নিরন্তর নদীর স্রোত। সুর্যোদয় আর সূযার্স্তের অন্তরঙ্গতায় কেটে গিয়েছে আঠারোটি দশক। স্নানার্থীদের পায়ে পায়ে এই ঘাটের বয়স হল ১৮৩ বছর। বাবুঘাট— নামে ‘বাবু’ থাকলেও এখন তার বাবুয়ানা নেই বললেই চলে।
ঘাটের প্রবেশ পথ
জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র দাস ১৮৩০ সালে এই ঘাট নির্মাণ করেন। জাতিতে মাহিষ্য রাজচন্দ্র ছিলেন রানি রাসমণির স্বামী। চৌরঙ্গি থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত একটি পাকা রাস্তাও নির্মাণ করেন রাজচন্দ্র। প্রথমে সেই রাস্তার নাম ছিল বাবু রাজচন্দ্র দাস রোড। পরে হয় অকল্যান্ড রোড, বর্তমানে যা অতি পরিচিত রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ। স্ট্র্যান্ড রোডের উপরেই দণ্ডায়মান এই ঘাটের থামগুলিতে দেখা যায়
গ্রিসের ডোরিক স্থাপত্যের নিদর্শন। ১২টি আর্চ বিশিষ্ট ঘাটে নতুন করে রং করা হয়েছে। ভেঙে যাওয়া সিঁড়ির পরিবর্তে বসেছে পাথরের স্ল্যাব।
কথায় বলে ফেলো কড়ি, মাখো তেল। সে দৃশ্যই নজরে পড়ে বাবুঘাটে। বাঁ দিক ঘেঁষে ঘাট সোজা গঙ্গার দিকে নেমে গেলেই দেখা যায়, পর পর কাঠের পাটাতন রাখা। প্রমাণ মাপের আয়তাকার সেই পাটাতন আসলে প্রাচীন ‘মাসাজ পার্লার’। কবে থেকে এই দলাইমলাইয়ের কাজ গঙ্গার ঘাটে হয়ে আসছে তা অবশ্য মনে করতে পারলেন না প্রদীপ বারিক। ওড়িশার পুরী জেলার বাসিন্দা প্রদীপবাবু পেশায় ‘মাসাজ শিল্পী’। বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকেই চলে আসছে পারিবারিক এই পেশা। বললেন, “দিন ক্ষণ মনে নেই, বাপ বলল, আর ভিড়ে গেলাম।” কেমন লাগে? পাশে বসে থাকা শ্রীনিবাস বারিক বললেন, “কেমন আর লাগবে! আরামপ্রিয় মানুষকে আমেজ দিয়ে বড়ই তৃপ্ত লাগে।” পাশ থেকে বিনোদ বারিক যোগ করলেন, “তবে শুধু যে আমেজের কারণেই আমাদের কাছে মানুষ আসে, তা ঠিক নয়। বাতের ব্যথায় কষ্ট পান এমন অনেকেই আসেন।” কী রকম ‘কড়ি’ লাগে এই দলাইমলাই করতে? প্রদীপ বারিক জানালেন, ঘণ্টা প্রতি ১০০ টাকা। তবে ‘মাসাজ’ করতে শ্রীনিবাস-বিনোদদের যে পরিশ্রম হয়, সে তুলনায় পারিশ্রমিক ‘বেশ কম’। এমনটাই বললেন ‘মাসাজ’ করাতে আসা উত্তর কলকাতার বাসিন্দা সোমনাথ দত্ত। তবুও দর-দাম করেই সোমনাথবাবুরা নিজেদের শরীর ছেড়ে দেন প্রদীপ বারিকদের হাতে। তেলের সঙ্গে কর্পূর-লেবু-লবনের মিশ্রণ দিয়ে এই মাসাজের বেশ সুনাম আছে সারা শহর জুড়ে। গড়ের মাঠে ফুটবল খেলতেন দমদমের বিশ্বনাথবাবু। খেলার পরে এই ঘাটে এসেছেন একাধিক বার। তখন থেকেই দেখছেন এই তেল-মালিশ।
ঐতিহাসিক নানা বর্ণবহুল ঘটনার সাক্ষী বাবুঘাট। ১৮৭৪ সালে এই ঘাট দেখে এক ভাসমান সেতুকে। গঙ্গার বুকে পর পর নৌকা সাজিয়ে, কলকাতা-হাওড়ার মধ্যে সংযোগকারী ওই ভাসমান সেতু প্রস্তুত করেন স্যর ব্রাডফোর্ড লেসলি। ১৯৪৩ সালে ওই একই জায়গায় নির্মাণ করা হয় রবীন্দ্র সেতু, ঘাটের ডান দিকে, যার খ্যাতি হাওড়া ব্রিজ নামে।
১৯৯২ সাল, ঘাটের বাঁ দিকে তৈরি হয় দ্বিতীয়টি— বিদ্যাসাগর সেতু। সুদূর উত্তরাখণ্ড থেকে ভারতের নানা শহর ঘুরে গঙ্গা নদী সাগরে মিশেছে কলকাতাকে ছুঁয়ে। এক এক জায়গায় তার ভিন্ন ভিন্ন নাম। কল্লোলিনী তাকে চেনে ‘হুগলি নদী’ নামে। সেই নামানুসারে সেতু দু’টি প্রথম ও দ্বিতীয় হুগলি সেতু নামেই পরিচিত। প্রাচীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনার মালা হয় দীর্ঘ। ঘাটের গায়ে নদীর জল লিখে যায় সেই সব কথা।
চক্ররেলের ইডেন গার্ডেন স্টেশনের কিছুটা দূর থেকে বাবুঘাটের চত্বর শুরু হয়েছে। মূল প্রবেশ পথের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অফিসবাবুদের গাড়ি। দু’পাশের পায়ে চলার পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোটবড় নানা দোকান— ফুল থেকে মণিহারি, কী নেই তাদের পসরায়! আপাতত কয়েক দিনের ‘গেস্ট’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বড় রথও। প্রবেশদ্বারের ভিতরে, ঠিক মাঝ বরাবর উঁচু বেদীর উপর রাখা আছে এক জোড়া জগন্নাথদেবের মূর্তি। একটি মূর্তি এখানকার স্থায়ী ‘বাসিন্দা’। গঙ্গা পাড়ের বহু পুরনো এই দেবস্থানে নিয়মিত পুজো না হলেও রথ থেকে উল্টো রথ পর্যন্ত তাঁর যথেষ্ট সেবা-যত্ন হয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় জগন্নাথের গল্পটা কী? “ঘাটের কাছেই বিবাদী বাগ জগন্নাথ সেবা সমিতির একটি মন্দির আছে। এই মূর্তি সেই মন্দিরের। প্রতি বছরই উৎসব উপলক্ষে রথে চেপে জগন্নাথদেব এখানে আসেন। এ বারও এলাকার কাউন্সিলর সন্তোষ পাঠক-সহ প্রচুর মানুষ রথ টেনে নিয়ে এসেছেন।” জানালেন পুরোহিত নিরঞ্জন মিশ্র। বাবুঘাটে গঙ্গার পাড়ে বিভিন্ন পুজোর কাজ লেগেই থাকে। সঙ্গে থাকে পারলৌকিক ক্রীয়াকর্মাদির কাজও। সেই সবই সামলান নিরঞ্জন। কোন ছোটবেলায় বাপ-দাদাদের হাত ধরে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। ‘দেশে’ আর তেমন যাওয়াই হয় না, কাজের চাপে। দেশ মানে ওড়িশার কোণার্ক। বর্ষা কালে তো তেমন পুজোআচ্চা নেই— কৌতূহল মেশানো প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন বছর পঞ্চাশেকের নিরঞ্জন। “কেন রথটা পুজো নয় বুঝি! আমরা এ সময়টায় জগন্নাথের পুজো করি। ৯ দিন ধরে ভাগবত পাঠ করা হয়। ওই তো আমাদের জগন্নাথদেব।” ওঁর আঙুল তোলা পথে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় সেই জোড়া জগন্নাথ মূর্তি।
বাবুঘাটে আরও নানা মন্দিরের মাঝেই রয়েছে শ্রী শ্রী গঙ্গাধরের মন্দির। বংশ পরম্পরায়
মদনমোহন পাণ্ডা পুজোর কাজ করে চলেছেন এই মন্দিরে। ঘাট যেখানে গঙ্গায় নেমে গেছে, তার এক ধারে রয়েছে কমলা রঙের একটি বজরঙ্গবলীর মূর্তি। যথেষ্ট সমাদরে এখানে তাঁর পুজো করেন ভক্তরা।
ঘাটে ঢোকার মুখে ফুটপাথের উপরেই রয়েছে ছোট্ট একটি পুলিশ আউটপোস্ট। ভাল করে না দেখলে বোঝার উপায় নেই তার অস্তিত্ব। ভুট্টা-ছোলাবাজার দোকানের সঙ্গে গাছের ডালে ঝোলানো রঙিন জ্যারিকেনের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে সরকারি ‘নীল-সাদা’ সেই পুলিশ গুমটি। এখানেই প্রায় ৯০ বছরের ছোলার দোকান চালাচ্ছেন ৬৭ বছরের রাজেন্দ্র। এক সময় বাবা-জ্যাঠার দোকান ছিল। শালপাতায় আদাকুচি-বিটনুন ছড়ানো ভেজা ছোলা বেশ উপাদেয়।
ঘাট সংলগ্ন একটি শৌচাগারের গা ঘেঁষে পর পর বাসস্থান-দোকানঘর। বংশ পরম্পরায় বারিক-মিশ্র-পাণ্ডাদের বসবাস এই চত্বরে। সেই সঙ্গে, সারা বাবুঘাট জুড়েই ওড়িশাবাসীদের রমরমা। কাজের সূত্রে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই এখানে আছেন কয়েক পুরুষ ধরে। কেউ পুজো করেন, কেউ মাসাজ করেন, কেউ বা নরসুন্দরের কাজ। ঘাট থেকে উঠে আসতেই বাঁ দিকে পড়ে একটি শিব মন্দির। নামে শিব মন্দির হলেও হিন্দুদের তেত্রিশ কোটির মধ্যে কে নেই এখানে— শিব, কালী (শ্মশানকালী, তারামা, ভবতারিণী), দুর্গা, গণেশ, গঙ্গা, হনুমান! ছোট্ট এই মন্দিরে অত দেবদেবী একসঙ্গে কী করে সামলান? প্রশ্নের উত্তরে স্মিত হেসে পুরোহিত শ্যামসুন্দর পতি জানালেন “সবই উনাদের কৃপা।” ওড়িশার ভদ্রক থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন শ্যামসুন্দর। তার পর বছর চল্লিশেক আগে বাবার সঙ্গে লেগে পড়লেন ভগবান সেবার কাজে। তিনি আরও জানালেন, “বাবুঘাট তীরবর্তী ভাগীরথী সংঘ নামের একটি ক্লাব এই মন্দির পুনর্নির্মাণে বাবাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল সে আমলে।” এখন সেই ক্লাবঘর ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি শিবলিঙ্গের ফাঁকে চোখে পড়ে সোনালি রঙের একটি আশ্চর্য বুদ্ধ মূর্তি। হিন্দুদের মন্দিরে সমান গুরুত্বের সঙ্গে সেই বুদ্ধ মূর্তির পুজো করেন শ্যামসুন্দরবাবু। এবং তার থেকেও আশ্চর্যের, সংস্কৃত মন্ত্রে হিন্দুদেবদেবীর পুজো করলেও বুদ্ধদেবের পুজো হয় খাঁটি পালি ভাষায়। কোথায় শিখলেন এই মন্ত্র? “বাবার কাছে।” অকপট উত্তর শ্যামসুন্দরবাবুর।
বাবুঘাটের এমনই মহিমা!
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.