দিন আসে, দিন যায়, তার ফাঁকেই ইতিহাসে ঢুকে পড়ে তার চলাচলের খবর। পুরনো দিনের শহুরে খবর দিয়ে চেনা যায় এখনকার
অতি পরিচিত শহরের অতীতটাকে, তার নাগরিক জীবনযাপন থেকে খেলাধুলো, সংস্কৃতি বা কূটকচালি থেকে রাজনীতির হাল।
পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতা শহরের গতিবিধি চিনতে ২১ ডিসেম্বর ১৯৬৩ থেকে ২০ জানুয়ারি ১৯৬৪ এক মাসের কিছু বিশেষ খবর।

শনিবার ৫ পৌষ, ১৩৭০ (৩০ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৫ শকাব্দ) SATURDAY, 21 DECEMBER, 1963
• মোহনবাগান ক্লাবের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উত্সব বিশেষ সমারোহে পালিত হইবার সিদ্ধান্ত: শুক্রবার সন্ধ্যায় ভারতীয় অ্যাসোসিয়েশন হলে মোহনবাগান ক্লাবের ৭৪তম সাধারণ বার্ষিক সভার অনুষ্ঠানের পূর্বে একটি বিশেষ সাধারণ সভার অনুষ্ঠান হয়। ক্লাবের সহ-সভাপতি শ্রী ডি বি সেন সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। এই বিশেষ সভার আলোচ্য বিষয় ছিল ক্লাবের ৭৫ বত্সর পূর্তি উপলক্ষে আগামী ৬ই ডিসেম্বর (১৯৬৪) হইতে ৬ই জানুযারী (১৯৬৫) পর্যন্ত একমাসব্যাপী ‘প্ল্যাটিনাম’ উত্সব পালনের ব্যবস্থা করা। অবশ্য প্রস্তাবিত কার্যসূচী অনুযায়ী আগামী ১৫ই আগস্ট কালীঘাটে পূজাদি এবং ক্লাব প্রাঙ্গণে ‘হোমাদি’ শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের সহিত এই উত্সবের সূচনা হইবে। এই বিশেষ সভায় উক্ত উত্সব পালনের আনুষাঙ্গিক ব্যয়ের জন্য সভ্যদের নিকট হইতে একশত টাকা করিয়া চাঁদা সংগ্রহ করিবার প্রস্তাবও গৃহীত হয়।

মঙ্গলবার ৮ পৌষ, ১৩৭০ (৩ পৌষ, ১৮৮৫ শকাব্দ) TUESDAY, 24 DECEMBER, 1963
• কলিকাতায় নতুন বেতার কেন্দ্র: কলিকাতার সঙ্গে ভারতের পূর্বসীমান্তের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সংবাদ আদানপ্রদানের জন্য একটি নতুন বেতার কেন্দ্র চালু হইতেছে। ঐখান হইতে আগরতলা, গৌহাটি, পোর্ট ব্লেয়ার (আন্দামান) প্রভৃতির সঙ্গে সরাসরি রেডিও, টেলিফোন এবং টেলিগ্রাম সংযোগের ব্যবস্থা হইবে। ডাক ও তার বিভাগের পরিচালনায় ঐ কেন্দ্রটি স্থাপিত হইয়াছে বজবজের পথে গোপালপুরে। কেন্দ্রীয় ডাক ও তারমন্ত্রী শ্রীঅশোক সেন আজ (মঙ্গলবার) ঐ কেন্দ্রের উদ্বোধন করিতেছেন। কেন্দ্রটি হইতে দার্জিলিং, শিলিগুড়ি ও ইম্ফলে রেডিও টেলিগ্রাম পাঠানো যাইবে। ইহা ছাড়াও ভবিষ্যতে ঐখান হইতে নেপালের সঙ্গে রেডিও টেলিফোন এবং পাঁচশত মাইল এলাকার মধ্যে অবস্থিত জাহাজের সঙ্গে ভূখণ্ডের টেলিফোন ও টেলিগ্রাম সংযোগ স্থাপনেরও প্রস্তাব আছে।


কার্ফুর জন্য ঘরেই যখন বসে থাকতে
হচ্ছে, কিছু সোয়েটার বুনে ফেল......

এ ফুটপাতে কারফিউ নেই,
তাই ভাড়া একটু বেশী।

উনি অফিসে যাননি কার্ফু যে! তাই
টেস্ট-ম্যাচের টিকিট কিনতে গেছেন।

মঙ্গলবার ৮ পৌষ, ১৩৭০ (৩ পৌষ, ১৮৮৫ শকাব্দ) TUESDAY, 24 DECEMBER, 1963
• কলিকাতার রাস্তা উন্নয়নের বরাদ্দ: কলিকাতা কর্পোরেশনের ১৯৬৩-৬৪ সালের বাজেটে রাস্তা মেরামত ও উন্নয়নের খাতে ২৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করিবার প্রস্তাব হইয়াছে। গত বত্সর এই খাতে ব্যয় হয় দশ লক্ষ টাকা। সোমবার কর্পোরেশনের জনৈক মুখপাত্র জানান, সর্বপ্রথমে ঠনঠনিয়া এলাকা ও মন্মথ দত্ত রোডের (বেলগাছিয়া) জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হইবে। এই জন্য তিন লক্ষের কিছু বেশি টাকা মঞ্জুর হইয়াছে। বেলগাছিয়ার মন্মথ দত্ত রোড নীচু থাকার দরুন একটু জল হইলেও পাইকপাড়া-বেলগাছিয়ার একাংশ জলমগ্ন হইয়া যাইত। ইহা বন্ধ করিবার উদ্দেশ্যে মন্মথ দত্ত রোডটিকে ১৪ ইঞ্চি উঁচু করার কাজে হাত দেওয়া হইয়াছে। ইহা ছাড়া ঠনঠনিয়া এলাকায় অতিরিক্ত জলবাহী নালা নির্মানের কাজও সুরু হইয়া গিয়াছে।

বৃহস্পতিবার ১০ পৌষ, ১৩৭০ (৫ পৌষ, ১৮৮৫ শকাব্দ) THURSDAY, 26 DECEMBER, 1963
• ‘বড়দিনের’ রাত্রে হাঁড়কাঁপুনি শীত: “শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন’ — বুধবার রাত্রে হাঁড়কাঁপুনি ঠান্ডায় কলিকাতার পথে দাঁড়াইয়া কবির এই উপলব্ধির কথাই মনে পড়িতেছিল। বড়দিনের কলিকাতার আকাশ সমস্তদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকে। রাত্রেও মেঘের আহরণে তারকার ঝিকিমিকি ঢাকা পড়ে। চাঁদকেও ম্লান দেখায়। বেশী রাতে শীত আরও বাড়িবে— আবহাওয়াবিদগণের ইহাই মত। তবে আশার বাণীও তাঁহারা শুনাইয়াছেন—বৃষ্টি বাদলের আশঙ্কা নাই। আবহাওয়া মোটামুটি ভালই থাকিবে। বুধবার সন্ধ্যা ৫টার পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪.৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকিলেও রাত্রের দিকে তাপমান যন্ত্রের পারদ যে আরও বেশ খানিকটা নামিয়া যায় তাহা যাঁহারা রাত্রে বাড়ীর বাহির হইয়াছে তাঁহারা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাইয়াছেন।

বৃহস্পতিবার ১০ পৌষ, ১৩৭০ (৫ পৌষ, ১৮৮৫ শকাব্দ) THURSDAY, 26 DECEMBER, 1963
• কন্যাকুমারীতে স্বামীজীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা: কন্যাকুমারীতে বিবেকানন্দ শিলার উপরে স্বামী বিবেকানন্দের একটি প্রতিমূর্তি নির্মাণের অনুমতি লাভের জন্য সংসদের তিনশতাধিক সদস্য সম্মিলিতভাবে কেন্দ্রীয় সরকার এবং মাদ্রাজ সরকারের নিকট এক আবেদন প্রেরণ করিয়াছেন। নিখিল ভারত স্বামী বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী উদযাপন এবং বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল কমিটি (কেরলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রনীতিবিদ শ্রীমন্নাথ পদ্মনাভনের নেতৃত্বে এই কমিটি গঠিত হইয়াছে) দীর্ঘকাল যাবত্ এই প্রতিমূর্তি নির্মাণের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করিয়া আসিতেছেন। বর্তমানে লোকসভা এবং রাজ্যসভার ৩২৩ জন সদস্য যে আবেদন করিয়াছেন তাহা হইতে দেখা যাইতেছে যে, সমগ্র জাতির অধিকাংশ লোক কমিটির এই দাবির সমর্থক। সংসদের এই সমস্ত সদস্যের ভিতরে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ রহিয়াছেন। এই স্থানে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, কমিটি এক সময়ে স্বামীজীর স্মরণার্থ এই শিলার উপর্ একটি স্মৃতি-ফলক স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু এই স্থানে কেয়কজন খৃষ্টান ধীবর এই স্মৃতি ফলকটি অপসারিত করে। ঐ সময়ের পর হইতে মাদ্রাজ সরকার আর এই স্থানে প্রতিমূর্তি নির্মাণের অনুমতি দিতেছেন না।


অধ্যাপক সত্যেনন্দ্রনাথ বসুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে
মহাজাতি সদনে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। —আনন্দ চিত্র।

শুক্রবার ১১ পৌষ, ১৩৭০ (৬ পৌষ, ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, 27 DECEMBER, 1963
• সংবাদপত্রগুলির সমস্যা দূর করিতে সরকার সচেষ্ট: বৃহস্পতিবার কলিকাতার গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে ভারতীয় এবং পূর্বাঞ্চলীয় সংবাদপত্র সমিতির এক সম্বর্ধনা সভায় সমিতির সভাপতি শ্রীঅশোককুমার সরকারের স্বাগত ভাষণের উত্তরে কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী শ্রী সত্যনারায়ণ সিংহ বলেন, বর্তমান সংবাদপত্রগুলিকে যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইতেছে ভারত সরকার সম্ভাব্য সকল উপায়ে সেগুলি দূর করিবার চেষ্টা করিতেছেন। শ্রী সিংহ বলেন, বৈদেশিক মুুদ্রার অভাবেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের প্রধান অন্তরায়। এদেশে সংবাদপত্র মুদ্রণের কাগজ সরবরাহ ঘাটতি মিটান সম্ভব। যে সকল সংস্থাকে এই কাগজ উত্পাদনের লাইসেন্স দেওয়া হইয়াছে কতকগুলি অসুবিধার জন্য তাঁহারা উত্পাদন আরম্ভ করিতে পারিতেছেন না। এদেশে যাহাতে যথেষ্ট পরিমাণে সংবাদপত্র মুদ্রণের কাগজ পাওয়া সম্ভব হয় সেই উদ্দেশ্যে শ্রী সিংহ এই সকল উত্পাদকের সহিত মিলিত হইয়া সকল অসুবিধা দূর করিবার চেষ্টা করিতেছেন বলিয়া জানান।

শুক্রবার ১১ পৌষ, ১৩৭০ (৬ পৌষ, ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, 27 DECEMBER, 1963
• স্বামীজীর আদর্শে ধর্মমহাসভা: ১৯৮৩ সনে চিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দ যে সর্বধর্মীয় বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রচার করিয়াছিলেন সেই আদর্শেরই ব্যাপক প্রসারের জন্য আগামী ২৯শে ডিসেম্বর হইতে কলিকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে এক ধর্মমহাসভার আয়োজন করা হইয়াছে। স্বামী বিবেকানন্দ জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই ধর্মমহাসভায় বিভিন্ন দেশ হইতে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধরা যোগদান করিবেন। এই ধর্মমহাসভার উদ্বোধন করিবেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রেসিডেন্ট শ্রীমত্ স্বামী মাধবানন্দজী মহারাজ। বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক বৈঠকে স্বামী বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ এই ধর্মমহাসভার তাত্পর্য বিশদভাবে বুঝাইয়া বলেন: বৈদিক ধর্ম, হিন্দুধর্ম, ইসলামধর্ম, খৃষ্টধর্ম, জুডাইজম, সুফিধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদি বিশ্বের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ধর্মের প্রবক্তাগণ এই সভায় নিজ নিজ ধর্মের তাত্পর্য ব্যাখ্যা করিবেন।

রবিবার, ১৩ পৌষ, ১৩৭০ Sunday, Dec 29, 1963
• কলিকাতায় সোস্যালিস্ট মহাসন্মেলনে ডঃ রামমনোহর লোহিয়ার ভাষণ: কলিকাতায় সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে শনিবার সোস্যালিস্ট পার্টির জাতীয় সন্মেলনের উদ্বোধন করিয়া সমাজতন্ত্রী নেতা ডঃ রাম মনোহর লোহিয়া ভারতে বিকল্প সরকার গঠনের জন্য এক শক্তিশালী বিরোধী সংস্থা গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তা জানান। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য হইতে আগত প্রায় ৩শত প্রতিনিধি সন্মেলনে যোগ দেন। সোস্যালিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান শ্রীরাজনারায়ণ সিংহ উহাতে পৌরোহিত্য করেন। মহামান্য ডঃ সুধীরকুমার চট্টোপাধ্যায় অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হিসাবে সকলকে স্বাগত জানান। ডঃ লোহিয়া বলেন, স্বাধীন ভারতের কংগ্রেস সরকার কোনদিনই দেশের অর্ধেকের বেশি লোকের ভোট-সমর্থন পান নাই। গত ১৯৬২ সালের অক্টোবরের পর ঐ হার আরও নামিয়া যায় এবং সম্ভবত এক তৃতীয়াংশেরও কমে দাঁড়ায়।

সোমবার, ১৪ পৌষ, ১৩৭০( ৯ পৌষ, ১৮৮৫ শক) Monday, December 30, 1963
• ২৪ পরগণা সাংবাদিক সন্মেলনে শ্রীঅশোককুমার সরকারের ভাষণ: ‘অন্যান্য দেশে জাতীয় সংবাদপত্র ও আঞ্চলিক সংবাদপত্রের ভূমিকা আলাদা। সেখানে বিভিন্ন প্রান্তের জন্য রহিয়াছে অসংখ্য ছোট ছোট সংবাদপত্র এবং উভয়ের কর্মবিভাগও মোটামুটি চিহ্নিত। কিন্তু আমাদের দেশে, বিশেষত বাংলা সংবাদপত্রের ভূমিকা দ্বৈত। আঞ্চলিক ক্ষুদ্র সংবাদপত্রের অভাবে বৃহত্ জাতীয় সংবাদপত্রকে যুগ্ম দায়িত্ব বহন করিতে হইয়াছে। ফলে অনেক সময় ভারসাম্য থাকে না, নাগরিক রাজনীতি ও পৌরসমাচারের চাপে গ্রামের বার্তা অস্ফুট থাকিয়া যায়।’—আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রীঅশোককুমার সরকার ২৪ পরগণা জেলা সাংবাদিক সঙ্ঘের বার্ষিক সন্মেলনে সভাপতির ভাষণে উপরোক্ত মন্তব্য করেন। রবিবার বিকালে বসিরহাট টাউন-হলে এই সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সোমবার, ১৪ পৌষ, ১৩৭০( ৯ পৌষ, ১৮৮৫ শক) Monday, December 30, 1963
• কলিকাতায় ধর্ম মহাসন্মেলন আরম্ভ: রবিবার পার্ক সার্কাস ময়দানে স্বামী বিবেকানন্দ শতবার্ষিকী উত্সব উপলক্ষে আয়োজিত আটদিনব্যাপী ধর্ম-মহাসন্মেলনের উদ্বোধন করিয়া রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী মাধবানন্দজী মহারাজ প্রকৃত বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মানুরাগীদের সঙ্ঘবদ্ধভাবে উদ্যোগী হইতে আহ্বান জানান। তাঁহার মতে ধর্মকে অধর্ম হইতে রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্বে স্থায়ী শান্তি-প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব তাঁহাদের উপর ন্যস্ত হইয়াছে। সত্তর বত্সর আগে ১৮৯৩ সালে চিকাগো ধর্ম মহাসন্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ যে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করিয়াছিলেন এই ধর্মসভায়ও বিভিন্ন দেশ হইতে আগত প্রতিনিধিগণ তাহা শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করেন।

মঙ্গলবার, ১৫ পৌষ, ১৩৭০( ৯ পৌষ, ১৮৮৫ শক) Tuesday, December 31, 1963
• কলিকাতায় গঙ্গায় মুক্তিস্নান: সোমবার পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ ও চূড়ামণি যোগ উপলক্ষ্যে কলিকাতার গঙ্গাতীরে বিপুল জনসমাগম হয়। হাজার হাজার নরনারী গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে সমবেত হন। বিকাল চারটা হইতে ভিড় বাড়তে থাকে। সংকীর্তণ, শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনির মধ্যে ধর্ম প্রাণ নরনারী গঙ্গা স্নান করেন। সন্ধ্যায় চন্দ্রোদয়ের পর কলিকাতা হইতে উন্মীলন ও মোক্ষ দৃশ্য হয়। তাহার পরও বহুক্ষণ মুক্তিস্নান চলে।

বুধবার, ১৬ পৌষ, ১৩৭০(১১ পৌষ, ১৮৮৫ শক) wednesday, January 1, 1964
• মোহন বাগান ক্লাব-তাবুর উদ্বোধন: মঙ্গলবার অপরাহ্নে শুচি-শুভ্র পরিবেশের মধ্যে ভারতীয় স্থল বাহিনীর সৈন্যধ্যক্ষ জেনারেল জে এন চৌধুরী কলিকাতা ময়দানের নতুন অঙ্গনে মোহনবাগানের নূতন ক্লাব-তাবুর দ্বারোদ্ঘাটন করেন। ক্রীড়াক্ষেত্রের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন সভাপতি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আর উপস্থিত ছিলেন বহু স্মরণীয় ক্রীড়াযুদ্ধের সব বিজয়ী বীর—স্মৃতির রাজারা। তাঁহাদের সহিত আগামী দিনের সব অরুণ আলো—সদ্য ডুরান্ড বিজয়ী খেলোয়াড়গণ।
মোহনবাগান তাঁবুর উদ্বোধনে চিফ অফ আর্মি স্টাফ জে এন চৈধুরী।-আনন্দ চিত্র।
প্রায় এক লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিরাট তাবুর উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠান অঙ্গনে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আবার ক্লাব ঐতিহ্যের স্মৃতির চাদর গায়ে মুড়িয়া যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন তাঁহাদের আনন্দের অভিব্যক্তিও চাপা থাকে না। কোন ক্লাবের দ্বারোদ্ঘাটন উপলক্ষে ইতিপূর্বে এরূপ দর্শক সমাগম এবং এরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না।

বৃহস্পতিবার, ১৭ পৌষ, ১৩৭০(১২ পৌষ, ১৮৮৫ শক) Thursday, January 2, 1964
• কলিকাতায় গরম: বুধবার ইংরেজী নববর্ষের দিন কলিকাতায় হঠাত্ বেশ গরম পড়িয়া যায়। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উভয় তাপমাত্রাই স্বাভাবিক অপেক্ষা বেশী ছিল। এইদিন এমন কি বাড়ী, বাড়ী এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁতে বহুদিন পর আবার পাখার সুইচে হাত পড়ে। কয়েকদিন তীব্র ঠান্ডার পর হঠাত্ এই গরম যেন অসহ্য বোধ হয়। তাই পাখা না ঘুরাইয়া চলে না। এইদিন কলিকাতার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা — ২৮.২ ডিঃ সেঃ(৮৩.৭ ডিঃ ফাঃ-স্বাভাবিক অপেক্ষা ২ ডিঃ সেঃ বেশী) এবং ১৯.২ ডিঃসেঃ(৬৬.৭ ডিঃ ফাঃ-স্বাভাবিক অপেক্ষা ৭ ডিঃ সেঃ বেশী)। বায়ুতে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন আর্দ্রতার ভাগ ছিল শতকরা যথাক্রমে ৯৭ এবং ৪১ ভাগ।বৃহস্পতিবার শীত বাড়িবে, কিন্তু স্বাভাবিকের উপরেই থাকিবে-আবহাওয়াবিদগণের ইহাই মত।

Saturday, January 4, 1964, শনিবার, ১৯ পৌষ, ১৩৭০(১৪ পৌষ ১৮৮৫ শক)
• পরলোকে ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত: কলিকাতার খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথ ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শুক্রবার সন্ধ্যা ৫-৪৫ মিঃ এ ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্গত রাজারহাট থানায় বাগুইআটিতে সজ্ঞানে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁহার বয়স হইয়াছিল ৭৯ বত্সর। তিনি দুই পুত্র ও চারি কন্যা রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি কিছুদিন যাবত্ নিম্নরক্তচাপ রোগে ভুগিতেছিলেন। পরিচয়— ডাঃ সেনগুপ্ত ১৮৮৪ সালে বরিশাল জেলার ফয়েরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে আসেন এবং জাতীয় আন্দোলনে যোগ দেন। স্কুলের পাঠ শেষ করিয়া বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ হইতে তিনি এফএ পাশ করেন। ২৪ বত্সর বয়সে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিত্সা শুরু করেন এবং নিজের দক্ষতায় অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সর্বজনপরিচিতি লাভ করেন।

Sunday, January 5, 1964, রবিবার, ২০ পৌষ, ১৩৭০(১৫ পৌষ ১৮৮৫ শক)

নতুন চাল কতটা পচিয়ে বেচবেন
যদি বলে দেন তো মূল্য নির্ধারণ
করতে সুবিধে হয়।
ব্যবসায়ী মহলে বিভ্রান্তি: শনিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানমণ্ডলীতে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন ধান চালের দর বাঁধিয়া দেওয়া সম্পর্কে যে সরকারী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, চাউল ব্যবসায়ী মহল মনে করেন যে, এখনও পর্যন্ত তাঁহাদের এই বিষয়ে মন্তব্য করার মত সময় আসে নাই। শনিবার চাউল ব্যবসায়ী সমিতির একজন মুখপাত্র আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধির নিকট বলেন যে, সরকার ধানের দরের কথা ঘোষণা করেন, চাউল ব্যবসায়ী মহল মনে করেন যে, এখনও পর্যন্ত তাঁহাদের এই বিষয়ে মন্তব্য করার মত সময় আসে নাই।

বৃহস্পতিবার, ২৪ পৌষ, ১৩৭০ THURSDAY, JAN. 9, 1964
• রোভার্স কাপ ফাইন্যালে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব: গতবারের রোভার্স কাপের যুগ্ম-বিজয়ী ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আজ সেমি-ফাইনাল খেলায় মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে ১-০ গোলে পরাজিত করিয়া এবারও রোভার্স কাপের ফাইনালে উঠিয়াছে। দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটের সময় লেফট ইন অসীম মৌলিকের একমাত্র গোলে খেলাটির জয়-পরাজয় মীমাংসিত হয়। মহামেডান দলের উপর আধিপত্য বিস্তার করিয়া খেলিয়া ইস্টবেঙ্গল যোগ্য দল হিসাবে বিজয়ীর সম্মান অর্জন করে। ইস্টবেঙ্গলের সংঙ্ঘবদ্ধ এবং যোগাযোগপূর্ণ আক্রমণের বিরুদ্ধে মহামেডান দল মোটেই তাহাদের খ্যাতি অনুযায়ী খেলিতে পারে নাই। একমাত্র গোলরক্ষক মুস্তাফার দৃঢ়তার জন্য মহামেডান দল বেশী গোলে পরাজয়ের হাত হইতে অব্যাহতি পাইয়াছে। সমস্ত খেলার মধ্যে মুস্তাফা অনেকগুলি বিপজ্জনক বল প্রতিরোধ করিয়াছেন।

বৃহস্পতিবার, ২৪ পৌষ, ১৩৭০ THURSDAY, JAN. 9, 1964
• মাছের বাজার প্রায় ধোয়ামোছা: কলিকাতায় মাছের আকাল যথাপূর্বং বুধবারও দেখা গেল, বাজার প্রায় ধোয়ামোছা। সরকার ইতিপূর্বে আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে ওপেন জেনারেল লাইসেন্স পুনঃপ্রবর্তন হইলেই পুনরায় পাকিস্তান হইতে মাছ আমদানী শুরু হইবে। কিন্তু মত্স্য দপ্তরের পূর্বাপর সকল আশ্বাসের মত ইহাও ব্যর্থ হইয়াছে। বাজারে মাছ নাই। শীতের মরশুমে রকমারি মাছে বাজার পূর্ণ থাকিত। কিন্তু সেই মাছ ত নাই-ই, সাধারণ রুই, কাতলা, মৃগেলও উধাও হইয়াছে। শীতের কৈ কুলিনত্ব লাভ করিয়া সাধারণের ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। বুধবার বিভিন্ন বাজারে দেখা যায়, মাঝারি কৈ মাছ ৬ টাকা ও ৮ টাকা— একটু বড় কৈ মাছ ১০ টাকা কিলো। সামুদ্রিক আড় জাতীয় এক ধরণের নিকৃষ্ট শ্রেণীর মাছ বাজারের শোভাবর্ধন করিতেছে। আর কিছু তেলাপিয়া। মত্স্য বিভাগের নিকট গেলে তাঁহারা একটা হিসাব দাখিল করেন। অনর্গল বলিয়া যান কোন রাজ্য হইতে কি পরিমাণ মাছ আমদানী হইয়াছে। কিন্তু মাছের বাজারে গেলে সেই মাছের হদিস মেলে না। সরকারী খাতাপত্রের মধ্যেই সেই মাছ সীমাবদ্ধ থাকে।

বৃহস্পতিবার, ২৪ পৌষ, ১৩৭০ (১৯ পৌষ, ১৮৮৫ শক) THURSDAY, JANUARY 9, 1964
• পশ্চিমবঙ্গে ধান-চাউলের সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য: ধান ও চালের দাম রাজ্য সরকার বাঁধিয়া দিয়াছেন। বুধবার এক সরকারী বিবৃতিতে ধান ও চালের চার রকম শ্রেণী বিভাগ এবং প্রত্যেক শ্রেণীর উত্পাদক ও খুচরা দর ঘোষণা করা হয়। এই বিধি বুধবার হইতেই রাজ্যের চালের বাজারে প্রযুক্ত হইয়াছে। এই নতুন আইনানুযায়ী জেলাওয়ারী ভিত্তিতে ধান ও চালের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারিত হইয়াছে। ১৯৫৮ সনের পশ্চিমবঙ্গ মুনাফা নিরোধ আইন অনুয়ায়ী এই আইন বলবত্ হইয়াছে।
এলাকা বিক্রয়কারী চাউলের শ্রেণী
কলকাতা
ও শিল্প এলাকা
উত্পাদক/মিলওয়ালা মণপ্রতি-(মোটা) ২১.৭৫ ---(মাঝারি) ২৩.২৫---(মিহি) ২৫.৮৭--- (অতিমিহি) ২৭.৫১
কুইন্টালপ্রতি-(মোটা) ৫৮.২৭ ---(মাঝারি) ৬২.২৯---(মিহি) ৬৯.৩২--- (অতিমিহি) ৭৩.৬৮
পাইকার মণপ্রতি-(মোটা) ২২.৭৫---(মাঝারি) ২৪.২৮ ---(মিহি)২৬.৯৪ --- (অতিমিহি) ২৮.৬০
কুইন্টালপ্রতি-(মোটা)৬০.৯৫ ---(মাঝারি)৬৫.০৬ ---(মিহি)৭২.১৭ --- (অতিমিহি) ৭৬.৬৫
খুচরাবিক্রেতা মণপ্রতি-(মোটা) ২৪.০০---(মাঝারি)২৫.৫৩ ---(মিহি)---১৮.১৯ (অতিমিহি) ২৯.৮৫
কুইন্টালপ্রতি-(মোটা)৬৪.৩০---(মাঝারি)৬৮.৪১---(মিহি)৭৫.৫২ --- (অতিমিহি) ৮০.০০
কিলোগ্রামপ্রতি -(মোটা)০০.৬৪---(মাঝারি)০০.৬৮---(মিহি)০০.৭৬--- (অতিমিহি) ০০.৮০

শনিবার, ২৬ পৌষ, ১৩৭০ (২১ পৌষ, ১৮৮৫ শক) SATURDAY, JANUARY 11, 1964
• গড়িয়ায় গুলিবিদ্ধ হইয়া কলেজের ছাত্রের মৃত্যু: কলিকাতার ছাত্রসমাজ শুক্রবার বিভিন্ন সভা এবং মিছিলের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভ জানায়। দুপুরের দিকে শহরের শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের স্কুল-কলেজের ছাত্ররা তাহাদের ক্লাশ হইতে বাহির হইয়া বিক্ষোভ মিছিল বাহির করে। এ সম্পর্কে এইদিন কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এই দিনের একটি অপ্রীতিকর ঘটনা: গড়িয়ার দীনবন্ধু এন্ড্রুজ কলেজ প্রাঙ্গণে নিরস্ত্র কয়েকশত ছাত্রের উপর পুলিশের বেপরোয়া গুলিবর্ষণ। পরিণাম: বি-এ প্রথম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র শ্রীভুদেব সেনের গুলিবিদ্ধ হইয়া মৃত্যুবরণ। একজন অধ্যাপক এবং জনকয়েক ছাত্র বুলেটের আঘাতে সামান্য আহত।

রবিবার, ২৭ পৌষ, ১৩৭০ SUNDAY, JAN. 12, 1964
• শুক্রবারের হাঙ্গামায় ১৬৯ জন গ্রেপ্তার: মধ্য কলিকাতায় বহুবাজার, মুচিপাড়া ও তালতলা এলাকায় শুক্রবারের ঘটনা সম্পর্কে ধৃত মোট ১৬৯ জনকে শনিবার চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী এস পি চ্যাটার্জীর এজলাসে ৮টি দলে ভাগ করিয়া হাজির করা হয়। তাহাদের আরও তদন্ত সাপক্ষে জেলহাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রথম দলে রমজান খাঁকে চাঁদনী চক স্ট্রীটে পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগে প্রকাশ, রমজান খাঁ বৃহস্পতিবার ক্রাউন সিনেমার নিকট একটি ছোরা মারার ঘটনা লইয়া স্থানীয় লোকেদের নিকট উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দিতেছিল এবং ঐ এলাকার সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টি করিয়া জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করিতেছিল। দ্বিতীয় দল এসএসএস জাহিদ ও অপর ২২ জনকে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” প্রভৃতি নানারূপ ধ্বনি দিয়া সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টির চেষ্টা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ নিরাপত্তা আইন অনুসারে শুক্রবার বেলা ১-৩০ মিঃ নাগাদ ফিয়ার্স লেনে গ্রেপ্তার করা হয়।

সোমবার, ২৮ পৌষ, ১৩৭০ (২৩ পৌষ, ১৮৮৫ শক) MONDAY, JANUARY 18, 1964
• কলিকাতায় সৈন্যবাহিনীর উপর উপদ্রুত অঞ্চলের পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ: রবিবার রাত্রি হইতে সৈন্যবাহিনী কলিকাতার কয়েকটি উপদ্রুত এলাকার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করে। ঐ দিন শহরের পরিস্থিতির কোন উন্নতি দেখা না দেওয়ায় আরও অধিক সংখ্যক সৈন্য এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আসিয়া পৌঁছে। ঐ দিন কড়েয়া, বহুবাজার, জোড়াসাঁকো, পার্ক সার্কাস ও মাণিকতলা থানা এলাকায়ও কার্ফু জারী করা হয়। বেলিয়াঘাটা, ইন্টালী ও বেনেপুকুর থানায় সকাল ৭টা হইতে ৯টা পর্যন্ত বাদে দিবারাত্রি সর্বক্ষণের জন্য সান্ধ্য আইন বলবত্ থাকিবে। অপর সাতটি থানা যথা-তালতলা, আর্মহার্স্ট স্ট্রীট, কড়েয়া, বহুবাজার, জোড়াসাঁকো, পার্ক স্ট্রীট ও মাণিকতলায় সন্ধ্যা ৬টা হইতে ভোর ৫টা পর্যন্ত উহা চালু থাকিবে। রবিবার কলিকাতা ও সন্নিহিত এলাকার নয় হাজার সমাজবিরোধী ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। অগ্নিসংযোগের ঘটনার সংখ্যাই বেশী হয়। অপরাহ্নে একটার সময়ে নগরীর পূর্ব প্রান্ত হইতে ১৩টি অগ্নিসংযোগের সংবাদ পাওয়া যায়। ঐদিন রাত্রি ১০টা পর্যন্ত শতাধিক অগ্নিসংযোগের ঘটনা হয়।

কলকাতায় উপদ্রুত
এলাকায় সেনা টহল।

উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শনে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন
ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ।

সোমবার, ২৮ পৌষ ১৩৭০ (২৩ পৌষ, ১৮৮৫ শক) MONDAY, JANUARY 13, 1964
• পুলিশ ও সৈন্যদলের প্রতি কড়া হুকুম: ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীগুলজারিলাল নন্দ রবিবার কলিকাতায় সাংবাদিকদের কাছে দৃঢ়কন্ঠে বলেন, যে কোন প্রকারেই হউক সোমবারের মধ্যে কলিকাতা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের হাঙ্গামা বন্ধ করিতে হইবে। শ্রীনন্দ বলেন, হাঙ্গামা দমনের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে অধিকতর কঠোর হইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। কোন দয়া-মায়া নয় এবার অবস্থা আয়ত্তে আনিবার জন্য চূড়ান্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। শ্রীনন্দ আজ সোমবার সকাল নয়টায় বিধানসভা ভবনে পশ্চিমবঙ্গের সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সহিত এক বৈঠকে মিলিত হইবেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রবিবার সন্ধ্যায় দিল্লি হইতে বিশেষ বিমানে করিয়া কলিকাতায় পৌঁছান। তাঁহার সঙ্গে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী শ্রীঅশোক সেন এবং স্টেট ট্রেড্রিং কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান শ্রীগোবিন্দন নারায়ণও ছিলেন। বিমানঘাঁটি হইতে তাঁহারা দুজনেই সরাসরি লালবাজার যান ও সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, পুলিশ ও সামরিক কর্তৃপক্ষের সহিত এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হন।

মঙ্গলবার, ২৯ পৌষ, ১৩৭0 Tuesday, January 14, 1964
• পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রতি শান্তির আবেদন: সোমবার সকালে ও বিকালে কলিকাতায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও সংস্থার প্রতিনিধি ও নেতাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রীগুলজারীলাল নন্দ, কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রী শ্রী অশোক কুমার সেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন, সংসদ- বিধানসভা ও বিধান পরিষদের সদস্যগণ এবং পদস্থ সরকারী কর্মচারীগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় আলাপ-আলোচনার পর নিন্মলিখিত আবেদনটি প্রচার করা হইয়াছে :- গত চারদিন লুঠতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ফলে কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের আরও কয়েকটি অঞ্চলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হইয়াছে। কিছু জীবনহানিও ঘটিয়াছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, এই ঘটনাগুলি পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীরই বেদনাময় প্রতিক্রিয়া। আমরা জানি পাকিস্তান হইতে এ ব্যাপারে তীব্র প্ররোচনা আসিয়াছে। তথাপি আমাদের দেশের জনগণকে ইহা উপলদ্ধি করিতে অনুরোধ জানাইতেছি যে, পাকিস্তান যে অন্যায় করিয়াছে, ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর গুন্ডামি চালাইয়া তাহার প্রতিকার সম্ভব নয়। কঠোরহস্তে এই গুন্ডামি দমন করিতে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় সর্বপ্রকার প্রয়াস পাইতে দল, সম্প্রদায় ও মত নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর জনগণ কৃতসঙ্কল্প।

মঙ্গলবার, ২৯ পৌষ, ১৩৭0 Tuesday, January 14, 1964
• রনজি ক্রিকেট বাঙ্গলা পূর্বাঞ্চলের চ্যাম্পিয়ন: বাঙ্গালা ও বিহার দলের রনজি ক্রিকেট প্রতিযোগীতায় তৃতীয় দিনের খেলায় বিহারের প্রথম ইনিংসে ৩৪৪ রানের প্রত্যুত্তরে বাঙ্গলার প্রথম ইনিংস আজ ৪৫৩ রানে শেষ হইয়া যায়। অম্বর রায় দৃঢ়তা সহকারে ব্যাট করিয়া ১০৩ রান তোলেন। রায় ছাড়া শ্যামসুন্দর মিত্রের ৫২ এবং বি চন্দ্র ৪৮ রান উল্লেখযোগ্য। বাংলা প্রথম ইনিংসের ফলাফলে বিজয়ী হইয়াছে। বিহারের দ্বিতীয় ইনিংসে ২ উইকেটে ২১ রান উঠিবার পর খেলা শেষ হয়। এই খেলায় জয়লাভের ফলে বাংলা ১৯ পয়েন্ট লাভ করিয়া পুর্ব অঞ্চলের চ্যাম্পিয়ান এবং বিহার ১৫ পয়েন্ট লাভ করিয়া দ্বিতীয় স্থান লাভ করিয়াছে।


আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এম সি চাগলা।-আনন্দ চিত্র।

মঙ্গলবার, ২৯ পৌষ, ১৩৭০ Tuesday, January 14, 1964
• সবজির বাজার আবার আগুন: কলিকাতার বাজারে তরিতরকারীর দর আবার বাড়িয়া গিয়াছে। গোলযোগের দরুন কলিকাতার বাহির হইতে শাকসব্জী ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমদানী হইতেছে না। তরিতরকারীর পরিমাণ বাজারে খুব কম। ফলে সোমবার অল্প সময়ের মধ্যে ঐগুলি প্রায় নিঃশেষিত হয়। আলু ছাড়া আর সব তরিতরকারীর দরই চড়া। বেগুন কিলো ছয় আনায় নামিয়াছিল – ঐদিন উহা এক টাকা পর্যন্ত উঠে। ফুলকপির দাম দ্বিগুন, বাঁধাকপিও আট আনা হইতে দশ আনার কমে পাওয়া যায় না। কড়াইশুটির দামও বাড়িয়া দ্বিগুন হয়- টমাটোও তথৈবচ। কুমড়া ও লাউয়ের কাটা ফালি কৃষকায় হয়। পালং এর দাম তিনগুণ। কিলো ১৬আনা পর্যন্ত নামিয়াছিল। ঐ দিন আট আনার কমে পালং পাওয়া যায় না। দশ আনা দরে সিম চৌদ্দ আনা হইতে এক টাকা পর্যন্ত উঠে। কাঁচালঙ্কা হইতে শুরু করিয়া সব রকম আনাজ তরকারীর দামই এইরূপ অগ্নিমূল্য থাকে।

বুধবার, ৩০ পৌষ, ১৩৭0 Wednesday, January 15, 1964
• কলিকাতার অবস্থার ক্রমোন্নতি স্থানে স্থানে কার্ফু শিথিল: কলিকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য উপদ্রুত এলাকায় মঙ্গলবার হাঙ্গামাজনিত অবস্থার উন্নতি অব্যাহত থাকে। এইদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রেসনোটে জানানো হয় যে, আজ বুধবার কলিকাতায় সকাল ৭টা হইতে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত কোথাও কার্ফু থাকিবে না। তাহার পর সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে সকাল ৭টা পর্যন্ত কার্ফু যথারীতি বহাল থাকিবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীগুলজারীলাল নন্দ মঙ্গলবার কলিকাতা ত্যাগের পূর্বে বলেন, পরিস্থিতি উন্নতির পথে। তবে শান্তি ও শৃঙ্খলা এবং সকল সম্প্রদায়ের মনে আস্থা ফিরাইয়া আনার ব্যবস্থা এখনও যথেষ্ট নয়। এই সম্পর্কে আত্মসন্তোষের অবকাশ নাই। তিনি এইদিনও শহরের কয়েকটি উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করেন। তাঁহাকে উভয় সম্প্রদায়েরই ক্ষয় ক্ষতির চিহ্ন দেখান হয়।

বুধবার, ৩০ পৌষ, ১৩৭0 Wednesday, January 15, 1964
• কলিকাতার নয়া পুলিশ কমিশনার: শ্রীপ্রণবকুমার সেন ডি-আই-জি মঙ্গলবার অপরাহ্ন হইতে কলিকাতার পুলিস কমিশনারের কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন। বর্তমান পু্লিশ কমিশনার শ্রীশচীন্দ্রমোহন ঘোষ মঙ্গলবার হইতে এক মাসের ছুটি লন বলিয়া জানা গিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন ঐদিন বিকালে সংবাদটি সমর্থন করেন এবং বলেন যে, কয়েকদিন ধরিয়া হাঙ্গামাদমনে ব্যস্ত থাকার পর শ্রী ঘোষ শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছেন। সি আই ডি পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল শ্রী প্রনব কুমার সেন একদা কলিকাতার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনাররূপেও গণ্য হইতেন। চব্বিশ পরগনা জেলার সাম্প্রতিক হাঙ্গামার পর ঐ জেলার পুলিশের কাজকর্ম পরিচালনার সামগ্রিক ভারও শ্রী সেনের উপর ন্যস্ত হইয়াছিল।
বৃহস্পতিবার, ৩ পৌষ, ১৩৭০ (২৮ অগ্রহায়ণ, ১৮৮৫ শক) Thursday, December 19, 1963
• মহানগরীর জনজীবন বিপর্যস্ত: চার-পাঁচ দিন ধরিয়া হাঙ্গামার ফলে কলিকাতার জনজীবন অস্বাভাবিক হইয়া পড়িয়াছে। বাজারে জিনিসপত্র নাই, যানবাহন ও ডাক চলাচল ব্যবস্থা বিঘ্নিত, এমন কি, কোথাও কোথাও পোষ্টাল মেলও পাঠান হয় নাই। সকালবেলা গোয়ালার দেখা নাই এবং হরিণঘাটার দুধও তেমন মিলিতেছে না। যে অঞ্চলগুলিতে কার্ফু জারী হইয়াছে, সেখানকার জনসাধারণের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। আইনে যেটুকু সময় ছাড় পাওয়া যাইতেছে, সেই সময় বাজার হাট করিবার জন্য দৌড়াদৌড়ি পড়িয়া যাইতেছে- আর এক নাগাড়ে কয়েকঘন্টা বাড়ীতে বন্দী থাকিবার পর ছেলেবুড়োর দল রাস্তায় ভীড় করিতেছে।

রবিবার, ৫ মাঘ, ১৩৭০ Sunday, January 19, 1964
• সোমবার অধিকাংশ স্কুল কলেজ খুলিবে: একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হইয়াছে যে, লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ এবং মৌলানা আজাদ কলেজ ভিন্ন কলিকাতার সমুদয় সরকারী স্কুল ও কলেজ সোমবার ২০শে জানুয়ারি পুনরায় খুলিবে। বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হইয়াছে যে, লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ ২২শে জানুয়ারী পর্যন্ত বন্ধ থাকিবে। মৌলানা আজাদ কলেজ একটি ত্রানকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় এই কেন্দ্রের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কলেজে ক্লাশ হইবে না।

সোমবার, ৬ মাঘ, ১৩৭০ Monday, January 20, 1964
• কলিকাতায় ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান: পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু উত্পীড়নের প্রতিক্রীয়াস্বরূর পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি অঞ্চলে সংঘটিত হাঙ্গামার ফলে কলিকাতায় এ পর্যন্ত ৬৫ জন নিহত হয়। পুলিশের গুলীতে নিহত হয় ৩৯ জন। হাঙ্গামায় ও পুলিশের গুলীতে মোট আহত হয় ৫৬২ জন। বিভিন্ন স্থানে পুলিস কর্তৃক এ পর্যন্ত মোট ৬৬৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রবিবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন সাংবাদিকদের নিকট হতাহত ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা সম্পর্কে ঐ তথ্য পরিবেশন করেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, হাঙ্গামায় ৬৫ জন নিহতের মধ্যে ২৫ জন হিন্দু ও ২৫ জন মুসলমান। বাকি কয়েকজনের পরিচয় জানা যায় নাই। ২৯ জন হিন্দু ও ৮ জন মুসলমান পুলিশের গুলিতে মারা যায়। ১০ জন কোন ধর্মাবলম্বী জানা যায় নাই। হাঙ্গামায় যাহারা আহত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে ১১৭ জন হিন্দু, ২৬২ জন মুসলমান, ৩ জন খ্রীষ্টান। ১০ জনের কোন পরিচয় পাওয়া যায় নাই। শনিবার পর্যন্ত কার্ফু অমান্যের জন্য মোট ১,৬৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।


বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যা মন্দিরের সেন্ট্রাল ভবনের উদ্বোধন। — আনন্দ চিত্র।

আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই সকল সংবাদের বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত।
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.