২৯ কার্তিক ১৪১৯ বৃহস্পতিবার ১৫ নভেম্বর ২০১২


    কুমড়ো কথা
কার্তিক মাস চলছে। সামনেই বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের কালীপুজো। বাড়ির ন্যাড়া ছাদের উপর আকাশ প্রদীপের নাট-বল্টুটাতে শেষ প্যাঁচটা দেওয়া চলছে। আর প্রতিবেশী আমেরিকানরা পেল্লাই সব কমলা কুমড়োর পেটের ভেতর থেকে শাঁস বের করে ছুরি দিয়ে নকশা কেটে তার ভেতর বাল্ব লাগাচ্ছে। সন্ধে হলেই বাড়ির বাগানে ওগুলোর ভেতর থেকে জ্বলে উঠবে আলো, শেষ হবে সেই হ্যালুইনে গিয়ে।

আমেরিকায় অক্টোবর মাসটা হল কুমড়ো তোলার সময়। কাগজে পড়লাম, বাড়ি থেকে দেড় ঘণ্টা দূরেই কুমড়ো নিয়ে একটা আস্ত মেলা বসতে চলেছে। যদি এটা শুধু ছোটবড়, কাঁচাপাকা, সবুজ-কমলা কুমড়ো বেচাকেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তা হলে হয়তো খবরটা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না অতটা। কিন্তু পড়ে বুঝলাম, চাষিরা এখানে শুধু কুমড়োর পসরা সাজাবেন না, তাবড় তাবড় রাঁধুনিরা জিভে জল আনা সব কুমড়োর পদও রেঁধে খাওয়াবেন।
ছোটবেলা থেকে মোটা হয়ে যাওয়ার ভয়ে আলু আর এই এক কুমড়ো থেকে সর্বদা দূরে দূরেই থেকেছি। তা ছাড়া ছোলা দিয়ে কুমড়োর ছক্কা আর পুঁইশাক-কুমড়োর চচ্চড়ি ছাড়া অন্য কোনও ‘ভ্যারাইটি’ আমার সামনে হাজির করা হয়েছিল বলেও তো মনে পড়ে না। কুমড়ো প্রীতি বলতে যা বোঝায় তা কোনও কালেই আমার ছিল না। তাই নিছক কুমড়োর পায়ে একটা গোটা সপ্তাহান্ত বলি দিতে ঠিক ইচ্ছা হচ্ছিল না। কিন্তু যখন দেখলাম কুমড়োর পিত্জা, কুমড়োর আইসক্রিম আর সঙ্গে ‘জগত্ বিখ্যাত’র ট্যাগ, তখন এই রসনালোলুপ আর কৌতূহল প্রিয় মনটা আর বাঁধ মানল না।

নির্দিষ্ট দিনে মেলায় হাজির হয়ে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। ডাউনটাউনে রাস্তার এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছোট ছোট সব খাবারের স্টল। হাতে গরম এবং ঠান্ডা, টাটকা সেই খাবার, ক্রেতার মরজিমাফিক তারই চোখের সামনে বানিয়ে দিচ্ছেন রাঁধুনিরা। অযথা কর্মচারীর ভিড়ে গাজন নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। তা ছাড়া রাঁধুনি যদি ভোজনরসিককে চোখের সামনে চেটেপুটে খেতে দেখেন তার চেয়ে সুখ আর কিছুতে নেই। মেলার খাবারের এই এক মজা। রেস্তোরাঁর দামও দিতে হয় না, অথচ পরিমানে অল্প অল্প করে, কম দাম দিয়ে কিনে, নানা জিনিস চেখে পরখ করেও নেওয়া যায়। বিগ টাইম ইনভেস্টমেন্ট-এর আগে একটা ছোট্ট করে টেস্ট ড্রাইভ। গাড়ির উপরের এই রান্নাঘর কাম চলমান রেস্তোরাঁর একটা জনপ্রিয় নামও রয়েছে, ‘মিল অন হুইল’।

যাই হোক, মনস্থ করলাম একটু ভাজা দিয়েই শুরু করি। সেই মতো আমাদের কুমড়োফুলের বড়া (পামকিন ব্লসম)-র স্টলে লাইন দিলাম। বাঙালিদের মতো সাহেবরাও যে এর এত বড় ভক্ত, তা লাইন দেখেই টের পেলাম। রসনা বোধহয় দেশ-জাতির বাধা মানে না! তবে এই বড়া কর্নফ্লাওয়ারের ব্যাটারে ভাজা না হয়ে যদি আমাদের ‘ইস্টাইলে’ বেসন আর লঙ্কাকুচিতে ভাজা হত তা হলেও কি এতটাই পাগলামি থাকত?
ফুল থেকে সরে এসে এ বার ফলের কাছে গেলাম। ময়দা আর ঈস্ট দিয়ে বানানো বেসের উপর টোম্যাটোর বদলে কুমড়োর সস্। নাম ‘পামকিন পিত্জা’। টপিং হিসাবে নরম গরম মার্সমেলোর পরশ। জীবনে এই একটাই জিনিস খাওয়া বাকি ছিল— মিষ্টি পিত্জা, সেটাও হয়ে গেল এ যাত্রায়। কিন্তু এই মিষ্টি-পিত্জা ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতার ময়রাদের এ বার ভেবে দেখার সময় এসেছে। আধুনিক বাঙালি প্রজন্মের নতুন আগ্রহ পিত্জার সঙ্গে সাবেকি বাঙালিয়ানার মাইলস্টোন দই-সন্দেশকে যদি একটু মিলিয়ে দেওয়া যেত, তা হলে ভাইফোঁটার ভাল থিম হতে পারত কিন্তু!

মেলায় ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার দু’ধারে সাজানো কুমড়োর কেক, কাপকেক, কুকিস, প্যানকেক, চিজকেক, ব্রাউনি, ব্রেড, পাই, পাফ, ডোনাট, প্রেটজেল, ওয়েফেল, ক্যান্ডি ইত্যাদি চোখে পড়ল। আমি একটু মিষ্টির ভক্ত, তাই এর মধ্যে থেকে বেছে নিলাম পামকিন আইসক্রিম আর চিজকেক। দক্ষিণের ধোসার আদলে তৈরি, চালের বদলে এখানে ময়দার লেই দিয়ে বানানো পাতলা রুটি ক্রেপস, সেখানেও পেলাম কুমড়োর ছোঁয়া। এতে আবার কুমড়োর মাখন লাগানো। কুমড়োর স্বাদ ও গন্ধযুক্ত এই বিশেষ মাখন আজ ব্যস্ত নাগরিক জীবনের জাঁতাকলের চক্করে আধুনিক হেঁশেল থেকে প্রায় উধাও হতে বসেছে। আমাদের কাসুন্দি, পাঁপড়, বড়ির মতোই দুর্লভ সব কুমড়োর পদ যেমন পামকিন সস্, পিকল, মাখন— এই মেলা থেকেই আজকের সদাব্যস্ত কর্মরত গৃহিণীরা বয়াম ভর্তি করে কিনে নিয়ে যান। ঠাকুমা-দিদিমাদের পরিশ্রমসাধ্য সেই রেসিপি কিছু প্রফেসনাল শুভানুধ্যায়ীর দৌলতে (ভায়া এই মেলা) আজও কুমড়ো প্রিয় মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করে চলেছে।

এই পর্যন্ত লেখাটি পড়ে যাদের ভ্রূ ঈষত্ কুঞ্চিত, সেই সব ঝাল-মশলা বিলাসিদের জন্য এ বার জানাই সুখবর। তাদের কথা ভেবেই বানানো ‘পামকিন চিলি’। পামকিন পিউরি, মাংসের কিমা বাটা আর নুন-লঙ্কা গুঁড়োর রগরগে ত্রিসঙ্গম। সাধারণত হটডগের সঙ্গে মাস্টার্ড সস্ বা টোম্যাটো কেচাপ আর বার্গারের সঙ্গে মেয়োনিজ চলে। কিন্তু পামকিন ফেস্টে এলে এ সব ধরা বাঁধা নীতিকথাকে তুলে রাখতে হবে। মেলার খাবার খেতে হলে যেমন ক্যালোরি, হাইজিন এ সব বিষয়ে প্রশ্ন করা মানা, তেমনি পামকিন ফুড ফেয়ার উপভোগ করতে হলে সব বাছবিচার ভুলে ওই পামকিন-চিলি সহযোগেই কী মাংসের রোল, কী ফিশ অ্যান্ড চিপস, হটডগ থেকে সাব, বার্গার পর্যন্ত সব চাখতে হবে, এটাই দস্তুর।

বার্গারের কথায় মনে পড়ে গেল, ‘পামকিন জো’ বলে আরও এক ধরনের বার্গার মেলে এখানে। ওই পামকিন চিলি টাইপই একটা পুর, সঙ্গে ভাজা পেঁয়াজ। কিন্তু কোথাও যেন আলাদা ওই সস্-এর থেকে। হতে পারে রাঁধুনির হাতের জাদু।

ব্রেড

চিজ কেক

আইসক্রিম

কুকিজ

কাপ কেক

ওয়েফেল

প্যান কেক

‘পামকিন ডাম্পলিং’ বলে আরও একটা জিভে জল আনা উপাদেয় পদ আছে। পরিচয়ে মোমোর আদল কিন্তু অন্তরে নেই মশলার পুর। ‘সেদ্ধ-টেদ্ধ’ টাইপ শান্ত স্বভাবা মোটেই নয় সে। বরং অনেকটা তালের বড়ার মতোই কুমড়োর কমলা নরম শাঁসের সঙ্গে ময়দা মেশানো, ছাঁকা তেলে ভাজা ছোটখাট পিংপং। কামড় বসালেই তেল টুপটাপ ইলশেগুঁড়ি।

বাড়াবাড়ি মনে হল? তা হলে মনকে সান্ত্বনা দিতে আছে ‘পামকিন-ট্যাকো’। নামে মেক্সিকান হলেও আসলে আকারে প্রকারে মায়ের হাতে তৈরি গরম গরম রুটিতে মোড়া কুমড়োর তরকারি। তবে কিনা অ্যাভোগাডো দিয়ে বানানো ‘গুয়াকামোলে’-র টাকনাটা কল্পনা করে নিতে হবে। আর সে জন্যই ওটা রুটি-তরকারি আর এটা কেতা মারা ‘ট্যাকো’।

পানীয়তে গলা না-ভেজানো পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণ হয় না। পামকিন নিয়ে এত কিছু যখন বললাম, তখন এটাই বা বাকি থাকে কেন! কিন্তু এই পানীয়তে এসেই থমকে গেলাম আমি। হাতেগোনা কয়েকজন রাঁধুনি ছাড়া ব্যাপারটায় তেমন একটা উত্সাহ নেই কারওরই— কি ক্রেতা, কি বিক্রেতার। কুমড়োর শাঁস, ক্রিম, চিনি সহযোগে বানানো ‘স্মুদি’ বিক্রি হচ্ছিল বটে, কিন্তু অন্য ফলের সঙ্গে ‘পাঞ্চ’ করতে গিয়ে, পামকিনের নিজস্বতা হারিয়েছে। মানছি, তখন গরমের হাঁসফাঁসানি ছিল না, ‘ফল’ ঋতুর মৃদুমন্দ বাতাস তখন ঠান্ডার দিকেই পাল্লা ঝুকিয়েছে। তা বলে পানীয় নিয়ে কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে না? তবে পামকিন আর চকোলেট দিয়ে বানানো একটা গরম পানীয়, যেটা আমার কাছে হতাশ হতে হতেও একটা বড় পাওয়া।

এই মেলাতে জিভে জল আনা কুমড়োর অনেক পদের সন্ধান পেয়েছি। সত্যি বলতে কি কুমড়ো নিয়ে বেশ কিছুএক্সপেরিমেন্টও ঘুর ঘুর করছেমাথায়, যেমন পামকিন-আইসক্রিম যদি হয়, তবে আমাদের দই বানানো যাবে না কেন? হট চকোলেট যদি হয়, তবে কুমড়োর-চা/ কফিই বা কী দোষ করল? কুমড়োর স্মুদির মতো লস্যিই বা নয় কেন? যাগগে, থাক। এ সব আমার একান্তই নিজস্ব ভাবনাচিন্তার ফসল!

শুধু যাওয়ার আগে, উত্সাহী পাঠকদের জন্য একটা গোপন ও জরুরি পরামর্শ— দারুচিনির গন্ধ সহ্য হয় তো? কুমড়োর প্রায় সিংহ ভাগ পদেই কিন্তু এই জিনিসটা লেজুড় হয়ে থাকবে। বলা যায় এরা দুই হরিহর আত্মা। এক জন থাকলেই অবধারিত ভাবে অন্য জন হাজির হয়ে যাবেন। যাদের এই লেখাটিকে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে, তাদের জন্য বলি ‘মেলাবে ও মিলিবে’ এর যোগফল যদি হয় ‘মেলা’, তবে জিভ খোলা রেখে, মধ্যপ্রদেশ দিয়ে সব কিছুকে সাদরে আপ্যায়ন জানানোর নাম কিন্তু ‘পামকিন ফুড ফেস্ট’।

ছবি: লেখক

এই লেখকের অন্য প্রবন্ধ


Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • আপনার রান্নাঘর চিঠি পুরনো সংস্করণ

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.