ময়দান ও ক্লাব
ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব
(সিসিএফসি)
তিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে, জোব চার্নকের ‘পদধূলি’ পড়ার ১০০ বছরের মধ্যেই শহর কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাবের। কারণ ইংরেজরা পূর্ব ভারত থেকেই নিজেদের সাম্রাজ্যের শিকড় বিস্তার করতে শুরু করেছিল। কয়েক শতাব্দী থাকার পরিকল্পনা যেখানে থাকে, সেখানে বিনোদনের কিছু ব্যবস্থা রাখতে হয় বৈকি। মূলত সেই ভাবনা থেকেই এই ক্লাবের গোড়াপত্তন। বর্তমানে আমরা যে ক্লাবটিকে দেখি তা গত দু’শতকে আরও দু’টির সমন্বয়ে, অর্থাত্ মোট তিনটি ক্লাব মিলে তৈরি হয়েছে।
সিসিএফসি ক্লাবের প্রতিষ্ঠা দিবস নিয়ে একটি সুন্দর ইতিহাস রয়েছে, যা ক্লাবের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এইচ জে মুরহাউস-এর সৌজন্যে ক্লাবের সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। ১৯৫৫ সালে পর্তুগালের ওপোর্তো ক্লাবের তৎকালীন সেক্রেটারি অ্যালান আর টেট ক্লাবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে লন্ডনের দ্য টাইমস্ পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি দাবি করেছিলেন, ব্রিটেনের বাইরে ওপোর্তো-ই বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ক্রিকেট ক্লাব। চিঠিটি প্রকাশ্যে আসতেই বিশ্বের নানা প্রান্তের ক্লাবের তরফ থেকে পত্রিকার দফতরে চিঠি পাঠানো হয়। দেখা যায় বিশ্বের অনেকগুলি ক্লাবই ওপোর্তোর চেয়ে বয়সে প্রবীণ। সে সময়ে কলকাতা থেকে আরউইন রোসেনওয়াটার নামে এক সাহেব লন্ডন টাইমস্ পত্রিকায় একটি চিঠিতে সিসিএফসি-র নাম উল্লেখ করেন। প্রমাণ হিসেবে ১৭৯২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মাদ্রাজ কুরিয়র নামক পত্রিকায় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব (তৎকালীন নাম) বনাম ব্যারাকপুর ও দমদমের একটি ক্লাবের খেলার সূচির কথাও জানান। এই খবরে উইসডেন নড়েচড়ে বসে। কর্তৃপক্ষ প্রমাণটি ঠিক হিসেবে গণ্য করলে উইসডেনের বিচারে সিসিএফসি-কে ব্রিটেনের বাইরে প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাবের আখ্যা দেওয়া হয়। ক্লাবের প্রতিষ্ঠার তারিখ সম্বন্ধে সঠিক কোনও তথ্য না থাকায় প্রতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ১৭৯২ সাল— সিপাহী বিদ্রোহেরও ৬৫ বছর আগে!

কলকাতা ময়দানে তথাকথিত ক্লাবগুলির সঙ্গে সিসিএফসি-র প্রাথমিক কিছু র্পাথক্য রয়েছে। এই ক্লাবের অবস্থান কলকাতা ময়দানের অন্যান্য ক্লাবের মতো ফুটবল বা ক্রিকেট মানচিত্রে না থাকলেও (ঠিকানাটিও ঠিক ময়দান বলা যায় না) কলকাতা তথা ভারতের ক্রীড়া ক্ষেত্রে এই ক্লাবের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
আজকে যাকে সবাই ইডেন গার্ডেন্স নামে চেনে, তা গড়ে ওঠার পেছনেও সিসিএফসি-র অবদান রয়েছে। ঘটনাক্রম শুরু হয়েছিল ১৮২০ সালে। এর আগে পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম ও রাজভবনের মাঝে এই ক্লাবের খেলার মাঠ ছিল।। সদস্যদের সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ক্লাবের একটি স্থায়ী আস্তানা তৈরি করা হবে। সেই মতো ১৮২৫ সালে কলকাতা ময়দানে একটি জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তৈরি হয় স্থায়ী খেলার মাঠ। পুরনো কলকাতার আঁকা ছবিতে এই মাঠের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৪১ সালে মাঠটিকে বেড়া দিয়ে ঘেরার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষ ক্লাবের কাজকর্মে সন্দিহান হয়ে তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ করে চিঠি লেখেন। ফলস্বরূপ, ক্লাবটি ময়দানের পূর্ব প্রান্তে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন ম্যাজিস্ট্রেট। সেখানে গিয়েও মিটল না সমস্যা। ১৮৬৪ সালে একটি রাস্তা তৈরির জন্য ফের বিপত্তি দেখা দেয়। ম্যাপ অনুযায়ী রাস্তাটি ক্লাবের মাঝ বরাবর আঁকা হয়েছিল। ফলে ফের ক্লাবটি সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ক্লাবের তরফ থেকে গভর্নর জেনারেলের কাছে প্রার্থনা করেও কোনও কাজ হয়নি। অগত্যা উৎখাত হতে হয়। এ বার তাদের ক্লাব তৈরির অনুমতি দেওয়া হয় ‘ইডেন গার্ডেন্স ইস্টার্ন এন্ড’-এ। বার বার অনুরোধ করার পর সে বছর ১৯ এপ্রিল এখানেই একটি প্যাভিলিয়ন গড়ার অনুমতি পায় সিসিএফসি। তার পর লর্ডসের প্যাভিলিয়নের অনুকরণে বর্মা সেগুন দিয়ে ১২৫ ফুট/ ২৫ ফুটের একটি সুন্দর প্যাভিলিয়ন গড়ে তোলা হয়। পরে ১৯৭০ সালে, বিসি রায় ক্লাব হাউস তৈরির সময় কাঠের প্যাভিলিয়নটি ভেঙে ফেলা হয়।

১৮৮৯-’৯০-এ সিসিএফসি ফের শিরোনামে আসে। সে সময়ে ক্লাবের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ব্রিটেনের মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব কলকাতায় খেলতে আসে। এটাই ছিল ভারতে ক্রিকেট খেলতে আসা প্রথম কোন বিদেশি দলের সফর। এর পরে আরও অনেক দল খেলতে আসে ভারতে। এ সব ঘটনাই ভারতে ক্রিকেট বোর্ড গঠনের ভাবনাকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং ভারতকে টেস্ট খেলিয়ে দেশের মর্যাদা পেতে সাহায্য করেছিল। সিএবি গঠন হওয়ার পর ১৯৫০ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের হাতে ইডেন গার্ডেন্সের সত্ব তুলে দেন ক্লাবের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট টি সি লংফিল্ড। প্রথম বার বাংলা যখন রঞ্জি ট্রফি জেতে, লংফিল্ড ছিলেন সেই বিজয়ী দলের অধিনায়ক। তার পর নানা ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে আজকের ইডেন।
কসরতের সরঞ্জাম...
১৯৪৭ সাল থেকে বিভিন্ন খেলায় ক্লাবের অধিনায়কদের তালিকা
সবিস্তার...
কেরি প্যাকারকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটের জনক বলা হয়। ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি নির্দিষ্ট সংখ্যক ওভারে ক্রিকেট খেলার প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু প্যাকারের মস্তিস্ক প্রসূত যুগান্তকারী ধারণাটি ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে সিসিএফসি-র কিছু সদস্যদের মাথায় আসে। শুধু তাই নয়, সে মাসেই ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব এবং মার্চেন্টস একাদশের মধ্যে একটি ৫ ম্যাচের সিরিজ খেলা হয়েছিল। শুনলে অবাক হতে হয়, সেই সিরিজে প্রত্যেকটি ইনিংসই ছিল ২০ ওভারের!

সিসিএফসি-র আরও একটি সুর্বণ ঐতিহ্য রয়েছে। ১৮৭২ সালে একই প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব। নাম ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব হলেও আদপে খেলা হত রাগবি। কারণ সেই সময়ে ব্রিটেনে রাগবি এবং ফুটবল ছিল সমার্থক। (এ সম্বন্ধে স্কটিশ রাগবি ইউনিয়নের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৮৭৩ সালে যখন এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার নাম ছিল স্কটিশ ফুটবল ইউনিয়ন। পরে ১৯২৪ সালে নাম পাল্টে স্কটিশ রাগবি ইউনিয়ন করা হয়।) যাই হোক, ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব ইংল্যান্ডের বাইরে প্রাচীনতম রাগবি ক্লাবের স্বীকৃতি পায়। ১৮৯০ সালে ক্লাবটি একটি রাগবি টুর্নামেন্টের আয়োজনে করে— ক্যালকাটা রাগবি ইউনিয়ন চ্যালেঞ্জ কাপ। সে উপলক্ষে একটি সুন্দর রূপোর কাপও তৈরি করা হয়। পরবর্তীকালে কাপটির নাম হয় ‘ক্যালকাটা কাপ’। আজও প্রতি বছর ক্যালকাটা কাপ উপলক্ষে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মধ্যে একটি রাগবি ম্যাচ খেলা হয়। ১৯৬৫ সালে এই ক্লাবটিও মিশে যায় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে।
ইতিহাসের পাতা থেকে...
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্লাব সদস্য তাঁদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ছবি, জার্সি
ও নানা খেলার সামগ্রী ক্লাবকে দান করেন, যা এখন সংগ্রহশালায় রয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হয়েও বরাবর প্রতিযোগিতামূলক খেলা থেকে দূরেই থেকেছে সিসিএফসি। এ জন্যই ভারতের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল টুর্নামেন্ট ট্রেডস্ কাপে অংশ নেয়নি তারা। ১৯৪০-এর দশক থেকে খেলায় ক্লাবের মান পড়তে শুরু করে। ১৯৫০ সালে ফুটবলে অবনমনও হয়। সে বছরই ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব বালিগঞ্জে (গুরুসদয় রোডে, বর্তমান ক্লাবটি যেখানে রয়েছে) স্থানান্তরিত হয়। তখন এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জি ডি গুজ, এ সি কাউড্রে প্রমুখ দিগ্গজ। এঁদের মধ্যে গুজ ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ সি কাউড্রে ছিলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক স্যর কলিন কাউড্রের প্রপিতামহ। পরে ১৯৬৫ সালে ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাবও বালিগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। তার পর বর্তমান ক্লাবের নামকরণ হয়। সেখানেই ধীরে ধীরে প্যাভিলিয়ন, সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, সংগ্রহশালা, বার, জিম গড়ে উঠেছে। বছরভর বিভিন্ন খেলায় ঠাসা থাকে ক্লাবের ক্রীড়াসূচি। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন মার্চেন্টস কাপ। ১৯৭৩ সালে সাইকেল পোলোয় প্রথম মার্চেন্টস কাপ খেলা হয় এই ক্লাবে। ইন্ডোর গেমসের মধ্যে ব্যাডমিন্টন, টেবল টেনিস, সাঁতার, ডার্ট নিয়েই মেতে থাকে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাব।


দীপঙ্কর নন্দী

ক্লাবের বর্তমান সিইও দীপঙ্কর নন্দী বলেন, “সিসিএফসি এখন মূলত পাঁচটি খেলার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, হকি এবং রাগবি। ১৯৮১ সালে আমি যখন এর সদস্য হই, তখন মোট সদস্যসংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৩০০। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা প্রায় ১৮০০। ২০০১ সাল থেকে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার জন্য অনেকে অপেক্ষারত।” তিনি জানান, এখন যে জমিতে তাঁদের ক্লাব রয়েছে, সেটিও সেনাবাহিনীর কাছ থেকে লিজে নেওয়া। প্রত্যেক ৩০ বছর অন্তর লিজ পুনর্নবীকরণ হয়। যদিও ৯০-এর দশকের পর থেকে ক্লাবে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ক্লাব হাউসের সংস্কার হয়েছে। সুইমিং পুল, জিম, বার ইত্যাদি হয়েছে। নৈশালোকে খেলার জন্যে ফ্লাড লাইটও বসানো হয়েছে মাঠে। ধীরে ধীরে কলেবরে অনেক বড় হয়েছে ক্লাব। ভবিষ্যতে সদস্যসংখ্যা বাড়ানো নিয়ে চিন্তাভাবনা রয়েছে তাঁদের। তাঁর কথায়: “খেলাকে ভিত্তি করে ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হলেও, ঐতিহ্যকেই এই ক্লাব বরাবর প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। খেলাকে আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে দেখা হয়েছিল বলেই প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা থেকে দূরে থেকেছে সিসিএফসি। তবে গত বছর আমাদের ক্লাব হকি লিগ জিতেছে। ফুটবলেও আমরা দ্বিতীয় ডিভিশনে রয়েছি। সিসিএফসি একমাত্র ক্লাব যেখানে এখনও সাইকেল পোলো-র মতো ‘ইউনিক গেম’ খেলা হয়। প্রত্যেক বছর ‘ক্যালকাটা কাপ’ উপলক্ষে একটি রাগবি ম্যাচ খেলা হয়। ফলে আমরা ক্লাবের ঐতিহ্যকে আজও বহন করে চলেছি।”


সাইকেল পোলো। ছবি ক্লাবের পুস্তিকা থেকে সংগৃহীত।

তথ্য: জয়দীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রজত কর্মকার।
ছবি: রজত কর্মকার।
তথ্য সূত্র: ক্লাব কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ও ক্লাবের ওয়েবসাইট।
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.