আপনার কলমে...
১৪ কার্তিক ১৪১৮ মঙ্গলবার ১ নভেম্বর ২০১১


গিঙ্গো পেট্রিফায়েড ফরেস্ট: ছোট্ট একটু বেড়ানো
সিয়াটেলে রয়েছি প্রায় পনেরো বছর। অথচ ঘরের কাছের গিঙ্গো পেট্রিফায়েড ফরেস্টে যাওয়া হয়নি। নাম শুনিনি এমন নয়, যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না তেমনও নয়। কিন্তু নানা কারণেই আর যাওয়াটা হয়ে ওঠেনি। একে ভূগোলের ছাত্রী তায় আবার বাড়ির এত্ত কাছে! শেষমেশ একদিন হঠাত্ ঠিক করে ফেললাম, যাবই! পর্যটক বলতে আমরা তিন জন, ছেলে আর ছেলের বাবা-মা।
বেরিয়ে পড়লাম এক সকালে। কর্তা বললেন “তোমরা দু’জনে গাড়ি চালাও, আমি ব্যাক সিটে ঘুমোব।’’ ছেলে বলল, সে ড্রাইভ করবে। অতএব আমার স্থান ‘প্যাসেঞ্জার-সিটে’। বাড়ি থেকে অরণ্যের দূরত্ব প্রায় ১৫৩ মাইল। সকাল দশটায় রওনা হয়ে প্রথমে ইন্টারস্টেট ৯০ ইস্ট, তারপর হানটিনজার রোড ধরে প্রায় ২ মাইল যাওয়ার পর ভ্যানগেট পৌঁছলাম। তখন প্রায় দুপুর সাড়ে বারোটা।

পার্কে ঢোকার মুখেই একটা ‘গিফ্ট শপ’। একটু এগিয়ে ‘পার্ক ইন্টারপ্রেটিভ সেন্টার’। এই সেন্টারের পেছন দিকেই কলম্বিয়া নদীর ওয়ানাপুম ‘রিসার্ভার’। নীল টলটলে জল। প্রচুর মানুষ বোটিং করছেন। এখানে ‘ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড’ও রয়েছে। উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম প্যাসিফিকের সব থেকে লম্বা নদী এই কলম্বিয়া, প্রায় ১২৪৩ মাইল লম্বা।
মূল নদীর উপর রয়েছে ১৪টি ‘হাইড্রোইলেকট্রিক ড্যাম’। বিদ্যুৎ তৈরি হয় নদীর শাখা-প্রশাখা থেকেও।

পার্ক থেকে বেরিয়ে আরও প্রায় ২ মাইল গেলে পেট্রিফায়েড ফরেস্ট। চারদিকে ঢেউ খালানো জমি— ৩০০ ফুট বা তার থেকেও বেশি উঁচু। পাথরে রুক্ষ শুকনো লাভা প্রবাহের চিহ্ন। বড় গাছ বিশেষ নেই। ছোট ছোট ঝোপ, তাও শুকিয়ে গেছে। উঁচু জায়গাগুলো ন্যাড়া বললেই চলে। বেশ গরম হাওয়া বইছে। ঢোকার মুখেই ‘ফরেস্ট রেঞ্জার’-এর বাড়ি। মানচিত্রে দেখলাম ঘুরে দেখার দু’টো ‘লুপ’ আছে। ছোটটা প্রায় আধ মাইল, ঘুরতে আধ ঘন্টা মতো সময় লাগে, অন্যটা আড়াই মাইলের ‘লুপ’— ২২ রকমের ‘পেট্রিফায়েড লগস’ আছে। পথ মোটামুটি চড়াই। আমরা ছোট লুপই ধরলাম। রোদের তেজ বেশ, ‘স্ট্র হ্যাট’ মাথায় থাকলে আরাম বোধ হয়। এক জায়গায় সতর্কবার্তা নজরে এল— পথের পাশে ‘র‌্যাটেল স্নেক’ থাকতে পারে। যদিও খুব গরমে ওদের কমই দেখা যায়।

গিঙ্গো পেট্রিফায়েড পার্কের ইতিহাস মায়োসিন যুগের অর্থাত্ প্রায় ১ কোটি ৫৫ লক্ষ বছর আগের। তখন এটা ছিল সবুজ ও ভেজা, নানা ধরনের গাছে ভরা এক অঞ্চল (গিঙ্গো, সুইটগাম, রেড উড, ডগলাস ফার, ওয়ালনাট, স্প্রুস, এলম্, ম্যাপল, হর্স চেস্টনাট, কটন উড, ম্যাঙ্গোলিয়া, ম্যাড্রোন, সাসাফ্রাস, ইউ এবং উইচ হ্যাজেল)। পুরো এলাকা জুড়ে ছিল অনেক অগভীর হ্রদ ও জলাভূমি। আর হ্রদের ধারে সারিবদ্ধ সাইপ্রাস গাছ। সমতলের উপরভাগে ছিল ডেসিডুয়াস গাছের (গিঙ্গো, ম্যাপল, ওয়ালনাট, ওক, সাইকামোর, হর্স চেস্টনাট) ঘন আবরণ। একদম উঁচুতে ছিল ডগলাস ফার, হেমলক, স্প্রুস। ব
ন্যা বা নদীর জলপ্রবাহে জলাভূমির আশপাশের সমস্ত গাছ নষ্ট হয় এক সময়। পরে সাউথ ইস্টার ওয়াশিংটনে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে গলিত লাভাস্রোত এই এলাকাকে প্রায় সমতল করে দেয় এবং ধ্বংস হয়ে যায় বড় গাছগুলিও। কিন্তু জলে ভেজা, কাদায় ঢাকা গাছগুলি একই রকম থেকে যায়। আর লাভা স্রোত জলে মিশে তৈরি হয় ব্যাসল্ট। আস্তে আস্তে ব্যাসল্টে মোড়া এই গাছগুলোর রাসায়নিক রূপান্তরণ হতে থাকে । লাভাস্রোতের সিলিকা ও অন্যান্য ধাতুও জলের সঙ্গে মিশে নানা রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটায়। এই প্রক্রিয়াকেই ‘পেট্রিফিকেশন’ বলা হয়। বিভিন্ন ধাতু কাঠের মধ্যে দিয়ে চুঁইয়ে যাওয়ার ফলে নানা রঙের সৃষ্টি করে। বছরের পর বছর ধরে এই প্রক্রিয়া চলার ফলে কাঠ পাথরে পরিণত হয়েছে, একে বলা হয় ‘ট্রিস অফ স্টোন’।

ছোট লুপে ঢুকেই প্রায় সাত-আটটা নানা আকারের পেট্রিফায়েড গাছ। সুরক্ষার কারণে সবই লোহার খাঁচায় বন্দি। ওয়ালনাট আর ওয়াটার চেস্টনাট দু’টো নজরে পড়ে আয়তনের জন্য। এদের যে অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, সেই অবস্থাতেই সংরক্ষিত করা হয়েছে। সুন্দর, মসৃন এবং রঙের কী বাহার! না দেখলে বিশ্বাস হবে না! প্রকৃতির কী অপূর্ব সৃষ্টি!

ফিরে এলাম ইন্টারপ্রেটিভ সেন্টারে। এক দিকে বেশ কিছু পেট্রিফায়েড গাছ সাজানো রয়েছে। প্রতিটাতে তার ইতিহাস লেখা। সবগুলোতে হাত বুলিয়ে দেখলাম। সেন্টারের বাইরে তিনটে গিঙ্গো গাছ। পাতাগুলো ভীষণ সুন্দর।

এই সব গাছ-পাথর দিয়ে নানা ধরনের জিনিস বা গহনা তৈরি করা হয়। ছবি তোলার পর্বেই ঘন্টা দুই কাটিয়ে দিয়ে খেতে গেলাম। এ বার ফেরার পালা। ফেরার পথে দেখি মাইলের পর মাইল ধরে রয়েছে ‘উইন্ড মিলস’। ছবির মতো সুন্দর লাগছিল দেখতে। পরে দেখলাম নানা জায়গায় গাছ পাকা চেরি, নেকটারিন, পাম, অ্যাপ্রিকট বিক্রি হচ্ছে। কিছু কেনা হল। দোকানি মেয়েটি বললেন, “তোমরা তো টাটকা ফল খাবে, পিট (মানে আঁটি ফেলার জন্য ব্যাগ) দেব?” এখানে কোনও কিছুই রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলার নিয়ম নেই।
সকালে বেরোনোর আগে ছেলে একটি ‘গ্যাজেট’ গাড়ির ড্যাসবোর্ডে রেখেছিল। তাড়াহুড়োতে তখন কিছু জানতে চাইনি। ফেরার পথে ‘ফ্রি ওয়ে’তে গাড়ি বেশ জোরেই চলছিল। ‘ফ্রি ওয়ে’ মানে রাস্তায় কোনও আলো নেই, ৬০-৭০ মাইল বেগে গাড়ি চালানো যায়। কর্তা পেছনে নাক ডাকছে। পাহাড়-গাছপালা-নদী জানলার ওপার দিয়ে তীব্র গতিতে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ‘ট্যাঁ ট্যাঁ’ শব্দে চমকে জানলার বাইরে তাকালাম। ছেলে গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে বলল, “পুলিশ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে গাড়ির গতি পরীক্ষা করছে। পুলিশের কাছে গাড়ির গতি মাপার যে ‘র‌্যাডার গান‘ থাকে, তার হদিশ পেলেই এই ‘গ্যাজেট’টা শব্দ করে।” সত্যিই রাস্তায় অনেক পুলিশ। কোনও রকমের ট্রাফিক নিয়ম না মানলেই একটা বিচ্ছিরি অঙ্কের জরিমানা। আর যে সব জায়গায় রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেখানে জরিমানা দু’গুণ। ‘ইতিহাসের অরণ্য’ দেখে প্রায় সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি ফিরে এলাম।

এক কথায়: মায়োসিন যুগের গাছপালা দেখার অভিজ্ঞতা মনে রেখাপাত করে।
 

১৯৮১ সাল থেকে মার্কিন দেশেই বসবাস। পেশায় ‘কমিউনিটি কলেজ ইনস্ট্রাকটার’ এবং হিসাব রক্ষক। নানাবিধ শিক্ষার মধ্যে ভূগোল একটি বিশেষ বিষয়। ভারত ও মার্কিন দেশ জুড়ে বহু জায়গাই ঘোরা। আসলে বেড়ানোটাই একমাত্র ভাল লাগার অস্তিত্ত্ব।

ছবি: লেখক


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ