১৯৩৬ থেকে ৪১ সাল পর্যন্ত টানা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে হঠাত্ই ‘নর্তকী’ ছবির রোম্যান্টিক চরিত্র ছেড়ে তিনি স্বামীজীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সে ছবি মুক্তি পাওয়ার পর ঘোষণা করলেন— এ বার থেকে তিনি চরিত্রাভিনেতা। এ কথা শুনে উত্তমকুমার বলেছিলেন এমন সিদ্ধান্ত শুধু ওই অভিনেতার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ভারতবর্ষের ‘বেস্ট স্ক্রিন অ্যাক্টর’ শিরোপা দিয়ে বলেছিলেন, অভিনয় জগতে তিনি একটা যুগ। চলচ্চিত্রে অভিনয়ে একটা থিয়েটারি ঢঙ ছিল। প্রথমে সেটি ভাঙেন প্রমথেশ বড়ুয়া। পরে যিনি অভিনয় শিল্পকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন অতীতের তাঁরায় সেই ‘ব্লু-ব্লাডেড অভিনেতা’ ছবি বিশ্বাস।
“ক্যান আই টক টু রিনা ব্রাউন?”
“লেকিন খোঁকি তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে না, হামাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না।”
“দাও, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বচ্ছর।”
“সুদখোরের টাকায় আমার একমাত্র ছেলের উপনয়ন হতে পারে না তারাপ্রসন্ন।”
“মনে রাখব? কেন মনে রাখব? ওর বিশেষত্বটা কী?”
সপ্তপদী, কাবুলিওয়ালা, সবার উপরে, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা— বাঙালির মনে এমন আরও ছবির সংলাপ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে শুধু ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের গুণে। গিরিশ-যুগের অভিনয়ের ধারাটি শিশির ভাদুড়ি বা অহীন্দ্র চৌধুরী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। একই মঞ্চে, একই ধারায় তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। কিন্তু সর্বত্রই বজায় ছিল তাঁর স্বকীয়তা। মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশিম’ নাটকে ছবি বিশ্বাস নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। এ তো গেল মঞ্চের কথা। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় প্রসঙ্গে স্বয়ং সত্যজিত্ রায় বলেছিলেন,
“ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর মতো চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না। এক দিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃষ্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি— একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।”
জলসাঘর-এ বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায়।
মঞ্চ থেকে ছবি, ছবি থেকে আবার মঞ্চ— দাপটে চালিয়ে গিয়েছেন ছবি বিশ্বাস নিজের অভিনয় জীবন। আর তাই ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নাটকটির উৎসর্গ পত্রে তাঁকে ‘নট সম্রাট’ নামে অভিহিত করেছিলেন মন্মথ রায়।
জন্ম ও পরিবার
রাজা শশাঙ্ক দেবের উত্তর পুরুষ শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯০২ সালের ১৩ জুলাই। কাত্যায়নীদেবী ও ভূপতিনাথের এই পুত্র সন্তানটিকে সুন্দর দেখতে ছিল বলে মা তাঁকে ‘ছবি’ বলে ডাকতেন। আর সেই ছবি নামটিই চলচ্চিত্র জগতে পরে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল।
১৬০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে দিল্লির সম্রাট আকবরের কাছ থেকে ‘বিশ্বাস’ উপাধি পেয়েছিলেন তিতুরাম দে। তাঁর উত্তরপুরুষ রামকান্তের পুত্র চণ্ডীচরণ দে বিশ্বাস ১৭০০ সালে বড় জাগুলিয়া থেকে ২৪ পরগনার বারাসতের ছোট জাগুলিয়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। বসতবাড়িটির নাম ‘কালীনিকেতন’।
এর পর
সামন্ততান্ত্রিক পরিচয়কে পিছনে ফেলে শিক্ষা ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নিয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারটি কলকাতায় চলে এল। জাগুলিয়ায় যাতায়াত রইল, তবে সে কেবল পুজো-পার্বণে।
কলকাতায় বিশ্বাস পরিবারের উত্তর প্রজন্ম কালীপ্রসন্ন বিশ্বাস থাকতেন বিডন স্ট্রিটে। অর্থে, প্রতিপত্তিতে, ঐতিহ্যে, অনুষ্ঠানে, দান-ধ্যানে, দয়া-দাক্ষিণ্যে বনেদি পরিবার হিসেবে বিডন স্ট্রিটের বিশ্বাস পরিবারের পরিচিতি ছিল। কালীপ্রসন্নের ছোট পুত্র ভূপতিনাথ ছিলেন প্রতিষ্ঠিত পাট ব্যবসায়ী। বিডন স্ট্রিটেরই প্রতাপচাঁদ মিত্রের কন্যা কাত্যায়নীদেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ভূপতি-কাত্যায়নী দম্পতির ছোট ছেলের নাম শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস। চিত্রজগতে তিনি নাম হিসেবে ‘ছবি’ ও ‘বিশ্বাস’ পদবি ব্যবহার করতেন।
সদানন্দের মেলা ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পাহাড়ী সান্যাল ও সুচিত্রা সেনের সঙ্গে।
‘ছবি’র
দশ মাস বয়সে মা কাত্যায়নীর মৃত্যু হয়। অসময়ে মা চলে যাওয়ায় মেজ জ্যাঠাইমার কাছে মানুষ হয়েছেন তিনি। নয়ানচাঁদ স্ট্রিটের একটি কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষাজীবন শুরু। পরে ক্ষুদিরাম বসু লেনের সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চমশ্রেণি পর্যন্ত পড়ে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। তবে বন্ধুদের সঙ্গলাভের আশায় প্রেসিডেন্সি ছেড়ে পরে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
বালক ছবিকে সকলে ভালবাসতেন। তাঁর বাবা ভূপতিনাথের পাটের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল ‘মরান অ্যান্ড কোম্পানি’। সেই সূত্রে প্রতিষ্ঠানের এক বিভাগীয় কর্তা জি এস আলেকজান্ডার প্রায়ই বিশ্বাস-বাড়ি আসতেন। নিঃসন্তান এই দম্পতি ছবিকে দত্তক নিতে চাইলেন। কিন্তু তাতে বাধ সেধেছিলেন মাতামহী। কাজেই আলেকজান্ডার পরিবারে আর যাওয়া হয়নি ‘ছবি’র।
৩৪ নম্বর বিডন স্ট্রিটের যে বাড়িতে ছবি বিশ্বাসের জন্ম হয় তার সামনের দিকের বেশির ভাগটাই জনৈক ভোলানাথ দত্তকে বিক্রি করা হয়। যেটি বর্তমানে ‘ভোলানাথ ধাম’ নামে পরিচিত।
গোপীমোহন লেনের বাসিন্দা শচীন্দ্রনাথ বসুর কন্যা নীহারবালাদেবী ওরফে সমীরাদেবীর সঙ্গে ছবি বিশ্বাসের বিয়ে হয়। তাঁদের দুই পুত্র— মলয় ও দিলীপ এবং একটিই কন্যা, মঞ্জুলা।
নাট্য জগত্
মদন মিত্র লেনে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের বাড়ির বৈঠকখানায় ছিল ‘বারবেলা বৈঠক ক্লাব’। এখানে হত সখের অভিনয়। সম্ভবত এই ক্লাবে যোগদানের মাধ্যমেই ছবি বিশ্বাসের অভিনয় জীবনের হাতেখড়ি। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউ হলে নানা সুধীজন আসতেন। সেখানেই ছবি বিশ্বাস পরিচিত হলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ির সঙ্গে। নিয়মিত না শিখলেও নিজেকে মনে করতেন শিশিরকুমারের শিষ্য। এই ভালবাসা থেকেই জড়িয়ে পড়লেন ললিতচন্দ্র বসু পরিচালিত শিকদারবাগান বান্ধব সমাজের সঙ্গে। বান্ধবসমাজের ‘নদীয়া বিনোদ’ কীর্তনাভিনয় প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৩-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেখানে ছবি বিশ্বাস নিমাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মোট ১৭৫ রজনী অভিনীত হয় ‘নদীয়া বিনোদ’। পরে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন রমেশচন্দ্র দত্তের সহযোগিতায় গঠিত কাঁকুড়গাছি নাট্য সমাজ ও হাওড়া নাট্য সমাজের সঙ্গে।
ছোট জাগুলিয়ার ‘বান্ধব সমিতি’ ছবি বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ির সামনে ম্যারাপ বেঁধে মঞ্চস্থ করল ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটক। সে নাটকে ছবি ‘চিন্তামণি’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। শৈশবে কিছু দিন সঙ্গীতচর্চা করেছিলেন তিনি। জমিরুদ্দীন খান সাহেবের কাছে নাড়াও বেঁধেছিলেন।
নানা রাজনৈতিক ঘটনায় কলকাতা উত্তাল হল। ব্যবসায় ধাক্কা খেল বিশ্বাস পরিবার। ভূপতিবাবু বিডন স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে উঠে এলেন মোহনবাগান লেনে। এই সময় নাট্য পরিচালক সতু সেন ছবিবাবুকে মিনার্ভা থিয়েটারে ডেকে পাঠালেন। কিছু দিনের মধ্যে নাট্য নিকেতন মঞ্চে জ্যোতি বাচস্পতি রচিত ‘সমাজ’ নাটকে পেশাদার শিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সালটা ছিল ১৯৩৮। নাট্যকার মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশেম’ ওই বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর মঞ্চস্থ হয়। তার পর ‘পথের দাবী’, ‘পরিণীতা’ ও ‘ভারতবর্ষ’ করে নাট্যমন্দির ছেড়ে নাট্য ভারতীতে চলে এলেন ছবিবাবু। মঞ্চায়িত হল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’। নুটুবিহারীর চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করলেন ছবি বিশ্বাস। এটি পরে চিত্রায়িতও হয়েছিল। ‘দেবদাস’, ‘ধাত্রীপান্না’, ‘কাশীনাথ’, ‘চাঁদ সদাগর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘গৈরিক পতাকা’, ‘বিজয়া’, ‘পরমারাধ্য শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ডাকবাংলো’-সহ ৩৯টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন মিনার্ভা, স্টার, শ্রীরঙ্গম ও সুন্দরম-এ। ‘স্বামী’ নাটকটি সুন্দরমকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল আর সে সঙ্গেই নাট্যশিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। এমন নাট্যশিক্ষক, যিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন নাটকে প্রম্পটারের কোনও স্থান নেই।
ছবি বিশ্বাস খুব ভাল আবৃত্তিকারও ছিলেন। রেডিওতে তিনি আবৃত্তির অনুষ্ঠান করতেন সে আমলে। বেতারে তাঁর নাটক সম্প্রচারিত হত— চাণক্য, চন্দ্রগুপ্ত।
চলচ্চিত্র ও ছবি
সে কালের বিখ্যাত পরিবেশক রিতেন অ্যান্ড কোম্পানির খগেন্দ্রলাল চট্টোপাধ্যায় ছবি বিশ্বাসকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অভিনেতা ও পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তীর সঙ্গে। ১৯৩৫ সালের শেষ দিকে নিরুপমাদেবীর লেখা ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ নিয়ে ছবি করার জন্য তিনি নায়কের মুখ খুঁজছিলেন। লম্বা, সুদর্শন ছবি বিশ্বাস চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখলেন ১৯৩৬-এ বিশু চরিত্রে।
‘নদের নিমাই’, ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’, ‘সখের চোর’, ‘শিউলিবাড়ি’, ‘রাজা সাজা’, ‘আম্রপালী’, ‘বিচারক’, ‘সপ্তপদী’, ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’-সহ প্রায় ২৫৬টি বাংলা চলচ্চিত্র ও তিনটি হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘জলসাঘর’ ও ‘দেবী’— সত্যজিৎ রায়ের এই তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস। ‘জলসাঘর’-এর জন্য ৫৫ বছরের প্রৌঢ়কে ঘোড়ায় চড়া রপ্ত করতে দিন সাতেক রাইডিং স্কুলে এক ঘণ্টা করে যেতে হয়েছিল। নিখুঁত অভিনেতা ছিলেন বলেই তা রপ্ত করতে পেরেছিলেন ছবিবাবু। ‘দেবী’ ছবির শ্যুটিঙে বেশি আঠা দিয়ে কিছুতেই গোঁফ লাগাতে চাননি তিনি। তাঁর স্কিন
‘কাবুলিওয়ালা’র ভূমিকায়
বড় ডেলিকেট যে! শোনা যায়, বেশি সাঁটাসাঁটি করলে ঠিক অভিনয়টি হবে না— এমন মন্তব্যও করতে ছাড়েননি স্পষ্টভাষী ছবিবাবু। আর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় মূর্তিমান কাঞ্চনজঙ্ঘার মতোই যে শেষ দিনটি পর্যন্ত অবিচল রইল, সে কথা বাঙালি মাত্রেই জানে!
শেষের দিকে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল দিনে এক হাজার টাকা। তবে অনেক প্রযোজক ও পরিচালকের অনুরোধে তিনি দিনে ২৫০ টাকাতে কাজ করেছেন, এমন উদাহরণও আছে। অনেক ছবিতে তাঁর অভিনয় নায়ক-নায়িকাকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। হাঁপানিকে অদ্ভুত ভাবে কাজে লাগিয়ে তিনি অসামান্য এক বাচনভঙ্গি তৈরি করেছিলেন। চলচ্চিত্র মাধ্যমে পোশাকে-চলনে-বলনে একটা পরিবর্তন এনেছিলেন ছবিবাবু। রহমতের আলখাল্লা থেকে বিশ্বম্ভরের বেনিয়ান, সাহেবি হ্যাট-কোট-স্যুট বা জরির জোব্বা— সবই যেন তাঁর শরীরে অন্য মাত্রা পেত। উত্তমকুমারের ধাক্কাপাড় ধুতির ডিজাইন নিজেই কারিগরকে দিয়ে করিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। উত্তমের গ্ল্যামারের সঙ্গে মানানসই সেই ধুতি পরে ‘উত্তমকুমারের ধুতি’ নামে পরিচিত হয়েছিল।
‘প্রতিকার’ ও ‘যার যেথা ঘর’ নামের দু’টি ছবি পরিচালনা করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া দু’টি ছবিতে নির্বাক অভিনয় করেন ছবিবাবু— বিজলীবরণ সেনের ‘মানিক’ ও সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’-এ। তিনটি ছবিতে গানে লিপ দিয়েছেন তিনি— ‘প্রতিকার’, ‘একদিন রাত্রে’ ও ‘দাদাঠাকুর’-এ।
জলসাঘর ছবিতে গঙ্গাপদ বসুর সঙ্গে ছবি বিশ্বাস।
মানবিক ছবি
ছোট জাগুলিয়ায় সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য ছবি বিশ্বাস প্রায় ১০ বিঘা জমি দান করেছিলেন। ১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জাগুলিয়া গ্রামের ঘরে ঘরে চাল-ডাল-জামা-কাপড় পৌঁছে গিয়েছিল তাঁরই বদান্যতায়।
১৯৫৯ সালে বসুশ্রীর একটি ঘরে ‘অভিনেতৃ সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্ঘের সভাপতি অহীন্দ্র চৌধুরী আর সহ-সভাপতি ছিলেন ছবি বিশ্বাস। তিনি মনে করতেন অভিনয় শিল্পে কলাকুশলীদের ভূমিকাই মুখ্য। নিজে অভিনেতা হয়েও মনে করতেন সিনেমার আয়ের অংশ কলাকুশলীদের মধ্যে আগে ভাগ করে দেওয়া উচিত, অভিনেতারা নেবেন সকলের শেষে। যে কোনও আন্দোলনে তিনি থাকতেন সকলের আগে। রঙ্গসভা নামে একটি নাটকের দলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ছবি বিশ্বাস।
অন্য ছবি
খুব ভাল টেবল টেনিস খেলতেন ছবি বিশ্বাস। ক্রিকেট খেলাতেও আগ্রহী ছিলেন। অন্য দিকে ছিলেন গানের খুব ভাল সমঝদার, বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের। গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সঙ্গে ছবি বিশ্বাস জমিরুদ্দীন খান সাহেবের কাছে তালিম নিয়েছিলেন।
তবে এ সবের পাশে অবসর সময় শুধুই বাগান নিয়ে পড়ে থাকতেন। সেখানকার ফুল কখনও ছিঁড়তেন না, কাটিং করতেন। তোড়া সাজিয়ে উপহার দিতেন অতিথিকে। তাঁর বাঁশদ্রোণীর বাড়ির বাগানে ৬০ রকমের জবা ও ৩০ রকমের গোলাপের গাছ ছিল। নানা ধরনের হাতের কাজেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। মাটির বা প্লাস্টিকের নানা পাত্রে রং দিয়ে আঁকতেন। বাটিকের কাজ করার পাশাপাশি শাড়িতে এমব্রয়ডারির কাজও করতেন। নিজের হাতে সাজাতেন ছেলেমেয়ের বিয়ের ও দোলের তত্ত্ব। অতিথিপরায়ণ ছবি বিশ্বাস জাগুলিয়ার বাড়িতে একটি গেস্ট হাউস করেছিলেন।
১৯৬১ সালে জাকার্তা যাওয়ার পথে দমদম বিমানবন্দরে ছবি বিশ্বাস ও ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ে।
শেষের সে দিন
‘প্রতিশ্রুতি’ ও ‘দিকশূল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য পেয়েছিলেন বিএফজেএ পুরস্কার। বার্লিন ও জাকার্তা চলচ্চিত্র উৎসবেও গিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অভিজ্ঞান ও রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই শিল্পী ১৯৬২ সালের ১১ জুন জাগুলিয়া যাওয়ার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের অনুরোধে ছবি বিশ্বাসের দেহ ময়নাতদন্ত হয়নি। তিনি বলেছিলেন, সবাই জানে এটা দুর্ঘটনা। আর শিল্পীর দেহে কাটাছেঁড়া চলে না। ছবিবাবুর মৃতদেহ কলকাতার সমস্ত নাট্যাঙ্গনগুলি ঘুরিয়ে টালিগঞ্জের বাড়ি হয়ে কেওড়াতলা শ্মশানে দাহ করা হয়েছিল। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মৃত্যুর পর মন্তব্য করেছিলেন, ছবিদা চলে গেলেন। এ বার থেকে ব্যারিস্টারের চরিত্রগুলো কেটে মোক্তারের চরিত্র করতে হবে।
স্মৃতিচারণ
অনুরাধা বসু (পৌত্রী, মলয় বিশ্বাসের কন্যা)
আমার দাদুভাই ছবি বিশ্বাস তাঁর নাতিনাতনিদের ভীষণ আদর করতেন। শ্যুটিং সেরে বাড়ি ফিরতেন রাত করে। আমি খুবই ছোট তখন। ঘুম থেকে তুলে প্রতি রাতে আদর করে তাঁর আনা খেলনাটি হাতে দিতেন। সবই অবশ্য মা-কাকিমার কাছে শোনা। আমাকে ডাকতেন ‘ঘটগিন্নি’ বলে। বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে গোলাপের বাগান ছিল। মাঝে ছিল তার প্রিয় ফুল রঙ্গনের গাছ। তারই ছায়ায় কাটাতেন ছুটির দিন। সিনেমায় তার অভিনয়ে যেমন দেখেছি, আসলে, সেটাই ছিল তাঁর স্বাভাবিক চলনবলন। সংসারেও ছিল একই ভূমিকা। ‘বধূ’ ছবিতে সাবিত্রীদেবীকে যে ভাবে বলেছিলেন, “পর বেটি কত গয়না পরবি, পর।” তেমন ভাবেই মা ও কাকিমাকে বলতেন। বৌমাদের ডাকতেন বড়মা ও ছোটমা বলে। তাঁর জন্য আমি গর্বিত। আবার দুঃখিতও। তাঁকে সে রকম ভাবে আর পেলাম না বলে।
কল্যাণ বিশ্বাস (পৌত্র, মলয় বিশ্বাসের পুত্র)
দাদুভাই যে মাপের অভিনেতা ছিলেন, তার যোগ্য সম্মান কিছুটা পেয়েছিলেন বটে, তবে না-পাওয়ার পাল্লাটা বেশ ভারী। শারীরিক অসুস্থতার জন্য দিঘা গিয়েছিলেন। কথা ছিল, ফিরে এলে তাঁকে ‘নটসম্রাট’ উপাধি ও জীবনের ৬০ বছর পূর্তি নিয়ে সংবর্ধনা দেবে শিল্পীসমাজ। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, অনুষ্ঠানের প্রদীপ ১৩ জুলাই জ্বলে ওঠার এক মাস আগেই নিভে গেল। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মরণোত্তর শিল্পী হিসেবেও সম্মান দেখানোর জায়গা অনেক থাকে, সেখানেও ফাঁক রয়ে গিয়েছে। শিল্পী সমাজের অনেকেই ছবি বিশ্বাস বলতে, আজও নমস্কার করেন। কিন্তু তাঁরাও কি ভুলে গেলেন? এক সময়ে আলোচনা হয়েছিল টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন ছবি বিশ্বাসের নামে হবে ও সামনে উত্তমকুমারের মূর্তি বসবে। মূর্তি বসলেও আমার দাদুভাইয়ের নামে আজও কোনও রাস্তা, স্টেশন বা মঞ্চের নামকরণ হল না। এ দুঃখ ভোলার নয়।
মাধবী মুখোপাধ্যায় (অভিনেত্রী)
আমি তখন খুব ছোট, বছর পাঁচ কি সাত। মিনার্ভা থিয়েটারে নাটক হবে ‘ধাত্রীপান্না’। বনবীরের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করলেন ছবি বিশ্বাস। বিপরীতে ছিলেন সরযূবালা। আমি ছেলে কনকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তখন কিছুই জানতাম না। প্রথম শিক্ষা ওঁর কাছেই। আমার নামটি ওঁর খুব বড় লাগত। তাই ছোট করে ‘মাধু’ বলে ডাকতেন। পরে সকলেই ওই নামে ডাকতেন।
ওঁর বহু নাটক দেখেছি। ‘বিজয়া’ নাটকে রোম্যান্টিক নায়কের ভূমিকায় তাঁর সে কি অভিনয়। নায়িকা সরযূবালা। অসাধারণ জুটি ছিল। ‘ঝিন্দের বন্দী’তে ডবল রোল। সেখানে আমার কোনও অভিনয় ছিল না। তা বলে বসেও থাকতাম না। মাঝেমধ্যে নাচতাম। মঞ্চে তাঁর মতো অভিনয় আর দেখিনি। আগে অবশ্য ছিলেন শিশির ভাদুড়ি, নরেশ মিত্র। ওঁর সঙ্গে ‘প্রার্থনা’য় অভিনয় করেছি। ‘প্রার্থনা’ ছবিতে সুপ্রিয়াদেবীর ছোটবেলার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলাম আমি। আমার বাবা ও মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস ও মলিনাদেবী। এক এক সময় দেখেছি শুধু কথা না বলেও সাঙ্কেতিক অভিনয়েও কি অনন্য ছিলেন। সেখান থেকে মূল্যায়ন করতে গেলে ছবি বিশ্বাসের মতো সাবলীল অভিনয় আর দেখেছি বলে মনে হয় না।
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় (অভিনেত্রী)
কী বলব আর কী বলব না। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন। সামনে এসে দাঁড়ালে আভিজাত্য যেন ঝরে পড়ত। ওঁর কাছেই অভিনয় শেখা। আমার সৌভাগ্য যে ওঁর সঙ্গে আমি প্রায় আটত্রিশটি ছবিতে অভিনয় করেছি। ‘প্রফুল্ল’ ও ‘শ্রেয়সী’তে কিছু দিন ওঁর সঙ্গে অভিনয় করেছি। তাঁর মতো হাঁটা-চলা-কথা বলার এমন বুদ্ধিদীপ্ত অভিব্যক্তি আর তো পেলাম না।
বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা)
ছবি বিশ্বাস শুধু বাংলার নয় সারা ভারতবর্ষের মধ্যে অভিনয়ের একটি ইনস্টিটিউশন। আমার সৌভাগ্য ‘দাদাঠাকুর’, ‘মায়ামৃগ’, ‘বধূ’, ‘অতল জলের আহ্বান’-সহ বেশ কয়েকটি ছবিতে আমি ওঁর সঙ্গে কাজ করেছি। ফলে সেই অভিজ্ঞতা আমার পরবর্তী সময়ে খুব কাজে এসেছে। প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ছে। ‘মায়ামৃগ’ ছবির নায়ক আমি। এসেছি বাংলায় অভিনয় করতে। এখানে আমরা বাবা-ছেলের চরিত্রে ছিলাম। ফ্লোরে এসে ওঁকে প্রণাম করতেই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? তুমি এসেছ, তোমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। শুধু মুখে বলেই থেমে যাননি একেবারে হাতে ধরে যাকে বলে শিখিয়ে দেওয়া, সেই ভাবে শিখিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। হলিউডের তারকার সঙ্গে তুলনীয়। মঞ্চের অভিনয়ের জন্য কী ভাবে কথা বলতে হবে যাতে শেষ সারির দর্শকটিও তা শুনতে পান, শিখিয়েছিলেন। আবার ফিল্মের ক্ষেত্রে বলেছিলেন, চোখ কান খাড়া রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে ক্যামেরা তোমাকে ফলো করছে। দু’টো ক্ষেত্রেই সমান দক্ষ ছিলেন তিনি। ফ্লোরে সবাই খুব ভয় পেতেন। উত্তমকুমার বলতেন ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ডায়ালগ বলতে গেলেই সব ভুলে যাই। যেন বাজপাখির চোখ। আমাদের সকলেরই অভিভাবক ছিলেন তিনি।
বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা)
আমার দুর্ভাগ্য, ওঁর সঙ্গে আমার অভিনয় করা হয়ে ওঠেনি। আসলে উনি যখন অভিনয় করছেন তখন আমি এই জগতে আসিনি। আমি তখন উত্তর কলকাতায় থাকি। এক দিন দেশবন্ধু পার্কে ফুটবল খেলছি। হঠাৎ শুনলাম গাড়ি দুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাস মারা গিয়েছেন। আর জি করে মৃতদেহ এনেছে। দৌড়ে গিয়েছি দেখার জন্য। সেই সৌম্য চেহারা নিথর। মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘সবার উপরে’র সংলাপ, ‘কাবুলিওয়ালা’য় মিনি-কাবুলিওয়ালার কথাবার্তা, ‘দাদাঠাকুর’ সিনেমা। সেই সময় লুকিয়েচুরিয়ে সিনেমা দেখাই ছিল বড় কষ্টের। তবুও ‘জলসাঘর’-সহ বেশ কয়েকটি ছবি ওই ভাবে দেখেছি। মঞ্চ অভিনয় আর দেখা হয়ে ওঠেনি। কারণ থিয়েটার দেখতে যাওয়া ছিল বড় কঠিন ব্যাপার। ‘ডাকবাংলো’ নামের একটি নাটক চলছিল তখন, কিন্তু দেখা আর হয়ে ওঠেনি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা)
অভিনয়ের সময় তাঁর মতো ওইরকম রাজকীয় উপস্থিতি আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি। স্টুডিও বা মঞ্চের ক্ষেত্রে তাঁর সেই উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতা, সুপুরুষ, গৌরবর্ণ, দাম্ভিক, হাবেভাবে সকলের থেকে আলাদা— এই সব তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিল। অভিনয় শেখার জন্য যখন তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছি, দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বাইরের বহু লোকের ধারণা ছিল তিনি দাম্ভিক। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। হয়তো উনি কোনও ব্যাপারে সাহায্য করেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলে তিনি খুব আন্তরিক ভাবে জানাতেন এখন শেখার বয়স, এখন শেখার সময়, শিখে নাও। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দেবী’র মতো ছবি করেছি ওঁর সঙ্গে। ‘দেবী’তে আমাদের অভিনয় ছিল পিতা-পুত্রের। যে দিনই আমাদের কাজ থাকত, আমি মনে করতাম আজকের দিনটা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্কট কালে সকলে মিলে রাস্তায় নেমেছেন, তার পুরোভাগে ছিলেন ছবি বিশ্বাস। এক বার ইন্দ্রপুরী স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাকে ব্যর্থ করার জন্য সেই আন্দোলনে সবাইকে নেতৃত্ব দিলেন ছবিদা। সবাই জানতেন তিনি সামনে থাকলে তা সফল হবেই। সেই হিসেবে মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে, মনে রাখবে।
তথ্য ও সাক্ষাৎকার: পাপিয়া মিত্র।
ঋণ: নও শুধু ছবি/কল্যাণী মণ্ডল
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.