১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ শুক্রবার ১ জুন ২০১২



 
বৈশাখ বন্দনায় রাতভর ‘মেলা’
মেলায় হঠাত্ই একটা ‘খুন’ হল! এবং তার পরেই রক্তাক্ত সে মেলার ‘মৃত্যু’! সেই মৃত্যু থেকেই আর একটা মেলা ‘জন্ম’ নিল। বুরুডির মেলাকে এ ভাবেও দেখা যায়!

মানবাজার থেকে ডাক্তার সুরজিৎ সিংহ হাঁসদার গাড়িতে যাচ্ছি, সঙ্গে সাংবাদিক বন্ধু সমীর। আজ সারা রাত জাগতে হবে! কেন না যে মেলাটা দেখতে যাচ্ছি, সেটা নাকি সারা রাত জেগেই থাকে!

পৌঁছে দেখলাম, বিষয়টা সত্যি-ই!

অমন ক্লান্তিহীন— জাগন্ত আর ভরন্ত মেলায়, গাছের নীচে হঠাত্ই আমার ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখি, একটি আদিবাসী পরিবারের সঙ্গে শেষ রাতের ঘুমটা আমি সেরে নিয়েছি। বাচ্চা-কিশোর-কিশোরীরা তখনও ঘুমিয়ে। কানের কাছে বেলডি-বাকড় গ্রামবাসী অন্ধ গায়ক ধীরেন মুর্মু গান গেয়ে মাধুকরী করছেন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে, রাস্তার ধারে। বন্ধুরা— সুরজিৎ ও সমীর, রাতের শুরুতেই মেলায় চরকি পাক দিয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছেন। থেকে গিয়েছি আমি।
বাংলার ১৩৮৬ সাল পর্যন্ত এই মেলাটাই বসত বোরো থানা থেকে মাইল দুই দূরের বোরো গ্রামে। মানবাজার থেকে বান্দোয়ানের পথে পিচ রাস্তা থেকে মাইল দুই ভেতরে গেলেই দেখতে পাওয়া যেত মেলার আয়োজন। আর এক দিন সেখানেই ঘটে গেল মর্মান্তিক সেই ঘটনা। সাঁওতালদের সঙ্গে শবরদের বিবাদের জেরে মেলার ভেতরেই খুন হলেন পালু টুডু!

আর পালু টুডু-র ‘আত্মা’ই মেলাটাকে সরিয়ে আনল ওই পিচ ঢালা সড়কের গা-লাগা মাঠ বুরুডিতে। মানবাজার থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরের এই পিচ রাস্তাটা মেলার রাত্রে ঢুকে যায় আদিবাসীদের নাচ ও গানের ভিতরে। ১৯৮০ সালে এই মেলার জন্ম। সে দিনের সেই মেলা আজ দেখতে দেখতে ৩২ বছর পার করে ফেলল!

বৈশাখী এই মেলাটা শুধুমাত্র সাঁওতালদেরই। তাই এখানে এই সময়ে এসে পড়েন ভিন্ জেলা বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া ও বাঁকুড়ার আদিবাসীরা। আমাকে সমস্ত মেলাটার এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সে দিন বুঝিয়ে দিলেন ‘পালু টুডু স্মৃতি রক্ষা কমিটি’র সম্পাদক রামেশ্বর হেমব্রম। কী কী নিয়ম মেনে মেলায় ঘুরব তা-ও বুঝিয়ে দিলেন সভাপতি হরিপদ মান্ডি। মেলা কমিটির দাবি, পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার আদিবাসী মানুষের জমায়েত হয় এখানে। তার মধ্যে কিশোরী ও যুবতীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আজ অবধি মেলায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মেলা শুরুর আগে পালু টুডু-র বেদিতে ফুল-মালা দিয়েছেন সকলে। তার পর মেয়েরা সেজেছেন ও পুরুষেরা ধামসা-মাদলে ব্যস্ত হয়েছেন।
মেলায় শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়— ঝাড়খণ্ড, দুমকা, পুরুলিয়া মিশে যায়। মেলাটা যখন সাজুগুজু শুরু করছে, তখনই, পিচ রাস্তা ধরে হাঁটা দিলাম কিলোমিটার খানেক। বোরো থানার কাছে কৃত্তিবাস মাহাতোকে জাগিয়ে সাইকেল নিলাম। যে মেলার নব যৌবন চলছে তার উৎসস্থল— আদি মেলার স্থল, কিছুটা আলপথ ধরে, বার কয়েক ঠোক্কর খেতে খেতে বোরোর শিব মন্দির প্রাঙ্গনে পৌঁছলাম তিন কিলোমিটার টপকে। সেখানেও দেখলাম অদ্ভুত ব্যাপার। সারা রাতের গানের আসর। এখানে যোগীন্দ্র মাহাতোর সমাধি মন্দির আছে। মেলায় তখন চলছিল বাউল গান। তবে, আমাকে টানছে যে বুরুডি। কেন না সেখানে মেলার যৌবন। ডাকছে যৌবনমেলা।

আট কিলোমিটার প্যাডেল ঘুরিয়ে পেটে তখন রাহুর খিদে।

‘ডাকা, ডাকা ডাকা। ডাকা আগুই মে।’ ‘ডাকা’ শব্দের অর্থ আদিবাসী ভাষায় ভাত। বড় করে রং বেরঙে লেখা, ‘আলেয়া সরভর রে’ মানে— বুরুডি কচিপাতা হোটেল। এত হোটেল! হবেই তো। “সারা রাতে হাজার হাজার মানুষ খাবে না!” বললেন পড়শি গ্রাম বসন্তপুরের দিকু সোরেন। ‘প্লেট সিস্টেম’ আট টাকা— ভাত তরকারি ডাল। আর ‘মিল সিস্টেম’ ২০ টাকা— মাংস ভাত। ‘ডাকা উতু নাঞাম কানা’, অর্থাৎ ওই টাকাতে আরও ভাত পাওয়া যাবে। ‘আলেয়া ডাকা জিল হাকু নে মঃ আ’— আমাদের হোটেলে ভাত মাছ মাংস পাওয়া যাবে। আমার সাঁওতালি ভাষার জ্ঞান শুধু ওই দু’ তিনটে বাক্যেই সীমাবদ্ধ। তাও উচ্চারণে ভুল আছে বলেই মানি।

খাব কি? সুন্দর সুন্দর, আমাদেরই পূর্ব দেবতাদের এত মনোযোগ দিয়ে কখনও দেখেছি? কালো বলেই হাসি এত সুন্দর। কত রকমের গয়না! কত রকম পোশাকের রং! খাবারে শুধু বেশি ঝাল এই যা!
বোরো ব্লকের ডাঙরড়ি মোড় থেকে দক্ষিণে রামপুর এবং পুব দিকে মেলাটা কত দূর পর্যন্ত ডালপালা ছড়িয়েছে তা আন্দাজ করতে পারার ক্ষমতা নেই আমার। দেখলাম পাতা নাচ। দেখলাম জ্যান্ত মাদল। বড় বড় আঁড় বাঁশির দোকান। শিখলাম অনেকটা। কত ভদ্র ও শান্ত। মেলায় কোলাহলের ভিতর নেই ‘আদম’ অথবা ‘ইভ-এর ইঙ্গিত। দেখলাম না কোনও পুলিশও। হোমগার্ড ছাড়াই মেলাটা আপনি আপনিই এত সুশৃঙ্খলিত! তবে মেলায় যেমন পুরনো জিনিস বিকোচ্ছে তেমনি এসে গিয়েছে ভিডিও এবং বিলিতি মদ!

গয়না ও সাজার দোকানে ভিড়, সেখানে যুবতী-কিশোরীরাই বেশি। খোলা আকাশের নীচে এমন এমন সঙ্ঘবদ্ধ মেলা সত্যি-ই বড় বিস্ময়ের। প্রচুর আদিবাসী ভাষায় বইয়ের দোকান। সেখানে বাচ্চাদের ভিড় প্রচুর। হয়তো এরা খুঁজে পাচ্ছে অলচিকি হরফে নিজেদের সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস। কত অচেনা জিনিস কিনলাম। লম্বা লম্বা বুনো সিম। সেগুলো ভিজিয়ে ছোবড়া হয়। তাই দিয়ে ঘরের দেওয়াল ও মেঝে মাজার কাজ খুব সুন্দর হয় নাকি!

ভোরের আলোয় মেলার অন্য রূপ। মেলাটায় তখন রাত জাগার ক্লান্তি। খোলা আকাশের নীচে ঠান্ডা বাতাসে রাতের ক্লান্তি কাটিয়ে সূর্য উঠছে ধীরেসুস্থে। মেলাটা চলতে শুরু করেছে ঘরের দিকে।

কিছু কথা...
কোথায়, কী ভাবে এবং কবে: পুরুলিয়া থেকে মানবাজার ৫২ কিলোমিটার। এই পথ যাওয়ার জন্য বাস বা গাড়ি পাওয়া যায়। মানবাজার থেকে বুরুডির মেলাস্থল সতেরো কিলোমিটার। এখানে কিন্তু কোনও হোটেল নেই। সে ক্ষেত্রে পুরুলিয়া থেকে ভাড়ার গাড়িতে এসে, রাতে মেলা দেখে, সকালে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। মানবাজারে ছোটখাটো হোটেল আছে। তাই এখানে থেকেও মেলা দেখা যেতে পারে। প্রতি বছরের ৩ ও ৪ বৈশাখ মেলা আয়োজিত হয়, বাঁধা দিন।

ছবি: সমীর দত্ত


রোজের আনন্দবাজার এ বারের সংখ্যা সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর স্বাদবদল চিঠি পুরনো সংস্করণ