রাস্তায় জ্যাম দেখলেই আমার কান্না পায়
(আবৃত্তিশিল্পী এবং প্রথম বাংলা আবৃত্তি ব্যান্ডের প্রবর্তক)
মার জন্ম মেদিনীপুর জেলাতে হলেও শৈশব থেকেই কলকাতার সঙ্গে একটা যোগসূত্র ছিল। ঋষি রাজনারায়ণ বসুর পরিবারের আমি। বাবা-দাদু নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত করতেন। আমাকেও নিয়ে আসতেন। কিন্তু একটু বড় হতেই পড়াশোনা করতে পুরোপুরি কলকাতায় চলে আসা। কী ঝকঝকে শহর! এক একটা দিন যে কী আনন্দে কাটত বোঝাতে পারব না। আমার জীবনের বড় সাধ বুঝি পূর্ণ হল। ভোরে কলকাতার রাস্তাগুলো আরও কত না ঝকঝক করত। কোন ভোর থেকে বড় বড় হোস-পাইপের জল ঢেলে রাস্তা ধোওয়া হতো। হস্টেলের জানলা দিয়ে মাঝেমধ্যে তা দেখতাম। বাবা বলেছিলেন আবৃত্তির জন্য খুব ভোরে রেওয়াজ করলে কণ্ঠের তেজ বাড়ে।

এই প্রিয় শহর তার মূল্য দিয়েছে প্রতিটি সময়ে, প্রতিটি মুহূর্তে। এই শহরের কাছে আমি ঋণী। আজ যখন দেশ ছেড়ে বিদেশের বিভিন্ন শহরে অনুষ্ঠান করতে যাই, তখন বার বার স্বীকার করি— আমার প্রেরণা আমার শহর কলকাতা। আমেরিকার টেক্সাসে বঙ্গ সম্মেলনে মধ্যরাতে আমার অনুষ্ঠান ছিল। ৬ হাজার শ্রোতা। অফুরন্ত প্রাণভরা অভিনন্দন। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়েই বলেছিলাম, “আমাকে শিল্পী হিসেবে এমন পরিপূর্ণতা দিয়েছে আমার প্রিয় শহর কলকাতা।” বিশ্বাস করুন শ্রোতাদের করতালিতে ভরে গিয়েছিল সমগ্র প্রেক্ষাগৃহ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও জয় গোস্বামীর সঙ্গে মহড়ায়

স্কুল-কলেজে পড়া থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পেতাম। আমার প্রথম স্মরণীয় অনুষ্ঠান ছিল শিশির মঞ্চে। সেই অনুষ্ঠানে অন্যরা কে ছিল শুনবেন! প্রথম সারিতেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেনের মতো কলকাতার আরও অনেক সেলিব্রিটি। তার চেয়েও উল্লেখযোগ্য ঘটনা, সুচিত্রা মিত্র ও শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে একই মঞ্চে অনুষ্ঠান করা আমি এখনও যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না। এখনও কানে বাজে সেই সব ব্যক্তিত্বের প্রশংসা।

ছোট থেকেই কলকাতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে বিভিন্ন জনের আবৃত্তি শুনতাম। তা শুনে নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরে নিতাম। বেশ কয়েক জন শিল্পী নিজের ভাইয়ের মতো কাছে ডেকে শুধু ভুল শোধরাতেন না, প্রেরণাও দিতেন। সেই সব অভিজ্ঞতা কতটা যে কাজে লেগেছিল তা বুঝেছিলাম যখন প্রথম বার দেশের বাইরে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠান করতে যাই। সেটি ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যাল’। বুঝুন! বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা হাজির সেখানে। ভুলচুক হবার জো নেই। ঢাকা শহরের বিশিষ্টজনরাও এসেছেন আমার আবৃত্তি শুনতে। আমি সেই যে শুরু করেছি আর শেষ করতে পারছি না। নির্ধারিত আবৃত্তির পরেও একের পর এক আবৃত্তি শোনাতে হচ্ছে শ্রোতাদের অনুরোধে। এই সাফল্য আমাকে পরবর্তীতে সত্যিই অনেক সাহস এনে দিয়েছিল। আর তখনই ঢাকার একটি বড় ক্যাসেট কোম্পানি আমার আবৃত্তি রেকর্ড করার অনুমতি চেয়ে নেয়।

আমার জীবনের এই সাফল্যের বড় প্রেরণা কিন্তু আমার বাবা। ছোটবেলা থেকেই তিনি যে ভাবে আমাকে সময় দিতেন তার সুফল আজও পাচ্ছি। মাত্র কয়েক মাস আগে বাবা মারা গেলেন। আমার আবৃত্তির বড় অভিভাবক চলে গেলেন। হাজার দুঃখের মাঝেও তাই ভাবি, মানুষ তো চিরকাল বাঁচেন না। তাই নিজের ইচ্ছে এবং প্রতিভাকে আমার মধ্যেই দিয়ে গেলেন।

রবীন্দ্র্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রাবণী সেনের সঙ্গে... আবৃত্তি-ব্যান্ডের প্রবর্তক বেঞ্জামিন জেফেনিয়রের সঙ্গে...

ইদানীং বড় অভিমানী হয়ে যাচ্ছি। সেই অভিমান এই শহরকে ঘিরেই। সারা দিনের ব্যস্ততায় যখন কোনও জরুরি কাজে যাচ্ছি দেখি যানজটে গাড়ি-ঘোড়া থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে বলে ফেলি, কই বিদেশে তো এত জ্যাম হয় না। আমরা কেন পারছি না আমাদের গতি বাড়াতে? উপলব্ধি করি, আন্তর্জাতিক মানের পরিষেবার বড় অভাব ইদানীং। বর্ষাকালে তো কাজেরও ক্ষতি। শহরের বিভিন্ন জায়গায় একটু বৃষ্টিতেই যে ভাবে জল দাঁড়িয়ে যায় তাতে ভোগান্তি ছাড়া আর কিছুই নেই। এর থেকে পরিত্রাণের পথ কী?

জানি না।

তবু, অনেক মান-অভিমানের পরেও কোথায় যেন এই শহর নিয়ে আমার গর্ববোধ হয়। এই শহরই তো আমাকে শিল্পী করেছে, পরিচিতি দিয়েছে। আর দিয়েছে বেঁচে থাকার পরিপূর্ণতা।

 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.