আপনার কলমে


অচেনা অরণ্য অচানকমার
শৈবাল দাস
(কলকাতা)
বিলাসপুর স্টেশনের বাইরে তখনও আসিনি, পকেটে মোবাইলটা কাঁপতে শুরু করল। ফোন ধরতেই ও পারে আর্থার ট্র্যাভেলস-এর মহিলাকণ্ঠী, ‘মিস্টার দাস, আপলোগ কাঁহা পর হ্যায়?’ জানালাম, স্টেশনে এই মাত্র পৌঁছেছি। হিন্দিভাষীর গলা, ‘ঠিক আছে, দশ মিনিটের মধ্যে একটা লালরঙা সুমো পাঠাচ্ছি। গাড়ির নম্বর...’। আরে! নম্বর পরে হবে। অচানকমারের জঙ্গলের কোর এরিয়ায় ঘুরব লালরঙের গাড়ি নিয়ে? তার পর বাইসনের দল গুঁতিয়ে গাড়ি সুদ্ধ হাফিস করে দিক আর কী! তা ছাড়া, সেটা না হলেও রঙিন গাড়ি নিয়ে জঙ্গলের গহনে প্রবেশ করে পরিবেশ নষ্ট করার কোনও অধিকার আমার নেই। অন্য গাড়ি পাঠানোর অনুরোধ জানালাম। উত্তর এল, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে আপনারা চা-নাস্তা করুন, আমি অন্য ব্যবস্থা করছি।’

হাওড়া থেকে গত রাতে মুম্বই মেলে উঠেছি। খেয়েছি অনেক তাড়াতাড়ি, এখন প্রায় সকাল আটটা। খিদে পেয়েছে। নাস্তা করতে করতে দেখছিলাম স্টেশনের স্থাপত্য। খুব সুন্দর। বিলাসপুর ছত্তীসগঢ়ে, আর এই বিলাসপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত অচানকমার অভয়ারণ্য এখনও বহু পর্যটকের কাছে অচেনা-অদেখা।

স্টেশন চত্বর প্রায় খালি হয়ে গেল। চা-জলখাবারে পেট ভর্তি হল, কিন্তু গাড়ির দেখা নেই। ফোন করব বলে ঠিক করেছি, চলন্ত একটি গাড়ি থেকে এক যুবক আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেই, গাড়ি ঘুরিয়ে পজিশন নিল। মালপত্র গাড়িতে তোলার আগে জেনে নিলাম গাড়িতে অতিরিক্ত টায়ার মজুত আছে কি না। ড্রাইভার ‘হ্যাঁ’ বলাতে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। দু’রাত, তিন দিনের সফর। ঝুঁকি না নেওয়াই ভাল।
বিলাসপুর স্টেশন থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে অচানকমারের জঙ্গলমহলের প্রথম গেট। সেখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ‘ছাপোরয়া বনবাংলো’, এখন যদিও ‘ভূতবাংলো’ নামেই পরিচিত। বাংলোর পেছনে নতুন তৈরি হওয়া জঙ্গলঘেরা সরাইগুড়িতে ‘টাইগার রিসর্ট’-এ আমাদের বুকিং ছিল। অচানকমার স্যাংচুয়ারির অফিসার ইন-চার্জ রাঠৌর সাহেব আগাম জানিয়েছিলেন, যা খাবেন সব নিয়ে আসবেন। রসুইকর আছে, বানিয়ে দেবে।

ড্রাইভার কানাইহার সঙ্গে আলাপ হল। বছর ২২/২৩-এর ছটফটে যুবক বললেন, “কোটা-কেওকি রোডে বিলাসপুর থেকে অমরকণ্টক বহু বার যাতায়াত করেছি ট্যুরিস্ট নিয়ে, জঙ্গলকে দু’পাশে রেখে। কিন্তু, জঙ্গলের ভিতর থাকব বা ঘুরব এই প্রথম।” যাই হোক, ঝাঁ চকচকে রাস্তায় গাড়ির গতি বাড়তে থাকল। পথে এক বার দাঁড়াতে হল খাবার, মুরগি ইত্যাদির জন্য। পথের দু’পাশে জঙ্গল চিরে পিচ ঢালা মসৃণ পথ। ছত্তীসগঢ়ের সম্পদ এই বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমির মধ্যে ছড়িয়ে আছে ২২টির মতো বনবস্তি। বৈগ ও গেন্দ উপজাতি অধ্যুষিত ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার এই অরণ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করছে চারশোর মতো বাইসন বা ইন্ডিয়ান গাউর, অজস্র হরিণ, ভালুক, বাঘ ও লেপার্ড। বিভিন্ন পাখির স্বপ্নরাজ্য এই জঙ্গল। ‘মেকল’ পর্বতশ্রেণির কোলে এই অভয়ারণ্যে নাকি খান তিরিশেক বাঘ আছে। জানি না একই বাঘকে দু’বার গোনা হয়েছে কিনা! সরিস্কায় তো সে রকমই হয়েছিল শুনেছিলাম। তবে জঙ্গলে বাঘ অবশ্যই আছে, তার প্রমাণ পরে পেয়েছি। লেপার্ড-এর সংখ্যা বাঘের চেয়ে বেশি।

শাল, সেগুন, গামার, কুসুম-এর আকাশছোঁয়া অহঙ্কার দেখতে দেখতে কখন যে বনবাংলোর সামনে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। ড্রাইভার হর্ন বাজাতেই চেকপোস্টের সামনে রক্ষী উপস্থিত। কাগজপত্র দেখে নিয়ে পোস্ট তুলে নিল। বিশালকায় ছবির মতো বাংলোর সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই শিস দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক হলুদ বুলবুলি আর বৌ কথা কও পাখি। ছোট্ট ছানাকে বুকে চেপে নিয়ে হনুমানটা যে ভাবে গাছে উঠে আমাদের ভ্যাংচাতে লাগল, বুঝলাম এই বহিরাগতদের ওর একদম পছন্দ নয়। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হতেই নিস্তব্ধ দুপুরে ভল্লুকের ডাকটা বেশ সুন্দর লাগছিল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই চৌকিদার উপস্থিত। এসেই যা বলল, তা শুনে আমাদের তো আক্কেল গুড়ুম। রিসর্টে আমাদের বুকিং ছিল ঠিকই, কিন্তু নির্মীয়মাণ এই কটেজের কিছু কাজ এখনও বাকি। ঘরগুলো চালু হতে আরও দিন কয়েক লাগবে। তা হলে? “কোনও অসুবিধা হবে না। আমি ফোন করে সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিয়েছি। এই ছাপোরয়া বাংলোতেই থাকবেন।” নিশ্চিন্ত হলাম। ঝকঝকে বনবাংলোটিতে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। দু’খানা বিশাল ঘর, সঙ্গে তার চেয়েও বড় মার্বেল ফিটিংস বাথরুম, ডাইনিং রুম নিয়ে এলাহি ব্যবস্থা। কিন্তু ঘরে ঢুকতে গিয়েই ফের বাধা। একটা ঘরে বিছানার উপর খাকি উর্দি পড়ে আছে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা আছে তির, ধনুক, বল্লম, টাঙ্গি। দেখে বোঝাই যাচ্ছে আদিবাসীরা যেমন ব্যবহার করে ঠিক সে রকম দেশজ অস্ত্রশস্ত্র। ব্যাপার কী! ঘর থেকে বেরোতে যাব, দেখি পেছনে চৌকিদার সন্তরাম যাদব ফিক ফিক করে হাসছে। কী ব্যাপার সন্তরাম? ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী আছে জানতাম, তুমি কি তাদের অস্ত্রাগারে ঢুকিয়ে দিলে নাকি? রসিক লোক চৌকিদার, এক গাল হেসে বলল, ‘ঘাবড়াও মাত সাহেব!’ সেই দিন সকালে ডিএফও সাহেব এসেছেন সার্চে। দিন কয়েক আগে কুম্ভিপানিতে তেন্ডুয়া (লেপার্ড) পোচিং হয়েছে, ধরা পড়েছে এই সব অস্ত্র আর চোরাশিকারির সাথিরা। আজ রাতটা একটু কষ্ট করে সবাইকে পাশের ঘরে থাকতে হবে। পর দিন অফিসাররা সব চলে গেলে, ভূতবাংলোর সব ঘরই আমাদের। ভূত বাংলো নাম কেন, জিজ্ঞেস করলাম সন্তরামকে। ‘ও আপনাকে লাগোরাম রসুইকর জানাবে, বহুত পুরানা আদমি, এই জঙ্গলের অনেক কিছু খবর রাখে’ বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল চৌকিদার তার ডিউটিতে।

এ বার অরণ্যভ্রমণে শুরুতেই কেমন সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যা প্রায় অযাচিত।
পাখির মেলা...
ইন্ডিয়ান রোলার গ্রিন বি-ইটার সারপেন্টাইন ঈগল
গাড়ির মাথা থেকে খাদ্যসামগ্রী নামিয়ে আদিত্য আর বিশ্বজিৎ নিয়ে যায় বাংলোর পেছনের রান্নাঘরে। রান্নাঘর প্রায় মিনিট দুয়েকের রাস্তা। দুপুরে সব্জি-ভাত আর রাতে মুরগির অর্ডার দিয়ে ফেরার পথে রাঁধুনি লাগোরাম আলাপ করিয়ে দেয় ফরেস্ট গাইড তিহারির সঙ্গে— জাতে বৈগ, স্থানীয় আদিবাসী। তিহারি জঙ্গলকে চেনে হাতের তালুর মতো। গাছগাছালি, জীবজন্তুর উপর অগাধ জ্ঞান। ‘আপনারা নিজের গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে ঘুরবেন, নাকি বন দফতরের হুডখোলা জিপসি নেবেন? একটা গাড়িতে ছ’জনের অনুমতি।’ আমরা দশ জন। ‘তা হলে আপনাদের গাড়ি নিন, আমি পারমিশন করে রাখছি’, বলল তিহারি। দশ টাকা মাথা পিছু। গাড়ির জন্য প্রবেশ মূল্য একশো টাকা। বিকেল ৪টে থেকে ৬টা। ৬টার পর বেরোতেই হবে অরণ্য থেকে। এটাই নিয়ম। মনটা দমে গেল। সন্ধের মুখে চলে আসতে হবে। চতুর্দশীর চাঁদ যখন সবে উঁকি দেবে তখনই তো জঙ্গল কথা বলে। দেখা যাক কী হয়। সন্ধ্যার জঙ্গল কী উপহার দেয়।

দুপুরের খাওয়া সেরে সবে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি একটা ঘরে। নিঃশব্দ জঙ্গল হঠাতই গাড়ির আওয়াজ আর মানুষের কোলাহলে ভরে গেল। কৌতূহলে বাংলোর বারান্দায় বেরিয়ে দেখি প্রিজনভ্যান, গাড়ি আর জিপের মিছিল। প্রায় জনা দশেক উর্দিপরা অস্ত্রধারী গাড়ি থেকে নেমে আসছে। বেলা প্রায় তিনটে। বারান্দায় চেয়ার লেগে গেল, আমরা ঘরে ঢুকে গেলাম। মনে চাপা অস্বস্তি। দশ মিনিটের মধ্যেই চৌকিদার এসে বলল ডিএফও সাহেব আপনাকে ডাকছেন। আমাকে কেন? একটু অবাক হলাম। যাক ভালই হল, আলাপ হয়ে যাবে। ‘নমস্তে, কলকাতা থেকে আসছেন’? প্রতি-উত্তরে নমস্কার জানিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চোস্ত হিন্দিতে বললেন, ‘ঘরটা দখল করে নিয়েছি, কষ্ট হল তো?’ কী বলব বুঝলাম না। একজন আইএফএস এতটা বিনয়ী। মিনিট পনেরো আড্ডায় জমে গেলাম। জঙ্গল ভালবাসি, লেখালেখি করি শুনে খুব খুশি হলেন। জানলাম অচানকমারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ওঁদের নানান চেষ্টার কথা। চোরাগোপ্তা শিকার বা পোচারদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই লড়তে হয়। বছরখানেক বাদে তেন্ডুয়া শিকারের এই ঘটনার জন্য এই ছোটাছুটি, এত ব্যস্ততা। তবে ধরা পড়েছে চোরাশিকারির সঙ্গীসাথিরা, এটাই বড় ব্যাপার। লেগে থাকলে মূল চক্রীরাও পার পাবে না। ছেলেবেলায় চোর ধরা পড়েছে শুনলে খুব দেখতে ইচ্ছে করত। গিয়ে দেখতাম আর হতাশ হতাম। এ তো আমাদের মতোই দেখতে। আজ প্রিজন ভ্যানে বন্দি চোরাশিকারিদের দেখেও হতাশ হলাম। রুক্ষ মুখ, ক্ষয়াটে খড়ি-ফাটা হতদরিদ্র চেহারা, পরনের ধুতিটাও ফুটিফাটা। এদের দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে পেছন থেকে ধনী এক মাফিয়া চক্র, যা চিরকাল হয়ে আসছে। ডিএফও সাহেব চলে যাচ্ছেন, সৌজন্যতার খাতিরে গাড়ি অবধি গেলাম। কথা প্রসঙ্গে আর্জি জানালাম আজ সন্ধ্যার জঙ্গল ভ্রমণের সময়টা একটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। অনুমতি দিলেন, চৌকিদার আর গাইডকে ডেকে বলেও দিলেন। গাড়িতে বসার আগে বললেন, জঙ্গলকে ভালবাসলে সে কখনও আশাহত করে না।
ইন্ডিয়ান বাইসন ওয়াটার হোলে চিতলের দল
জলদা রোড বেরিয়ারের গেট খুলতেই গাড়ি যখন কোর এরিয়ায় প্রবেশ করল তখনই বিকাল প্রায় পাঁচটা। গাইড বলল সোজা যাব ‘দররাপানি’। এই সময়টা বাইসনের দল এসে জড়ো হয়। মাঝিডংরিতে চলে যায় ঝরনার জল খেতে। জঙ্গলের কাঁচা বনপথ ধরে আধঘণ্টা চলার পর হঠাৎ ড্রাইভার খ্যাচাং করে ব্রেক কষল। কী হল? রাস্তার পাশেই জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড এক গাউর বা ইন্ডিয়ান বাইসন। মদ্দা দলপতি আপনমনে পাতা চিবিয়ে চলেছে। কিছুটা দূরেই তার দলের অন্য সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সূর্যাস্তের রোদে নিকষ কালো পেশিবহুল শরীরে যেন যৌবনের ঝিলিক। পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত সাদা রঙের অপূর্ব সৃষ্টি। যেন সাদা মোজা পরে আছে। ড্রাইভারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বুঝলাম অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তার এই ব্যাপারটা একদম নতুন। গাড়ি স্টার্ট দিতেই দূরের দলটা হুড়মুড়িয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। মদ্দাটা কোনও ভ্রূক্ষেপ না করে পাতা চিবোতেই থাকল। আমরা এগিয়ে চললাম ধীরে ধীরে। সামনে চড়াই রাস্তা, বোল্ডার-নুড়ি পাথরের পথ। পথ কোথায়? এ তো বর্ষার জলে নেমে আসা ধারাপথ শুকিয়ে এক বনপথ। এই পথেই যেতে হবে মাঝিডংরি। অনভিজ্ঞ জঙ্গলে ড্রাইভার যেন ঠিক মাঝদরিয়ায়। শুকনো মুখে বলে, “স্যর এই পথে মারুতি জিপসি ছাড়া অন্য গাড়ি ওঠা বেজায় ঝামেলা। ফেঁসে গেলে সবার বারোটা বেজে যাবে।” গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম সবাই। গাইড জানান দিল চলুন দলবেঁধে সব হেঁটে যাই, গাড়ি এখানেই থাকুক। জঙ্গল পথে হুল্লোড় করতে করতে চড়াই ভাঙতে থাকলাম। অসহায় ড্রাইভার জঙ্গলপাগলদের পাল্লায় পড়ে সঙ্গ নিল। মাঝিডংরির জঙ্গল টিলায় সূর্যটা লাল-সেগুনের ফাঁক দিয়ে যেন সোনা রং উগরে দিচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়েল, কমন টিস, ময়ূর, মদনটাকের স্বরে ভরে আছে সারা বন। শেষ শীতের এই সময় থেকে সারা অচানকমারে জলের সমস্যা শুরু হয়। গ্রীষ্মের শুরুতেই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মাঝিডংরির ঝরনা তাই শুকিয়ে গিয়েছে, সামনে জমে থাকা ওয়াটার হোলে জড়ো হয়েছে গাউর, চিতলের দল। লেপার্ড এসে পড়ে যখন তখন। বাঘের আগমন এখানে কদাচিৎ ঘটে। সূর্যটা ডুবে গেছে কিছু ক্ষণ আগেই। আকাশের গায়ে লাল ছিটে লেগে আছে এখনও, সেটাও মুছে যাবে। জঙ্গলে ঝিঁঝিঁ পোকারা পাঁচালি পড়তে শুরু করেছে সমবেত ভাবে। গুনগুন আওয়াজ আর বনজ পাতার গন্ধে যেন সন্ধ্যার আরতি হচ্ছে অরণ্যের সংসারে। তন্ময় হয়ে উপভোগ করছিলাম প্রকৃতির লীলাখেলা।

সেগুনের ফাঁকে সোনা রং
‘চলুন ওঠা যাক। এই সময়টায় মহুয়ার গন্ধে ভালুক বেড়িয়ে পড়ে।’ তিহারির কথায় সম্বিৎ ফিরল। এই একটা প্রাণী বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ করতে পারে যখন তখন। পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে নেমে আসছি। জুতোর ভিতর কাঁকড় ঢুকে গিয়েছে। একটু দাঁড়িয়ে পড়ি, ঠিক করে নেওয়ার জন্য। সঙ্গীরা সামান্য এগিয়ে। চাঁদনি রাতে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল কে যেন জল ছিটিয়ে দিচ্ছে ওপর থেকে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটু সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। আকাশের দিকে তাকাই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে। মেঘহীন ঝকঝকে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামে কী ভাবে। মনের ভুল নয়তো? না। একাধিকবার হতে থাকল। হাল্কা আওয়াজে সঙ্গীদের দাঁড়াতে বলি। গাইড এসেই রহস্যের সমাধান করে দেয়। দাঁড়িয়ে ছিলাম এক বিরাট শালগাছের নীচে। শালগাছের পাতার ঝাঁকে ঝাড়বাতি রূপ, যার নাম ‘ঝুমরি’। সারা দিনের ধরা জলের ধারা বয় সাঁঝে। সালোক সংশ্লেষের ফলাফল। সেলাম প্রকৃতি! জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে যখন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছি তখন প্রায় আটটা। ভাগ্যিস বাড়তি সময়ের অনুমতি পেয়েছিলাম। বিনা প্রশ্নে জঙ্গলরক্ষী চেকপোস্ট তুলে নিল। গাড়ি সটান বাংলোর গেটে। গাইডকে ছেড়ে দিলাম। শুধু জানালাম কাল খুব ভোরে বেরোব, যাব অন্য প্রান্তে। কারিয়াবোদারের গহন পথে। যেখানে বড়ে মিঞার আগমন ঘটে। লামোরামের তৈরি রুটি ও মুরগির ঝোলে রাতের খাবারটা বেশ জমে গেল। ডাইনিং টেবিলে ভূতবাংলোর গল্পর প্রসঙ্গ আবার উঠল। ‘আজ আপনারা সবাই ক্লান্ত, শুয়ে পড়ুন কাল বলব’, বলে চলে গেল লামোরাম। তথাস্তু বলে যে যার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। মাথার উপর দিয়ে সশব্দে হুতোমের দল উড়ে গেল জঙ্গলকে চমকে দিয়ে।

পরের দিন ঠিক ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙল ময়ূরের ডাকে। বাংলোর বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই দেখি দু’টো হরিণ কুসুম গাছটার ফাঁক দিয়ে আমায় দেখছে, কয়েকটা কালো ঝুঁটি হলুদ বুলবুল আর প্রোটিনকোল বা শামুকখোল পাখি নেচে বেড়াচ্ছে সামনের লনে। মনটা আনন্দে ভরে গেল। একরাশ তৃপ্তি পাওয়া এই ভোরের জন্য সবুজ জঙ্গলে ছুটে আসা। জীববৈচিত্রের এই সান্নিধ্য কংক্রিটের জঙ্গলে তো মেলে না!

বাংলোর বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম গাইড তিহারি চলে আসছে। ড্রাইভার-সহ সঙ্গীরা তৈরি হয়ে নিল। মৈকুমঠে চা খেয়ে নেওয়া যাবে, এখন বেরিয়ে পড়ি। এই ভোরেই হয়তো সাক্ষাৎ হয়ে যেতে পারে বাঘ বা লেপার্ডের। গাড়ি ঢুকে পড়েছে গহনে। ছোট পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই ভেঙে এগিয়ে চলেছে শুনশান অরণ্যর জিপ-চলা পথ ধরে। সারা অচানকমারের জঙ্গলে প্রচুর বাঁশগাছ বা বাঁশঝাড় আছে। বাঁশবনের বাড়বাড়ন্তে এই জঙ্গল এক বনজ সম্পদ। এখানকার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ বাঁশ যায় বিলাসপুর জেলার সর্বত্র। এক কথায় বলা যায় এই জঙ্গলের বড় আয় শুধু বাঁশ বিক্রি করেই। জমে থাকা জলের কুণ্ডের ধারে জড়ো হওয়া বড় এক হরিণ পরিবার চকিতে পালিয়ে গেল গাড়ির আওয়াজে। দূরে পাহাড়ের ঢালে একদল গাউর চরে বেড়াচ্ছে। পাতা খসার দিনে জঙ্গলে এক অন্য অনুভূতি। একটা বিরাট পাকুড় গাছের নীচে গাড়ি দাঁড়াল। গাইড সোজা গাড়ি থেকে নেমে এসে গাছের উপর দিকে তাকিয়ে রইল। এই গাছেই এক লেপার্ড হরিণ মেরে জমিয়ে পিকনিক করেছিল। এই ধরনের ‘কিলিং’ বা শিকার দেখতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কানহা অরণ্যে দেখেছিলাম।

বেলা বাড়ছে। পেটে দানাপানি পড়েনি। প্রকৃতিকে দু’চোখ ভরে গিলছিলাম। টাটিধার-এর বনপথ, পাহাড়ি ঝোরা পেরিয়ে গাড়ি হাইরোডে পড়ল। এই জঙ্গলে হাতি নেই। তবে একটা কথা পরিষ্কার, গাইড বা স্থানীয় লোক ছাড়া জঙ্গলে ঢুকলে অরণ্যপথে হারিয়ে যাওয়ার একশো ভাগ সম্ভাবনা। লামনি চেকপোস্টের কাছে চায়ের দোকানে দাঁড়াতেই হল শরীরে রসদ ভরে নেওয়ার জন্য। এখান থেকেই অচানকমারের রাস্তা নামনি চেকপোস্ট পেরিয়ে সোজা পাহাড় ডিঙিয়ে, এঁকেবেঁকে চলে গেছে অমরকণ্টকে। এখান থেকে অমরকণ্টক প্রায় ৩৫ কিমি। এ পথ দিয়েই কাল যাব। সে আলাদা গল্প।

ছাপোরথার পথে গাড়ি ফিরে চলল হাইওয়ে ধরে। এই পথে প্রচুর ট্রাক চলে। তবে প্রত্যেককেই চলতে হয় নির্দিষ্ট গতি ও শব্দের আইন মেনেই। অনেক সময় রাস্তার ধারে গ্রামে জলের খোঁজে জড়ো হয় বন্য প্রাণীরা। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যখন তখন। এই রাস্তায় বেশ কিছু বনবস্তি পেরোতে হয়। এখানকার বাসিন্দা বৈগ্য, গোঙ্গ এবং কিছু ওঁরাও আদিবাসী। এদের জীবন খুব সাদামাঠা। রোটি, আচার আর মহুয়া পেলেই ওদের দিলখুশ। জলের অপ্রতুলতায় ধান-সব্জির আবাদ সামান্যতম। গ্রীষ্মের রুক্ষ জমিতে লড়াই করে করে ওরা এখন অল্পেই সন্তুষ্ট থাকে। হাতের তালুতে মেহেন্দি পরার ঢঙে আদিবাসী মেয়েরা গায়ে উল্কি আঁকায়। ওদের কাছে এটা খুব শখের। নির্মেদ পেটানো শরীর, কোমরে জড়ানো গয়না আর পায়ে বালা-পরা আদিবাসী রমণীদের বেশ সুন্দর লাগে।
নানা রূপে...
উইয়ের ঢিবি লালের ছোঁয়া... মৌচাক
খাওয়া সেরে একটু দিবানিদ্রা দিয়ে বিকেলে বাংলোর হাতায় বসে আছি। এমন সময় সফরসঙ্গী মানস এসে বলল,‘দাদা, একবার বাংলোর পেছনে চলো। একটা জিনিস দেখবে।’ সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম। ফরেস্ট গার্ড বাইকে বসে আছে। কারিয়াবোদারে ফরেস্ট ডিউটিতে গিয়েছিল। হাতে শালপাতায় মোড়া কী যেন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই শালপাতার মোড়ক খুলে দিল। আরে! এ তো কোনও জন্তুর বিষ্ঠা, শুকিয়ে গিয়েছে। আজ সকালেই যে অঞ্চলে আমরা ঘোরাঘুরি করছিলাম সেখানেই পাওয়া গিয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের প্রাতঃকৃত্যের এই অংশবিশেষ। শিক্ষিত চোখ ঠিক খুঁজে পেয়েছে শুকনো পাতার আড়ালে জঙ্গলের ভিতর পড়ে থাকা এ জিনিস। গার্ড দেখাল বাঘটি হরিণ শিকার করে খেয়েছিল আগে। লোম ও হাড় লেগে আছে বিষ্ঠার গায়ে। অনেকেই হয়তো নাক সিঁটকোবেন, কিন্তু হলফ করে বলতে পারি এ রকম দুর্লভ অভিজ্ঞতা ক’জনের হয়েছে জানি না। যাই হোক, ফরেস্ট গার্ডকে বললাম, “সবই তো বুঝলাম। কিন্তু এ দুষ্প্রাপ্য জিনিস নিয়ে এখন কী করবে ভাই?” আমার নাছোড় প্রশ্নে ফরেস্ট কর্মীটি হেসে ফেলে। “নমুনা পাঠানো হবে বিলাসপুর হেড কোয়ার্টারে প্রমাণের জন্য, পরীক্ষার জন্য।” যাক, ভাল লাগল এই ভেবে যে সরিস্কার মতো এই জঙ্গলে ভ্যানিশ হয়ে যায়নি শার্দুল মহারাজরা।

একই রকম ভাবে আজ ভোরেও ঘুম ভাঙল। আজ বিদায় নেব অচানকমার থেকে। ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি সবাই। গাড়িতে লাগেজ তুলে নিচ্ছি হাতে-হাতে। রসুইকার লাগোরামকে চা আনতে দেখে সঙ্গী কৌশিক তাকে পাকড়াও করল, ‘ভাইয়া, ভূতবাংলোর রহস্যটা কিন্তু ভাঙলে না।’ হাতে হাতে চা ধরিয়ে দিয়ে একটু হেসে লামোরাম বলে— প্রায় আশির দশকের কথা। তখন অচানকমারে ছাপোরয়ায় শুধু এই একটাই বনবাংলো। বৌ ও দুই বাচ্চা-সহ বেড়াতে আসেন এক ভদ্রলোক। তিনি প্রচণ্ড সন্দেহবাতিক এবং মানসিক রোগী। প্রায়ই ভাবতেন বাচ্চা দু’টি তাঁর নয়। এই সন্দেহপ্রবণ মন জন্ম দেয় জিঘাংসার। আপনারা যে ঘরে ছিলেন সেখানে এক ভোরে ঘুমন্ত স্ত্রী ও শিশুদের গায়ে আগুন ধরিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় লোকটি। জঙ্গলের আকাশ-বাতাস খানখান হয়ে যায় তাদের আর্ত চিৎকারে। আশপাশের মানুষদের তৎপরতায় ধরা পড়ে যায় উন্মাদ লোকটি। এর পর তদন্ত ও নানা গুজবের কারণে বহু দিন বন্ধ থাকার পর পুরো বাংলোটি নতুন করে সংস্কার করা হয়। তত দিনে সিনেমাওয়ালারা গল্প ফেঁদে, ছবি বানিয়ে বেশ পয়সা কামিয়ে নিয়েছে।

ঘটনার সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এ রকম যদি কিছু ঘটেই থাকে তবে সত্যিই তা দুঃখের। এ রকম ঘটনা আজও ঘটে অনেক জায়গায়। মানুষের মানবিকতাকে পশুদের পাশবিকতার সঙ্গে মাঝে মাঝে তুলনা করা হয়। কিন্তু এ ঘটনায় অরণ্যের পশুরাও লজ্জা পাবে। খ্যাঁক-খ্যাঁক হাসির আওয়াজে সবাই চমকে উঠি। বাংলোর সামনের জমিতে সেই হনুমানটি বসে, বুকে চেপে-ধরা ছোট্ট ছানাটির গায়ে হাত বুলোচ্ছে। এ বার ভ্যাংচাচ্ছে, না উপহাস করছে ঠিক বুঝলাম না। বিদায় অচানকমার। ভাল থেকো।

খুঁটিনাটি
১) এই অরণ্যে ঘোরার সেরা সময় অক্টোবর থেকে জুন
২) মুম্বইগামী যে কোনও ট্রেন ছাড়াও অন্য ট্রেনে বিলাসপুর গিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে হবে অরণ্যভ্রমণে
৩) অরণ্যসংলগ্ন স্থানে থাকার জন্য আবেদন করতে পারেন: Superintendent Achnakmar SanTuary, Bilaspur, Chattisgarh।
অন্যান্য সহায়তার জন্য ফোন করতে পারেন 09903036840

এক কথায়: গুনগুন আওয়াজ আর বনজ পাতার গন্ধে যেন সন্ধ্যার আরতি হয় অরণ্যের সংসারে।
পেশায় অ্যাকাউন্টস কনসালট্যান্ট। অরণ্য প্রকৃতি আর বন্য প্রাণের নেশায় প্রথম ঘর ছাড়া ১৫ বছর বয়সে। ক্যামেরা খাতা কলম আর ভাঁড়ে জমানো পয়সা, এই সম্বল করে পাড়ি দেওয়া দেশ বিদেশে। সময় ও বয়সের পরিবর্তন হলেও নেশাটা আজও একই রকম রয়ে গেছে।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• ‘শীতল সবুজের পথ বেয়ে’ কাজিরাঙার কাহিনি
• রঙিন মনে পারমাদনে খয়েরবাড়ির বাঘাশ্রমে
• সৌম্দর্য ও ইতিহাসের হাতছানি: বক্সাদুয়ার


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ