আপনার কলমে


বুদ্ধদেবের বোধি অর্জনের প্রাণকেন্দ্র
নূপুর বাগচী
তিহাসের পাতায় তার নাম উরুভেলা। আঠারো শতকে ‘বোধগয়া’ নামে পরিচিতি পায় এই স্থান। মহাভারতে উল্লেখিত নিরঞ্জন নদীর পাড়ের এই ধর্মস্থানে প্রথম বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেন সম্রাট অশোক। ‘বোধিমণ্ড বিহার’ নামের সেই দেবালয় এখনকার অতি পরিচিত ‘মহাবোধি’ বৌদ্ধমন্দির। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে কুশানদের রাজত্বকালে এই মন্দির সংস্কার করা হলেও, পরবর্তী কালে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হওয়ায় এই স্থাপত্যও অবহেলিত হয়। উনিশ শতকে স্যর আলেকজান্ডার কানিংহ্যামের নেতৃত্বে মন্দির পুনঃস্থাপনের কাজ শুরু হয়। বহু বছরের পরিশ্রমের পর লোকসমক্ষে আসে আজকের বুদ্ধগয়া। ৫৫ মিটার উচ্চতার মন্দির চূড়া দেখা যায় প্রায় ১১ কিলোমিটার দূর থেকে।

আমরা অনেক বছর ধরেই আমেরিকার সিয়াটেলের বাসিন্দা। তাই দেশে আসার আগেই ঠিক করে নেওয়া হয় ‘এ বার কোন কোন জায়গা দেখব’। ২০১১ সালের তালিকায় প্রথমেই ছিল বুদ্ধগয়া— গৌতম বুদ্ধ যেখানে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন জীবনের চরম সত্য। ফল্গু নদীর পাড়ে একটি বট গাছের নীচে ‘তিন দিন তিন রাত’ ধ্যানমগ্ন ছিলেন তিনি। বোধিসত্ত্ব লাভ করার পর বুদ্ধদেব সাত সপ্তাহ ধরে সাতটি ভিন্ন স্থানে আবারও ধ্যান করেন এবং শেষে সারনাথ গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন।

ডিসেম্বর মাস। ভোর পাঁচটা নাগাদ গয়া স্টেশনে ঢুকল দুন এক্সপ্রেস। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে কুয়াশার অন্ধকারে ঢাকা স্টেশনে নামলাম। ভাগ্যিস গরম চা পাওয়া গেল। না হলে কাঁপুনি এসে যেত! বাইরে আলো ফোটেনি তখনও। নিরাপত্তার কথা ভেবে স্টেশনের বাইরে না গিয়ে ওয়েটিং রুমে কিছু ক্ষণ বসে রইলাম। নেপাল, ভুটান, সিকিম, তাইল্যান্ড, কোরিয়া, মায়ানমার— নানা দেশ থেকে প্রচুর বৌদ্ধধর্মাবলম্বি মানুষের ভিড় ওয়েটিং রুমে। কোনও রকমে একটু জায়গা করে বসে পড়লাম দু’জন।

প্রায় সকাল সাতটা নাগাদ বাইরে এলাম। স্টেশনের খুব কাছেই আচার্য শ্রীমত্ স্বামী প্রণবান্দজী মহারাজ প্রতিষ্ঠিত ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। ঠিক ছিল ওখানেই থাকব আমরা। ঘরে পৌঁছে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম বিষ্ণুপাদ মন্দিরের উদ্দেশে। কথিত, রামচন্দ্র স্বয়ং ফল্গুর পাড়ে তাঁর পিতার উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করেন। মহাভারতের নিরঞ্জন নদীই আজকের ফল্গু। বিষ্ণুপাদ মন্দির চত্বরেই রয়েছে অক্ষয়বট। রামায়ণে আছে, সীতার আশীর্বাদেই এই বটবৃক্ষ সেই যুগ থেকে অমর হয়ে রয়েছে। পিণ্ডদান পর্বের আগে শ্রীরাম যখন স্নানে গেছেন, সীতা দেখেন দু হাত বাড়িয়ে দশরথ তাঁর থেকেই পিণ্ড চাইছেন। উপায়ান্তর না দেখে বালি দিয়ে পিণ্ড তৈরি করে দশরথকে দেন তিনি। রাম ফিরে এলে সীতা ঘটনার বিবরণ দেন। তাঁর কথার সত্যতা প্রমাণে সাক্ষী দিয়েছিল কেবল এই বটগাছ। ফল্গু নদী তথ্য অস্বীকার করায় সীতা তাকে অভিশাপ দেন। যে কারণে ধুধু বালিয়াড়ির নীচ দিয়ে বয়ে চলে সে, সবার অলক্ষে।
মন্দির চত্বর
সঙ্ঘ থেকেই এক জন পুরোহিত ঠিক করে দেওয়া হল, তাঁর ৫০০ টাকা দক্ষিণা। বিহারের পুরোহিতরা পুজো করেন ৩০০ টাকায়। একটি ছোট ছেলে গ্লাস ভর্তি করে ফল্গুর জল এনে দিল। প্রথমে শ্রীবিষ্ণুপাদ ও তার পর অক্ষয়বটে পিণ্ডদান করে ফিরে গেলাম সঙ্ঘে। এখানে খাওয়াদাওয়া বিনামূল্যে। খিদের মুখে গরম গরম ভাত, ডাল, তরকারি, ছানার ডালনা আর চাটনি— পেট ভরে খেলাম। শীত কাল, তাড়াতাড়ি বেলা শেষ হয়ে যায়। তাই একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পডলামব বুদ্ধগয়ার মন্দির দেখতে।

বেলা তিনটে নাগাদ বেরিয়ে দেখি রাস্তায় মানুষের ঢল! টেম্পো-ট্যাক্সি কিছুই যেতে চাইছে না মন্দিরের দিকে। গত সাত দিন ধরে বৌদ্ধদের ‘মোনলাম’ উত্সবের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ভক্তরা এসেছেন এখানে। এ মাসের শেষে আরও এক বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য দলাই লামা আসবেন শহরে। তবে দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার হওয়ায় একটি সরকারি বাস উঠে বসলাম। আর আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছেও গেলাম। বাসের রাস্তা মগধ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দিয়ে। সুবিশাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর খুব সাজানো ও পরিষ্কার। জায়গায় জায়গায় তাঁবু টানানো দেশ বিদেশ থেকে আসা বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের জন্য। মন্দিরের খানিক দূরে বাস থামল। দলে দলে লোক চলেছে মন্দিরের দিকে। অবাক হলাম, কোনও কোলাহল নেই। দর্শনের জন্য ভীষণ লম্বা লাইন। আমরা চারিদিক ঘুরে, মন্দিরের গায়ে নানা মূর্তির ছবি তুলে লাইনে দাঁড়ালাম। মন্দিরের ভেতরে সমতল থেকে সামান্য উঁচু একটি বেদীর উপর সেই সৌম্য মূর্তি। হলুদ অঙ্গবস্ত্র পরিহিত সোনালি মূর্তি। ভক্তদের দান করা শুধুমাত্র হলুদ রঙের কাপড়ই পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। অনেকে দেওয়াল ঘেঁষে বসে ধর্মগ্রন্থ পড়ছেন, কেউ কেউ মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। ছবি তোলায় কোনও বাধা নেই। তাই অনেককেই বেদীর কাছে গিয়ে মূর্তির ছবি তুলছেন।
বেদীতে মাথা ঠেকিয়ে মুখ তুলে মূর্তির দিকে তাকালাম। কী যে অনুভূতি, ঠিক বোঝাতে পারব না! অত সুন্দর শান্ত সৌম্য মূর্তি, অমন সুন্দর অর্ধনিমিলিত নীল চোখ— একেবারে মনের গভীরে ছুঁয়ে গেল। কোনও এক মন্ত্রবলে স্থির হয়ে বুদ্ধদেবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছু ক্ষণ। সম্বিত ফিরল হঠাত্ কাপড়ে টান পড়তে। পিছন ফিরে দেখি, এক মহিলা দু’টি কমলালেবু আর দু’টি আপেল নেওয়ার জন্য ইশারা করছেন। মহিলার পাশেই দেখি একটা বিশাল সাদা থলিতে অনেক কমলালেবু আর আপেল। বাইরে বেরিয়ে মন্দিরের পেছন দিকে গেলাম। সেখানে এক দল ভক্ত ধর্মীয় গান গাইছেন। কী ভাষা বুঝতে পারলাম না, তবে অনেকে বসে শুনছেন। মন্দিরের ডান দিকে বিরাট এক বটগাছ— বোধিবৃক্ষ। ভক্তরা নানা মনস্কামনা করে গাছের ডালে রঙিন কাপড়ের টুকরো বেঁধে দিয়েছেন। আমরা আরও কিছু ক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম বাসস্ট্যান্ডে। হাতে আর সময় নেই। বারাণসী যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে যে রাত ন’টা নাগাদ।

এক কথায়: অত সুন্দর শান্ত সৌম্য মূর্তি, অমন সুন্দর
অর্ধনিমিলিত নীল চোখ— একেবারে মনের গভীরে ছুঁয়ে গেল।

১৯৮১ সাল থেকে মার্কিন দেশেই বসবাস। পেশায় ‘কমিউনিটি কলেজ ইনস্ট্রাকটার’ এবং হিসাব রক্ষক। নানাবিধ শিক্ষার মধ্যে ভূগোল একটি বিশেষ বিষয়। ভারত ও মার্কিন দেশ জুড়ে বহু জায়গাই ঘোরা। আসলে বেড়ানোটাই একমাত্র ভাল লাগার অস্তিত্ত্ব।
ছবি: লেখক

লেখকের আরও ভ্রমণকথা
• চিনের প্রাচীরে কয়েক মুহূর্ত
• গিঙ্গো পেট্রিফায়েড ফরেস্ট

রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যাসংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘরস্বাদবদল চিঠিপুরনো সংস্করণ