এখনও বইছে তিতাস
‘আবু মিয়া একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজের সহকারী সম্পাদক। সারা সপ্তাহের খবরগুলো ছোট করে রচনা করা থেকে প্রুফ পড়া ও সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত অনেক কাজ তাকেই করতে হয়। শুধু কাগজে তার নাম নেই। জমিলা তার চিঠিতে বেশ খোঁচাটা দিয়েছে, ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। সম্পাদক কে? না, কাগজটার মালিক। সব কিছু তুমিই করছো— আর তোমার নামটাই কাগজের এক কোণে ওরা ছাপতে পারছে না।’ গল্পের বয়ানে এই লেখা যিনি লিখেছিলেন এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। খুব কম লিখেছিলেন। জীবিতও ছিলেন অল্প কাল। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিতে কালোত্তীর্ণ সাহিত্যিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। লেখা ও সাক্ষাত্কার: উজ্জ্বল চক্রবর্তী।

তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।
স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।
ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠ দিয়ে বয়ে গিয়েছে তিতাস। তার পাড়েরই একটি গ্রামের নাম গোকর্ণঘাট। সেখানকার মৎস্যজীবী মানুষরা ছিলেন মল্ল বা মালো সম্প্রদায়ের। ত্রিপুরা-কুমিল্লা অঞ্চলে কৈবর্ত সমাজের প্রধান চারটি বর্গের অন্যতম এই মালো। বর্ণহিন্দু সমাজের চোখে তাঁরা প্রায় ব্রাত্যই ছিলেন। ব্রাত্যজনের সেই রুদ্ধ দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন এক পুরুষ— অদ্বৈত মল্লবর্মণ। নিজের ইচ্ছা, শিক্ষা, কর্ম, শিল্পীসত্ত্বার জোরে ভাগ্য ও সমাজের সমস্ত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তাঁর পরিচয় এবং সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁর প্রতিভার বিচার করা যায় না। কয়েকটি মাত্র কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং উপন্যাস। তা সত্ত্বেও বাঙালি পাঠক তাঁকে মনে রেখেছে। বাংলা নাট্যমঞ্চ তো বটেই বাঙালির সিনেমার ইতিহাসেও তিনি অনায়াসে ঢুকে পড়েছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’কে নিয়ে। উপন্যাসটি শুধু বাংলায় পড়া হয় না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের কারণে বিশ্ব পাঠকের ‘রসদ’ সে। তাঁর জীবনীকারদের মতে, এই উপন্যাসটি আসলে অদ্বৈতের যাপন করা জীবনেরই কথা-চিত্র।

নদিয়ার বগুলায় গত বছরের নভেম্বর মাসে অদ্বৈত জন্মশতবর্ষ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের অধ্যাপক এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনীকার শান্তনু কায়সার বলেন, “মালো না হলে ‘তিতাস’ লেখা যায় না। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, মালো হলেই ‘তিতাস’ লেখা যায় না। এ জন্য শিল্পীর যে কঠিন অন্তর্যাত্রা প্রয়োজন, আজীবন সাধনা করে অদ্বৈত তা অর্জন করেছেন।” এখানেই সাহিত্যিক হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের স্বার্থকতা।

জন্ম, ছেলেবেলা ও পড়াশোনা
১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে গোকর্ণঘাটে অদ্বৈত মল্লবর্মণের জন্ম। তাঁর বাবা অধরচন্দ্র ছিলেন পেশায় মৎস্যজীবী। মালোপাড়ার অন্য পরিবারগুলির মতো তাঁদের পরিবারও খুব দরিদ্র ছিল। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে অদ্বৈত ছিলেন দ্বিতীয়। দারিদ্রের সঙ্গে বাস, তাই ছোটবেলাটা খুব যে স্বস্তিতে কেটেছে, এমন নয়। যদিও আমৃত্যু এই দারিদ্র এবং নিঃসম্বলকে সঙ্গী করেই জীবন কেটেছে অদ্বৈতের। শৈশব কাটতে না কাটতেই হারিয়েছেন বাবা ও মা-কে। শুধু তাই নয় তাঁর দুই ভাইও একে একে মারা যায় ওই ছোটবেলাতেই। এমনকী, যে বোনকে সম্বল করে তাঁর বেঁচে থাকা, কুড়ি বছর বয়স হতে না হতেই সেও মারা যায়। কাজেই ছেলেবেলা জুড়েই অদ্বৈতকে সঙ্গ দিয়েছে অবহেলা, দারিদ্র এবং মৃত্যুর মতো অনুষঙ্গ। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি তিনি। যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন। জীবনযুদ্ধ।

খুব ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে জানার ইচ্ছা অদ্বৈতের মধ্যে ভীষণ ভাবে ছিল। নিরক্ষর মালোদের মধ্যে থেকেও জ্ঞান অর্জনের নানা প্রয়াস তাঁর মধ্যে দেখা যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মাইনর স্কুলে তাঁর বিদ্যার্থী জীবনের শুরু। তাঁর জীবনকথার লেখক তপোধীর ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, মালো সমাজের কয়েক জন চাঁদা তুলে অদ্বৈতের পড়াশুনোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর মতে, বিভিন্ন ভাবে লাঞ্ছিত মালো সমাজ তখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পীড়ন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল। অদ্বৈতই ছিল তাদের সেই মুক্তির ঘুড়ি। তাঁকে সামনে রেখে মালোরা দিনবদলের স্বপ্ন দেখছিল। মাইনর স্কুলে অদ্বৈত প্রথম হতেন বলেও জানিয়েছেন তপোধীর। এর পরের অধ্যায় নিয়ে শান্তনু কায়সার জানিয়েছেন, মাইনর স্কুলের পাঠ শেষে অদ্বৈত অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে একটু মতবিরোধ আছে। কারও কারও মতে, মাইনর স্কুলের পর তিনি এডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন-এ ভর্তি হয়েছিলেন। এই স্কুলের বর্তমান নাম রামকানাই অ্যাকাডেমি। এখান থেকেই ১৯৩৩ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু পরের বছর পড়াশোনায় ছেদ পড়ে এবং অদ্বৈত কলকাতায় চলে আসেন।

গোকর্ণের এই ভিটেতেই জন্মগ্রহণ করেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ

প্রথম লেখা
অদ্বৈত মল্লবর্মণের সহপাঠীদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি কবিতা লিখতেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে তিনি ‘তিতাস’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। শান্তনু কায়সারের মতে, কবিতা ছাড়াও গল্প-প্রবন্ধ লেখার অভ্যাসও তাঁর ছাত্রজীবনেই গড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্কুলে পড়াকালীনই ‘মাসপয়লা’, ‘খোকাখুকু’ বা ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় অদ্বৈতের লেখা ছাপা হয়েছে। এ সমস্ত লেখা তাঁকে কিছুটা পরিচিতিও দিয়েছে তত দিনে। পেয়েছিলেন কিছু পুরস্কারও।

কলকাতায় চলে আসা
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় তিনি একটি বাড়িতে গৃহশিক্ষকতার কাজ করতেন। সেই সুবাদে ওই পরিবারে থাকার জায়গাও পান। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে তাঁকে ওই আশ্রয় ছেড়ে দিতে হয়। কুমিল্লারই কান্দিরপাড়ে কিছু দিন থাকার পর অদ্বৈত পড়াশোনায় ইতি টানেন। এর পর পরই ১৯৩৪ সালের মে-জুন মাস নাগাদ তিনি চলে আসেন কলকাতায়। এই আসার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল, রোজগার। কলকাতায় এসে প্রথমে ‘ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভা’র মুখপত্র ‘ত্রিপুরা’য় কাজ পেলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তবে খুব বেশি দিন এই পত্রিকায় কাজ করেননি। কুমিল্লার নরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন ‘নবশক্তি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সে কাগজের প্রধান সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সহ-সম্পাদক হিসেবে সেখানে কাজ শুরু করেন অদ্বৈত। ‘দেশ’ পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক সাগরময় ঘোষ এক জায়গায় লিখছেন, ‘নবশক্তি’ প্রকাশের সমস্ত দায়িত্ব একাই সামলাতেন অদ্বৈত। সাগরময় সে সময় অদ্বৈতের সহকারী হিসেবে ওই পত্রিকায় কাজ করেন। দু’জনের বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে সাগরময় ‘যুগান্তর’ ঘুরে ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দেন। অদ্বৈত তখন ‘নবশক্তি’র সম্পাদক। লোকসংস্কৃতি বিষয়ে নানা মূল্যবান লেখা লিখছেন। ‘রাঙামাটি’ উপন্যাসটিও এই সময়ে লেখা। ১৯৪১ সালে বন্ধ হয়ে যায় নবশক্তি।

গোকর্ণ গ্রামের প্রবেশপথে লেখকের আবক্ষমূর্তি।
এর পর অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘মোহাম্মদী’ নামের একটি মাসিক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাতেও কাজ করতেন। দু’টো পত্রিকারই দফতর একই বাড়িতে হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা হয়নি। এই সময়ে তিনি লিখলেন উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। সাতটি সংখ্যায় ধারাবাহিক ভাবে সে লেখা প্রকাশিত হয় ‘মোহাম্মদী’তে। কিন্তু মাঝপথে চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় লেখা শেষ করতে পারেননি অদ্বৈত। পাশাপাশি তাঁর লেখা কয়েকটি কবিতাও ছাপা হয় এই পত্রিকায়। অনেকে মনে করেন, এই কবিতাগুলি রাজশক্তির বিরুদ্ধে হওয়ায় পরিচালকমণ্ডলীর সঙ্গে তাঁর মতের অমিল হয় এবং তিনি কাজ ছেড়ে দেন। এর পর বেশ কিছু দিন অন্য কয়েকটি জায়গায় কাজ করেন। শেষে ১৯৪৫ সালে সাগরময় ঘোষের আগ্রহে অদ্বৈত মল্লবর্মণ আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দেন। সাগরময় তখন এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক।

লেখালেখি
ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্র— কবিতা-গল্প-নিবন্ধ লেখায় মনোনিবেশ করেন অদ্বৈত। কলকাতায় আসার পর তাঁর লেখার পরিমাণ যায় বেড়ে। কর্মক্ষেত্রে জোগান দেওয়ার জন্য হলেও সে সব লেখায় অদ্বৈত নিজের ছাপ রাখতেন। বিশেষ করে প্রবন্ধের ক্ষেত্রে তাঁর বিষয় ভাবনা বড় অন্য রকম ছিল। বারমাসী গান, এ দেশের ভিখারি সম্প্রদায়, পল্লিসঙ্গীতে পালা গান, পাখির গান, বরজের গান, ভাইফোঁটার গান— এমন সব আশ্চর্য বিষয় নিয়ে লেখার পাশাপাশি তিনি এই সময়ে ছোটগল্প ও উপন্যাসও লিখেছেন। তাঁর মাত্র চারটি সংরক্ষিত গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়— সন্তানিকা, কান্না, স্পর্শদোষ এবং বন্দী বিহঙ্গ। আর তিনটি উপন্যাস— রাঙা মাটি, শাদা হাওয়া এবং তিতাস একটি নদীর নাম।

‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত তাঁর একটি অনুবাদমূলক রচনা ‘জীবনতৃষা’ পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। উনিশ শতকের প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ্-এর ব্যতিক্রমী জীবন অবলম্বনে আরভিং স্টোন বিখ্যাত এক উপন্যাস লেখেন— লাস্ট ফর লাইফ। এই উপন্যাসেরই বাংলা অনুবাদ ‘জীবনতৃষা’। তবে অনেকের মতে এই লেখা নিছক অনুবাদ নয়, অদ্বৈতের সৃষ্টি জীবনের এক অংশ। ভ্যান গগ্ এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের মানবিক ও শৈল্পিক উপস্থাপন নিয়ে অনেকে দু’জনকে সমভাবনার সহযাত্রীও আখ্যা দিয়েছেন। শান্তনু কায়সার এ প্রসঙ্গে বলেন, “এই দুই শিল্পী প্রাগুক্ত দুর্লভ ক্ষমতা ‘দুই ভিন্ন কাল ও পরিবেশে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন’ তাই কি তাঁদের উভয়কে সাঁইত্রিশ বছরের আয়ু দিয়েছিল?”

আশ্চর্যজনক ভাবে, বেঁচে থাকার সময়কাল কিন্তু এই দুই শিল্পীর একই— মাত্র ৩৭ বছর।

তিতাস ও অদ্বৈত
শৈশব ও কৈশোর যথেষ্ঠ অবমাননা ও দারিদ্রের মধ্যে কাটানোর পর কলকাতায় পৌঁছে যুবক অদ্বৈতের ভাগ্য যে ফিরেছিল এমন উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে। তবে সব লেখাই যে কাজের তাগিদে তেমন নয়। আসলে এই সব লেখালেখির আড়ালে শিল্পী অদ্বৈত ব্যস্ত ছিলেন এক অনন্তের সন্ধানে। নিজের যাপন করা জীবন, ফেলে আসা অতীত, এমনকী, বাংলাদেশের সেই প্রান্তিক এবং অবহেলিত মালোদের কথা এক বারের জন্যও ভোলেননি তিনি। ‘দেশ’ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর শেষ না হওয়া ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে নতুন ভাবে লেখা শুরু করেন তিনি। সমাজে অপাংক্তেয় নিন্মবর্গীয়দের ব্রাত্যজীবন এই উপন্যাসের আধার। শহর কলকাতায় বসে এ লেখা কী ভাবে সম্ভব? তপোধীর ভট্টাচার্য বললেন, “এই উপন্যাস অদ্বৈত মল্লবর্মণের আত্ম-বিনির্মাণ। তাই এই উপন্যাস লিখতে তাঁকে কোনও বাড়তি উদ্যম নিতে হয়নি। তিনি ছিলেন অবজ্ঞাত মালোদের এক জন। সহজাত জীবনের আখ্যান এবং সময় ও পরিসরের নিগূঢ় সম্পর্কের তাৎপর্য তাঁকে চেষ্টা করে বুঝতে হয়নি।”

এই উপন্যাসকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ঋত্বিক ঘটক। কেন এই ছবি তিনি করেছিলেন, সে প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য: আমার কৈশোর এবং প্রথম যৌবন পূর্ব বাংলায় কেটেছে। সেই জীবন, সেই স্মৃতি, সেই নস্ট্যালজিয়া আমাকে উন্মাদের মতো টেনে নিয়ে যায় তিতাসে, তিতাস নিয়ে ছবি করতে।— তিতাস উপন্যাসের সেই পিরিয়ডটা হচ্ছে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার, যা আমার চেনা, ভীষণ ভাবে চেনা। তিতাস উপন্যাসের অন্য সব মহত্ব ছেড়ে দিয়েও এই ব্যাপারটা আমাকে প্রচণ্ড ভাবে টেনেছে। ফলে তিতাস একটা শ্রদ্ধাঞ্জলি গোছের সেই ফেলে আসা জীবনস্মৃতির উদ্দেশ্যে। এ ছবিতে কোনও রাজনীতির কচকচি নেই, উপন্যাসটা আমার নিজের ধারণায় এপিক ধর্মী। এ ছবিতে আমি ঢংটা ধরবার চেষ্টা করেছি। আমার শৈশবের সঙ্গে তিতাসের বহু ঘটনা জড়িয়ে আছে।

মালোপাড়ার তীরে তিতাস নদী

শেষের সে দিন
কলকাতায় আসার পর অদ্বৈত কখনও নিজের খেয়াল নেননি। মেসবাড়িতে থাকার খরচাপাতি সামলে উঠে খাওয়াদাওয়ার প্রতি নজরও দিতে পারেননি ঠিক করে। এক দিকে দরিদ্র স্বজনদের চিন্তা আর অন্য দিকে বই কেনা— স্বাস্থ্য সম্পর্কে বড়ই বেখেয়াল হয়ে উঠছিলেন দিন দিন। সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, “সাহেবরা সে সময়টায় কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাঁদের সংগ্রহের বইপত্র সবই প্রায় বেচে দিচ্ছেন অল্প দামে। সে সব নিয়েই কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় জমে উঠছে পুরনো বইয়ের দোকান। অদ্বৈত ঘুরে ঘুরে সেই সব বই নিজের সংগ্রহে রাখতে শুরু করেন। কাজেই বই কেনার পেছনে যে বেশ টাকাপয়সা খরচা করতেন অদ্বৈত তা স্পষ্ট।” তাঁর মৃত্যুর পর সে সব বই রামমোহন লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষকে দান করে দেওয়া হয়।

সেই সময় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তিতাস পারের মালো পরিবারগুলি উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে পড়ে। কাজের ফাঁকে অদ্বৈত তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা করেন। এগিয়ে দেন অর্থ সাহায্য। অতিরিক্ত রোজগার করতে তাঁকে বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে আংশিক সময়ের কাজও নিতে হয়। কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক ধকল— এ দু’য়ের চাপ নিতে নিজেকে যতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন, তা কখনওই দেননি অদ্বৈত। আর এই সময়েই তাঁর যক্ষা ধরা পড়ে। নিজে জানতেন এই ক্ষয়রোগের কথা। কাউকে কিছু বলতেন না। একে তাঁর অন্তর্মুখী স্বভাব, দুইয়ে চাকরির নিরাপত্তা— রোগ গোপন করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষমেশ সাগরময় ঘোষ এবং আনন্দবাজার গোষ্ঠীর অন্য সহকর্মীদের আন্তরিক চেষ্টায় তাঁকে কাঁচড়াপাড়ার যক্ষা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের প্রাক্ কথায় প্রকাশক লিখছেন, ‘আনন্দবাজার পত্রিকার অর্থানুকূল্যে অদ্বৈত স্বাভাবিক ভাবেই রোগমুক্তির পথে অগ্রসর হইতেছিলেন— কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর ইতিহাস অন্যরূপ।’

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর দিন গুনতে অদ্বৈত মোটেও রাজি ছিলেন না। এক দিকে অসমাপ্ত উপন্যাস আর অন্য দিকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা তাঁকে শুভানুধ্যায়ীদের শত অনুরোধকে এড়িয়ে নারকেলডাঙার ষষ্ঠীতলা রোডের বাড়িতে নিয়ে আসে। ওই বাড়িতেই ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যু হয়।


শান্তনু কায়সার (বাংলাদেশ) (অধ্যাপক এবং গবেষক)
১৯৭৪ সালের জুন মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে যোগ দেওয়ার পরই আমি অদ্বৈত চর্চায় ব্রতী হই। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়ে এই আগ্রহ জন্মায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকার সুবাদে তা যেন আরও জোরদার হয়। মিন্নাত আলি ও প্রাণতোষ চৌধুরীকে নিয়ে বেশ কয়েক বার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অদূরে অদ্বৈতর জন্মস্থান গোকর্ণঘাটে যাই। সেখানে স্থানীয় ও মালোপাড়ার লোকজনের সঙ্গে আলাপ হয়। অদ্বৈতর বিদ্যালয়ে যাওয়ার অন্যতম সহযোগী রূপচাঁদ বর্মণের সঙ্গেও কথা হয় আমার। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কবি মতিউল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। মতিউলকে লেখা অদ্বৈতের প্রথম তারুণ্যে ভরা চিঠি পড়তে দিয়েছিলেন তিনি। বেশ পরে সরাইলের সুধীর দাশ ও হিমাদ্রীশেখর সরকারের সৌজন্যে আমার হাতে আসে অদ্বৈতর দ্বিতীয় চিঠি। এটি তিনি জীবনের শেষ পর্বে হাসপাতাল থেকে লিখেছিলেন। ধীরে ধীরে অদ্বৈত সম্পর্কে নানা তথ্য জোগাড় করি এবং তাঁর অন্য রচনার সন্ধান করি।

অদ্বৈত-চর্চার শুরুতে আমি তাঁর মা ও বোনের নাম জানতাম না। এই বোনের আদলেই তিনি ‘তিতাস’-এ বাসন্তী চরিত্র নির্মাণ করেন। ঢাকার বাংলা অ্যাকাডেমি ১৯৮৭ সালে আমার ‘অদ্বৈত মল্লবর্মণ’ প্রকাশ করেছে। এ বছর কলকাতা থেকে ‘জন্মশতবর্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণ: জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ প্রকাশিত হচ্ছে। এই দুই বইয়ের পার্থক্যই আমার অদ্বৈত-চর্চার ধারাবাহিকতার প্রকাশ। নিরবচ্ছিন্ন এই চর্চা আমাকে কম ঋদ্ধ করেনি। বলা যায়, অদ্বৈত আমার জীবনের অন্যতম প্রধান প্রত্যয়।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নিশ্চয়ই তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, কিন্তু অদ্বৈত তাতেই সীমাবদ্ধ নন। বরং জন্মশতবর্ষের আলোয় সম্পূর্ণ ও অখণ্ড অদ্বৈত মল্লবর্মণই আমাদের বিবেচ্য হওয়া উচিত বলে মনে করি। অদ্বৈতর জীবদ্দশায় প্রকাশিত তাঁর একমাত্র গ্রন্থ ‘ভারতের চিঠি— পার্ল বাককে’য় তিনি যে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, যার পরিণততর প্রকাশ ঘটেছে ‘শাদা হাওয়া’ উপন্যাসে, তা তাঁর ব্যক্তি ও লেখকজীবনের অন্যতম প্রধান দিক। একে বাদ দিয়ে পূর্ণ অদ্বৈতকে বোঝা সম্ভব নয়।

তিনি ছিলেন তাঁর রচনার সবচেয়ে বড় সমালোচক। সে কারণে ‘মোহাম্মদী’তে প্রকাশিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর খসড়াকে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিতে রূপ দেওয়ার সময় তিনি অতটা নির্মম ভাবে এর পরিমার্জন করতে পেরেছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি বলেছিলেন ‘মাস্টার আর্টিস্ট’। কিন্তু লেখকের জন্মশতবর্ষে তাঁর ‘তিতাস’ প্রকাশের এত বছর পর বলতে দ্বিধা নেই, তিনিও কম বড় ‘মাস্টার’ ছিলেন না। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁর অর্জন বিশ্ব মানদণ্ডেও তুলনাহীন।

তিনি স্বল্পায়ু ছিলেন, কিন্তু এর মধ্যেই এক ধরনের পূর্ণতা তাঁর ঘটেছিল। তাঁর উপন্যাস পড়ে কখনও কখনও মনে হয় সাম্প্রতিক ডিসকোর্স পড়ছি। সৃজন ও মননের এক অসাধারণ যুগলবন্দি অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তাঁর ছোটগল্প মাত্র কয়েকটি, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। তিতাস পোশাকি নয়; ঘরোয়া, আটপৌরে। ব্রাত্য জীবনের রুদ্ধ মুখ খুলে তিনি তাকে অনন্য করেছেন।


তপোধীর ভট্টাচার্য (শিলচর) (সাহিত্যিক এবং অধ্যাপক)
‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের অনন্য স্রষ্টা অদ্বৈত মল্লবর্মণ সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবেড়িয়া শহরের কাছে গোকর্ণঘাট গ্রামে ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি সংক্ষিপ্ত জীবনের যাত্রা শুরু করেন। সংক্ষিপ্ত, কারণ মাত্র ৩৭ বছর বয়সে, ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। অদ্বৈত চারটি ছোটগল্প ও চব্বিশটি নিবন্ধ লিখেছেন। এ ছাড়া ‘ভারতের চিঠি পার্ল বাককে’ এবং ‘জীবনতৃষা’ নামে তাঁর দু’টি বইও প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলি তাঁর বিচিত্রগামী প্রতিভার দৃষ্টান্ত। শেষোক্ত বইটি প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ভ্যান গগের জীবনকাহিনি ‘লাস্ট ফর লাইফ’-এর অনুবাদ। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর জন্য যদিও অদ্বৈত স্মরণীয়, ‘রাঙা মাটি’ ও ‘শাদা হাওয়া’ নামে আরও দু’টি ছোট উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন।

১৯৩৪ সালের ২৩ জুন একটি ছাত্রের কবিতা পড়ে চিঠিতে অদ্বৈত যা লিখেছিলেন, তা তাঁর নিজের সম্পর্কেও প্রযোজ্য। “সাধনা না করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে নাই। আর সাধনা যা করিবেন নীরবে নীরবেই করিবেন। আগুন কখনও ছাই ঢাকা থাকে না।” বাংলা সাহিত্যে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর স্বাতন্ত্র্য অনস্বীকার্য। অদ্বৈত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শুধুমাত্র উপন্যাসই লেখেননি, আত্মস্মৃতি ও আত্ম জিজ্ঞাসার মন্থনে তৈরি করেছেন নতুন বাস্তবতা আর পুনর্বিন্যস্ত এক নতুন পৃথিবী। অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিজে সক্রিয় পর্যবেক্ষক ও কথক; আখ্যানে তাঁর উপস্থিতি বর্তমানের হৃদস্পন্দনে কৌম অতীতকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছে। পরিবর্তমান সময়ও যেন উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। অদ্বিতীয় এই উপন্যাসকে আমরা তাই কেবলই পুনরাবিষ্কার করতে থাকব।


রামকুমার মুখোপাধ্যায় (সাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ, বিশ্বভারতী গ্রন্থণ বিভাগ)
অদ্বৈত মল্লবর্মণ যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে জল-হাওয়ার মধ্যে তিনি মানুষ, তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে। সাহিত্য জীবন শুরু করেন গল্প-কবিতা দিয়ে। সাহিত্যের মাপকাঠিতে খুব উচ্চমানের না হলেও সে সব কবিতা মনকে কোথাও ছুঁয়ে যায়। লোকসংস্কৃতি নিয়ে অসাধারণ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন অদ্বৈত। নিজের দেখা জীবনকে তিনি ধরেছিলেন সেই সব লেখায়। কয়েকটি ছোটগল্পও লিখেছিলেন। সাহিত্যের কারবারিরা এই ছোটগল্পগুলি নিয়ে তেমন আলোচনা করেননি। তবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের বিশেষ পরিচিতি কিন্তু তাঁর উপন্যাসকে ঘিরে। হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র উপন্যাস, তবুও সে লেখাকে নিয়ে সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা নাট্যমঞ্চ সমৃদ্ধ হয়েছে। উজ্জ্বল হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসও। উৎপল দত্তের নির্দেশনায় নাটক এবং ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় সিনেমা— ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ আজও বাঙালি মনে রেখেছে। তাঁর এই উপন্যাসটি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, ফরাসি-সহ অন্যান্য ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। ইংরেজিতে এই উপন্যাস অনুবাদ করেছেন কল্পনা বর্ধন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বাঙালি মানসকে এতটাই আলোড়িত করে যে, অনেক বাবা-মা তাঁদের সন্তানদের নাম রেখেছেন তিতাস। জীবনকাল খুবই ছোট হলেও বাংলা সাহিত্যের জন্য যে শব্দাবলী অদ্বৈত লিখেছেন, তা এখনও আমাদের সম্পদ। ছোটবেলা থেকে শুরু করে প্রায় সারা জীবনই তিনি দারিদ্রের মধ্যে কাটিয়েছেন। তাঁর লেখায় আমরা সেই জীবনযাপন দেখতে পাই। জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর দেহ-মনকে যে ভাবে গড়ে তুলেছে, সেই অনুভূতিই তিনি ঢেলে দিয়েছেন সাহিত্য নির্মাণে। শুধু বুদ্ধি বা মেধা নয়, নিরন্ন বা ছিন্নমূল মানুষও নয়, তাঁর লেখার আসল যাদুকাঠি জীবন-অনুভব। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। তার মধ্যে বিশ্বভারতীর গ্রন্থণ বিভাগও রয়েছে। সেই একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে জেনেছি, তিনি এমন এক জন মানুষ ছিলেন, যিনি সর্বদা অন্যের কথাই ভাবতেন। এ দেশের ভিখারি সম্প্রদায় নিয়ে তাঁর অসামান্য একটি প্রবন্ধের কথা মনে পড়ছে। এমন একটা বিষয় নিয়ে যে লেখা যায়, সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তো বটেই, ভাবনাটা এই লেখক আমিকেও বেশ অবাক করে। আমার আশা, জন্মশতবর্ষে তাঁকে আরও বেশি করে জানবে ও পড়বে আজকের প্রজন্ম। সেটা কিন্তু বেশ জরুরি।


কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় (চলচ্চিত্র পরিচালক)
অদ্বৈত মল্লবর্মণের সঙ্গে আমার পরিচয় মূলত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের মাধ্যমে। বাংলাদেশের একটি নদী লাগোয়া গ্রামের কথা এই লেখায় এমন ভাবে উঠে এসেছে যা আমার কাছে এক বিস্ময়। উপন্যাস পড়ে যতটা বিস্মিত হয়েছি, ঠিক ততটাই আশ্চর্য হয়েছি ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখে। উপন্যাসের বিস্তৃতি অনেক বড়। সিনেমা করার সময় ঋত্বিকবাবু তার পরিসর কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেছিলেন। কিন্তু তাতে মূল লেখার কোনও পরিবর্তন হয়নি। নদীমাতৃক দেশে মৎস্যজীবীদের বেঁচে থাকা, তাঁদের প্রতি দিনকার জীবন সংগ্রাম এবং অপসৃয়মান এই পেশা ও দৈনন্দিনতা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে উঠে এসেছে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ। সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র, দু’টি আলাদা মাধ্যম হলেও আমার মনে হয়, দু’টো নির্মাণই কালজয়ী। ‘পথের পাঁচালি’র মতোই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পড়া এবং দেখা আমার কাছে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। কী অসামান্য দক্ষতায়, এক বিশাল ক্যানভাসে নির্মিত হয়েছে এই উপাখ্যান! এমন ‘ডিটেইল’, সাহিত্যের পাঠক এবং চলচ্চিত্র নির্মাণকারী হিসেবে আমাকে ভাবায়। সিনেমা তো আছেই, কিন্তু মূল ‘টেক্সট’টাও সারা বিশ্বের কাছে বন্দিত। এই আখ্যান আসলে বিশ্ব সাহিত্যের সম্পদ। উৎপল দত্ত তিতাস-কে মঞ্চে উপস্থাপন করেছিলেন। আমি দেখিনি, কিন্তু যাঁরা দেখেছিলেন সেই মঞ্চায়নে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির পাশে আমি অদ্বৈত মল্লবর্মণের নির্মাণকেও রাখব। যদিও নামটি আম-বাঙালির কাছে আজও অনুচ্চারিত, তবুও এই জন্মশতবর্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণকে আরও বেশি করে পড়া উচিত বলে আমি মনে করি।


ঋণ: • বাংলাদেশ থেকে বর্তমান গোকর্ণঘাট ও তিতাস নদীর ছবি-সহ নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন প্রাণতোষ চৌধুরী, জয়দুল হোসেন এবং বাবলু ভট্টাচার্য।
• অদ্বৈত মল্লবর্মণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি
• অচিন্ত্য বিশ্বাস, অদ্বৈত মল্লবর্মণ: একটি সাহিত্যিক পরিস্রোত

 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.