‘নাটক আমার স্ত্রী, সিনেমা আমার ফিঁয়াসে’
তাঁকে কমেডিয়ান বললে ভীষণ রেগে যেতেন। বলতেন— কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনও সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি এক জন চরিত্রাভিনেতা। কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদারের— চলচ্চিত্র, মঞ্চ, যাত্রা ও টিভি সিরিয়ালখ্যাত এক অভিনেতা। সংলাপের সাহায্যে নয়, শারীরিক ভাবভঙ্গি দিয়ে যে হাস্যরস তৈরি হয়, সেই ‘স্ল্যাপস্টিক’ অভিনয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। তাঁকেই গুরু মেনে এই অভিনেতা অতবড় নাম ছেঁটেকেটে বাংলা অভিনয় জগতে এলেন রবি ঘোষ নামে। আগামী ২৪ নভেম্বর তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

ভিনয় ছিল তাঁর মজ্জায় মজ্জায়। তাই কোনও বাধাই তাঁর সেই ‘প্যাশন’কে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর পেশাদারিত্ব? ঠিক সময়ে কাজের জায়গায় পৌঁছনো ছিল তাঁর স্বভাব। ‘ঠগিনী’ ছবি তৈরির সময় এক দিন বেশ দেরি হল ফ্লোরে পৌঁছতে। দুপুরের ব্রেকের আগে পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ শেষ হলে জানা গেল তিনি সেই সকালেই মা-কে দাহ করে এসেছেন। তাই দেরি। অনেক সময় গাড়ির চালক না এসে পৌঁছলে, ট্যাক্সি ধরে বেরিয়ে পড়তেন, জানালেন তাঁর স্ত্রী বৈশাখি ঘোষ। পরিচালক সন্দীপ রায় বলছেন, “কমেডিয়ান হিসেবে তাঁর খ্যাতি হলেও আদতে তিনি ছিলেন চরিত্রাভিনেতা।” আসলে রবি ঘোষ এমনই একটা নাম, বাঙালি যাঁকে এক জন কমপ্লিট অভিনেতা হিসেবেই চেনে।

সনাতনের চরিত্রে
পর্দায় অভিনেতা রবি ঘোষের যে রূপ দেখা যায়, ব্যক্তি হিসেবে একেবারেই তিনি তার বিপরীতের। একটি গুরুগম্ভীর মানুষ, যিনি সময় পেলেই রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে সময় কাটাতেন। আর পড়তেন প্রবন্ধ-নাটকের নানা বই। প্রথম জীবনে কমিউনিজিমে দীক্ষিত হয়েও পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পড়তেন। সে অর্থে নিজে পূজার্চনা না করলেও, অন্যের বিশ্বাস-ভক্তিকে কখনও ছোট করেননি। মাঝে মধ্যে অবশ্য কৌতুকের ভঙ্গিমায় বলতেন— আমাকে রসেবশে রাখিস মা! পরচর্চা-পরনিন্দা করে সময় নষ্ট করতেন না, এমনকী খারাপ শব্দও ব্যবহার করতেন না কখনও। “তবে, ‘মাইরি’ শব্দটা প্রায় প্রতি ক্ষণেই বলে ফেলতেন রবিদা।”, বললেন তাঁর এক সময়ের প্রতিবেশী ও পরম বন্ধু-চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ।

আড্ডাবাজ, পরোপকারী মানুষটি খেতে ভালবাসলেও খুবই পরিমিত আহারে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রিয় খাবার ছিল লুচি ও পাঁঠার মাংস। ভালবাসতেন লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে। তবে, গোল বাঁধত যখন তা বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। সন্ধে বা রাতে বাড়িতে অতিথি এসে উপস্থিত হলে খুবই গম্ভীর হয়ে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলতেন। সময়ে-অসময়ে এ ভাবেই অবস্থার সামাল দিতেন এই ‘মজার’ মানুষটি। বৈশাখিদেবীর সঙ্গে একমত সন্দীপ রায়। তিনি শোনালেন আরও একটি ছোট্ট ঘটনা, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখানো হবে। সেই সূত্রে রবিকাকার বিদেশ যাওয়া, প্রথম বার। এক দিন রবিকাকা ও তপেনকাকাকে নিয়ে শপিং-এ বেরিয়েছি। জার্মানদের চেহারা লম্বা-চওড়া হয়। সেখানে কোনও জামাকাপড় রবিকাকার ফিট করছে না। শেষে এক জার্মান মহিলা ছোটদের বিভাগে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় কিনিয়ে দেন। অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে রবিকাকা কেনাকাটা করে ফিরে আসেন।

পারিবারিক জীবন
২৪ নভেম্বর, ১৯৩১। কোচবিহারে মামাবাড়িতে জন্ম হয় রবি ঘোষের। বাবা জীতেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার আদতে ছিলেন পূর্ব বাংলার বরিশালের গাভার বাসিন্দা। চাকরিসূত্রে তিনি থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। মা জ্যোৎস্নারানি ছিলেন কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী ও বড়মামা ছিলেন শচীনকর্তার প্রিয় ছাত্র। পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় ছিলেন রবি। বড় দিদি সবিতা এবং ছোট দীনেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও তপতী।

পড়াশোনার শুরু কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে। পরে ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন উত্তমকুমারের ভাই অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং এই কলেজেরই নৈশ বিভাগে বি কম-এ ভর্তি হন। নিয়মিত শরীরচর্চার শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই। পরবর্তী কালে ‘জিম’ না গেলেও, মর্নিং ওয়াক এবং বাড়িতেই নিয়মিত ব্যায়াম করতেন তিনি, জানালেন স্ত্রী বৈশাখি ঘোষ।
কসরতরত... বাবা-মা প্রথম স্ত্রী অনুভাদেবীর সঙ্গে
প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্তর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময়। সেই সময় হঠাত্ই অসুস্থ হয়ে পড়েন রবি ঘোষ। অনুভাদেবীর শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের পর তাঁরা বিয়ে করলেও, ১৯৭২ সালে অনুভাদেবীর অকাল মৃত্যুতে সেই সম্পর্ক দীর্ঘ হয়নি। এই ঘটনার এক দশক পর ১৯৮২ সালে রবি ঘোষ বিয়ে করেন বৈশাখিদেবীকে। তখন তিনি মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে।

৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ জীবনাবসান হয় এই চরিত্রাভিনেতার।

অভিনয় জীবন
অভিনয়কে সঙ্গে নিয়েই জন্মেছিলেন রবি ঘোষ। এবং তার বিকাশ ঘটে স্কুলে পড়াকালীনই। ছাত্রজীবনে ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল গড়ে মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। নাটকের জন্য বহু বার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অভিনয় করা তাঁর বাবা জীতেন্দ্রনাথ একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্নারানিকে বলতেন, “রবি অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিল দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতো চেহারা।” বাবা না হলেও, মা ও বড়মামার সমর্থন ছিল পুরোপুরি।

১৯৫৩ সালে কলকাতা পুলিশকোর্টে (ব্যাঙ্কশাল) চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সে সব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। অভিনয় জীবন শুরু পাঁচের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে। পরিচালক উৎপল দত্ত। নাটকে রবি ঘোষের চরিত্র ছিল এক জন সংবাদপত্র বিক্রেতার, মঞ্চের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর ভূমিকা। মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের অভিনয় দেখে পরিচালক মৃনাল সেন সে দিনই বুঝেছিলেন তাঁর অভিনয় দক্ষতা। সোভিয়েত নাট্যকার সিমোনোভের লেখা ‘দ্য রাশিয়ান কোয়েশ্চেন’ অবলম্বনে নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সরোজ দত্ত। কলেজের বন্ধু, অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই উৎপল দত্তের নাটকের দল লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এর সংস্পর্শে আসা।
নানা চরিত্রে...
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সাল। উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে এলটিজি-র নিবেদিত ‘অঙ্গার’নাটকের প্রথম শো। এবং সে দিন থেকে নাটকের শেষ রজনী পর্যন্ত তাতে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। ১৯৫৯ সালের উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কারও লাভ করেন অঙ্গারের জন্য। উল্লেখ্য, প্রথম শো-এর পাঁচ দিন আগে, ২৫ ডিসেম্বর পিতৃহারা হন রবি। কিন্তু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ সরিয়ে রেখে অভিনয়ের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর পেশাদারিত্ব।

উত্পল দত্ত পরিচালিত নাটক বাদ দিলে কেবলমাত্র অভিনেতা-বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ঘটক বিদায়’ নাটকে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। স্টার থিয়েটারে প্রায় ‘পাঁচশো নাইট’ নাটকটি চলে রমরমিয়ে। চলচ্চিত্রে অবশ্য সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, গুরু বাগচি, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অসিত সেন, দিলীপ রায়, গৌতম ঘোষ, শিবু মিত্র, বিমল কর, সলিল সেন, সন্দীপ রায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস, রাজা মিত্র, অঞ্জন চৌধুরী-সহ বহু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

‘অঙ্গার’ নাটকে রবিবাবুর অভিনয় দেখেই পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিংহ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র জন্য তাঁকে ডাকেন। এর পরেই প্রস্তাব আসে সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’-এর জন্য। থিয়েটার থেকে চলচ্চিত্রে এলেও দু’টি মাধ্যমের তফাত মাথায় রেখে একটার পর একটা বাংলা ছবির চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠেন রবি ঘোষ।

মঞ্চাভিনেতা থাকাকালীন নিজের একটি নাটকের দল ‘চলাচল’ গড়ে তোলেন। ঠগ, অলীকবাবু, ছায়ানট-সহ ৮টি নাটক প্রযোজনা করে সেই দল। লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এ থাকাকালীন ‘নবসংস্করণ’ ও ‘শোধবোধ’ নামে দু’টি নাটকের পরিচালকের কাজ করেন রবিবাবু। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ ও ‘নিধিরাম সর্দার’ নামে দু’টি সিনেমা পরিচালনার কাজও করেছেন এই রবি ঘোষ।

কর্মসূচি
১৯৫৯-১৯৯৪ পর্যন্ত প্রায় ২০৬টি চলচ্চিত্র।
১৯৫২-১৯৯৫ পর্যন্ত প্রায় ৩৯টি নাটক করেছিলেন। উল্লেখ্য শ্রীমতী ভয়ঙ্করী ১০০০ রজনী, (বিজন থিয়েটারে ৯০০ ও সুজাতা সদনে ১০০)। কনে বিভ্রাট ৬৩৫ রজনী, (সারকারিনায় ৫৩৫ ও সুজাতা সদনে ১০০), নব সংস্করণ, শোধবোধ, ঠগ, ধনপতি গ্রেফতার, অলীকবাবু, ছায়ানট ইত্যাদি।
হিন্দিতে অভিনয় করেন সত্যকাম, সব সে বড়া সুখ, আজ কি রবিনহুড, পতঙ্গ।
১৯৮৭-১৯৯৬ পর্যন্ত যাত্রা ৪টি। পাল্কি চলে রে (নট্ট কোম্পানি), বিয়ে পাগলা বুড়ো, লাট সাহেবের নাতজামাই, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল (মুক্তলোক)
১৯৮৬-১৯৯৮ পর্যন্ত দূরদর্শনে ধারাবাহিক গোয়েন্দা ভগবান দাস (রবি ওঝা), হুতোমের নকশা (তপন সিংহ), ফেলুদা ৩০ (সন্দীপ রায়), গোপাল ভাঁড় (দেব সিংহ), মনোরমা কেবিন (জগন্নাথ গুহ), মৃত্যুসাক্ষী (হিন্দি, আশিস মিত্র), নেপোলিয়নের বিয়ে (সুভাষ চট্টোপাধ্যায়), রিপোর্টার এক্স (সোমনাথ বিশ্বাস), দে রে ও মনোরমা কেবিন (যীশু দাশগুপ্ত) সহ প্রায় ১৪টিতে। (যেগুলির মধ্যে কিছু কিছু এখনও অসমাপ্ত রয়েছে)।

সম্মান
‘অঙ্গার’ নাটকের জন্য উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কার লাভ ১৯৬০-এ।
মরিশাস সরকারের আমন্ত্রণে ‘সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র উৎসবে’ যোগদান। বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার সংসদ কর্তৃক ‘সাবাস পেটো পাঁচু’ নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতার পুরস্কার।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার
‘গুপীবাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বিএফজে পুরস্কার।
‘নয়নতারা’র জন্য আনন্দলোক পুরস্কার।
লায়ন্স ক্লাব থেকে শ্রেষ্ঠ নাট্যপরিচালকের পুরস্কার ‘হীরালাল পান্নালাল’ নাটকের জন্য।

মূল্যবান মন্তব্য
• হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়— সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। রবি পেয়েছিল।
• তপন সিংহ— গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।
• সত্যজিৎ রায়— রবির চোখ দুটোই কথা বলে।
• উৎপল দত্ত— স্টেজ ম্যানেজারের পদ ছেড়ে এ বার নাটক পরিচালনা কর।
• তাপস সেন— বহু মানুষের নানা সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিল তা তাদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নয়, একটি খাঁটি মানুষ।
• উত্তমকুমার— রবির পাশে অভিনয় করতে সব সময় ভয় লাগে। আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে।
• তপেন চট্টোপাধ্যায়— একনিষ্ঠ পাঠক দশটি কৌতূক নকশা নিয়ে কলম ধরেছিলেন ‘হাসতে যাদের মানা’ বইটির জন্য। ১৯৯৭-এর বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তপেন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, দেখছি রবিদা বইমেলায় কাদা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় হাঁটছেন। শনিবার বইমেলায় জুটি ছিলাম, মঙ্গলবার একা হয়ে গেলাম।
• কমলকুমার মজুমদার— রবির অঙ্গভঙ্গি বেশ ভাল।, ভাল করে অভিনয় শেখার চেষ্টা করলে এক জন ভাল অভিনেতা হতে পারবে।

স্মরণীয় কিছু ঘটনা
১৯৭০: গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির মুখ্য চরিত্র হিসেবে সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ।
১৯৭২ নেতাজি ইনস্টিটিউটে সমরেশ বসুর উপন্যাস ‘বিবর’ এর নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করা ও পেশাদারি নাট্য-পরিচালকরূপে আত্মপ্রকাশ।
১৯৮৭ তে যাত্রায় যোগদান ও নট্ট কোম্পানির পালা ‘পাল্কি চলে রে’
১৯৯৫ স্বজন নাট্যগোষ্ঠীর অতিথি শিল্পী হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ।
১৯৯৬ শেষ বারের মতো যাত্রায় যোগদান। মুক্তলোকের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’।

স্মৃতিচারণ
বৈশাখি ঘোষ (স্ত্রী)
সারা ক্ষণ হাসিখুশি মানুষটি আসলে খুবই গুরুগম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। আমাকে আড্ডা মারতে দেখলে খালি বলতেন, বাড়িতে এত ভাল ভাল বই আছে পড়লেই তো পার। বিয়ের পরে আমাকে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ দিয়েছিলেন। ছোটবেলা মামাবাড়ি কোচবিহারে কাটলেও পরে কলকাতায় চলে আসেন। আমি উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগানের মেয়ে। নাটক দেখতে খুবই পছন্দ করতাম। বিজন থিয়েটারে শ্রীমতী ভয়ঙ্করী-তে ওঁর অভিনয় দেখেছিলাম। মানিকদা অথবা বাবু (সন্দীপ রায়) ছবি তৈরির সময় নিয়ে যেতেন। যাত্রায় যাওয়াটা আমার পছন্দের ছিল না। কিন্তু উনি মাটির মানুষগুলোর কাছে মিশে যেতে চেয়েছিলেন। অর্থকষ্ট ছিল না তবুও যাত্রাটা পেয়ে বসেছিল। প্রযোজকরা বাড়িতে পড়ে থাকতেন। এত ‘জার্নি’ সঙ্গে পরিশ্রম ওঁর রক্তের শর্করা বাড়িয়ে দিয়েছিল। খুব আমুদে আর আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। জয়া ভাদুড়ির লোকাল গার্জেন ছিলেন। ওই পরিবারেরও উনি একজন হয়ে উঠেছিলেন। তবে বরিশালের কুলীন কায়স্থ বলে খুব দেমাক ছিল! তাই লোকজন নেমতন্ন করে বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। কিছু বললে উত্তর আসত ওরকম একটুআধটু হয়েই থাকে। ম্যানেজ করে নিতে হবে।


মৃণাল সেন (পরিচালক)
মনে পড়ছে সেই ঘটনাটা। আমারও তখন কম বয়েস। ‘সাংবাদিক’ নাটকে কয়েক সেকেন্ডের একটা চরিত্রে মঞ্চের এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রবি ঘোষ। অসাধারণ এক টুকরো ছবি আমার মন দখল করে নেয়। আমি একটা পত্রিকায় এক প্যারা লিখেওছিলাম। আজ রবি নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কত যে স্মরণীয় ছবি ও করে গেল।


মনোজ মিত্র (অভিনেতা)
রবিদা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সারির মধ্যে কত-তম, আমি ব্যক্তিগত ভাবে সেটা বলতে পারব না। কিন্তু তাঁর একটা বিশেষত্ব ছিল, একটা অনন্যতা ছিল। তাঁর অভিনয়ের জায়গা ছিল ওঁর চোখ। তিনি নিজেই ছিলেন একটা ‘রকম’। উত্তমকুমারকে যেমন দেখা যায়নি কোনও খারাপ চরিত্রে অভিনয় করতে, ঠিক তেমনই রবিদাকে দেখা যায়নি এমন কোনও ছবিতে অভিনয় করতে যেটা দর্শক নিতে পারেনি। আমরা ‘হুতোমের নকশা’য় মামা-ভাগ্নে চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। আমি মামা প্রাণবল্লভ ও রবিদা ভাগ্নে রাধাভল্লব। ছবি তৈরির সময়ই চলে গেল। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ আমরা একসঙ্গে অভিনয় করি। ‘জীবনপুরের পথিক’ ছবিতেও আমরা দু’জন ছিলাম। রবিদা কাজের লোক আর আমি এক বদমায়েশ বাবু। নানা স্তরের মানুষের স্বর অনায়াসে নিজের গলায় আনতে পারতেন। অত্যন্ত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন।


মাধবী মুখোপাধ্যায় (অভিনেতা)
রবি ঘোষ যখন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি করতেন তখন ওখানেও থিয়েটার করতেন। তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়। পরে উৎপল দত্তের দলে যোগ দেন ও খুবই সফল হয়েছিলেন। ছবিতে যখন এলেন, সেই অর্থে ‘নফর সংকীর্তন’ ওঁর প্রথম চলচ্চিত্র হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ছবিটির কাজ শেষ না হওয়ায় ওই ছবিটি আর ওঁর করা ছবির তালিকায় প্রথম হল না। ‘কাউকে বোলো না’ ছবিতে আমি ও রবি ঘোষ স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করি। বহু ছবিতে অভিনয় করেছি একসঙ্গে। অসাধারণ মাপের অভিনেতা ছিলেন। একসঙ্গে থিয়েটার করেছি ‘ঘটক বিদায়’-এ। স্টেজ পুড়ে যাওয়ার পরে যেখানেই করেছি সেখানেই হাউসফুল হয়েছে।


চিন্ময় রায় (অভিনেতা)
উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ নাটকে প্রথম আলাপ। তার পরে আমরা যে ছবিটি এক সঙ্গে করি সেটি ‘গল্প হলেও সত্যি’। এটি আমার প্রথম ছবি ও ছোট্ট একটা চরিত্র। রবিদা বললেন, চেহারাটা রোগা হলেও অভিনয়টা ছাড়িস না। পারলে বিকেলে আমার বাড়িতে চলে আসিস। সেই যে রবিদার বাড়িতে ঢুকলাম, সম্পর্ক ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। রবিদার কালীঘাটের বাড়িতে জমিয়ে আড্ডার সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ও বিদেশি নানা ছবির গভীর আলোচনা হতো। রবিদা এমন এক জন কমেডিয়ান ছিলেন যিনি ব্যাকরণ সম্মত অভিনয় করতেন। এমন কোনও ছবি নেই যেখানে তাঁকে বাড়াবাড়ি করতে দেখা গিয়েছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার ও রবিদা— যে ক’জন কমেডিয়ান এসেছেন, রবিদার আসাটা যেন আবির্ভাব হয়ে দাঁড়ায়। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ ছবিতে রবিদার সঙ্গে অভিনয় করে খুব খুশি হয়েছি। ‘অপরূপা’-সহ প্রায় ৮টি ছবিতে এক সঙ্গে অভিনয় করি। কিন্তু এমনই ভাগ্য যে রবিদা যাত্রায় চলে যাওয়ায় পরের দিকে ওঁর সঙ্গে আর ছবি করা হয়ে ওঠেনি।


সন্দীপ রায় (পরিচালক)
রবিকাকা এমন এক জন মানুষ, এমন এক জন অভিনেতা যিনি প্রায় আমাদের পরিবারের এক জন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬২ সাল থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর পরিচয়। বাবা প্রথম দেখেন উৎপল দত্তের নাটকে। উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘মেঘ’ ছবিতে রবিকাকার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তাই বাবা ওঁকে নেন ‘অভিযান’-এর এক অদ্ভুত চরিত্র রামা-য়, যা দর্শক কোনও দিন ভুলবেন না। বাবার বিভিন্ন ছবিতে রবিকাকা ফিরে ফিরে এসেছেন নানা চরিত্রে। অনেক ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেছেন, কিন্তু তার কী বিন্যাস! ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ ‘মিস’ করি। আর গুপী-বাঘা সিরিজে সত্যি কথা বলতে বাঘাও যেমন গুপীও তেমন। এঁরা যেন একে অন্যের পরিপূরক। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত খাঁটি ছিলেন।


বীরেশ চট্টোপাধ্যায় (পরিচালক)
১৯৭২-এ মুম্বইতে হৃষীদার কাছে কাজ করতে গিয়ে দেখি একটি হিন্দি ছবির কাজ চলছে। তাতে কলকাতার দু’জন অভিনেতা রয়েছেন— কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। ছবির নাম ‘সব সে বড়া সুখ’। অসাধারণ সেই ছবি। কলকাতায় যখন সহ-পরিচালকের ভূমিকায় কাজ করেছি তখন রবিদার অভিনয় দেখেছি, কিন্তু তেমন ভাবে চিনতাম না। ‘অভিযান’ দেখার পরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। তখনই মনে হয়েছে ওই রকম দুর্ধর্ষ অভিনেতার সঙ্গে কাজ করতেই হবে। ‘মোহনার দিকে’ রবিদাকে নিয়ে আমার প্রথম কাজ। দীপঙ্কর ও রবিদার সঙ্গে যে সিকোয়েন্স ছিল সেটায় যে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন রবিদা, আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।


দীপঙ্কর দে (অভিনেতা)
অভিযান-এ মোষের পিঠের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে চলে গেল! শুধু কমেডিয়ান বললে মস্ত বড় ভুল থেকে যাবে। তিনি এক জন টোটাল আর্টিস্ট। এবং এটা একশো শতাংশ ঠিক। আর গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর কথাই আলাদা। তাঁর আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় ক্ষমতা়, কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভূত। সুবর্ণগোলক, মোহনবাগানের মেয়ে, বাঞ্ছারামের বাগান-সহ নানা ছবিতে অভিনয় করার সময় বুঝেছিলাম ‘টাইমিং’ ব্যাপারটা কী? কত বড় ও বিচক্ষণ অভিনেতা ছিলেন তিনি। কথায় কথায় উদ্ধৃতি দিতেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে। এমন নয় যে তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন, পড়াশোনা করতেন খুব গভীর ভাবে। নানা বিষয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা চলত। ফ্লোরে বা আড্ডায় কারওর সঙ্গে অন্য কারওর কোনও ঝামেলা হলে রবিদা গাইতেন ‘এক দিন কিনে নেবে তাঁরে’, পরে বলতেন, ‘তোর আর কিছু করার নেই। শুয়ে পড় শুয়ে পড়।’ এত রসবোধ ছিল! তাঁর নিজের দুঃখকষ্টকে কোনও দিন কারওর সামনে প্রকাশ করেননি। বার বার বলতেন বই পড়ার কথা। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-র কথায় যে মন ভাল হয়ে যায় তা বলতেন সব সময়। বেশির ভাগ জায়গায় ভৃত্য, গাড়ির ক্লিনার, রান্নার ঠাকুর, দালাল, গরিব উকিল, নায়কের রকে বসা বন্ধু, কোথাও বা বাজনদার বাঘা— এক একটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন টুকরো টুকরো বাক্য দিয়ে অথবা শব্দের বদলে নীরব অভিব্যক্তি দিয়ে। চোখ দিয়েই উতরে দিয়েছেন কত ছবি। বহু পরিচালক ওই গুণটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। পুরো ছবিতে নিজের সংলাপ বলতে কিছুই নেই। শুধু অন্য চরিত্র যে কথা বলবে নির্বাক হয়ে তা শোনা আর তার শেষ শব্দটা আবার বলা— এখানে সেন্স অফ টাইমিং আর ডাবল টেক একটা বড় ফ্যাক্টর। এই গুণটা গুরু উৎপল দত্তের কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন।


সন্ধ্যা রায় (অভিনেতা)
রবিবাবু অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাবলীল ও সরল ভাবে মিশতেন। ওঁর পড়াশোনা ছিল গভীর। চলচ্চিত্র ছাড়া নাটক, যাত্রা নিয়ে চর্চা ছিল মনে রাখার মতো। কুহেলি-র একটা দৃশ্য মনে পড়ছে। এক ভৃত্য কাজ করতে আসত ভূতের বাড়িতে। সন্ধের আগে ফিরে যেতে হত। অথচ কাজের তাগিদে, পেটের তাগিদে তাকে রোজ আসতে হতো সেই দূর পাহাড়ের ধার থেকে। সততার মধ্যে দিয়ে জীবন-সংশয়ের যে অভিব্যক্তি তিনি তুলে ধরেছিলেন সেখানে রবিবাবু একেবারেই স্বতন্ত্র এক অভিনেতা। কাজের ফাঁকে যে সব আলোচনা হতো তাতে তিনি বহু সময় খেদ প্রকাশ করতেন। এই গরিব দেশে সে সুযোগই তো নেই যে এমন ছবি হবে যার মধ্যে দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অমর হয়ে থাকবে। যদি গুপী গাইন বাঘা বাইন না হতো, তা হলে আমরা তাঁর অ্যাক্টিং রেঞ্জ জানতে পারতাম না। তিনি যে বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন এক অভিনেতা সেটা আমাদের চোখে ধরাই পড়ত না। কোনও ছোট চরিত্রকেই কোনও দিন অবহেলা করেননি রবিবাবু।

ঋণ: ছবি ও তথ্য রবি ঘোষ স্মারক সংকলন।
তথ্য ও সাক্ষাৎকার: : পাপিয়া মিত্র
নিজস্ব চিত্র
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.