দিন আসে, দিন যায়, তার ফাঁকেই ইতিহাসে ঢুকে পড়ে তার চলাচলের খবর। পুরনো দিনের শহুরে খবর দিয়ে চেনা যায় এখনকার
অতি পরিচিত শহরের অতীতটাকে, তার নাগরিক জীবনযাপন থেকে খেলাধুলো, সংস্কৃতি বা কূটকচালি থেকে রাজনীতির হাল।
পঞ্চাশ বছর আগের কলকাতা শহরের গতিবিধি চিনতে ২১ অক্টোবর ১৯৬৩ থেকে ২০ নভেম্বর ১৯৬৩ এক মাসের কিছু বিশেষ খবর।
সোমবার, ৩ কার্তিক, ১৩৭০ (২৯ আশ্বিন, ১৮৮৫ শকাব্দ) MONDAY, OCTOBER 21, 1963
• কুমারটুলি জমজমাট প্রতিমা ক্রেতাদের ভিড়: কুমারটুলির অলিগলিতে লোকে গিজগিজ করিতেছিল। মনে হইতেছিল, এতটুকু খালি জায়গা কোথাও নাই। রবিবারের কুমারটুলি যেন এক নতুন রূপ ধারণ করে। পূজার আর চারদিন বাকী। অর্ডারী প্রতিমা ডেলিভারি লইবার জন্য দূর দূরান্ত হইতে লোক আসিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। মৃত্ শিল্পীর এতটুকু ফুরসত্ নাই। শেষ তুলির স্পর্শ লাগাইয়া শিল্পী কারখানা হইতে প্রতিমা বাহির করিয়া দিতেছেন। দেবীর চরণে প্রণতি জানাইয়া অপলক দৃষ্টিতে শেষবারের মত তাকাইয়া দেখিতেছেন কোথাও কিছু খুঁত্ আছে কিনা। ওদিকে রিষড়ার যুবক সঙ্ঘের সম্পাদক তাগিদ দিতেছেন: সন্ধ্যা হইয়া আসিল, জি টি রোডের পথ ধরিয়া যাইতে হইবে। কথা ছিল সকালে ডেলিভারি দিবেন, এখনো বাকী? সোনারপুর মিলন সঙ্ঘের ছেলেরা ত ক্ষেপিয়া লাল। সে কি মশাই, কথা দিয়া কথা রাখেন না! চাঁদা তোলা এখনো বাকী, রবিবারটা এখানেই কাটিয়া গেল। শিল্পীর মুখে এক কথা, এই যে পাঁচ মিনিট! ব্যস্ততার অন্ত নাই। কুমারটুলি সরগরম হইয়া উঠিয়াছে। ছোট বড় প্রতিটি কারখানায় গত কয়েকদিন ধরিয়া প্রায় দিবা-নিশি কাজ চলিতেছে। শিল্পীর চোখের ঘুম চলিয়া গিয়াছে।
বুধবার, ৫ কার্তিক, ১৩৭০ (১ কার্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) WEDNESDAY, OCTOBER 23, 1963
• আজ ষষ্ঠী: পূজো এল। পিঠে পিঠে ঢাক, হাতে কাঠি— শ্যামবাজারের পাঁচ মাথায় ঢাকিদের এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ, গড়ের বাদ্যির জোগাড় নিয়ে হ্যারিসন রোডে ব্যাগ পাইপ আর শানাইওয়ালা ড্রেস পরে কুচকাওয়াজের জন্য তৈরী, গণেশ ঠাকুর ইঁদুর-সহ ঠেলাগাড়ির সওয়ারী, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তার খাটানো কমপ্লিট, —হ্যালো, ওয়ান...টু...থ্রী, ভলানটিয়াররা রেডি, আর মাত্র ক’টি ঘণ্টা, দিনের আলো নিভতে না নিভতে বোধন, রাত পোহালেই পূজো। আর্বিট্রেশন, কিংবা বড়সাহেবের চেম্বার দুয়ারে পায়চারি— সহ ইতি, কলকাতায় এখন পুজো। আপিসে আপিসে তালা পড়েছে, হাওড়ার মুট বয়ে বয়ে গরম ট্যাক্সি হুড্ খুলে হাওয়া খাচ্ছে, লালদিঘির টলটলে জলে সাদা মেঘ ভাসছে, টেলিফোন ভবনের ছুটিহীন মেয়েটি জানালা দিয়ে অপলক সেদিকে তাকিয়ে আছে। ওঁরা কিংবা দোকানে দোকানে যাঁরা দেড়মাস ধরে পূজোর কলকাতাকে সাজাচ্ছেন সেই ছুটিহীন পসারীরা, অথবা লালবাজারের অতন্দ্র প্রহরীরা অবশ্য ব্যতিক্রম। সীমান্তে দূরবীন ঠেকিয়ে যে বাঙ্গালী ছেলেটি পূজো উদযাপন করতে চলেছে, কিংবা পূজোর কলকাতাকে সচল রাখার দায়িত্ব নিয়ে যে গৃহস্থদল ট্রাম আর বাসের কাণ্ডারী, ব্যতিক্রম তাঁরাও।
বুধবার, ৫ কার্তিক, ১৩৭০ (১ কার্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) WEDNESDAY, OCTOBER 23, 1963
• পূজোয় মাইক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ: কলিকাতা পুলিশের এক বিজ্ঞপ্তিতে দূর্গাপূজার উদ্যোক্তাগণকে পূজোমণ্ডপ হইতে সহ্গীত প্রচারের উদ্দেশ্যে লাউডস্পিকার ও মাইক্রোফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনুরোধ করা হইয়াছে। পূজার উদ্যোক্তাদের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিতে এবং এই সকল নিষেধাজ্ঞা কার্যে পরিনত করিতে তাঁহাদের সহযোগিতা লাভের জন্য স্থানীয় আধিকারিকগণকে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
পূজা মণ্ডপের বাহিরে কোন মাইক্রোফোন অথবা লাউডস্পিকার বসাইবার অনুমতি দেওয়া হইতেছে না। ডিভিসন সমূহের ডেপুটি কমিশনারদের ১৯৬৩ সালের ২৪শে হইতে ২৬শে অক্টোবর (সপ্তমী হইতে নবমী) পর্যন্ত ও ১লা নবেম্বর, (লক্ষ্মীপূজা) কেবল সকাল ৬টা হইতে রাত্রি ১০টা পর্যন্ত মণ্ডপের ভিতর লাউডস্পিকার ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে।
শুক্রবার, ৭ কার্তিক, ১৩৭০ (৩ কার্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, OCTOBER 25, 1963
• দুর্যোগের পরিবেশে মহাসপ্তমী উদযাপন: কালো পিচঢালা আকাশ হইতে অবিরাম বর্ষণ বৃহস্পতিবার কলিকাতা ও শহরতলী এলাকার বাঙ্গালীর বহু আকাঙ্ক্ষিত জাতীয় উত্সব দূর্গাপূজার প্রথম দিন সপ্তমী দিবসের আনন্দ ম্লান করিয়া দেয়। মহানগরের বিভিন্ন পূজামণ্ডপে সুসজ্জিত তোরণ নির্মিত হইয়াছে, আলো ঝলসিয়া উঠিয়াছে, মাইক বাজিয়াছে, প্রতিমা দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাস্তা ও ফুটপাথ জুড়িয়া অবরোধ বসিয়াছে, পোশাকদূরস্ত স্বেচ্ছাসেবক বাঁশি হাতে প্রস্তুত রহিয়াছে, ‘প্রবেশ নিষেধ’ কণ্টকিত পথের মোড়ে মোড়ে ট্র্যাফিক পুলিশের কড়া পাহাড়া তীব্র হুইসিলে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করিয়াছে। কিন্তু বৃথা। বরুণ দেবতা অকরুণ অঝোরধারায় উত্সবের আনন্দ ভাসাইয়া দিলেন। সকল আয়োজন এই দিনের জন্য ব্যর্থ হইল। ভিজা স্যাঁতসেঁতে কাদা-ল্যাপটানো রাজপথে অন্যান্য বত্সরের মত প্রাণোচ্ছল জনস্রোত অনুপস্থিত। ট্রামে-বাসে যাত্রী একরকম নাই বলিলেই চলে। সন্ধ্যায় পূজামণ্ডপগুলির ভিতরে চাঁদোয়ার নীচে মুষ্ঠীমেয় লোকের জটলা—পাড়ার ছেলেমেয়েরা দেবীর অরতি দেখিতে আসিয়াছে, আর বাহির হইতে পারে নাই। বিভিন্ন অঞ্চলে বাড়ীর সামনে সুসজ্জিতা তরুণীরা দাঁড়াইয়া আছে। বোধ হয় মনে মনে বরুণ দেবতাকে অভিসম্পাত দিতেছে, তিনি উত্সবের একটি দিন এমন অশ্রান্ত বর্ষণে মাটি করিয়া দিলেন।
শুক্রবার, ৭ কার্তিক, ১৩৭০ (৩ কার্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, OCTOBER 25, 1963
• মা এবার মেঘবাহন: যেন সপ্তমী কোরমাখানো নতুন কাপড় পরিধান করে হাসতে হাসতে উপস্থিত হলেন, —হুতোমের সেই সপ্তমী এবার আর কলকাতায় আসেনি। যদিও দোলায় চড়ে বেহারাদের পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে আসার কথা এবং যদিও তদনুযায়ী ফলং-সকড়ং ভষেত্-এর সিম্পটমসও কিছু কিছু ছিল তাহলেও মা এসেছেন এবার মেঘের বাহনে। (‘একে মহিলা তার উপর ভি আই পি মেজাজের ঠিক কি’—প্যান্ডেলে শ্রুত)। সে কী আলিপুরের হাওয়া কলের কারিগরী দেখতে অথবা ওয়াস এন্ড ওয়ার-এর মাহাত্ম যাচাই করতে সেকথা তিনিই জানেন। গত কাল সখেদে গোটা কলকাতা (অবশ্য রিক্সা ও ট্যাক্সিওয়ালা ব্যতিক্রম) জেনেছে মা এবার ছিচকাঁদুনে। সে কী সস্তা কেঁদে নাম কেনার মতলবে, অথবা সত্যিই চাল-চুলোর অবস্থা দেখে সেকথা দেবা ন জানন্তি, মনুষ্যা শুধু জেনেছে— গতিক এবার সুবিধের নয়।
শুক্রবার, ৭ কার্তিক, ১৩৭০ (৩ কার্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, OCTOBER 25, 1963
• মত্স্য দুর্মূল্য ও দুর্লভ: এমনিতেই বাজার আগুন। তারপর পূজার গরম। তাই রাজ্য সরকারের মত্স্য দপ্তরের আশার বাণীতে ছাই দিয়া বৃহস্পতিবার দূর্গা-সপ্তমীর দিন কলিকাতা ও সহরতলীর বাজারগুলিতে মাছের দাম চড়চড় করিয়া বৃদ্ধি পায়। অনেক বাজারেই কাটা পোনার দর ৬ টাকা পর্যন্ত উঠে, আর কাটা ইলিশের দর দাঁড়ায় ৪ টাকা—৫ টাকা। দমদম গোরাবাজারে কাটা ইলিশ ৫ টাকা দরেও বিক্রী হয়। অন্যান্য মাছেও ঐ দরের ঝাঁঝ লাগে। এই দিন মাংসহীন হওয়ায় আমিষভোজীদের সবটা চাপ অবশ্য মাছের বাজারেই পড়ে। কিন্তু আসল কথা, এই দিন মাছের বাজারে মাছের পরিমাণই ছিল খুব কম। পূজার দিন বলিয়া দই-মিষ্টির বাজারও অগ্লিমূর্তি ধারণ করে।দৈ-এর দর অন্যান্য দিনের তুলনায় ২৫ নয়া পয়সা হইতে ৭৫ নয়া পয়সা বেশি হাঁকা হয়। সন্দেশ, রসগোল্লা ইত্যাদি মিষ্টদ্রব্য অধিকতর ক্ষুদ্রাবয়ব ধারণ করে। তবে ভরসার কথা, খাদ্য দপ্তরের প্রশাসনিক গুণে কয়েকদিন আগে চালের বাজারের যে অবস্থা গিয়াছে তাহাতে দই সন্দেশ খাওয়ার সাধ অনেকেরই অন্তত কিছু দিনের মতো মিটিয়া গিয়াছে।
শুক্রবার, ৭ কার্তিক, ১৩৭০ (৩ কার্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) FRIDAY, OCTOBER 25, 1963
• পূজামণ্ডপ ভস্মীভূত, প্রতিমার ক্ষতি: বুধবার শেষ রাত্রে হ্যারিসন রোড- হায়াত্ খাঁ লেনের মোড়ে শিয়ালদহ পল্লী সর্বজনীন দুর্গোত্সবের পূজামণ্ডপে আগুন লাগে। ফলে মণ্ডপটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয় এবং আগুনের শিখায় দুর্গা প্রতিমা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে বৃহস্পতিবার তিলজলায় একটি পূজামণ্ডপে বৈদ্যুতিক সংযোগস্থলে আগুন লাগে এবং কাঁসারিপাড়া সর্বজনীন দূর্গোত্সব মণ্ডপের নিকট তিনটি বৈদ্যুতিক তারের স্তম্ভ উপড়াইয়া পড়িয়া বিভ্রাট ঘটায়। গত বছরও অষ্টমীর দিন টালিগঞ্জ, টাটিগড়, বেহালা ওকোন্নগরে মোট চারটি পূজামণ্ডপে আগুন লাগে।প্রথম দুইটি সম্পূর্ণ এবং শোষোক্ত দুইটি স্থানের পূজামণ্ডপ দুইটি আংশিক ভস্মীভূত হয়। ঐ বছর দশমীর দিনও হাওড়ার একটি পূজামণ্ডপ পুড়িয়া গিয়াছিল। বুধবার শেষরাত্রে হ্যারিসন রোড ও হায়াত্ খাঁ লেনের মোড়ে শিয়ালদহ পল্লী সর্বজনীন দূর্গোত্সবের পূজামণ্ডপে আগুন লাগিলে উদ্যোক্তা ও স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ত্রাসের মধ্যে সৃষ্টি হয়।
মাছ নয়, বলির জন্য পাঠাও নয়। পশ্চিমবঙ্গ
সরকার পূজার সময় কলিকাতাবাসীদের কেবল মুরগী,
হাঁস, ডিম ইত্যাদি বেশী করিয়া সরবরাহ করিয়াছেন।
প্যান্ডাল করতেই সব
টাকা খরচ হয়ে গেছে, সেজন্য
প্রতিমা কেনা হয়নি।
না, ঠাণ্ডা লাগেনি,
কানে তালা ধরেছে ডাক্তারবাবু,
সারারাত পটকা ফেটেছে।
শনিবার, ৮ কার্ত্তিক, ১৩৭০ (৪ কার্ত্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) SATURDAY, OCTOBER 26, 1963
• মহাষ্টমীতেও আবহাওয়ার সমান নষ্টামি: সম্বত্সরের দিন যাপনের গ্লানি বাঙ্গালী মহাপূজার তার দিনের আনন্দের প্লাবনে ডুবাইয়া ভাসাইয়া দিবে, জীবন সংগ্রামের ক্ষতে সাময়িক উপশমের প্রলেপ লেপিয়া দিবে, এবার হিংসুটি আবহাওয়ার প্রাণে তাহাও সহিল না। তাই সে অকাল বর্ষণের ষড়যন্ত্রে এই আনন্দ মাটি করিয়া দিতে উদ্যত হইয়াছিল। কিন্তু পারে নাই। শুক্রবার মহাষ্টমীর দিন আবহাওয়ার নষ্টামিকে উপেক্ষা করিয়াই কলিকাতার নাগরিকেরা আনন্দের ঢোলে কাঠি ঠুকিয়া ভাঙ্গা হাট আবার সরগরম করিয়া তুলিয়াছে। সন্ধ্যার দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি অনেকেরই মেজাজ খিঁচড়াইয়া দিয়াছিল। এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়াছিল আজও বুঝি সপ্তমীর ব্যর্থতারই পুনরাবৃত্তি ঘটিবে। কিন্তু মানুষের মনের দুরন্ত ইচ্ছার নিকট আবহাওয়াকে সাময়িক পিছু হটিতে হইয়াছে। রাত্রি যত বাড়িয়াছে, ভিড়ের স্রোতও তত। সন্ধ্যার দিকে আমরা যখন দক্ষিণ কলিকাতার পূজামণ্ডপগুলিতে যাই, তখন দর্শনার্থী পুরুষ, নারী, শিশু একে একে দুইয়ে দুইয়ে মণ্ডপে আসিতে সুরু করিয়াছে। ফিরিবার পথে দেখি মানুষের সারি দীর্ঘতর হইতেছে। উত্তর কলিকাতার ভিড় দক্ষিণ কলিকাতা হইতে অনেক বেশি। তবু অন্যান্য বত্সরের মত জনতা পথপ্লাবিনী নহে।
শনিবার, ৮ কার্ত্তিক, ১৩৭০ (৪ কার্ত্তিক, ১৮৮৫ শকাব্দ) SATURDAY, OCTOBER 26, 1963
• পূজায় সাহেবপাড়া: এ পাড়ায় পূজো হয় না। কোনবার হয় না, এবারও হয় নি— না বারোয়ারী, না বাড়িওয়ারী। এ পাড়ার— অর্থাৎ উত্তরে যার পার্ক স্ট্রীট, পশ্চিমে চৌরঙ্গী, আর পূর্ব ও দক্ষিণে লোয়ার সার্কুলার রোড— সেই ছিমছাম পল্লীটিতে কেউ কোন শরৎকালে ঢাকের বাদ্য বা কাঁসর ঘণ্টা শোনেনি। গোটা কলকাতা যখন কোলাহলে চঞ্চল, মাইকের পাল্লায় অতিষ্ট, এ পাড়ায় তখন বাড়ীর হুসহাস, পিয়ানোর ঠুংঠং আর আল সেসিয়ানের গর্জন। এ-ও কলকাতা, কিন্তু যেন আলাদা জগৎ— এটা কলকাতার সাহেবপাড়া। শুক্রবার গিয়েছিলাম কলকাতার এই খানদানি সাহেবপাড়ায় পূজো দেখতে। কোন পূজো যে ও পাড়ায় হয় না তা জানতাম। কিন্তু তবু ভাবলাম যাই না— সাহেবপাড়ায় পূজো না দেখতে পাই, পূজোর সাহেবপাড়া তো দেখতে পাব।
• তিন দিনের ব্যাপারীদের এবার গালে হাত: একে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, তাহার উপর একটানা বৃষ্টি — তিন দিনের ব্যাপারীরা এবার গালে হাত দিয়া বসিয়াছে। বিক্রীবাট্টা নেহাতই কম, গত বছরের তুলনায় অর্ধেকও নয়। তিন দিনের ব্যাপারী কারণ পূজার প্রথম তিন দিনের বাণিজ্যই ইহাদর প্রধান ভরসা। বেলুন বিক্রী বলুন, নাগরদোলা বা মেরি গো রাউন্ডই ধরুন, মাস্টার কালু বা অন্ধকূপের ওস্তাদ সন্তোষকুমার বা যাদুকর প্রফেসর করই হউন— যত দৌড়ঝাঁপ এই ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমী লইয়া। কিন্তু এবার সেই তিনটি দিনই মাঠে মারা গিয়াছে। ভিড় তেমন জমে নাই। গাঁ-গঞ্জ উজার করিয়া ছেলেমেয়ে ছুটিয়া আসে নাই এবং ফলে তিন দিনের ব্যাপারীদের বাজার একেবারে মন্দা। কেমন মন্দা? যেমন গ্রে স্ট্রীট এক্সটেনশনের গ্যাস বেলুন বিক্রেতা ভগীরথ প্রসাদ এবার গড়ে পাঁচ টাকারও (গত বছরের হিসাব দশ টাকা) বেলুন বেচিতে পারে নাই, রিপন স্ট্রীটের নাগরদোলাওয়ালা করিমের রোজগার তিন দিনেও পঁচিশ টাকার ঊর্দ্ধে উঠে নাই (আগেলা সাল কমসে কম পচাশঠো করকে রূপেয়া কামায়া থা) এবং উল্টাডাঙ্গায় মাস্টার কালু এবার তাহার তাঁবু খাটান আজবি খেল দেখাইয়াও দিনে চল্লিশ টাকার বেশী টিকিট বিক্রী করিতে পারে নাই (মসাই, গত বছর জুতিয়ে দিনে একশো টাকার টিকিট কেটেছি)।
• বারোয়ারী পূজার কথা: যদিও দেশে জরুরী অবস্থা, চাল, চিনি, মাছের বাজারে টানা হ্যাঁচড়া— কিন্তু বারোয়ারী মণ্ডপে তার প্রভাব কম। অবশ্য বারোয়ারীর কর্মকর্তারা চাঁদা আদায়ের বাজেটে ঘাটতি শব্দটা শুনিয়ে একটু হতাশ করে দিচ্ছিলেন। অনেকে মনে করেছিলেন, এবার বোধহয় বারোয়ারীর ডেকরেশনে কাট-ছাঁট হল। কিন্তু মিথ্যা আশঙ্কা। শহরের সার্বজনীন আনন্দময়ীর, মায় লক্ষ লক্ষ লোকের রিসেপসানেরও কোন ত্রুটি নেই। আর হবেই বা কেন! মা আসছেন,কানে ফিসফিসানি শুনেই মার বারোয়ারী মণ্ডপের সন্তানেরা দু’মাস আগে চাঁদার রসিদ নিয়ে গেরস্তের সদরে কড়া নেড়ে আগমনীর বার্তা শুনিয়ে আসছেন। অতএব বাজেট তখনই তৈরী এবং পূরণ করার পবিত্র দায়িত্ব প্রথম কিস্তিতে গেল বছর যাঁরা কৃতার্থ করেছিলেন তাঁদের উপরেই বর্তেছে।
• দুর্যোগের আশঙ্কা সত্ত্বেও নবমীর আনন্দউল্লাস: মহানবমীতেও সেই একই অবস্থা। দুর্যোগ নামিয়া না আসিলেও দুর্যোগের আশঙ্কা ছিল পুরামাত্রায়। মেঘলা আকাশ ছিল থমথমে। তাই নবমীপূজার দিনও উৎসবপ্রাণ নাগরিক প্রাণ খুলিয়া পথের বাহির হইতে পারেন নাই। ছেলেমেয়েদের লইয়া দূরপল্লীর প্রতিমা দেখার প্রোগ্রাম বাতিল হইয়াছে। বাহির হইতে প্রতি বৎসর যে বিপুল সংখ্যক নরনারীর স্রোত মহানগরীর পথঘাট-পূজামণ্ডপ উপছাইয়া দেয়, এ বৎসর দুর্যোগের আশঙ্কা উহা যেন থমকিয়া থাকে। তবে মহানবমীতে রাত্রি বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে পূজামণ্ডপগুলিতে ভীড় বাড়িতে থাকে। রাত্রি ১২টা নাগাদ দেখা যায়, কোন কোন পূজামণ্ডপে প্রচণ্ড ভীড় হইয়াছে, বহু রাস্তায় উৎসবমুখর নরনারীর স্রোত চলিয়াছে।
মঙ্গলবার, ১১ কার্ত্তিক, ১৩৭০ TUESDAY, OCTOBER 29, 1963
• কলিকাতা ও শহরতলীতে প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠান সম্পন্ন: এবার দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন শোভাযাত্রায় তাসা বা চড়বড়ির তুলনায় ঢাকের রেওয়াজটা বেশী ছিল। সেই সঙ্গে বেশী ছিল শোভাযাত্রীদের শৃঙ্খলাবোধ। তাই হয়তো বিসর্জন পর্বকে উপলক্ষ করিয়া উল্লেখযোগ্য অপ্রীতিকর ঘটনার কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই। দশমীর দিন, রবিবার এইবার ১৮৯০টি প্রতিমার বিসর্জন হইয়াছে। সোমবারও তিনটি প্রতিমার বিসর্জন হয়। রবিবার গঙ্গার দুই পারেই সারারাত ধরিয়া ‘দূর্গা মাই কী জয়’ ধ্বনি শোনা গিয়াছে। বিসর্জন শেষে ফিরিবার পথে যেন ঢাকের কাঠিতে করুন সুর –‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবে বিসর্জন’।
বৃহস্পতিবার, ১৩ কার্ত্তিক, ১৩৭০ THURSDAY, OCTOBER 31, 1963
• মাছের বাজারে ক্রেতা প্রতিরোধ আন্দোলন: বুধবার অতিলোভী মত্স্য বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ক্রেতা-প্রতিরোধ আন্দোলন নূতন রূপ লয়। ঘুঘুডাঙ্গা, বকুলতলা এবং গোরাবাজারের ঘটনার সূত্র ধরিয়া এইদিন দমদমের নাগেরবাজারে মাছ বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। ফলে, ক্রেতাদের নিকট বিক্রেতারা নতি স্বীকার করিতে বাধ্য হন এবং উৎকৃষ্ট শ্রেণীর মাছ প্রতি কিলো দেড় টাকা হইতে দুই টাকা কমে বিক্রি করেন। কলিকাতার গড়িয়াহাট বাজারেও জনসাধারণের চাপে জনৈক অতিলোভী মত্স্য বিক্রেতা নীতি স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। বেলা প্রায় ১১।।টা নাগাদ উক্ত মত্স্য বিক্রেতা বাজারে বসিয়াই অন্য এক ব্যক্তির নিকট হইতে ছোট ভেটকি ৩ টাকা কিলোয় কিনিয়া খরিদ্দারের নিকট কিলো প্রতি ৪ টাকা করিয়া বিক্রয় করিতে চেষ্টা করিলে উত্তপ্ত আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়।
কোন মাছ কত দর
দুই কেজি ওজনের উপরে রুই (কাটা ল্যাজা মুড়া বাদে)
৪ টাকা।
ঐ কাতলা (ঐ)
৪ টাকা।
এক কেজি ওজনের উপরে ভেটকি (ঐ)
৩.৭৫ টাকা।
এক কেজি ওজনের নীচে ভেটকি (ঐ)
২.৭৫ টাকা।
কাটা ইলিশ (আধ কেজি ওজনের উপরে)
৩.৫০ টাকা
বাটা
২.৭৫ টাকা।
পার্শে (তিন ইঞ্চির দৈর্ঘ্যের উপরে)
২.৮০ টাকা
ট্যাংরা (আড়াই ইঞ্চির উপরে)
২.৮০ টাকা
আড় (কাটা)
২.৭৫ টাকা
বোয়াল (কাটা)
২.৫০ টাকা
চিতল (পেটি)
৩ টাকা
পাবদা (তিন ইঞ্চির উপরে)
৩.২৫ টাকা
তপসে
৩.২৫ টাকা
গলদা চিংড়ি
৩.২৫ টাকা
বাগদা চিংড়ি (আড়াই ইঞ্চির উপরে)
৩ টাকা
কুচো চিংড়ি
২ টাকা।
শুক্রবার, ১৪ কার্ত্তিক, ১৩৭০ FRIDAY, NOVEMBER 1, 1963
• কলিকাতায় বাস চলাচলের নূতন ব্যবস্থা: আগামী ৪ ঠা নভেম্বর হইতে পাতিপুকুর লেকটাউন কলোনী হইতে সকাল ৮-৪৫ মিনিট এবং ৯-১৫ মিনিটে দুইখানি স্পেশাল এক্সপ্রেস বাস ডালহৌসী স্কোয়ার অভিমুখে রওনা হইবে। এই বাস দুইখানি যশোর রোড, বেলগাছিয়া রোড, ভূপেন বসু এভিনিউ, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রীট হইয়া ডালহৌসী স্কোয়ারে পৌঁছিবে। ইহা ছাড়া ঐদিন হইতে ৩বি রুটের বাস শ্যামবাজারের মোড় হইতে যশোহর রোড এবং বাঙুর এভিনিউর সংযোগস্থলের নিকট পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হইবে। ৩বি রুটের প্রথম গাড়ী সকাল ৫-৩০ মিনিটে এবং শেষ বাস রাত্রি ৮টায় ছাড়িবে। ৩এ বাস রুটের টার্মিনাস শ্যামবাজার (ক্যানাল ওয়েষ্ট রোড) হইতে সরাইয়া মাণিকতলা মেন রোড এবং সি আই টি রোডের সংযোগস্থলের নিকট স্হাপন করা হইবে। এই রুটের বাস সি আই টি রোড, নারকেলডাঙা মেন রোড এবং আচার্য প্রফুল্ল রোড ধরিয়া চলিবে। নূতন টার্মিনাস হইতে ভোর ৪-৪৫ মিনিটে প্রথম বাস ছাড়িবে এবং শেষ বাস ছাড়ার সময় ১০-৩০ মিনিটে। ঠাকুর পুকুর টার্মিনাস হইতে বাস ছাড়িবার সময়ের কোন পরিবর্তন হয় নাই।
বৃহস্পতিবার, ১৫ কার্ত্তিক, ১৩৭০ SATERDAY, NOVEMBER 2, 1963
• দর সম্পর্কে সরকারী ব্যবস্থা: পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলিকাতা ও শিল্পাঞ্চলে মাছের যে সর্বোচ্চ দর নির্ধারন করিয়া দিয়াছেন মত্স্য ব্যবসায়ের সহিত সংশ্লিষ্ট যে-কোন মহল হইতে তাহা বানচাল করিয়া দিবার অপচেষ্টা হইলে অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছাড়াও ব্যবসায়-লাইসেন্স বাতিল করিবার বিধান প্রয়োগ করিতেও সরকার এতটুকু কুন্ঠিত হইবেন না। শুক্রবার মত্স্য মূল্য নির্ধারণ ঘোষনার প্রথম দিনে সন্ধ্যার দিকে পুলিশ দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধির নিকট ঐরুপ মন্তব্য করিয়া বলেন যে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ মাছের সরকারী দর চালু করিতে বদ্ধপরিকর। ঐজন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার এবং এনফোর্সমেন্ট বিভাগের অফিসারগণকে ইতিমধ্যেই যথোচিত নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
শবসুদ্ধ তিন ইঞ্চির বেশী।
কিলো তিন টাকার ওপরে পড়বে।
—কন্ট্রোল দামেই বেচবো, তবে সেই
সঙ্গে দু টাকা ভাড়া দেবেন দয়া করে।
বৃহস্পতিবার, ১৫ কার্ত্তিক, ১৩৭০ SATERDAY, NOVEMBER 2, 1963
• মহানগরীতে কোজাগরী লক্ষী পূজা: কোজাগরী লক্ষী পূজা উপলক্ষ্যে শুক্রবার মহানগরী কলিকাতার বাঙালী হিন্দু গৃহসমূহ উত্সবের রূপ ধারণ করে। এইদিন সারা দিবসই পূর্ণিমা তিথি থাকে। বাঙালীর গৃহদেবী লক্ষীর আরাধনাও চলে ঘরে ঘরে। কেউবা পূজা করেন পারিবারিক চিরাচরিত প্রথায় লক্ষীর সরায়, কেউবা করেন মূর্তি পূজা। আলপনা ও লক্ষীর পদচিহ্নতে শ্রীমন্ডিত হইয়া উঠে গৃহাঙ্গন। লক্ষীর বেদীর সমুখে নানা উপচারে ভরা নৈবেদ্যর থালা। আর্থিক সঙ্গতি অনুযায়ী প্রত্যেকেই সমৃদ্ধি ও কল্যাণের দেবী গৃহলক্ষীর অর্চনা করেন। শিশুকন্ঠের কোলাহল ও শঙ্খধ্বণিতে মুখর হইয়া উঠে বাঙালীর গৃহ।
সোমবার, ১৭ কার্ত্তিক, ১৩৭০ MONDAY, NOVEMBER 4, 1963
• মুনাফা নিরোধ আইনে বিভিন্ন বাজারে ৮ জন মত্স্য-ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার: নির্ধারিত সর্ব্বোচ্চ দর অপেক্ষা বেশী দামে মাছ বিক্রয়ের এবং স্টলে মূল্য তালিকা না টানাইবার অভিযোগে রবিবার কলিকাতার বিভিন্ন বাজারে ৮ জন মত্স্য ব্যবসায়ীকে মুনাফা নিরোধ আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। নিউ মার্কেটে ১ জন, তালডাঙায় ২ জন, ইন্টালীতে ১ জন, গড়িয়াহাটায় ২ জন, কালীঘাটে ১ জন এবং শ্যামবাজার বাজারে ১ জন মত্স্যব্যাপারী ঐদিন গ্রেপ্তার হন।
মঙ্গলবার, ১৮ কার্ত্তিক, ১৩৭০ TUESDAY, NOVEMBER 5, 1963
• কলিকাতার বাতাসে শীতের আমেজ: শীত কি আসিয়া পড়িল? রবিবার রাত্রে কলিকাতা ও আশেপাশে অকাল বৃষ্টির পর সোমবার সকালে ঠান্ডার আমেজ এই প্রশ্ন জাগাইয়া তোলে। আবহাওয়া অফিসের মতে এই ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব প্রকৃত শীতের সুরু নয়। হিমালয়ের সানুদেশ ও নেপালের দিক হইতে এক “পশ্চিমী আলোড়ন” পূর্বমুখী হইয়াছে- তাহার ফলে বিহার পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে কিছু ঝড়বৃষ্টি, হিমেল হাওয়া বহিবার সম্ভবনা। আজও (মঙ্গলবার) কলিকাতায় এক পশলা বৃষ্টি ও বজ্রমেঘ সঞ্চারের সম্ভবনা আছে বলিয়া পূর্বাভাস পাওয়া গিয়াছে। তবে এই ধরসের আবহাওয়া দু’একদিনের মধ্যেই কাটিয়া যাইবে বলিয়া মনে হয়।
• পূজার দিন লইয়া বিরোধ, পঞ্জিকায় পঞ্জিকায় পাঞ্জা: পূজার দিন লইয়া দৃকসিদ্ধ ও পুরানো মতে পঞ্জিকার দ্বন্দ্ব এখনও মিটে নাই! প্রকাশ যে, রাজ্য সরকার নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা আগামী ১৩৭১ সালের (১৯৬৪—৬৫) পূজার দিনগুলির জন্য এখনও কোন সর্বসম্মত তালিকা পেশ করিতে সমর্থ হন নাই। ফলে ১৩৭১ সালের জন্য একইরূপ গণনার ভিত্তিতে পঞ্জিকাগুলি প্রকাশের সম্ভাবনা নাই। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৬৪ সালের জন্য সরকারী ছুটির তালিকা স্থির করিয়াছেন। ঐ তালিকা অনুসারে আগামী অক্টোবর মাসের ১২ই হইতে ১৬ই পর্যন্ত পাঁচদিন পূজার ছুটি ঘোষণা করিয়াছেন। এবং ছুটি একদিন বেশী হইতেছে, কারণ পুরানো পঞ্জিকামতে ১২ই এবং ১৩ই অক্টোবর দুইদিন সপ্তমী তিথি থাকিতেছে। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে অবশ্য অক্টোবরের ১২ই এবং ১৩ই সপ্তমী। রাজ্য সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ছুটির “অধিকন্তু ন দোষায়”। তবে লক্ষ্মী পূজা উপলক্ষে আগামী বছর ‘সরকারী ছুটি’ হিসাবে মাত্র একদিনই— ২০শে অক্টোবর, ছুটি ঘোষণা করা হইয়াছে।
শিয়ালদহ শাখায় বৈদ্যুতিকরণে উপস্থিত রেলকর্তারা।—আনন্দ চিত্র।
• দমদম কলিকাতায় হেলিকপ্টার সার্ভিস: শীঘ্রই কলিকাতা ময়দান এবং দমদম বিমানঘাটির মধ্যে হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। প্রকাশ, কলিকাতার একটি বিমানব্যবসার সংস্থা কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহন দপ্তরের নিকট ঐ সার্ভিস চালু করার অনুমতি চাহিয়া আবেদন করিয়াছেন। এই সংস্থা ১৪।১৬টি আসনযুক্ত হেলিকপ্টারে প্রতি রুটে দুই ঘণ্টা করিয়া সার্ভিস চালু করিবার প্রস্তাব করিয়াছেন। ইহা সারাদিন চালু থাকিবে। প্রতি ট্রিপে দশ মাইল বিমান দূরত্ব অতিক্রম করিতে দশ মিনিটের মত সময় লাগিবে। প্রত্যেক যাত্রীকে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হইবে। তিনি ২০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত মাল বিনাব্যয়ে বহন করিতে পারিবেন। প্রকাশ, প্রস্তাবিত সার্ভিসের জন্য রুশ এম আই-৪ হেলিকপ্টার আমদানীর জন্য আলাপ-আলোচনা চালান হইতেছে।
২০ কার্ত্তিক, ১৩৭০ (১৯ কার্ত্তিক, ১৮৮৫ শক) SUNDAY, NOVEMBER 10, 1963
• কলিকাতার উন্নয়নের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে গ্রহণের জন্য শ্রীসেনের আবেদন: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপ্রফুল্লচন্দ্র সেন আজ এখানে জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের অধিবেশনে এই আবেদন জানান বলিয়া প্রকাশ যে, কলিকাতার উন্নয়নের সমস্ত দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণ করা কর্তব্য। শ্রী সেন বলেন যে, চতুর্থ যোজনা রচনাকালে কলিকাতার উন্নয়ন ব্যবস্থা, এই মহানগরী হইতে বস্তি উচ্ছেদ ও পয়ঃপ্রণালীর উন্নতি সাধন ইত্যাদি বিষয়গুলি যে রাজ্যের যোজনার বাহিরে রাখা উচিত, তাহা মনে রাখা আবশ্যক। এই বিষয়গুলির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের যোজনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলিয়া তিনি দাবি জানান। এই সুযোগে মহারাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রীও অনুরোধ জানান যে, বোম্বাই শহরের উন্নয়নের দায়িত্বও কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রহণ করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। বৃক্ষসমূহ নির্বিচারে ধ্বংস করিয়া বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের যে ঝোঁক বোম্বাই শহরে দেখা দিয়াছে, তাহার জন্য তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন বলিয়া জানা যায়। তিনি বলেন যে, যাহারা বৃক্ষ ধ্বংস করিবে, তাহাদিগকে কঠোর শাস্তিদান করা উচিত।
সোমবার, ২৪ কার্ত্তিক, ১৩৭০ MONDAY, NOV. 11, 1963
• মাছের বাজারের উন্নতি: রবিবার কলিকাতায় মাছের বাজারে আরও কিঞ্চিত্ উন্নতি দেখা যায়। কলিকাতার সব বাজারেই ঐদিন পূর্বদিন অপেক্ষা বেশি মাছ উঠে। কেবল চালানী নয়, ভেড়ীর মাছও ঐদিন বাজারে কিছু বেশি পরিমাণ আমদানী হয়। বড় মাছের অভাব অবশ্য ঐদিন বাজারে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ছোট মাছ—যথা তেলাপিয়া, ল্যাটা, চিংড়ি, ছোট ইলিশ ইত্যাদির আমদানী ভালই ছিল। আমাদের দক্ষিণ শহরতলীর সংবাদদাতা জানান, রবিবার এই অঞ্চলেও মাছের বাজারের কিছুটা উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু এইদিনও চব্বিশ পরগণা উত্তর লবণ হ্রদ এলাকার ভেড়ীওয়ালাদের অধিকাংশ হাত গুটাইয়া বসিয়াছিল বলিয়া এক সূত্রে জানা যায়। আমাদের উত্তর শহরতলীর সংবাদদাতা জানান, রবিবার এই অঞ্চলে মাছের বাজারের অবস্থা প্রায় একই ছিল। কয়েকটি বাজারে সরবরাহ সামান্য বৃদ্ধি পাইয়াছে। তবে, বড়ো মাছ প্রায় দুষ্প্রাপ্য।
• সরকারের ভূমিরাজস্ব বৃদ্ধির চেষ্টা: কলিকাতার সমস্ত জমির উপর খাজনা ধার্য করার প্রস্তাব রাজ্য ভূমি রাজস্ব দপ্তরের বিবেচনাধীন। প্রস্তাবটি গৃহীত হইলে পৌর করের উপরও কলিকাতার জমির মালিকদের সরকারকে ভূমি রাজস্ব দিতে হইবে। আগামী বাজেটে ভূমি রাজস্ব খাতে আয় বাড়াইবার উদ্দেশ্যে সরকার এখন বিভিন্ন প্রস্তাব বিবেচনা করিয়া দেখিতেছেন। এ ব্যাপারে সরকারের মূল নীতিঃ আয় বাড়াইতে হইবে, কিন্তু গরীবের ঘাড়ে বোঝা বাড়ান চলিবে না। ভূমি রাজস্ব দপ্তর তাই চাষের জমির খাজনা বৃদ্ধির সকল প্রস্তাবের আওতা হইতে ৫ একরের কম জমির মালিকদের রেহাই দিতে চান। চা বাগানের রাজস্ব বৃদ্ধির প্রশ্নে ভূমি রাজস্ব দপ্তর মন প্রায় স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন বলিয়া জানা যায়। একটি সরকারী হিসাবমত, আদায়ের খরচ এক পয়সাও না বাড়াইয়া এই ভাবে কম করিয়াও ৫ লক্ষ টাকা রাজস্ব বাড়ান যাইবে। চা বাগান অঞ্চলে ভূমি রাজস্বের হার বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবত্ই একর প্রতি মাত্র ৯ টাকা ৫০ নয়া পয়সা। অনেক বাগানকে আবার কোন ভূমি রাজস্বই দিতে হয় না। ইংরেজ আমলের এক বিশেষ আইনবলে তাহারা ভূমি রাজস্বের আওতার বাহিরে। সম্প্রতি আসাম সরকারও চা বাগান অঞ্চলে ভূমি রাজস্বের আয় বাড়াইবার সিদ্ধান্ত লইয়াছেন।
• ময়দানের নিশাচরদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা: এ আরেক সিদ্ধান্ত। দেশের ভৌগলিক সীমানা নয়; নগর জীবনের শৃঙ্খলা ও উচ্ছৃখলা, নিরাপত্তা ও সন্ত্রস্ততার মধ্যে এই সীমানা। দেশের ভৌগলিক সীমানায় জওয়ানরা যেমন অতন্ত্র; এখানের ‘জওয়ানরাও’ তেমনই সতর্ক। এদেরই সতর্কতায় ময়দানের অধিকতর কুখ্যাত জায়গাগুলো আজ সন্ধ্যায় পরেও নিরীহ ভ্রমণবিলাসীদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এই বিশেষ ধরণের প্রস্তাবিত চারটি ‘পুলিস বাক্সের’ মধ্যে মাত্র দু‘টি ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে। এই দু’টোতেও এখনও পর্যন্ত টেলিফোন বসেনি, বিপদ সঙ্কেত দেবার অথবা নেবার কোন ব্যবস্থা হয়নি। বাক্স দু’টির চারটি করে ‘চোখ’ দিয়ে একজন করে পুলিস কেবল ঘড়ির কাঁটা ধরে চতুর্দিকে নজর রাখছে। আর তাতেই কাজ প্রায় হাসিল।
• কলিকাতায় শ্রীশ্রী শ্যামা পূজা: শ্রীশ্রী শ্যামাপূজা উপলক্ষে শুক্রবার মহানগরী কলিকাতা আবার উত্সবমুখর হইয়া উঠে। নগরীর পল্লীতে পল্লীতে শক্তিস্বরূপিণী শ্যামা মায়ের আরাধনা। অমাবস্যার অন্ধকার ভেদ করিয়া জ্বলে দীপান্বিতার আলো। মন্ত্ররবে মুখরিত হয় পূজামণ্ডপ। গভীর রাত্রির নিঃশব্দতা ভঙ্গ করিয়া ধ্যানমন্ত্র উচ্চারিত হয়ঃ—মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভূজাং। কন্ঠাবস—মুণ্ডালী গলদ্রুধিরচর্চিতাত্......। শ্যামাপূজার দিন প্রত্যুষ হইতে গভীর রাত্রি পর্যন্ত পল্লীর পূজামণ্ডপে দেবী দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে। সন্ধ্যা ও রাত্রি — অবশ্য অনেক স্থানেই জনতার ভীড় নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলিয়া যায়। মাইকের আওয়াজ আলোর রোস নাই, বাজি ও পটকা বিস্ফোরণ-সব মিলিয়ে পল্লীর পূজামণ্ডপ একদিকে জমজমাট হয়। অপর দিকে শান্তিপ্রিয় লোকদের কানে তালা লাগে। শহরতলীর শিল্পাঞ্চলে এবং নগরীর কোন কোন এলাকায় সকাল হইতেই মাইকে সিনেমার গান বহুলোকের রূচিবিরোধী হইলেও শক্তিসাধক তরুণ যুবাদের ভয়ে প্রতিবাদ করার হয় নাই। সর্বত্র কিন্তু এই অবস্থা নহে। অনেক স্থানে ভক্তিমূলক রামপ্রসাদী গান অথবা দেশাত্মমূলক গানের সুরধ্বনি মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করিয়াও রাখিয়াছি।
Monday, November 18, 1963, সোমবার, ১ অগ্রহায়ন, ১৩৭০(২৭ কার্ত্তিক, ১৮৮৫ শক)
• কেশবচন্দ্রের জন্মস্থান ও বসতবাটী সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত: ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের (চিত্তরঞ্জন এভিনিউস্থিত) জন্মস্থান ও বসতবাটীটি সরকারী দখলে আনিয়া ঐতিহাসিক ও জাতীয় সম্পত্তিরূপে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত হইয়াছে বলিয়া জানা যায়। প্রকাশ যে ঐ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কালেক্টরের পক্ষে ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের ও তাঁহার পিতামহ দেওয়ান রামকমল সেনের বসতবাটী দুইটি দখলে আনিবার জন্য নোটিশ জারী করা হয়। এখন সংশ্লিষ্ট জমি ও বাড়ীর মোট আনুমানিক মূল্য ২ লক্ষ ২৪ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়; এবং বর্তমানে উহা রাজ্য সরকারের অনুমোদনের প্রতীক্ষায় রহিয়াছে। ঐ জমি ও বাড়ী শিক্ষা বিস্তারের কাজে ব্যবহার করা হইবে। তাহা ছাড়া ঐস্থানে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্রের নামে একটি উপযুক্ত স্মৃতিসৌধও নির্মাণের প্রস্তাব আছে।
Monday, November 18, 1963, সোমবার, ১ অগ্রহায়ন, ১৩৭০(২৭ কার্ত্তিক, ১৮৮৫ শক)
চার আনা দামের সন্দেশ
এখন আর খালি চোখে
দেখা যায় না। আতস
কাচ দিয়ে দেখতে হয়।
• কলিকাতার বাজারে কম মূল্যে মিষ্টান্ন বিক্রয়: অবশেষে রবিবার কলিকাতার মিষ্টির বাজারে সত্য সত্যই ‘দমদমী দাওয়াই’এর প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গেই সন্দেশের কিলো দশ টাকা হইতে পাঁচ টাকায় নামিয়া আসিয়াছে। লেডিকেনির দর ছিল চার টাকা। অবশেষে তাহা দেড় টাকায় বিকাইয়েছে। এহেন অভূতপূর্ব ঘটনায় কেন্দ্রস্থল কলিকাতার সিমলা অঞ্চল—রামদুলাল সরকার স্ট্রীট আর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের কিছুটা এলাকা। রবিবার সন্ধ্যায় জনতা রামদুলাল সরকার স্ট্রীটের একটি মিষ্টির দোকানে আসিয়া দাবি করে পাঁজি দেখিয়া এভাবে মিষ্টির দাম বাড়ান চলিবে না। অন্যান্যদিনে যে দর থাকে সেই দরেই বিক্রয় করিতে হইবে। ক্রেতা সাধারণের পক্ষ হইতে এই ভাবে প্রবল প্রতিরোধের সন্মূখীন হওয়ায় এ দোকানের মালিক পাঁচটাকা কিলোদরে সন্দেশ বিক্রয় করিতে বাধ্য হন।
Tuesday, November 19, 1963, মঙ্গলবার, ২ অগ্রহায়ন, ১৩৭০(২৮ কার্ত্তিক, ১৮৮৫ শক)
• এবারের ভাইফোঁটার বাজার: ক্রেতা প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়াঃ সোমবার ভাই ফোঁটার দিন কলিকাতা ও হাওড়ায় বহু মিষ্টির দোকানেরই ঝাঁপ বন্ধ। আবার কোন কোন দোকানে অপেক্ষাকৃত কম দামে দই মিষ্টি বিক্রয় হয়। ঐদিন বাজারে বড় মাছ প্রায় ছিল না, ছোট মাছ জোগাড় করাও দুঃসধ্য হইয়া উঠে। মাংসের দোকানেও লম্বা লাইন পড়ে। ফলে এবারের ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় ভোজের অংশটি তেমন জমে নাই। মিষ্টির চড়া দামের বিরুদ্ধে রবিবার যে ক্রেতা প্রতিরোধ আন্দোলন সৃষ্টি হইয়াছিল সোমবার তাহা আরও বিস্তৃত হয়। এইদিন সুযোগ বুঝিয়া এক শ্রেণীর মাংস ব্যবসায়ী বেশী দর হাঁকিলে সেখানেও ‘দমদমী দাওয়াই’ প্রয়োগ করা হয়। ফলে কিলোপ্রতি সাড়ে চার টাকা হইতে মাংসের দাম তিন টাকায় নামিয়া আসে।
আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই সকল সংবাদের বানান ও ভাষা অপরিবর্তিত।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.