এই শহর যেন
‘দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ’
(মঞ্চগান শিল্পী ও অভিনেতা)
ন্মসূত্রে কলকাতার গা ঘেঁষা শহরের পথ-ঘাট-মাঠ-স্কুল-কলেজ চত্বরে এখনও উঁকি মারে সময়কালের শিক্ষা-দীক্ষা-নষ্টামি-দুষ্টুমি-মাস্তানির মায়াজাল। ক্যারাম-কাবাডি-গুলি-ডাংগুলি-লাট্টু-টেনিস-ফুটবল-ক্রিকেট সব খেলাই ছিল শৈশব আর কৈশোরের বেড়ে ওঠার আশ্রয়। ‘রামের সুমতি’র রামের মতোই পুকুর-পাঁচিল-নজর এড়িয়ে সদলবলে চুরি করেছি আম-জাম-পেয়ারা-আমড়া-কুল আর বাতাবি লেবু। পাড়ার প্রয়োজনে চোর ধরা বা মড়া পোড়ানো থেকে বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন পুজো-পার্বণ এমনকী শ্রাদ্ধের আসরে পঙক্তি ভোজনে পরিষেবা তথা পরিতুষ্টি। কৃতী শিক্ষককুলের ‘অকৃতি অধম’ ছাত্র হলেও পেয়েছি সস্নেহ সঞ্জীবন।

পরবর্তীতে পুরোপুরিই এই শহরে চলে আসা। বাবার রাশটানা শাসনের পাশাপাশি মায়ের প্রশ্রয়ে শুরু হল ছবি আঁকা, গল্পের বই ও কবিতা পড়া, লেখা, পত্রিকা প্রকাশ, গান শোনা আর সিনেমা-থিয়েটার-যাত্রার সঙ্গে সহবাস। মাত্র পাঁচ বছরের আমি মায়ের সঙ্গে মিনার্ভা মঞ্চে দেখেছিলাম প্রথম নাটক ‘অঙ্গার’। বাবার দমন রেখা পেরিয়ে মায়ের সঙ্গে মহাজাতি সদনে দেখলাম মহিলা শিল্পী মহলের ‘মিশরকুমারী’। পুরোভাগে কাননদেবী, মলিনাদেবী আরও কত জন। অকালেই পক্ব হলাম। কলেজ পেরিয়ে ‘সব পথ শেষে মিলে গেল এসে’ গানের সুরে। বাণিজ্যের সাম্মানিক স্নাতক আমি বাবার কলকাতাস্থিত ‘অডিট ফার্মের’ শিক্ষিত কর্মকুশলতায় ভারতবিখ্যাত এক জাহাজি প্রতিষ্ঠানের ‘ইন্টার্নাল অডিটর’ বনে গেলাম উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার দায়ে। উস্তাদের কলকাতার বাড়িতেই তালিমের পালা শুরু হল।
গুণীদের সংস্পর্শে...
সংযুক্তা পাণীগ্রাহী ও রঘুনাথ পাণীগ্রাহী আলি আকবর খাঁ সাহেবের সঙ্গে

ওয়েলেসলির অধুনা রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের অর্ধ-বাসিন্দা হয়ে উঠলাম মধ্য সত্তর দশকে। এক দিকে সে সময়ের শুনশান পার্ক স্ট্রিট আর অন্য প্রান্তে ধর্মতলা। সকালে রাস্তা জলে ভিজে উঠত পৌর ব্যবস্থায়। তখন মনে ছিল অর্থ রোজগার করব ‘বাণিজ্যে’ আর ব্যয় করব ‘শিল্পে’ মানে সঙ্গীতের সারস্বত সাধনায়। একদা হাওড়ার অলিগলি ঘোরা আমার সদা সঙ্গী ছিল সাইকেলের দু’চাকা। আর কলকাতার পাকে চার চাকার নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠা জীবনে বাধ মানল না উত্তর থেকে দক্ষিণ বা পূর্ব থেকে পশ্চিম। এমনকী বর্তমান মানচিত্রে যারা কলকাতা সীমায়িত তৎকালীন শহরতলীয় সেখানেও অবাধে পৌঁছে যেতাম সিনেমা-থিয়েটার-যাত্রা গানের অমোঘ আকর্ষণে। তার পর এল সেই অনিবার্য দণ্ড। ২০ জুন ১৯৯০। বাণিজ্য-সংগত আর সুর-সঙ্গীতের সংঘাত। বহু দূর গড়াল সে বিবাদ। ফলে ছাড়তে হল বাণিজ্য ধারা। একা এবং নিঃসঙ্গ। বাবা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। শুরু হল আর্থিক সংকট। সল্টলেক-বালিগঞ্জ-গোলপার্ক ঘুরে আজ অশ্বিনী দত্ত রোডে শরৎচন্দ্রের প্রতিবেশী আমি। সঙ্গীতজীবনের প্রথম ভাগে বহু ধারা বাংলা গানের পাঠ নিয়েছি বহু গুণীজনের কাছে।

ছোটবেলা থেকেই আমার কাছে সর্ব সময়ের সঙ্গী ছিল থিয়েটারের গান বা ‘মঞ্চগান’। গানের বহু বিচিত্র ধারার সঙ্গম ঘটল সেই ‘মঞ্চগানে’। এই কলকাতাই আমায় জোগান দিল নতুন সুরের পাঠ। সেই স্বরভূমিতেই গড়ে ওঠে আমার নতুন ভুবন। মঞ্চগান ঘিরে আমার চিন্তা ভাবনা অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন ঘোষের তত্ত্বাবধানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টরেট’ সম্মান পেল। কাকতালীয় হলেও তা জুটল এই কলকাতার নিত্য বাসিন্দা হিসেবেই।


দু’দশকে বদলেছে অনেক কিছুই। তবু কলকাতা আছে কলকাতাতেই। এই কলকাতার চৌহদ্দিতে স্পর্শ করা যায় গোটা ভারতের প্রাণের সুর। পাড়া থেকে পাড়া বা মোড় থেকে মোড় বদলে গেলেই বদলে যায় ‘দেয়ালে দেয়াল কার্নিশে কার্নিশ।’ ধরা যাক দক্ষিণের গোলপার্ক থেকে চলেছি উত্তরের পানে। গড়িয়াহাট পৌঁছলেই যে চেহারা পাই বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে তা উধাও। এগিয়ে গেলে পার্ক সার্কাসে ভিন্ন ছবি। আরও এগোলে ‘বউবাজারে’ শুধুই গয়না অথচ আর এক মোড় পেরোলেই কলেজ স্ট্রিটে বই আর বই। হেদুয়া পেরিয়ে হাতিবাগানে বহু ‘হল’ বন্ধ হলেও আজও বাজারের দরাদরির পাশে সিনেমা-থিয়েটারের হাতছানি। এর বাঁ দিকে চলে এলেই সন্ধের পসরা সাজিয়ে ভিন্ন পাড়া সোনাগাছি। সমাজ-সংস্কৃতি কাকে বলে জানি না তবে এখানেই অনুভব করি সন্ত কবীরের পথনির্দেশ ‘সংস্কৃতি হল ভাগ করে খাওয়া’ বা আলবেয়ার কাম্যুর জীবনবেদ ‘Art and revolt will die only with the last man’। যদিও আজকের কলকাতায় মেট্রোরেল নতুন গতি এনেছে। মলে মলাক্কার হয়েছে। স্কাই-স্ক্রাপারি বাড়িতে বাড়িতে টান পড়েছে খোলা আকাশে, সহজ বাতাসে নিস্তরঙ্গ জলাধারে। তবু এই কলকাতাই আমাকে, আমার সংসারকে, আমার সঙ্গীতকে, আমার মঞ্চগানকে দিয়েছে এক অনন্ত জীবন। যে জীবনে অভাব নেই, ক্লেদ নেই, ঈর্ষা নেই। আছে শুধু সুরের ঝরনাধারায় স্নাত অনাবিল আনন্দ। পেয়েছি নানা-বয়সি চেনা-অচেনা, জানা-অজানা, খ্যাত-অখ্যাত বহু মানুষের সুমন-সম্ভার।
আর কী চাই!
 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.