আপনার কলমে...
১৭ মাঘ ১৪১৮ বুধবার ১ ফেব্রুয়ারি ২০১২


‘শীতল সবুজের পথ বেয়ে’
শিলিগুড়ি থেকে ঘন্টা আড়াই তিনেকের পথ। সেবক রোড হয়ে তিন নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে শালুগাড়ার সেনাছাউনি, করোনেশন ব্রিজ। সে সব পেরিয়ে দু’ধারে শাল-সেগুনের জঙ্গল আর আঁকাবাঁকা গিরিখাতের মাঝে তিস্তাকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলা। মংপং, ওদলাবাড়ি, ডামডিম, মালবাজারের চা সাম্রাজ্য পেরিয়ে সামসিং হয়ে ‘সুনতালেখোলা’। গ্রীষ্মকাল, তবুও সারাটা পথেই সবুজের সমারোহ—

এই পর্যন্ত সবে বলেছি কি বলিনি, নীলাদ্রি সরাসরি ফুট কাটে, ‘‘স্বপ্নের মালাটা ভালই গাঁথছ। আরে যাবটা কোথায়? থামব কোথায়? থাকব কোথায়?’’
উরিব্বাস! ‘‘এত প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে? যেতে যেতেই দেখবি এর সঙ্গে ডুয়ার্সের আরও এক স্বল্পপরিচিত সৌন্দর্য। অরণ্যপ্রকৃতির মাঝে মূর্তি নদীর উল্লাসে পাথুরে রকি-আইল্যান্ড। ছোট বড় ট্রেকপথে ভরপুর প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। সুনতালেখোলা ও রকি আইল্যান্ড দু’জায়গারই বুকিং হয়ে গেছে।’’

মূর্তি নদীর পাথুরে উল্লাস

করোনেশন ব্রিজ
শিলিগুড়ি থেকে ৮৫ কিলোমিটার পেরিয়ে সবুজ ডুয়ার্সের চালসা পার করে আরও উত্তরে সর্পিল পথের উঁচুতে সামসিং। সেখান থেকে আরও একটু এগিয়ে সুনতালেখোলা— আমাদের গন্তব্য। চালসা পর্যন্ত কিছুটা জনপদ দেখা যায়। চালসার চৌমাথা ছাড়ালেই ম্যাজিক— পাহাড়ি রাস্তা ‘ইউ টার্নে’ উঠে যাচ্ছে আকাশ ছোঁবে বলে। সবুজ-আনন্দের ‘‘একটি কুঁড়ি দু’টি পাতা’’রা এখানে অকৃপণ। কোনও কোনও জায়গার ক্যানভাস এতই দুর্দান্ত যে মনে হয়, থাকি না এখানে দু’টো দিন, তাঁবুতে আস্তানা গেড়ে। এই উচ্চতা থেকে সবুজের ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া চা বাগিচাগুলি যেন চির যৌবনা। শিরীষ, শিমুলের ছায়ার নীচে টিকিয়ে রাখা এই চা বাগানের শ্রমিকরা কিন্তু টিকে আছে বড় কষ্টে। চা উৎপাদন আর মুনাফা— এই দুইয়ের অভাবে বিপর্যস্ত চা শিল্প। তার উপর ডুয়ার্সের রাজনৈতিক টানাপোড়েন। আমরা যারা প্রকৃতির লোভে ছুটে আসি এ সব জায়গায়, তারা কখনই উপলব্ধি করতে পারব না ওদের যন্ত্রণা!

আচমকা তীব্র ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ি প্রত্যেকে। হলটা কী? গাড়ি থেকে ঠিক হাত পাঁচেক দূরে একটা বাচ্চা আদিবাসী ছেলে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে একটা প্লাস্টিকের বল। জোর বাঁচান বেঁচে গেছে, পাশেই খেলছিল হয়তো! হৈ হৈ করে স্থানীয়রা ছুটে আসে। বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলাম। ওর মুখে অমলিন হাসি, যেন কিছুই হয়নি। বাচ্চাটাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে আবার গাড়িতে এসে বসতেই, সৌমেন বলল ‘‘খেলা খেলা দিয়ে শুরু খেলতে খেলতে শেষ...’’
‘‘অজান্তে লাইনটা বললি, জানিস কোন সিনেমার গান?’’
দলের সদস্য রাম আর বিলু বলে উঠল, ‘‘সবাই জানে ‘খেলা’।’’
‘‘ এটা জানিস কি, যে অঞ্চলটায় আমরা যাচ্ছি বা থাকব এই পুরো অঞ্চলটা ঘিরে ঋতুপর্ণ ঘোষের ক্যামেরা ঘুরে বেরিয়েছে, খেলা ছবিটার শুটিঙের কারণে?’’

সুনতানেখোলার উপর দড়ির ঝুলন্ত সেতু
মেটেলিতে সাময়িক চা পানের বিরতি। ‘মেটেলি’ মানে মাটির আলয়। ছোট্ট শহর। থুড়ি, শহর কেন বড় ‘গঞ্জ’ বলাই ভাল। স্থানীয় ভুটানি, লেপচাদের সঙ্গে দেহাতি পরিবাররা মিলে মিশে একাকার। বেশির ভাগই চা বাগানে কাজ করে চলেছেন বংশানুক্রমে। ঘিঞ্জি বসতি, পুরনো আমলের বাজার, মুদির দোকান, পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে পাইন গাছের নীচে গাছতলার সেলুন আর তারই পাশে এসটিডি বুথ ও কম্পিউটারে ফোটো তোলার দোকান। বোঝা যায়, দিন বদলাচ্ছে। মেটেলি থেকে এগিয়ে এলে বাঁ দিকের একটা পথ চলে গেছে সবুজ পাহাড়ি পথে— ‘জুরন্তি’, নেওড়া নদীর ধারে এক নির্জন সৌন্দর্য। ট্রেকিং-এর জন্য দারুণ সব জায়গা। শুধু দরকার পর্যটন দফতরের সহানুভূতি ও আন্তরিকতা। জনপদ থাকলেও যোগাযোগের অভাবে সে ভাবে গড়ে ওঠেনি পর্যটনকেন্দ্র। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের সব মশলা মজুত এখানে।

সামসিং বিট অফিস ছাড়িয়ে মাইল খানেক এগোলেই পাহাড়ের কোলে সামসিং বন বাংলো। আমরা বুকিং করেছি প্রায় নতুন জায়গায়,‘সুনতালেখোলা ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পে’। বন বাংলো ছাড়িয়ে কমলা বাগান, ভুট্টা খেত পেরিয়ে জিপের পথ শেষ। দু’পাশ আগলে রাখা পাহাড়ে মেঘ-রৌদ্রর এক অপরূপ খেলা চলছিল মধ্যাহ্নে। জিপ বা সুমো ছাড়াও সামসিং পর্যন্ত বাস আসে শিলিগুড়ি থেকে, তবে সংখ্যায় অল্প। জিপ ছেড়ে সমতলে ২ কিলোমিটার হাঁটা পথে রিসর্টের অবস্থান। মালপত্র কাঁধে ফেলে মাইল খানেক এগোতেই দেখি সুনতানেখোলা তির তির করে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে। পাহাড়ি এই পথকে দু’ভাগ করেছে এই নদী। ও-পারে যাওয়ার জন্য বানানো হয়েছে দড়ির ঝুলন্ত সেতু। ‘খোলা’ অর্থে ছোট নদী। সুনতানেখোলাকে এই মুহূর্তে নদী না বলে ‘ঝোরা’ বলাই শ্রেয়। বর্ষায় বা হঠাৎ বৃষ্টিতে যদিও ওর তাল কেটে গিয়ে সে হয় ‘নটরাজ’। সেতু পেরিয়ে একটু গেলেই পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন দফতরের ‘সুনতালেখোলা ওয়াইল্ডারনেস রিসর্ট’।

অরণ্য উপত্যকার পথটুকু ‘খোলার’ রিমঝিম শব্দ আর পাখির শিসে বুঁদ হয়ে রইলাম। পাহাড় ঘেরা ছায়া সবুজের মাঝে মাঝে কটেজের অবস্থান দেখে বিস্ময়ে অবাক। এই পথে প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদের ছড়াছড়ি। নানান উদ্ভিদ, ভেষজ গুল্ম, বেত, বাঁশ বা কুচ্চোর (ঝাড়ুগাছ) উপস্থিতি অন্ন জোগায় পাহাড়িয়াদের। বেশ কয়েক কিলোমিটার নেমে আসার পর এক পাহাড়ি বাঁকে অরণ্য হারিয়ে যায়। পথ এখানে ভীষণ সরু হলেও বিপজ্জনক নয়। পাহাড়ি পথে আলাপ হয় সোনম থাপার সঙ্গে। বছর পনেরো বয়স, কাঁধে স্কুল ব্যাগ, পড়তে যায় স্থানীয় বিদ্যালয়ে। রোজ আসা যাওয়ায় প্রায় সাত কিলোমিটার। কথা বলতে বলতে হঠাৎই নজরে আসে রঙিন তাঁবুর বর্ণময় সৌন্দর্যে ‘রকি আইল্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প’— যাকে আগলে রেখেছে পাশের ‘কিতাপ সিং’ পাহাড়, আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মূর্তি নদী। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমে যারা আগ্রহী, ‘অফবিট’ ভ্রমণে যারা উৎসাহী তাদের জন্য শিলিগুড়ির বাসিন্দা সুখেন্দু বিশ্বাসের অনবদ্য এই উপহার।

কিতাপ সিং পাহাড়ের কোলে পাথর দিয়ে তৈরি তাঁবুতে বসার ব্যবস্থা, ডাইনিং ও তার সংলগ্ন পাথুরে শিল্পের উপকরণে সজ্জিত। পাহাড়ি চাটানে দেওয়াল গেঁথে বাথরুম। আর যাদের তাঁবুতে থাকতে একদম ভরসা নেই সে রকম পরিবারের জন্য ঘর আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য মেনেই।

সুনতালেখোলা ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্পে

রকি আইল্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প
তাঁবুতে মালপত্র রেখে একটু জিরিয়ে নিলাম। সুখেন্দুবাবুর ওয়েলকাম ‘টি’-তে গলা ভেজাতেই ক্লান্ত শরীর সতেজ হয়ে যায়। পাথুরে পথ ডিঙিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি মূর্তির বুকে। ঠান্ডা জলস্রোতে দুপুরের স্নান সেরে নিলাম। সুখেনবাবুর খাওয়ার পদে পাই ঘরেলু আস্বাদ। পেট চুক্তি ডালভাত, সব্জি মাছ ও চাটনি। রাতে মাংস। দু’শো টাকায় জন প্রতি এই খাবারের সঙ্গে জল খাবার এক কথায় দুর্দান্ত। খেয়ে উঠতে না-উঠতেই আমাদের ঘিরে রাখে ৮/১০ টি কুকুর। খাবারের লোভে নয়, নতুন অতিথিকে ভরসা জোগাতে। জনহীন এই অঞ্চলে সারা রাত জেগে প্রতিটি তাঁবুর সামনে পাহারা দেয় বিশ্বাসী প্রভুভক্তের দল। এদের ভয়ে পাহাড়ি ভল্লুক বা অন্য বহিরাগত কেউ এ পথ মাড়ায় না। এখান থেকে সামনের উঁচু-নিচু পথ নদী পেরিয়ে চলে গেছে একদম উপরে ভালুখোপ, তিনকাটারি হয়ে ‘গোসুমে’। এও এক অনিন্দ্যসুন্দর ট্রেক রুট। কিন্তু এ বারে আমাদের যাত্রা বিরতি এখানেই। সুযোগ এলে শোনাব জলদাপাড়ার জঙ্গলের গল্প।

এক কথায়: সুনতালেখোলা ও রকি আইল্যান্ড: ছোট বড় ‘ট্রেক’পথে ভরপুর প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য।
 
পেশায় অ্যাকাউন্টস কনসালট্যান্ট। অরণ্য প্রকৃতি আর বন্য প্রাণের নেশায় প্রথম ঘর ছাড়া ১৫ বছর বয়সে। ক্যামেরা খাতা কলম আর ভাঁড়ে জমানো পয়সা, এই সম্বল করে পাড়ি দেওয়া দেশ বিদেশে। সময় ও বয়সের পরিবর্তন হলেও নেশাটা আজও একই রকম রয়ে গেছে।
ছবি: লেখক
লেখকের আরও ভ্রমণকথা





রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ