আপনার কলমে...
১৬ পৌষ ১৪১৮ রবিবার ১ জানুয়ারি ২০১২


অসলো-নরওয়ের ভ্রমণবৃত্তান্ত
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নরওয়ে ছিল আমাদের এবারের ইউরোপ ভ্রমণের বিশেষ আকর্ষণ। ইউরোপের উত্তরভাগের এই দেশের রাজধানী অসলো।

অসলোর রাউণ্ড ট্রিপ এয়ার টিকিট কাটা ছাড়াও “নরওয়ে ইন আ নাটশেল” ট্রিপ সম্পর্কে ইন্টারনেটে তথ্য জেনে অগ্রিম বুকিং করে নিয়েছিলাম। কারণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ফিয়র্ড, জঙ্গল, পাহাড়, ঝর্ণা নিশ্চিন্তে উপভোগ করার জন্য এই ধরণের ব্যবস্থাই সুবিধাজনক। আমাদের ট্রিপ ছিল অসলো টু অসলো— সকালে অসলো থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে রাত্রে আবার এখানেই ফিরে আসা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য “নরওয়ে ইন আ নাটশেল”-এর অন্যান্য ট্রিপও আছে। যেমন অসলো টু বার্গেন, বার্গেন টু বার্গেন, প্রভৃতি।
অসলো ফিয়র্ড অপেরা হাউস

অসলো গারদেমোওন এয়ারপোর্টে নেমে প্রথমেই নরওয়ের ক্রোনার কিনে নিলাম, এক ইউরোতে প্রায় আট ক্রোনার। ট্যুরিস্ট অফিস থেকে শহরের একটি ম্যাপও চেয়ে নিলাম। তাতে বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান চিহ্নিত ছাড়াও মেট্রো, বাস ও ট্রামের ম্যাপ দেওয়া থাকে। এ ছাড়া থাকে ঘন্টা হিসেবে ‘অসলো পাস’। চব্বিশ, আটচল্লিশ ও বাহাত্তর ঘন্টা অনুযায়ী তিন ধরণের পাস পাওয়া যায়। এতে ফেরি, বাস, ট্রাম এবং প্রায় সবকটি উল্লেখযোগ্য মিউজিয়ামের টিকিটও অন্তর্ভুক্ত। এয়ারপোর্ট থেকে অসলো সেন্ট্রাল স্টেশন যাওয়ার ট্রেনের পাস থাকার জন্য কিছু ছাড় পাওয়া যায়। আমাদের হোটেল একটি মেট্রো স্টেশনের খুব কাছেই ছিল। অসলো সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে মেট্রো করে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। এই শহরের যানবাহন পরিষেবা বেশ নিয়মিত, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা পৌঁছতে কোন অসুবিধাই হয় না। আরও একটি অভিনব প্রয়াস হল এখানে যত্রতত্র সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় যাতে চড়ে অনায়াসেই শহরটি ঘুরে দেখা যায়। আর এতে প্রকৃতিও দূষণমুক্ত থাকে। অসলোর যে হোটেলে আমরা ছিলাম সেখানে তিনজনের প্রতি রাতের ভাড়া ১৭০ ইউরোর কাছাকাছি। ব্রেকফাস্ট নিয়ে। খুব ভোরে ব্যাগে করে ব্রেকফাস্ট দরজার বাইরে রাখা থাকত— জুস, স্যান্ডউইচ, ফল ইত্যাদি। রিসেপশনে সবসময় চা কফি পাওয়া যায়। এছাড়া হোটেলের নীচে ‘ডেনি ডে লুকা’ রেস্তোরাঁয় পরিচিত নানা ধরণের খাবার পাওয়া যায়, যেমন চিকেন বা পনিরের টিক্কামশালা, তন্দুরি, ভর্তা ইত্যাদি— স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় যা অপ্রত্যাশিত।

হোটেল থেকে হাঁটাপথের দূরত্বে ফেরিঘাট হওয়ায় মালপত্র ঘরে রেখেই বেরিয়ে পড়লাম। “হপ অন হপ অফ” ক্রুজে চড়ে ঘুরে নিলাম অসলো ফিয়র্ডের গতিপথে সৃষ্ট লেক। পাহাড় ও হিমবাহের ঘর্ষণের ফলে যে অশ্বক্ষুরাকৃত দ্বীপের সৃষ্টি হয় তাকেই ফিয়র্ড বলে। শহরের নাম, পাশে অবস্থিত অসলো ফিয়র্ডের নামানুসারেই। ফেরি থেকে চোখে পড়ল অসলো অপেরা হাউস ও বিগডয় দ্বীপে অবস্থিত ফ্রান এবং কনটিকি মিউজিয়াম। এই “হপ অন হপ অফ” ক্রুজের উল্লেখযোগ্য অবশ্যই এদের কুচো চিংড়ির ডিশ ‘ট্রাডিশনাল শ্রিম্ফ বাফে’। সন্ধ্যায় সেন্ট্রাল স্টেশনে গিয়ে ইন্টারনেটে বুক করা “নরওয়ে ইন আ নাটশেল”-এর কনফার্মেশন নাম্বার দেখিয়ে টিকিটগুলি নিয়ে নিলাম। এতে ট্রেন, বাস ও আরেকটি ফিয়র্ডের ক্রুজের টিকিট অন্তর্ভুক্ত। পরদিন ভোরবেলা এই ট্রিপের যাত্রা শুরু। অসলো সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেনে করে প্রথমে মিড়ডাল-এর উদ্দেশে। শহর ছাড়িয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল পথের দুধারে পাহাড়, ঘন শ্যাওলা সবুজ আস্তরণে ঢাকা। পাহাড়ে ছড়ানো নুড়ির মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে নেমে আসা স্ফটিক স্বচ্ছ ঝর্ণা । আর পাহাড়ের গায়ে চরে বেড়ান ছাগল, হরিণ, খরগোশ।

অসলো থেকে মিড়ডালের পথে ব্লু আইস হিমবাহ
নরওয়ের রেলওয়ে প্রশংসনীয়ভাবে পরিচ্ছন্ন। পার্বত্য উপত্যকা ও অসংখ্য টানেল পাহাড়ে পাহাড়ে যোগাযোগ স্থাপন করে যাত্রাপথ সহজ ও সুগম করে তুলেছে। মিড়ডাল-এর কিছু আগে ফিনসে নামে একটি স্টেশনে ট্রেন কিছুক্ষণ দাঁড়াল। প্ল্যাটফর্ম থেকেই দেখা যাচ্ছিল সুবিশাল “ব্লু আইস” হিমবাহ। তার মধ্যে টলটলে নীল জলের লেক, চারদিকে বরফের পাহাড় দিয়ে ঘেরা। নরওয়ের সবথেকে উঁচু রেলস্টেশন ফিনসে। কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। জামাকাপড়ের উপর ভারি জ্যাকেট চাপিয়েও যেন শীত ঠেকানো যাচ্ছিল না। অসলো থেকে পাঁচ ঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগে মিড়ডাল পৌঁছতে। এখানে ট্রেন বদল করে উঠলাম পৃথিবীখ্যাত ফ্লাম রেলওয়েতে। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথটির যাত্রাপথ প্রধানতঃ নিম্নগামী। পথিমধ্যে দাঁড়াল এক অনিন্দ্যসুন্দর ঝর্ণার ধারে। সুউচ্চ পাহাড়ের উপর থেকে সগর্জনে নেমে আসছে। আরেক চমক অপেক্ষা করে ছিল আমাদের জন্য এখানে। ট্রেন থেকে নেমে একটু দাঁড়াতেই ঝর্ণার গর্জন ছাপিয়ে বেজে উঠল নরওয়েজীয় বাজনা। আর তার তালে তালে পাহাড়ের উপর ঝর্ণার ধারে এক মানবীর নাচ। নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে কল্লোলিত ঝর্ণার পাশে এই নৃত্যগীত এক অপার্থিব অনুভূতি এনে দেয়।
ফ্লামের পথে সেই ঝর্ণা সি-গাল পাহাড়ের ঢাল
বাকি পথটুকুতেও সবুজ গালিচায় মোড়া পাহাড়গুলি মাঝেমধ্যেই খুব কাছে চলে আসছিল। তারই মাঝে ছোট বড় বিভিন্ন মাপের ঝর্ণা নেমে আসছে দুদিকের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। মিড়ডাল থেকে ফ্লাম পৌঁছাতে মোট সময় লাগল পঞ্চাশ মিনিটের মত।

ফ্লাম থেকে আমরা উঠলাম ফিয়র্ড ক্রুজে। বোট দাঁড়িয়েই ছিল। “নরওয়ে ইন আ নাটশেল” এর যাত্রীদের অগ্রাধিকার। জাহাজে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল ফিয়র্ড ক্রুজ। মাথার উপরে সি-গাল উড়ছে আর দুপাশে বরফ গলা নীল জল। এই ফিয়র্ডটি নরওয়ের বৃহত্তম ও পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম ফিয়র্ড সোগনেফিয়র্ডের (Sognefjord) একটি শাখা। বোট কিছুদূর এগোতেই দুধারে দেখা গেল গগনচুম্বী পাহাড়ের ঢাল। জনপ্রাণীহীন। এদিকে ঠাণ্ডার কারণে জনবসতি বিশেষ গড়ে ওঠেনি। প্রকৃতি এখনও নিষ্কলুষ। জুন মাস বলে অবশ্য ঝকঝকে উজ্জ্বল দিন। তবে প্রবল শীত। বসন্তেও শুনেছি এর রূপের তুলনা হয় না। ক্রুজের শেষ অধ্যায় আরেকটি ফিয়র্ডের মধ্যে দিয়ে— ন্যারোফিয়র্ড (Naeroyfjord), যা ইউনেসকো ওর্য়াল্ড হেরিটেজ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। আমাদের ক্রুজ শেষ হল গুডভাঙ্গেনে গিয়ে। মোট সময় দুঘন্টার কিছু বেশি।

পাড়ে নেমেই চোখে পড়ল বাস প্রস্তুত। বাস নিয়ে চলল সওয়া ঘন্টাখানেক দূরত্বের গন্তব্য ভোস্-এ। পাহাড়ি রাস্তায় বাসের অভিজ্ঞতা নতুন নয়। কিন্তু এত সর্পিল পথ ও ক্ষণেক্ষণে চুলের কাঁটার মত বাঁক থাকা সত্ত্বেও পটু নরওয়েজীয় চালকের প্রচেষ্টায় তা বোঝার উপায় ছিল না। এই পথটির দুধারে বার্চ ও পাইন গাছের জঙ্গল। ভোস্ থেকে ট্রেনে রাত সাড়ে দশটায় অসলো ফিরে এলাম এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে।

আকেরসুস ক্যাসেল
পরদিন অসলোর বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখে নিলাম এক এক করে। সবথেকে ব্যয়বহুল দোকানে সাজান অসলো শহরের প্রধান রাস্তা কার্ল জোহানস্ গাটে। এই রাস্তার এক প্রান্তে রয়্যাল প্যালেস এবং অন্যপ্রান্তে অসলো সেন্ট্রাল স্টেশন। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি ও কেনাকাটি করা হল। এরপরে সোজা চললাম ফিয়র্ডের দিকে। এখানে ফেরিঘাটের বাঁদিকে আকেরসুস ক্যাসেল ও ডানদিকে নোবেল শান্তি মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামে মাদার টেরিজা, নেলসন ম্যাণ্ডেলা, মহম্মদ ইউনুস ও অন্যান্য নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের জীবনী ও কীর্তি বর্ণিত আছে। ফেরিতে গেলাম বিগডয় দ্বীপে। কন-টিকি মিউজিয়াম ও ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম দেখলাম। ভাইকিং মিউজিয়ামে ভাইকিংদের জাহাজ, সমাধিকক্ষ ও আসবাবপত্র রাখা আছে। কন-টিকি মিউজিয়ামে খর হায়ারডালের পলিনেশিয়া অভিযানে ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও বালসা কাঠের তৈরি ভেলা সংরক্ষিত আছে। সেই ইতিহাসও সবিস্তারে বর্ণনা করা রয়েছে দর্শকদের জন্য। মানব-জাতি বিশেষজ্ঞ ও অভিযাত্রী খর হায়ারডাল আদতে ছিলেন ভূগোল ও প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র। তবে ভেলায় করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে তুয়ামোটু দ্বীপ, এই ৮০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রমই তাঁর নাম জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়।

এর পরের গন্তব্য অসলোর ভিগেল্যাণ্ড স্কাল্পচার পার্ক। এটি গুস্তাভ ভিগেল্যাণ্ডের কল্পনাপ্রসূত। প্রায় পঞ্চাশ ফুট লম্বা গ্রানাইটের একটি মনোলিথিক স্তম্ভ আছে। স্তম্ভের গায়ে খোদাই করা ১২১টি মানব মূর্তি, যারা একত্রিত ও আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছে। এটিতে ঘটেছে স্থাপত্য ও আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন। আবার ‘বেবি-থ্রোয়ার’-এর মূর্তিতে বেশ পাশবিক অভিব্যক্তি।

বিকেল শেষ হয়ে আসছে। হাতে বেশি সময় নেই। এরপর ছুটলাম হোলমেনকোলেন-এর স্কি টাওয়ারে, যা ইউরোপ তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম ও উচ্চতম স্কি টাওয়ারগুলির একটি। বর্তমানে এর আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। এর চূড়া থেকে অসলো শহর আর অসলো ফিয়র্ডের দ্বীপপুঞ্জ সুন্দর দৃশ্যমান। এখানে একটি স্কি মিউজিয়ামও রয়েছে। রাখা আছে সাদা ভালুক আর নানান রকম পশমের পোষাক, অস্ত্র ও স্লেজ। এখান থেকেই স্যুভেনির নিয়ে নিলাম— এখানের জাহাজ ও নরওয়ের ম্যাপ সদৃশ ফ্রিজ-ম্যাগনেট। আর নিলাম নরওয়ের রূপকথার দানব টোল। টোল সম্পর্কে কথিত আছে যে এরা খুব বুড়ো, মানুষখেকো, শক্তিশালী প্রাণী যারা পাথর দিয়ে মানুষকে আঘাত করে অথচ বিদ্যুত ও বাজের আওয়াজে পালিয়ে যায়। এদের নিয়ে অনেক গল্প আছে নরওয়ের ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য।

স্কি টাওয়ার থেকে যখন নামলাম ঘড়িতে তখন প্রায় দশটা। এক্ষুনি সন্ধ্যে হবে। আরেক বার চলে গেলাম ফিয়র্ডের ধারে। ফিয়র্ডের জলে যেন লাল আবির গোলা। জাহাজের মাস্তুলের ফাঁক দিয়ে বাঁকা চাঁদ উঠেছে। এক অপরূপ দৃশ্য যা ভোলার নয়।

অসলোতে সব মাল্টিন্যাশনাল ফাস্ট ফুডের দোকানই আছে। তবে ইউরোপের অনেক শহরের তুলনায় কিছুটা ব্যয়সাধ্য। নরওয়েজীয় ক্যুজিনে মাছের পদের আধিক্য। ওই দেশের স্পেশাল ব্রাউন চিজ খেলাম যা অনেকটা খোয়া ক্ষীরের মত। পরে এর কালাকাঁদ বানিয়েছিলাম। বেশ ভালো হয়েছিল।

এক কথায়: বরফ গলা জল যেখানে হ্রদের আকার নিয়ে ফিয়র্ড সৃষ্টি করেছে...
দূর থেকে তার ঘন নীল জল হাতে নিলেই রঙহীন, নিরাকার, অথচ পবিত্র স্বচ্ছ।
 
পেশা ঘর গড়া। নেশা বেড়ানো। স্বামীর অধ্যাপনার সূত্রে সুযোগও জুটে যায়। ছেলের শখ বিভিন্ন দেশের কয়েন সংগ্রহ করা। আমেরিকা, এশিয়া ও ইউরোপের নানা দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। বেড়াতে গিয়ে বা অবসর সময়ে পড়ি ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও লোনলি প্ল্যানেট।
ছবি: লেখক




রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ