‘চিৎকার, চেঁচামেচি মাথাব্যথা...
হুল্লোড় হইচই ব্যস্ততা...
এই নিয়েই হল কলকাতা’
গানটির চুড়ান্ত স্বার্থকতা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে চলেছে আমাদের শহর।
‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না বোঝা’, চিরপরিচিত একটি প্রবাদবাক্য। তবে সারমর্মটা সত্যিকারের অনুভূত হয়েছে বিগত বছর তিনেকে। মেয়েবেলা থেকে বেড়ে ওঠার প্রতিটা মুহূর্ত কেটেছে কলকাতার বুকে। মায়ের বকুনি, বাবার প্রশ্রয় অথবা ভাইয়ের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা, ছোটবেলার মারপিট— সব কিছুকেই ঘিরে আছে আমাদের শহর। ছোটবেলার ছোট ছোট গল্পকথা, যেগুলির হয়ত আলাদা কোন অস্তিত্বই নেই কারো কাছে, আজ খুব বড় হয়ে ফিরে আসে জীবনে। হয়তো বা আর কোনও দিন সে সব দিনগুলি জীবনের সঙ্গে মেলানো সম্ভব হবে না বলেই। এর সঙ্গেই এসে পড়ে আরও অনেক অনেক কথা— কৈশোর-যৌবনের অনেক ভাললাগা বা মন্দলাগা।
স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢোকা মানেই তো অবাধ স্বাধীনতা! নেই দিদিমণিদের চোখরাঙানির ভয়, শুধু বছরের শেষে উপস্থিতির হার ঠিকঠাক রাখতে পারলেই হল। আমাদের কলেজটা ছিল শহরের বেশ মধ্যমণিতেই। তাই কলেজ জীবনের প্রথম কিছু দিন ছিল ভীষণ রোমাঞ্চকর। সেই প্রথম আমার দেখা কলকাতা শহরকে। হাতিবাগানের বাজার ছিল আমাদের কলেজের একেবারে কাছে। তাই মাঝে মাঝেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। আর ওই চত্ত্বরে তো দু’পা হাটলেই একটা করে সিনেমা হল। ক্লাস করতে তাই ইচ্ছে হত না মাঝে মাঝেই। এর পর শুরু হল অকারণ শহর ঘোরা। শোভাবাজার-শ্যামবাজার-বাগবাজারের অলিগলিতে ঘোরার নেশায় পেয়ে বসল আমায়। সঙ্গী হয়ত বা কেউ থাকত কখনও। কখনও আবার একা একাই ঘুরে বেড়াতাম। এ ভাবেই আমার চেনা বিবেকানন্দের পৈতৃক বাড়ি, ভগিনী নিবেদিতার বাড়ি, শোভাবাজার রাজবাড়ি, ঠনঠনিয়া কালিবাড়ি, গোলবাড়ি অথবা বাগবাজার ঘাট। মাঝে মাঝে ট্রামে চেপে ঘুরে বেড়াতাম শহর,আবার ফিরতি ট্রামে ফিরে আসা একই স্থানে। এর পর শুরু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। দল বেঁধে কফিহাউসে এক প্লেট পাকোড়া নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, বইপাড়ায় অকারণ ঘুরে বেড়ানো, কলেজ স্কোয়ারে লেকের জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা, প্যারামাউন্টে গলা ভেজানো অথবা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেই সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া। কিংবা প্রিন্সেপ ঘাটের সূর্যাস্ত আর বাগবাজার থেকে লঞ্চে করে সান্ধ্যভ্রমণ— এ ভাবেই কেটে যাওয়া আরও দু’টো বছর। এর পর আরও কিছুদিন চলে নন্দন, রবীন্দ্রসদন, আকাদেমি, চলচ্চিত্র উৎসব, বইমেলা আর ভিক্টোরিয়ার সামনে থেকে ঘোড়ার গাড়ি চড়ার চিরনতুন দিনগুলির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকা।
এক সময়
আসে জীবন গড়ার দিন। আর সেই সময়কে ভর করেই আজ শহর থেকে চলে আসা অনেকটা দূরে। ফেলে আসা সময়ের মধ্যে থেকে সেই সময়ের গুরুত্ব হয়ত আলাদা করে আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু আজ কলকাতা ছেড়ে আসতে হয়েছে বলেই বোধ হয় প্রতিনিয়ত অভাব অনুভব করি সেই উত্তাপের, সেই প্রাণের, সেই অতি পরিচিত শহর কলকাতার রাজপথের অথবা অলিতে গলিতে আটকে থাকা জীবনবোধের। কলকাতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া জীবনটাকে ফিরে পেতে ইচ্ছে করে ভীষণ ভাবে। তারই প্রতিক্ষায় শুধু দিন গোনা।
কর্মসূত্রে বর্তমানে কাঁথি শহরে বাস। তবে বাড়ি এ শহরেই। ভালবাসে
লেখালেখি করতে, বই পড়তে। কাজের পাশাপাশি একটি ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত। এ সব নিয়েই সময় কেটে যায় বেশ। তবে কলকাতাকে খুব ‘মিস’ করে সব সময়ে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.