত্সবের সঙ্গে ‘হরিহর একাত্মা’ হয়ে জুড়ে ছিল ‘ফ্রসটি— দ্য স্নো ম্যান’ এবং ‘স্নো এঞ্জেল’ বানানোর তোড়জোড়। বাড়ির সামনে সমুদ্র সৈকতের বালির মতো ছড়ানো বরফ কুচি থেকে তিনখানা বল গড়িয়ে একের পর এক বসিয়ে— ডালপালা দিয়ে তৈরি হাত, গাজর দিয়ে নাক, বোতাম দিয়ে চোখ, আর গলায় রং বেরঙের মাফলার, মাথায় টুপি পরে বাড়ির সামনের সাদা উঠোনগুলোতে বেশ দেখনদার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ফ্রসটি, পাহারাদারের মতো। আর সেই বরফের মধ্যে হুড-সহ জ্যাকেট মোড়ানো বাচ্চারা লম্বা হয়ে শুয়ে হাত দু’টিকে মাথা থেকে পা অবধি ছড়িয়ে বরফ সরিয়ে নিয়ে নিজেদের ছাপ দিয়ে গড়ে তোলে ‘স্নো এঞ্জেল’।

এ ভাবেই এক বার ক্রিসমাসে পৌঁছে গেলাম সান্তার হেডকোয়ার্টার বলে পরিচিত রোভানিয়েমি শহরে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, পায়ের তলায় ‘সুমেরু বৃত্ত’, আর আমি সেই বৃত্তে বন্দি! ভারতীয় জেনে ফিনিস সান্তা আমাদের ‘নমস্তে’ শব্দে স্বাগত জানালেন। অতলান্তিক পেরিয়ে যখন আমেরিকায় পা দিলাম, তত দিনে ফিনিস বাচ্চাদের ‘পিয়েত্রি’ এখানে ‘রুডল্ফ— দ্য রেড নোস রেইন ডিয়ার’ হয়ে গিয়েছে। স্কুলের বাচ্চারা প্রায় সারা মাস জুড়ে উত্সব বিষয়ক প্রজেক্ট করে চলেছে— কখনও তারা বানাচ্ছে
কুকি, কখনও বা এমএনএম দিয়ে সাজানো ‘জিনজার ব্রেড হাউস’। ব্যস্ত সান্তা যখন বাড়ির চিমনি দিয়ে নেমে এসে বাচ্চাদের উপহার দিতে হিমশিম, সে দিন বেচারি মিসেস ক্লস-এর কী করে কাটে, তাও জানিয়ে দেয় বাচ্চাদের বই। জার্মান ঐতিহ্য বজায় রেখে পঁচিশ তারিখে পৌঁছনোর জন্য কাউন্ট ডাউন করে সকলে একটা একটা করে দিন সরায় ‘অ্যাডভেন্ট ক্যালেন্ডার’ থেকে। বেসমেন্টের বাক্সবন্দি প্লাস্টিকের ‘ক্রিসমাস ট্রি’ তদ্দিনে জুড়ে গিয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ফায়ার প্লেসের পাশে। আর সেই গাছের গায়ে কত না অলংকার ঝোলানো! পা থেকে মাথা পর্যন্ত টুনিবাল্বের আলোর বৃত্তে কয়েক পাকে বাঁধা সেই গাছ। পায়ের কাছে অপেক্ষারত চকচকে রঙিন কাগজে মোড়ানো উপহার, যার মধ্যে লুকানো রয়েছে ছোট ছোট মুখগুলোর অসীম প্রত্যাশা আর অশেষ আনন্দের ভাণ্ডার। ক্রিসমাস ইভ-এ ‘ওয়ারশিপ সার্ভিস’-এর জন্য চার্চগুলোতে সমবেত ক্যারল হয়। আর

ক্যারল গাইছেন ফিনিশ প্রতিবেশী
ক্রিসমাসের দিন পারিবারিক উদযাপন। রাস্তা সে দিন আলোর জলসা বুকে নিয়ে শুনশান, একা। শুধু মাঝে মধ্যে উচ্চকণ্ঠের ‘হো হো হো’ হাসিতে আচমকা সান্তার প্রবেশ বাড়িগুলোতে ও বাচ্চাদের সঙ্গে হাত মেলানো। ইতিমধ্যে তাঁর ‘চর’ এল্ফ-এর সূত্রে বাচ্চাদের চাহিদা নিয়ে ওয়াকিবহাল সান্তা।

আমেরিকায় এসেই জানলাম, সারা ডিসেম্বর মাস জুড়ে এখানে উত্সবের মালা। শুধু ক্রিসমাস বলেই নয়, ক্রিসমাসের গা ঘেঁষেই ২৪ ডিসেম্বর ইহুদিদের আটটি মোমের ‘মেনরা’ দিয়ে আট দিনের আলোর উত্সব ‘হানুক্কা’। ইহুদি বাচ্চারা খেলায় মেতে ওঠে লাটিমের মতো ‘ড্রেইডেল’ নিয়ে। আর ২৬ ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের ঠিক পরের দিন থেকে অ্যাফ্রো-আমেরিকান ও অ্যাফ্রো-কানাডিয়ানদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সপ্তাহ জোড়া ‘কোয়ানজা’ উত্সব পালন।

ক্রিসমাসের এ কাল সে কাল নিয়ে কথা হচ্ছিল সহকর্মী হ্যানার সঙ্গে। হ্যানার আক্ষেপ, “ক্রিসমাস ইজ অল অ্যাবাউট গিভিং।” কিন্তু আজকাল বিজ্ঞাপনের প্রলোভন, দোকানগুলোর ব্যবসায়িক মানসিকতা বাচ্চাদের চাওয়ার খিদেটাকে শুধু বাড়িয়েই চলেছে। সত্যিই তো! দোকান জুড়ে ‘ছাড়’ নামের টোপের ফাঁদে কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ছে সকলে। এমনকী অর্ডার করলে সান্তার অফিস থেকে চিঠিও মেলে বাচ্চাদের। হ্যানার সঙ্গে সহমত হলেও জিঙ্গল বেলের সুরে আমরাও ভেসে যাই সকলের সঙ্গে।

জিনজার ব্রেড হাউস

খাবার টেবিলেও ক্রিসমাসের ছোঁয়া
ভাইকিং উপকথা অনুযায়ী ‘মিসেলটো’ পাতার তলায় কেউ দাঁড়ালে তাকে চুম্বন করে একটি ‘বেরি’ তুলে নেওয়া রীতি। ক্রিসমাসকে আশ্রয় করে বেরি সমেত মিসেলটো পাতা যেমন ঝুলে থাকে মার্কিনিদের দরজার মাথায়, গণ টোকাটুকির মতো করে আমরাও দরজায় ঝুলিয়ে রাখি মিসেলটো! তফাত্ এই, বেরিগুলো শুধু তোলার লোক না পেয়ে মুখ শুকিয়ে ঝরতে থাকে ওখানেই। কখন যেন অজান্তেই, ঘর সাজানোর মেজাজের সঙ্গে সারা বছরের রুচির সঙ্গে আপোস করে, বেমানান হলেও, টেবল সাজিয়ে ফেলি ক্যাটক্যাটে সবুজ ম্যাট, লাল বা সোনালি রঙের থালা দিয়ে! কোস্টারের উপর ধোঁয়া ওঠা খাবারের আশেপাশে গম্ভীর ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে প্রতি ক্রিসমাসে সংগ্রহ করা সান্তা, পেঙ্গুইন, স্নো ম্যান আকারের চিনামাটির বাসনগুলো। বাচ্চাদের উত্তেজনায় বাড়িতে কুকি বানিয়ে আভেন পালন করে ক্রিসমাসের ‘বেকিং ট্র্যাডিশন’। গাড়িতে বাংলা গানের সিডির সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে শুনছি কখনও ‘উই উইস ইউ এ মেরি ক্রিসমাস...’ কখনও বা তার স্পেনীয় তর্জমা ‘ফেলিস নেভিদা’। বছর শেষের দীর্ঘ শ্বাসের সঙ্গে কেমন করে যেন মিশে যায় নতুন বছর বরণের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা!

সান্তা, স্লে, রুডল্ফ, ক্যান্ডেল নাইট ডিনার, দোকানগুলোতে নানা মাপের নাটক্র্যাকার, টবে বসানো টকটকে লাল-সবুজ পয়েনসেটিয়া গাছ, ক্যারল, চকোলেট ভর্তি লাল-সবুজ মোজা, সবুজ পাইন পাতার বৃত্তে লাল ফিতে বাঁধা রিথ, মালায় মোড়ানো ফায়ারপ্লেস-সিঁড়ি, আলোর তারা, ক্যান্ডি, গৃহহারাদের জন্য খাবার ও খেলনা দেওয়া— সব মিলিয়ে ছোটবেলার বড়দিনের চেহারা পাল্টে কখন যেন হয়ে উঠেছে ‘ক্রিসমাস’। নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়েছি এর বাঁধনেও, দুর্গাপুজোর মতোই। যদিও এ বাঁধনের মূল উদ্যোক্তা বাড়ির কচিকাঁচারা। যিশু মানেই তো নির্মল অস্তিত্ব, এক বুক সারল্য। মেয়ের অনাবিল আনন্দের সঙ্গে ক্রিসমাসের পঁচিশ আমার কাছে কখন যেন হয়ে ওঠে হারিয়ে যাওয়া ছোট্টবেলার একটা মস্ত বড়দিন।

ক্রিসমাসে প্রিয় ফুল পোনসেটিয়া

জন্মভূমি অসম, কর্মভূমি আটলান্টা। পেশা শিক্ষকতা— শুরু হয়েছিল কলকাতা ও আমেরিকার কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে, এখন কচিকাঁচাদের পড়িয়েই সময় কাটে। হাত নিশপিশ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসতে না পারলে, শখটাই তো কাগজের গায়ে কলমের ফুলঝুরি ছড়ানো। নিজস্ব ভাবনাকে মঞ্চে তুলে ধরাও আর এক নেশা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সূত্রে দর্শকদের সঙ্গে আলাপচারিতা।

ছবি: লেখক

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ