আপনার কলমে...
১৪ কার্তিক ১৪১৮ মঙ্গলবার ১ নভেম্বর ২০১১


মাচু পিচু-র সন্ধানে
ত্যজিত্ রায়ের চলচ্চিত্র ‘আগন্তুক’-এ ভূ-পর্যটক ‘মামা’ মনমোহন মিত্র পৃথিবীর অনেক দুর্গম জায়গায় গিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল ‘মাচু পিচু’।

‘মাচু পিচু’ আসলে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি শহর। দক্ষিণ আমেরিকার ইংকা জাতি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে পেরু দেশের কুস্কো শহরে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে আসেন আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক হাইরাম বিংহ্যাম (Hiram Bingham)। একদিন আকস্মিক ভাবে তিনি মাচু পিচুর কথা জানতে পারেন এক স্থানীয় কৃষকের কাছে। শেষে অনেক পাহাড়-জঙ্গল ঘুরে ১৯১১ সালের ২৬ জুলাই মাচু পিচু আবিষ্কার করেন তিনি। ২০১১ সালটা তাই বিশেষ ভাবে পালিত হচ্ছে মাচু পিচুর শতবার্ষিকী হিসেবে। শহরের ধ্বংসাবশেষ তখন জঙ্গল ও গাছপালায় ঢাকা। পরবর্তী তিন বছর ধরে সে সব পরিষ্কারের পর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দল গবেষণা করে প্রমাণ করেন যে এটা সত্যিই ইংকাদের হারিয়ে যাওয়া শহর। ধীরে ধীরে এই ‘লস্ট সিটি’র কথা ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের একটি এই ‘মাচু পিচু’ কিন্তু বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার!
প্রশান্ত মহাসাগরের দৃশ্য
বহু দিন থেকেই ইচ্ছে ছিল মাচু পিচু যাওয়ার। ‘আগন্তুক’ ছবিটা দেখার পর বাসনাটা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। জুনের প্রথম সপ্তাহে ভার্জিনিয়া থেকে টেক্সাসের হিউস্টন হয়ে পেরুর রাজধানী লিমা পৌঁছলাম। ২০ ঘন্টার বিমান সফর। বিমানবন্দর থেকে হোটেল যাওয়ার রাস্তাটি ভীষণই মনোরম। আসলে প্রশান্ত মহাসাগরের ধার ঘেঁষে গ্রিন কোস্ট (স্প্যানিস ভাষায় costa verde) হাইওয়ে ধরে হোটেল যাওয়াটা হৃদয়ে অদ্ভুত হর্ষ জাগায়।

কয়েকশো বছরের পুরনো এই লিমা শহরটি পার্ক দিয়ে সাজানো। রাত হয়ে যাওয়ায় শহরটা আর তখন দেখা হল না।

পর দিন সকালে কুস্কো শহরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। পেরু পর্বতময় দেশ। লিমা থেকে কুস্কো যেতে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়িতে লাগে ২৫ ঘন্টা, কিন্তু বিমানপথে মাত্র ঘন্টাখানেক। তাই বিমানেই গেলাম। সমুদ্রতল থেকে কুস্কোর উচ্চতা ১২০০০ ফুট— ভারতের লেহ শহরের প্রায় সমান। এই ধরনের উচ্চতায় বাতাস অনেক পাতলা, তাই অল্প পরিশ্রমেই মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায় প্রথম প্রথম। প্রথম দিনটা সে জন্য উচ্চতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য বরাদ্দ। জোরে হাঁটা বা দৌড়ানো নিষেধ। পরামর্শ মতো বারবার কোকা পাতা দিয়ে তৈরি (কী তেতো !) চা খেলাম দিনে অনেক বার।

এখানে দু’টি ভাষা প্রচলিত— স্প্যানিস (যা স্পেনীয় আধিপত্যের জন্য) এবং কেচুয়া (ইংকাদের আদি ভাষা)। কেচুয়াকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারি ভাবে একে পেরুর দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কেচুয়া ভাষায় ‘মাচু পিচু’ মানে ‘পুরনো পাহাড়’।

পর দিন সকালে প্রাতরাশের মধ্যে ছিল ‘পান’ নামক বিশেষ স্থানীয় রুটি, যা খানিকটা পঞ্জাবি নান-এর মতো। ‘মাতে দে কোকা’ (কোকা পাতার চা)-ও খেলাম অনেকটা। এর পর কুস্কো শহর দেখার পালা। পঞ্চদশ শতাব্দীতে কুস্কো ছিল বিশাল ইংকা সাম্রাজ্যের রাজধানী। ইংকা জাতির লোকেরা দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বসবাস করত, যা বর্তমান পেরু, ইকুয়েডর, চিলি প্রভৃতি দেশগুলি। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইংকাদের সভ্যতা বিকশিত হয়। তার পর ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে (১৫২৮-১৫৩২) স্পেন থেকে জাহাজে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে সাম্রাজ্যবাদী সৈন্য নিয়ে সেনাপতি ফ্রান্সিস পিসারো একের পর এক দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিকে আক্রমণ করে সেখানে স্পেনের আধিপত্য স্থাপন করতে থাকেন। ইংকাদের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল এবং তাদের মধ্যে ঝগড়া এবং যুদ্ধ লেগেই থাকত। এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে পিসারো ইংকাদের রাজা আতাহুয়াল্পাকে বন্দি করে মুক্তিপণ হিসাবে বিশাল পরিমাণ সোনা হস্তগত করে। পরে রাজাকে নৃশংস ভাবে মেরেও ফেলে পিসারো। তার পর একে একে ইংকাদের শহরগুলিকে প্রথমে দখল ও পরে আংশিক ভাবে ধ্বংস করে দেয়। পরে রাজধানী সরিয়ে লিমা শহরে নিয়ে গেলেও ইংকাদের একটি শহর, মাচু পিচুর কথা তারা জানতেই পারেনি। আন্দিজ পর্বতমালায় প্রায় আট হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত ছিল এই শহর। জায়গাটা দুর্গম এবং পাহাড়ের নীচে থেকে এর অস্তিত্বের হদিশ পাওয়া সম্ভব ছিল না।

কুস্কো ক্যাথেড্রাল *
ফিরে আসি কুস্কোর কথায়।

কুস্কো শহরের কেন্দ্রস্থলে বিখ্যাত কুস্কো ক্যাথেড্রাল। স্পেনীয় আক্রমণকারীরা ইংকাদের পরাজিত করে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়। ফলে অনেক পুরনো ইংকা মন্দির ভেঙে তার পাথরগুলো দিয়ে তৈরি হয় ক্যাথলিক গির্জা। এই ভাঙা-গড়া শুরু হয় ফ্রান্সিস্কো পিসারোর সময় থেকে এবং চলে পরবর্তী দু’শো বছর ধরে। ক্যাথেড্রালের বাইরেটা আর পাঁচটা বড় ক্যাথেড্রালের মতোই, কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চমকে যেতে হয়। অনেকগুলি উপাসনা মন্দির বা চ্যাপেল আছে ভেতরে। ছাদ ও দেওয়াল জুড়ে সিডার কাঠের বিশালাকার কিন্তু সূক্ষ্ম কারুকার্য অত্যন্ত বিস্ময়কর, যার অনেকাংশই সোনার পাত দিয়ে মোড়া। গির্জার দেওয়ালে টাঙানো আছে অনেক পেন্টিং; যেখানে স্পেনীয়, রোমান এবং স্থানীয় অংকন-শৈলীর মিশ্রণ। ছবিতে জীবনযাত্রার প্রভাবও লক্ষ করা যায়, যেমন ‘লাস্ট সাপার’ শীর্ষক ছবিটিতে খাদ্য হিসেবে দেখা যায় ইংকাদের প্রিয় খাদ্য ‘কুই’ বা এক ধরনের গিনিপিগকে। গির্জার ভিতরে ছবি তোলা কিন্তু নিষেধ।

ক্যাথেড্রাল দেখে তার পর পৌঁছালাম পেরুর অন্যতম নামকরা এবং প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ সাকসাইওয়ামান (sacsayhuaman)এ— মার্কিনরা রসিকতা করে বলেন ‘সেক্সি উওম্যান’! এটা একটি বিশালাকার পাথরের দুর্গ, যেখানে পাঁচ হাজার সৈন্য থাকত। চারপাশে ছিল তিন সারি দেওয়াল (লম্বায় ১৫০০ ফুট এবং ৫৪ ফুট চওড়া)। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরের পাহাড় থেকে বড় বড় পাথর এনে পাশাপাশি বসিয়ে তৈরি করা হয় এই দুর্গ। সিমেন্ট বা চুন, বালি ছাড়াই পাথরগুলো এমন করে বসানো যে সূচ ঢোকানোর মতোও জায়গা নেই ! ধ্বংসাবশেষের কেন্দ্রস্থলটি বৃত্তাকার— যাকে কেউ কেউ মনে করেন এক ধরনের প্রাচীন ক্যালেন্ডার। অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য মনে করেন যে এই জায়গাটা আসলে দুর্গ নয়, এটি একটি মন্দির।

দুপুরে খাওয়ার জন্য বাস থামল যেখানে, সেখানে পর পর পাঁচটি রেস্তোরাঁ। শুনলাম সব জায়গার খাবারই মোটামুটি একই রকম। পেরুর জনসংখ্যার মধ্যে চৈনিক ও জাপানিদের সংখ্যাও কম নয়। খাদ্যে তার প্রভাবও পড়েছে। শেষ পাতে চালের পায়েস পেয়ে বেশ ভাল লাগল। সন্ধেতে গেলাম ‘নেটিভ আর্ট সেন্টার’-এর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে। সারা দিনের দ্রষ্টব্য জায়গার টিকিটের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত এই অনুষ্ঠানের প্রবেশপত্র। পরম্পরার পোশাকে সেজে প্রাচীন সঙ্গীতের তালে স্ত্রী-পুরুষের সমবেত নাচ প্রদর্শিত হল। প্রতিটি নাচের সঙ্গেই একটি প্রাচীন কিন্তু সাধারণ মানবিক কাহিনি জড়িত।

পর দিন সকালে বেরোলাম মাচু পিচুর উদ্দেশে— যা দেখার জন্য এত দূর আসা। সুর্য ওঠার আগেই কুস্কোর পোরয় ট্রেন স্টেশনে পৌঁছলাম। এখান থেকে ছোট লাইনের ট্রেন ছাড়ে মাচু পিচু পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘আগুয়াস কালিএন্তেস’ স্টেশনের উদ্দেশে। স্পেনীয় ভাষায় ‘আগুয়াস কালিএন্তেস‘ মানে ‘গরম জল’। তিন ঘন্টার এই ট্রেন যাত্রাটা বড়ই মনোরম এবং মাচু পিচু যাওয়ার আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় দ্বি গুণ। পর্যটকদের আকর্ষণ ও সুবিধা বাড়ানোর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি পেরু রেলের মুকুটমণি এই ভিস্টাডোম (vistadome) ট্রেন। এই ট্রেনকে বিলাসবহুল হয়তো বলা যায় না, কিন্তু নিখুঁত ব্যবস্থা। ট্রেন ছাড়ার একটু পরেই এলেন প্রাতঃরাশের ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাত্রী-সেবক যুবক যুবতীরা। এঁরা সবাই সুদর্শন, সপ্রতিভ, বহুভাষী এবং সকলেই অনূর্ধ পঁয়ত্রিশ। খাদ্যের মান এবং পরিমাণ দুই-ই ভাল এবং দাম ধরা থাকে টিকিটের মধ্যেই। ওঁরা জানালেন সন্ধেয় যখন এই ট্রেন ফিরবে, এই কর্মী যুবক যুবতীরাই মডেল সেজে ট্রেনেই ‘ফ্যাশন শো’ দেখাবেন। এমন ব্যাপার পৃথিবীর আর কোথাও হয় বলে শুনিনি।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকেরা চলেছেন এই ট্রেনে চেপে। জানলার ধারের জায়গা আগে থেকে বুক করা ছিল। আমার আশপাশের সিটগুলিতে বসেছেন কলম্বিয়া থেকে আসা বাবা, মা ও দুই সন্তানের এক পরিবার এবং জার্মানি ও স্পেন থেকে আসা দুই ডাক্তার। কাজ চালানোর মতো স্প্যানিস ও জার্মান ভাষা জানা আছে বলে সবার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে সুবিধে হল। আন্দিজ পর্বতমালার গভীর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা উরুবাম্বা নদী, কুস্কো থেকে মাচু পিচুর দিকে। সেই নদীর একেবারে পাশ দিয়েই রেল লাইন। নদীও যেমন এঁকেবেঁকে চলেছে, তেমনি চলেছে রেল লাইনও। প্রায় প্রতি মিনিটেই দিক পরিবর্তন হচ্ছে ট্রেনের। এত ক্ষণে পাহাড়ে সূর্যোদয় হল, আর সেই সঙ্গে শুরু হল রৌদ্রছায়ার খেলা। এ দিকে চপলা হরিণীর মতো উরুবাম্বা নদীর উচ্ছ্বল তরঙ্গ ট্রেনের গতিকে হার মানাবার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। ট্রেনের সাউন্ড-সিস্টেমে বাজছে দক্ষিণ আমেরিকার এবং বিশেষ করে আন্দিজ অঞ্চলের সঙ্গীত। হঠাৎ মনে পড়ে গেল পুরনো হিন্দি ছবি ‘মধুমতী’র সেই বিখ্যাত দৃশ্য ও গান ‘সুহানা সফর অর ইয়ে মৌসম হাঁসি’। রেল লাইনের দু’ধারে উঁচু পাহাড়, যার চুড়ায় কোথাও কোথাও বরফ জমে আছে। পাহাড়গুলো এত খাড়াই যে শুধু পাশের জানলা দিয়ে পুরোটা দেখা সম্ভব নয়। তাই ভিস্টাডোম ট্রেনের ছাদ জুড়ে বড় বড় স্বচ্ছ জানলা, যা দিয়ে পাহাড়ের চুড়াগুলো দেখা যায়। সে দিকে তাকালে মনে হয় পাহাড়গুলো যেন একেবারে মাথার উপরে এসে গিয়েছে।
তিন ঘন্টায় ৯২ কিলোমিটার পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছাল আগুয়াস কালিএন্তেস। এক কালের এই ছোট ঘুমন্ত শহর মাচু পিচুর পর্যটকদের দৌলতে এখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। স্টেশন থেকে বেরিয়েই বাস ধরলাম পাহাড়ে চড়ার। অত্যন্ত খাড়াই এবং সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে বাস চলতে লাগল। কিছু ক্ষণ পর পরই পাহাড়ি বাঁক, পেট গুলিয়ে যাওয়ার জোগাড়। ১২০০ ফুট উচ্চতা চড়লাম আধ ঘন্টায়। বাস থেকে নেমে ট্যুরিস্ট অফিসে টিকিট দেখিয়ে ঢুকলাম স্বাগতমকেন্দ্রে। বিভিন্ন ভাষার গাইড পাওয়া যায় এখানে। এক জন ইংরেজি ভাষার গাইড আমাদের নিয়ে এগিয়ে চললেন পায়ে চলা একটি রাস্তা দিয়ে। তার ধারগুলো সমান মাপের পাথর বসিয়ে বাঁধানো। একটা মোড় পেরোতেই হঠাৎ চোখের সামনে এসে গেল সেই বিখ্যাত দৃশ্য, যার ছবি দেখেছি এত কাল। ছবিতে এর বিশালতা একদম বোঝা যায় না। মাচু পিচুর ঠিক পেছনেই যে পাহাড়টি, তার নাম ‘হুয়ানা পিচু’, মানে ‘নতুন পাহাড়’। পশ্চাতপট হিসাবে এর সুন্দর আকৃতি মাচু পিচুর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মাচু পিচুর এই দৃশ্য পৃথিবী-বিখ্যাত।

ইংকারা মাচু পিচু তৈরি করেছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর হিসেবে। শহরের এক দিকে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে চাষাবাদ ও পশুপালনের জায়গা। পাহাড়গুলি খুব খাড়াই বলে সমতল জায়গা ছিল না। তাই পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির মতো অনেক ধাপ বানিয়ে চাষ করা হত। পাহাড়ের উপর দিকে একটি প্রাকৃতিক প্রস্রবণ ছিল, এখনও তার কিছুটা আছে। ইংকারা সেই জলই পুরো শহরের কাজে লাগাত। এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম। তাই সেই প্রস্রবণের জলের এক ভাগ সরাসরি পাঠানো হত চাষের জমিতে পাথরের তৈরি নালা দিয়ে। যা ধাপে ধাপে চুঁইয়ে নামত নীচে। এই ধাপগুলির গঠন অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। প্রত্যেক ধাপের নীচে আছে বড় বড় পাথরের টুকরো, তার উপরে মাঝারি পাথর, ছোট পাথর এবং সবচেয়ে উপরে মাটির স্তর যাতে চাষের গাছ লাগানো হত।

ধাপ চাষের জমি নালার ছবি বসবাসের এলাকা
প্রস্রবণের বাকি জলে শহরের ঘরবাড়িগুলিতে জল সরবরাহ করা হত আরও এক গুচ্ছ নালার মাধ্যমে। বড় নালা থেকে অনেক মাঝারি এবং সরু নালা দিয়ে জল পৌঁছত বাড়ি বাড়ি। বলাই বাহুল্য, প্রথম নালাটি যেত রাজার বাড়িতে, তার পরে অন্যান্যদের। ব্যবহৃত জলকে এরা ফেলে না দিয়ে আর এক গুচ্ছ নর্দমা দিয়ে নিয়ে যেত চাষের খেতে। পাহাড়ের উপরের এত উঁচুতে জলের পরিমাণ ছিল সীমিত, কিন্তু এরা সেই যুগে জল ব্যবহারের এবং পুনর্ব্যবহারের যে ব্যবস্থা করেছিল, তা আজকের যুগের ইঞ্জিনিয়ারদেরও বিস্মিত করে। নালার জলের স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সুন্দর ব্যবস্থা ছিল, যা আজও আছে। শহরের বাকি অংশ দু’ভাগে বিভক্ত— এক ভাগে বাসের ঘরবাড়ি, অন্য ভাগ সর্বজনীন এলাকা। বাড়িগুলি সবই পাথরের তৈরি কিন্তু চুন, বালির সাহায্য ছাড়া। প্রত্যেকটি পাথর কাটা হয়েছে যাতে সেটা তার পাশের পাথরের সঙ্গে নিশ্ছিদ্র ভাবে বসে যায়। আন্দিজ পর্বতমালা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, তাই ইংকারা এমন ভাবে বাড়ি তৈরি করত যাতে সেগুলো ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। বড় বড় পাথরগুলোকে তারা ব্রোঞ্জের কড়া দিয়ে জুড়ে দিত।

সর্বজনীন এলাকায় ছিল বিভিন্ন রকমের মন্দির। ইংকারা জ্যোতির্বিজ্ঞান ভালই জানত। মাচু পিচুর সর্বজনীন এলাকার একাংশে আছে একটি সূর্যমন্দির। প্রতি বছর ২১ জুন (দক্ষিণায়ন) সূর্যের আলো একটি বিশেষ জানলা দিয়ে এসে পড়ে মন্দিরের মেঝেতে চিহ্নিত একটি জায়গায়। যে হেতু মাচু পিচু দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থিত, তাই জুন মাস মানে এখানে শীতকাল। শহরের সবচেয়ে উঁচু একটা পাহাড়ের উপরে ইংকারা তৈরি করেছিল গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করার কক্ষ। ধর্মীয় ভাবে ইংকারা ত্রিভুবন— আকাশ, মর্ত্য ও পাতালে বিশ্বাস করত। আকাশের দেবতা ছিলেন কন্ডর পাখি, মর্ত্যের দেবতা পুমা (এক ধরনের বাঘ) এবং পাতালের দেবতা সাপ। এই তিন দেবতার ছবি এবং সাঙ্কেতিক চিত্র ছড়িয়ে আছে শহর জুড়ে।
সূর্যের মন্দির বা ইন্তিহুয়াতানা
মাচু পিচু তৈরি হয়েছিল ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। ইংকা সম্রাট পাচাকুটি কখনও কখনও এখানে এসে থাকতেন। মাচু পিচুকে পবিত্র ধর্মীয় স্থান বলে গণ্য করা হত এবং আশেপাশের এলাকা থেকে লোকেরা আসত ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে। মাত্র শ’খানেক বছর বাস করার পর ইংকারা ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে সমবেত ভাবে মাচুপিচু ছেড়ে চলে যায়। কারণ সঠিক ভাবে জানা যায়নি। অনেকে মনে করেন যে স্পেনীয়দের ভয়ে তারা পালিয়ে যায় অন্য পাহাড়ে। আবার কেউ মনে করেন স্পেনীয়দের থেকে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে তারা সবাই মারা যায়।

পায়ে হেঁটে মাচু পিচুর গোটা এলাকাটা ঘুরে দেখতে বেশ কয়েক ঘন্টা লাগল। এর উচ্চতা এবং প্রখর রোদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য ঘন ঘন জল খেতে হয়। আমি বোতলের জলের সঙ্গে গ্লুকোজ ও ‘মাতে দে কোকা’ মিলিয়ে নিয়েছিলাম। এই ‘লোকেশানে’ দক্ষিণ ভারতীয় সুপারস্টার রজনীকান্ত ও অভিনেত্রী ঐশ্বর্য রাই অভিনীত তামিল ছবি ‘এন্তিরন’-এর কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়। পেরু সরকার এখানে সিনেমার শুটিং করার অনুমতি দেয় না— তা হলে এই শুটিং হল কী করে? যাঁরা দক্ষিণ ভারতীয় ছবি দেখেন, তাঁরা জানেন অসম্ভবকে সম্ভব করার আর এক নামই হল রজনীকান্ত!

সারা দিন মাচু পিচু দেখে শুরু করলাম নামার পালা। আবার সেই বাস এবং তার পর সেই ভিস্টাডোম ট্রেন। ট্রেনের কর্মী যুবক-যুবতীরা সত্যিই একটা ‘ফ্যাশন শো’ করে দেখালেন, চলন্ত ট্রেনের ‘আইল’ দিয়ে ‘ক্যাট ওয়াক’ করে। সব মডেলরাই পেরুর বিখ্যাত ‘আলপাকা’ নামক পশমের বিবিধ পোশাক পরে তার বিজ্ঞাপন এবং বিক্রি করলেন। সব শেষে বিবিধ জন্তু জানোয়ারের মুখোশ পরে একটি প্রাচীন নাচের অনুষ্ঠান করলেন। সন্ধে আটটায় ট্রেন পৌঁছল কুস্কো শহরে এবং সেখান থেকে ফিরলাম হোটেলে। সারা রাত দেখতে থাকলাম মনের ক্যামেরায় তুলে রাখা মাচু পিচুর দৃশ্যাবলী।

বঙ্কিমের কথায় ‘অহো কি দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’।

লিমা শহর
পর দিন সকালে কুস্কো থেকে বিমানে ফিরে এলাম পেরুর রাজধানী লিমা শহরে, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এই মাচু পিচু যাত্রা। বিমানবন্দর থেকে হোটেলে ফিরে বাকি দিনটা বিশ্রাম। পর দিন প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম লিমা শহর দেখতে। লিমা শহরে ‘হপ-অন হপ-অফ’ বাস পরিষেবা বেশ মজার। এই ধরনের অনেকগুলি বাস একটি নির্ধারিত রুটে কিছু ক্ষণ পরে পরেই আসছে, যাচ্ছে। একটি দ্রষ্টব্য জায়গায় নেমে সেখানে যত ক্ষণ খুশি সময় কাটিয়ে আবার পরের বাসটিতে উঠে চলুন পরের দ্রষ্টব্য জায়গায়। টিকিট কাটতে হবে এক বারই। বাসের চালক পথের দু’ধারের দ্রষ্টব্যের বিবরণ দিচ্ছেন স্পিকারে, ইংরাজি ও স্প্যানিস ভাষায়।

রাস্তায় বড় ভিড়। পেরুর প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচন হবে কয়েকদিন পরেই, রাস্তাঘাটে তার অজস্র পোস্টার ও ব্যানার। গাড়িতে মাইক লাগিয়ে সমর্থকরা ‘ভোট দিন’ ধরনের প্রচার করছেন। প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দু’জন প্রার্থী— এক জন জাপানি বংশদ্ভূত কেইকো ফুজিমোরি এবং অন্য জন বাম-ঘেঁষা ওয়ান্তা হুমালা (পেরু থেকে ফেরার পর জেনেছিলাম যে হুমালা জিতেছেন)। শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রস্থল প্লাজা মেয়রের চারপাশে রয়েছে অনেক দেখার জিনিস— প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ, বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল অফ লিমা এবং নগর নিগমের প্রধান কার্যালয়। ক্যাথেড্রাল অফ লিমা প্রায় পাঁচশ বছর পুরনো গির্জা, বারোক ও ঔপনিবেশিক-শৈলীর মিশ্রনে তৈরি। এর ভেতরে আছে ফ্রান্সিস্কো পিসারোর কবর। এখান থেকে কাছেই সান ফ্রান্সিকোর গির্জা, যার সামনেটা কাঠের কারুকার্য করা (স্প্যানিস ভাষায় সান মানে হল সেইন্ট)। এই গির্জার মাটির নীচে রয়েছে ক্যাটাকোম্ব বা এক বিশেষ ধরনের কবরখানা। খনন করে কঙ্কালের অস্থিপুঞ্জ জড়ো করে জানা গেছে যে এখানে অন্তত পঁচিশ হাজার মানুষ কবর দেওয়া হয়।

আবার বাস ধরে শহরের পশ্চিম প্রান্তের মিরাফ্লোরেস এলাকায় পৌঁছালাম। সমুদ্রের ধার জুড়ে প্রায় দু’মাইল লম্বা পার্ক, যেখানে বাচ্চাদের খেলার অনেক ব্যবস্থা ছাড়াও জায়গায় জায়গায় রাখা আছে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি— বিনামূ্ল্যে। লোকে সেগুলোকে ব্যবহারও করছে দেখে খুব ভাল লাগল। পার্কের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা অংশে পৌঁছলাম যার নাম ‘পার্ক অফ লাভ’। এখানে আছে ভাস্কর ভিক্টর ডেলফিনের তৈরি বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘দি কিস’। এখান থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দৃশ্য দারুণ লাগে। এ ছাড়া লিমা শহরে ছড়িয়ে আছে অনেক সুন্দর পার্ক। শহরকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করার জন্য এদের চেষ্টা দেখার মতো। বিকেলে গেলাম শহরের কেন্দ্রস্থল সেন্ট্রাল পার্কে। এর একটা অংশের নাম কেনেডি পার্ক— মার্কিন প্রেসিডেন্টের নামে। এটাই শহরের সবচেয়ে জমজমাট এলাকা। চারপাশে বড় বড় দোকান, হাসিখুশি লোকেদের ভিড়। সন্ধে নামতেই চারিদিকে জ্বলে উঠল ঝলমলে আলো। একটা খোলা রেস্তোরাঁতে বসে লোকজন দেখতে দেখতে রাতের খাওয়া সারলাম। এ দেশের জনসংখ্যার বেশ কিছু অংশ চৈনিকদের বংশধর। তাই স্থানীয় খাবারের সঙ্গে তাদের খাদ্যের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে এক খাদ্যশৈলী যার নাম শিফা (chifa)। বেশ মুখরোচক! খাওয়া সেরে এই জমজমাট এলাকা ছেড়ে হোটেলে ফিরলাম। কাল খুব সকালেই ঘরে ফেরার উড়ান ধরতে হবে।

এক কথায়: এখান থেকে ফিরতে মন চায় না, কিন্তু
‘হায়রে হৃদয় তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়’।
 
পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কর্মসূত্রে এবং ভ্রমণ পিপাসায় পৃথিবীর বহু দ্রষ্টব্য জায়গা দেখার সুযোগ পেয়েছেন। ছেলেবেলা কেটেছে বীরভূম জেলায়। কলেজ জীবন দুর্গাপুর আরইসি এবং খড়্গপুর আইআইটি। কর্মসূত্রে ভারতের ভোপাল, নাগপুর, পুণে প্রভৃতি শহরে বাস করেছেন। গত ১৮ বছর ধরে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে বাস। লেখার অভ্যাস অনেক দিনের, তবে তা প্রধানত ইংরেজিতে। দু’টি কলেজপাঠ্য ইঞ্জিনিয়ারিং বইয়ের লেখক। বাংলা পড়ার অভ্যেস বরাবরই।
ছবি: লেখক ও ইন্টারনেট (*)

এই লেখকের আরও ভ্রমণকথা


রোজের আনন্দবাজারএ বারের সংখ্যা • সংবাদের হাওয়াবদল আপনার রান্নাঘর • খানা তল্লাশি • পুরনো সংস্করণ