আপনার কলমে...
১৪ কার্তিক ১৪১৮ মঙ্গলবার ১ নভেম্বর ২০১১


পিঁপড়ের সঙ্গে বনের পথে
ক বৃষ্টিভেজা সকালে আমরা সাত বন্ধু মিলে ঠিক করলাম পাঙ্গা অভয়ারণ্য ঘুরতে যাব। পাঙ্গা আমাদের সবার কাছেই নতুন। বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ উগান্ডাতে রয়েছে বছর পাঁচেক, কিন্তু এই অভয়ারণ্য তাদেরও দেখা হয়নি। উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় আমাদের কর্মক্ষেত্র ও বসবাস। আর কাম্পালা থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে পাঙ্গা। বাড়ির কাছে বলে এক দিনের অবসর-ভ্রমণের জন্যও বেশ ভাল।

গাড়িতে কাম্পালা-মাসাকা রোড হয়ে ৫০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম পাঙ্গা অভয়ারণ্যে। ভেতরে মাটির রাস্তা। বৃষ্টির পর খানিকটা পিছলও বটে! বাঁক নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল আমাদের গাড়ি। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ‘উগান্ডা ফরেস্ট অথোরিটি’র অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামল। ঘন লম্বা গাছে ঢাকা একটা ছোট বাঁশের তৈরি বাড়ি, সঙ্গে বাঁশেরই বানানো আতিথিশালা। তেমন রোদ না থাকায় আর লম্বা গাছের জন্য আলোআঁধারিতে বেশ লাগছিল। দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে অতিথিশালার একটি ঘরের দরজা খুলে দিল। বিশাল বাঁশের দরজা। লম্বা লম্বা পাইন গাছের সারি। তার ছায়াতেই গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। পাইনের ডালে লাল লেজওয়ালা ছোট ছোট বাঁদর লম্ফঝম্ফ করে বেড়াচ্ছে। অভয়ারণ্যের প্রবেশমূল্য জনপ্রতি উগান্ডার শিলিং (UGX) ১০,০০০। ভারতীয় টাকার মূল্যে আড়াই শো। বাঁদরের দলকে ‘টা টা’ বলে আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

যে কোনও অভয়ারণ্যেই নির্দিষ্ট রাস্তা বা ট্রেল থাকে ভ্রমণার্থীদের জন্য। হাঁটা শুরু করলাম মানচিত্র দেখে। মিনিট দশেক চলার পরে এক অদ্ভুত শব্দে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শুকনো পাতার ওপর চাল বা গম পড়ার ঝিরঝির শব্দ। কেউ ভাবল সাপ, কেউ ভাবল শুঁয়োপোকা। কিন্তু শুধু শব্দ শুনে আন্দাজ করা গেল না বলে মাটির উপর খুঁজতে লাগলাম শব্দের উৎস। কিছু ক্ষণের মধ্যেই দেখলাম পাতার নীচে একসঙ্গে প্রায় হাজার খানেক পিঁপড়ে। মানচিত্রে দেখলাম লাল কালিতে লেখা ‘সাফারি পিঁপড়ে থেকে সাবধান’। মনে পড়ল বইয়ে পড়া খুনি-পিঁপড়ের বৃত্তান্ত। এদের কামড়ে মারা যায় মানুষ। বাঁদর, পাখি প্রায়ই এদের ভোজ হয়।

এখানকার নিয়মে, অভয়ারণ্যের ভেতরে ঢুকলে গাইড পাওয়া যায়। আমাদের সঙ্গী হল টম। সামনে চারটি ট্রেল—
হর্নবিল ট্রেল: হর্নবিল পাখির বাসা সহ বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যায় এই পথে।
বেসলাইন ট্রেল: নানান পশুপাখিতে ভরা এই রাস্তা। ভাল করে ঘুরে দেখতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘন্টা।
বাটারফ্লাই ট্রেল: পঙ্কিল রাস্তা, তবে রঙিন প্রজাপতিতে ভর্তি।
ফ্যামেলি ট্রেল: এই পথে বেশি দেখা যায় বাঁদর।
আমরা বেছে নিলাম বেসলাইন ট্রেল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম সকাল ছ’টা, এখন বাজে আটটা। পেটে ক্ষিদের টান অনুভব হচ্ছে। তাড়াতাড়ি ব্রেড-জ্যাম খেয়ে শুরু হল পথ চলা।

প্রথমেই দেখা পেলাম এক দল হর্নবিলের। মগডালে বসে আছে সব জুটি বেঁধে। অল্প দূরত্বে দেখা দিল রসেস্ টুরাকো— নীল রঙের টুপি পরা পাখি। এর পর ১০০ মিটারের একটি টানেল পার হয়ে দেখি সারি বেঁধে সাফারি পিঁপড়ে— কয়েক সহস্র। এদের দু’টো দল— কর্মী আর রক্ষক। গর্ত করে চলেছে কর্মীর দল আর তাদের পাহারায় দু’ধারে রক্ষকরা (সংখ্যায় কর্মীর ১০ গুণ) সজাগ হয়ে রয়েছে। আমাদের এক বন্ধু একটু কাছে গিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করতেই রক্ষকের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আমরা সরে এলেও অনেক পিঁপড়ে পা বেয়ে গায়ে উঠে পড়ে। তখন বুঝতে না পারলেও, বেশ কিছু ক্ষণ পরে তাদের কামড়ে টের পেলাম। টম বলল, কামড় দেওয়ার আগে শব্দ বিনিময়ে একত্রিত হয়ে কামড়ায় এই পিঁপড়ে। আর শেষে মৃত্যুর সম্ভাবনাও থেকে যায়।
পাঙ্গা অভয়ারণ্যে থাকি আমরাও...
শুঁয়োপোকা মাকড়সা মথ সাফারি ইনসেক্ট
আমরা এগোতে লাগলাম বন্য রাস্তা দিয়ে বনজ ফল-ফুল দেখে আর ছবি তুলে। দেড় কিলোমিটার যাওয়ার পর ট্রেলের ঠিক মাঝখানে এক বিশাল বট গাছ তার শাখা আর উপশাখা নিয়ে ঘিরে রেখেছে রাস্তা। সব বন্ধুরা মিলে দোল খেলাম শাখা ধরে— এক যুগ পরে যেন ছোটবেলা ফিরে এল আবার। গুন গুন করে গান ধরলাম ‘দোলে দোদুল দোলে দুলনা’।

আবার পথ চলা। একটু এগোতেই দেখি একটা ঝর্না গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তার উপর দিয়ে। কী দারুণ দৃশ্য! এর মধ্যে আবার আকাশের মুখ ভার হয়ে এসেছে। হয়তো বৃষ্টি হবে। গল্প করতে করতে এসে পৌঁছালাম সরু একটা বাঁকে। পার হতে গেলে ঝোপ, জঙ্গল পার হতেই হবে। চললাম টমের নেতৃত্বে। ৫০০ মিটার এ ভাবে চলার পর একটি গাছের গায়ে লেখা রয়েছে ‘জায়ান্ট ফিগ ট্রি অ্যাহেড’— মানে ট্রেল প্রায় শেষ। পথের শেষ দেখার আশায় এগোতে লাগলাম। ফিগ গাছের আগেই দেখা পেলাম এক দল বিশেষ প্রজাপতির। তার পরেই দর্শন হল স্বয়ং রামভক্তের— বিশাল এক হনুমান রাস্তা দখল করে বসে আছে। অনেকটা বেবুনের মতো দেখতে। কিছু পরে অবশ্য নিজে থেকেই বিদায় নিল সে, যেন আমাদের ফটোগ্রাফির ইচ্ছের পরিতৃপ্তি ঘটাতেই তার আবির্ভাব হয়েছিল। আমাদের ১০০ মিটারের মধ্যেই সেই বিরাট ফিগ গাছ। নীচের পুরো জায়গাটা ফিগ ফলে ভরা। কিছু ফল পচে যাওয়ায় বাজে গন্ধ বেরোচ্ছিল। গাছ দেখতে গিয়ে খেয়ালই করিনি যে এটাও সেই ‘খুনি’ পিঁপড়ের রাজত্ব। কামড় খেয়ে, অনেক স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম ঘরের পথে। সঙ্গে থাকল এক সুন্দর বন্য রবিবারের অভিজ্ঞতা।
জায়ান্ট ফিগ ট্রি

এক কথায়: খুনি পিঁপড়ের রাজত্বে এক সুন্দর বন্য অভিজ্ঞতা।
 
শ্বশুর বাড়ি কেরলে হলেও আদতে বহরমপুরের মেয়ে। কর্মসূত্রে এখন উগান্ডার এডুকেশনাল এজেন্সিতে কর্মরতা। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বেড়ানোর হাতেখড়ি। বর্তমানে স্বামীর সঙ্গে জুটি বেঁধে দেশ দেখার নেশা। ভ্রমণের আকাঙ্খা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই কলম ধরা।
ছবি: লেখক

এই লেখকের আরও ভ্রমণকথা


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ