|
||||
বক্সা টাইগার রিজার্ভ প্রজেক্ট | ||||
ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত | ||||
Two roads diverged in a wood, and I— I took the one less travelled by, And that has made all the difference — Robert Frost |
||||
‘two roads diverged in a wood...’ |
||||
আলিপুরদুয়ার শহর ছাড়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। শীতের সকালের মিঠে রোদ মেখে আমরা চলেছি বক্সা টাইগার রিজার্ভ। দূরে ছবির মতো বনবস্তি, রাস্তার ধারের সরষে খেত, হাতির হাত থেকে বাঁচার জন্যে ইলেকট্রিক তারের বেড়া, গাড়ির ইঞ্জিনের একঘেয়ে শব্দ ছাপিয়ে ঝিঁঝির ডাক— অরণ্য আস্তে আস্তে তার নিজস্ব রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে নিজেকে মেলে ধরছিল। ‘এন্ট্রি পয়েন্ট পারমিট’ দেখিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম আলিপুরদুয়ার থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে বক্সা টাইগার রিজার্ভ প্রজেক্টের কোর এরিয়ায়। এই অরণ্য জলপাইগুড়ি জেলার উত্তর পূর্ব প্রান্তে অসম ও ভুটান সীমান্তে ৭৬১ বর্গ কিলোমিটার (কোর এরিয়া ৩৬৯ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে। তরাই থেকে সিনচুলা রেঞ্জের ৫৬০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রাচীন বনানী ১৯৮৩ সালে টাইগার রিজার্ভ ও ১৯৯২ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষিত হয়। জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বনাঞ্চল বাঘ, হাতি, লেপার্ড, বাইসন, গাউর, সম্বর, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, প্রায় ১৪৬ প্রজাতির পাখি, শতাধিক রকমের প্রজাপতি ছাড়াও বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ আর অর্কিডের জন্য ‘নেচার’ ফটোগ্রাফারদের কাছে ভীষণ আকর্ষণীয়। তবে সিনচুলা রেঞ্জের বেশির ভাগ অংশই প্রচণ্ড দুর্গম, তাই সাধারণ পর্যটকদের কাছে আজও অধরাই। যদিও এই নদী-পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা সিনচুলা রেঞ্জ ট্রেকারদের স্বর্গরাজ্য বিশেষ। |
||||
|
||||
আর এই ট্রেকিং-এর টানেই আমরা এসে পৌঁছালাম সান্তারাবাড়ি (৯১৪ ফুট)। গাড়ি-পথের এখানেই শেষ। এখান থেকে হাঁটা পথের শুরু। গভীর জঙ্গলের বুক চিরে পায়ে চলা পথ চলে গেছে আরও গভীরে। এ পথের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। চারপাশে প্রাচীন শাল, সেগুন, জারুল, চাপরাশির জঙ্গল ভেদ করে আসা সূর্যের আলো আঁধারির খেলা। নাম না-জানা অজস্র পাখির কলতান আর পাহাড়ি ঝোরার বয়ে চলার ছন্দ মোহিত করে দেয়। ২ ঘন্টা ঘাম ঝরানোর পর, ৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম বক্সাদুয়ার (২৬০০ ফুট)। বক্সাদুয়ার উত্তরবঙ্গের প্রাচীন জনপদ। এখানেই রয়েছে ঐতিহাসিক বক্সা দুর্গ। ভুটান থেকে ভারতে আসার ১১টি রুটের মধ্যে অন্যতম বক্সাদুয়ার রুটের সুরক্ষার জন্য এই দুর্গ নির্মিত। ১৭৭৪ ও ১৮৬৫ সালের ভারত-ভুটান যুদ্ধের সাক্ষী এই দুর্গ। খাড়া পাহাড় ও গভীর জঙ্গলে ঘেরা দুর্গম বক্সা ফোর্ট পরে কুখ্যাত জেলখানায় পরিণত হয়। অরুণ গুহ, ত্রিলোক্য সেন, মেজর সত্য গুপ্ত, অমলেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখ স্বাধীনতা সেনানীরা এই দুর্গে বন্দি ছিলেন। স্বাধীনতার পর বক্সা ফোর্টের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ৬০ দশকে তিব্বতী রিফিউজিদের রিলিফ ক্যাম্প ছিল বক্সা ফোর্ট। ধর্মগুরুদের দৌলতে তখন এই ফোর্ট আন্তর্জাতিক মানচিত্রে উঠে আসে। আজ যেমন আমরা আমাদের স্বাধীনতা সেনানীদের ভুলতে বসেছি, তেমনই চরম অবহেলার শিকার বক্সা ফোর্ট আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শেষ বিকেলের কুয়াশা মাখা আলোয় এর ভগ্নদশা দেখে সত্যিই দুঃখ হয়। ফোর্ট ছাড়িয়ে আর একটু উঠে এলেই ছবির মতো বক্সা বন বাংলো ও ট্রেকার্স হাট। এখানেই আজ আমাদের রাত্রিবাস। বাংলোতে ইলেকট্রিসিটি নেই, তবে জলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ি ঝোরা থেকে জল সরাসরি পাইপের মাধ্যমে বাংলোতে পৌঁছে যাচ্ছে। পর দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙল অজস্র নাম না জানা পাখির ডাকে। এ বার বেরিয়ে পড়া রোভার্স পয়েন্টের (৪৬০০ ফুট) এর পথে। দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। পথে পড়বে কমলা বাগান, পাহারের ঢালে সারি সারি কমলালেবুর গাছ। তাতে থোকা থোকা কমলা ঝুলে আছে। অপরূপ দৃশ্য। রোভার্স পয়েন্ট থেকে আরও ১২ কিলোমিটার গেলে রূপম ভ্যালি (৫০০০ ফুট)। এখান থেকে দেখা যায় ছবির মতো ভুটান উপত্যকা। এ ছাড়া চুনাভাটি চার্চ, আদমা পুকুরির মতো ছোট ছোট ট্রেক রুটও আছে। |
||||
|
||||
দুপুরে বক্সা বন বাংলোতে খাওয়া সেরে নেমে আসার পালা। আমরা ফিরব অন্য পথে— মহাকাল হয়ে জয়ন্তী, দূরত্ব ১২ কিলোমিটার, উতরাই-ই বেশি, ফলে সময় কম লাগে। মহাকাল মন্দির আসলে স্ট্যালাকটাইট গুহা। শিব চতুর্দশীর দিন এখানে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। জয়ন্তীতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্য ও কারিগরী বিভাগের বাংলোতে। বাংলো একদম জয়ন্তী নদীর পাড়ে, উল্টো দিকে ভুটান পাহাড়। দূরে ভাঙা রেল ব্রিজ। ব্রিটিশ আমলে জয়ন্তীতে মিটার গেজ রেল যোগাযোগ ছিল। ‘আবার অরণ্যে’ ছবির শুটিঙের পর থেকেই জয়ন্তী এখন পরিচিত ট্যুরিস্ট স্পট। চন্দ্রালোকিত রাতে ব্যালকনিতে বসে তিরতির করে বয়ে চলা ফিতের মতো জয়ন্তী নদী, দূরের পাহাড়, জঙ্গলের নিজস্ব শব্দ— চুপি চুপি রাত বেড়ে চলে... চাঁদটাও হাতছানি দেয়... পর দিন ভোরে জিপে করে ২ ঘন্টার জঙ্গল সাফারি, সঙ্গে ইকো ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের গাইড। জঙ্গলের ভিতর নজর মিনার আছে— বাইসন, হরিণের দেখা মিলবেই। রাজাভাতখাওয়ার নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার ঘুরে এ বার ঘরে ফেরার পালা। না কি আবার বেরিয়ে পড়ার কাউন্টডাউন? Unequal laws unto a saving race, That hoard, and sleep, and feed, and know not me. I cannot rest from travel... |
||||
|
||||
|
||||
ছবি: লেখক আরও তথ্য জানতে... |
||||
রোজের আনন্দবাজার • এ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল • স্বাদবদল • আপনার রান্নাঘর • পুরনো সংস্করণ | ||||