এখনও খুঁজি জলের মধ্যে জাহাজ,
আর জুতোর মধ্যে বাড়ি দেবেশ চট্টোপাধ্যায় নাট্য ব্যক্তিত্ব
'এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু, পালাতে চাই, তত সে আসে আমার পিছু পিছু'
কবীর সুমনের গানটা মনে পড়ল। কিন্তু এই শহর তো আমার ‘প্রথম সব কিছু’ জানে না! তবুও পালাতে চাইলে পালাতেও পারি না কেন? কেন?
উত্তর চব্বিশ পরগনার গ্রামে জন্ম, রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশোনা, হাবরা আর গোবরডাঙা কলেজে উচ্চশিক্ষা। এর ফাঁকে কলকাতা হাতছানি দিয়েছে, মায়াবী চোখের ইশারায় মাঝে মাঝেই পথ ভুলিয়েছে গ্রাম থেকে শহরে। বাবা-মার হাত ধরে কলকাতা ভ্রমণ সত্তরের দশকে, বছরে দু’ তিনবার বাঁধা ছিল। কখনও বা বেহালায় মামার বাড়িতে রাত্রিযাপন। খুব ছোটবেলায় একবার কোথায় একটা গিয়েছিলাম, সেখানে জলের মধ্যে জাহাজ আর পাশে জুতোর মধ্যে বাড়ি ছিল, অনেকটা রূপকথার মতো। ভেবেছিলাম আমার ছেলেকে সেখানে বেড়াতে নিয়ে যাব, কিন্তু ঠিকানাটাই কেউ বলতে পারল না। কলেজে পড়াকালীন অর্গানিক কেমিস্ট্রি পড়তে আসতাম কাঁকুরগাছির এক আবাসনে। গোবরডাঙা থেকে ফার্স্ট বনগাঁ লোকালে সকালে নেমে পড়তাম উল্টোডাঙা স্টেশনে। তার পর রেললাইনের সমান্তরাল রাস্তাটা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বস্তির মানুষজনের দিন শুরু হওয়া দেখতে দেখতে যখন পৌঁছতাম সেই স্যারের কাছে, তিনি প্রতিদিন ভালবেসে ব্রেকফাস্ট করে দিতেন। অত দূর থেকে আসতাম তো। আমি আমার নিজের শিক্ষকতার জীবনে এত ‘ভালমানুষ’ হতে পারিনি কখনও। পড়া শেষ হলে চলে যেতাম গ্লোব, নিউ এম্পায়ার, যমুনায়— ইংরেজি ছবি দেখতাম গোগ্রাসে। ফেরার সময় লেনিন সরণি দিয়ে ওয়েলিংটন, মৌলালি হয়ে শিয়ালদায়। রাতের ভিড়ে ঠাসা বনগাঁ লোকালে ধাক্কা খেতে খেতে গোবরডাঙার বাড়িতে। তখন আমার একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। মৌলালি, ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটের গলি থেকে উদ্ধার করতাম আশ্চর্য সব মণি-মাণিক্য। পুরনো দিনের নাটক থেকে রজার হুইটিকার— তার পর সেগুলো বগলদাবা করে চলে যেতাম কলেজ স্ট্রিট। টিউশনির জমা পয়সা থেকে ফুটপাত থেকে কিনে ফেলতাম বই, তা নিয়ে উঠে পড়তাম কফি হাউসে। ইনফিউশন আর পকোড়া খেতে খেতে উল্টে ফেলতাম তার পাতা।
মঞ্চ-বন্ধুরা...
সুজন মুখোপাধ্যায় ও ব্রাত্য বসুর সঙ্গে...
দেবশংঙ্কর হালদারের সঙ্গে...
এ সবই আশির দশকের শেষ দিককার কথা। ইতিমধ্যে ব্রাত্য (বসু) আমার বন্ধু হয়ে গেছে থিয়েটারের সূত্রে। ওর সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় হাঁটতাম, চেনা রাস্তা আর অচেনা গলি দিয়ে কত চেনা-অচেনা সুখ-দুঃখের স্মৃতি এখনও বহন করি। এই শহরের মেয়ে বাগবাজারের কস্তুরীর প্রেমে পড়লাম যখন, ব্রাত্য আমার সেই মনের কথা কস্তুরীকে জানিয়েছিল টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনে। তার পর চাকরি নিয়ে চলে এলাম কলকাতায়। থাকতাম শ্যামবাজার পাঁচমাথার কাছে বৃন্দাবন পাল লেনের একটা মেস-এ। ব্রেকফাস্ট করতাম পাঁচমাথার একটা চায়ের দোকানে— কড়কড়ে টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ। গোলবাড়ির কষা মাংস বা মিনার-এর কিমা দিয়ে ডিনার। নাটকের রিহার্সাল করতাম তেলেঙ্গাবাগানে, যেখানে অলিতে-গলিতে আপাত-নিষিদ্ধ সব খাদ্যবস্তুর হাতছানি।
এর পর এল অন্য জীবন। একা নয়, হলাম দু’জন। আমি ও কস্তুরী। লেকটাউনের ফ্ল্যাট, আদ্যনাথ সাহা রোডে শুরু হল জীবন-যাপন। ১৯৯৩ সাল, কলকাতার পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে গেলাম। ‘জীবন গিয়াছে চলে কুড়ি-কুড়ি বছরের পার’— কেমন যেন মুহূর্তে কেটে গেল কুড়িটা বছর। নিজের নাট্য দল ‘সংসৃতি’ তৈরি হল, আমার সন্তান ডোডো জন্ম নিল। ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ জনপ্রিয় হল, বিক্রি করতে হল ফ্ল্যাট। আরও আরও নাটকের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। চাকরি ছাড়লাম। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজের আস্তানা গড়লাম। একের পর এক ঘটনাবহুল জীবন। কত এল, কত গেল। সময়ের হাত ধরে কত কি মিলিয়েও গেল। মাঝে মধ্যে স্মৃতি হয়ে তারা ফিরেও আসে। খুব খারাপ লাগে না পিছু ফিরে দেখতে। এক এক সময়ে বিরক্তিও লাগে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির নাটমন্দিরে মঞ্চস্ত করা ‘গৃহ প্রবেশ’
যখনই ভেবেছি আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, এ বার পালাতে হবে। তখনই সেই মায়াবী চোখ আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলেছে ‘যত দূরে, দূরে দূরে যাবে বন্ধু, একই যন্ত্রণা পাবে’। তাই আর পালানো হল না, বুকের মধ্যে চোরা মফস্সল নিয়েই থেকে গেলাম কলকাতায়।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.