বর্ষার মেঘমেদুর আকাশ, সজল প্রকৃতির বুকে কামিনী, চাঁপা, মালতীলতাদের মিষ্টি সুবাস ও বর্ষণস্নাত পাখপাখালিদের কলকাকলিতে ভরা যে ক’টি দিন মনে দাগ কেটে যায়, তার মধ্যে অন্যতম রথের দিনটি। বৃষ্টিক্লান্ত প্রকৃতি এ দিন সেজে ওঠে আনন্দানুষ্ঠানের আবেশে— নিজস্ব ঢঙে, আপন ছন্দে। রথযাত্রা শুধু বঙ্গ বা ওড়িশাবাসীর নয়, এ উত্সব এখন সব্বার, গোটা বিশ্বের। পুরীতে জগন্নাথের রথ, মায়াপুরে ইসকনের রথ, শ্রীরামপুরে মাহেশের রথ, হুগলিতে রাজবলহাটের রথ, বেলঘরিয়ায় রথতলার রথ, আড়িয়াদহের রথ, আদ্যাপীঠের রথ— এ সব বিখ্যাত রথ তো আছেই, তা বাদেও রথ এখন সর্বত্র। পাড়ায় পাড়ায়, মন্দিরে, রাস্তায়, এমনকী অলিতে-গলিতে। বাচ্চারা কত দিন ধরে পরিকল্পনা করে নিজের ছোট্ট কাঠের রথটিকে সাজিয়ে তোলে এই সময়ে। রথ সাজানোর যেন এক প্রতিযোগিতা লেগে যায় তাদের!
রথের দিন বৃষ্টি যেন হতেই হবে। আর হবে নাই বা কেন! বর্ষাকালে বৃষ্টি হওয়াই তো স্বাভাবিক! তবুও সবাই জগন্নাথের কাছে প্রার্থনা করে, এ দিন বৃষ্টি যেন না হয়। রথের সাত দিন আগে থেকেই শুরু হয় উত্সব, জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা দিয়ে।
মূল অনুষ্ঠান হয় দু’দিন— সোজারথ এবং উল্টোরথ।
তবে রথের অন্য একটি বড় আকর্ষণ কিন্তু রথের মেলা। রথটানাকে কেন্দ্র করে কাছাকাছির কোনও মাঠে বা পথের উপরেই যে মেলা বসে তার আনন্দ রথটানা থেকে কিছু কম নয়। কোথাও সোজারথ আর উল্টোরথ এই দু’দিন মেলা বসে, কোথাও আবার টানা সাতদিন চলে মেলা। মেলায় কত্ত কিছু— মাটির পুতুল, খেলনা, হরেকমাল, ঘুগনি, আলুকাবলি, ফুচকা, গরম জিলিপি, চিনি বা গুড়ের গাঁটিয়া, নিমকি, চানাচুর, আইসক্রিম, প্রতিদিনের গৃহস্থালীর জিনিসপত্র, বেলুন, বাঁশি, সস্তার মনোহারী বস্তু, ফুল ও ফলের চারাগাছ— এ সব অতি পরিচিত ছবি। আর আছে নাগরদোলা, তার আকর্ষণও কিন্তু কম নয়। রথের মেলায় পাঁপড় ভাজা বা অন্য কোনও তেলেভাজা না খেলে দিনটাই যে বৃথা! তেলের গুণমান নিয়ে অবশ্য মাথা ঘামানো চলবে না।
মনে পড়ে, শহর ঘেঁষা মফস্সলে আমাদের ছোটবেলায় রথের আগের দিন বেলঘরিয়ার রথতলা থেকে বাবা একটা কাঠের ছোট রথ এনে দিতেন। সেটা নিয়ে আমার আনন্দের শেষ থাকত না। আর যদি সেটা দোতলা রথ হয় তা হলে তো কথাই নেই! সকালবেলা মা কাগজ কেটে ফুল তৈরি করে সেটাকে সাজিয়ে দিতেন। রথ সাজানো হয়ে গেলে উপরের খোপে বসাতাম জগন্নাথ, বলরাম আর সুভদ্রাকে এবং ঠিক তার নীচে ছোট্ট থালায় থাকত বাতাসা, গুজিয়া কিংবা নকুলদানা— ঠাকুরের প্রসাদ।
রথের মেলা দেখার জন্য দাদু, ঠাকমা, বাবা, মা, পিসি সবাই টাকা দিতেন— কেউ দু’টাকা, কেউ পাঁচ টাকা! সব মিলিয়ে দশ-বারো টাকা হত। সেই নিয়ে রথের মেলা দেখতে যেতাম। বন্ধুদের সঙ্গে গেলে ছিল আলুকাবলি, আইসক্রিম খাওয়ার স্বাধীনতা। বড়রা সঙ্গে থাকলে অবশ্য তা হত না। এক বার আড়িয়াদহের রথ দেখতে আমাদের বাড়ি এসেছিল আমার এক মাসতুতো দাদা। তার সঙ্গে সদলবলে বন্ধুদের নিয়ে মেলা দেখতে গিয়েছিলাম। দাদা আমাদের সবাইকে গরম গরম জিলিপি খাইয়েছিল। পয়সা জমানোর জন্য বাড়ি ফেরার সময় কিনে দিয়েছিল একটা বড় মাটির আম। সে আমটা পরের বছর রথ পর্যন্ত ছিল। যখন হাইকোর্ট পাড়ায় চাকরি করতাম, দু’ এক জন সহকর্মী রথের দিনে অফিসের সকলকে পাঁপড় ভাজা, জিলিপি বা ল্যাংচা খাওয়াতেন। ছুটি না পেলেও সবাই মিলে খাবার খেয়ে ‘সেলিব্রেট’ করতাম রথের দিনটাকে।
যখন আরও ছোট ছিলাম, মনে পড়ে ঠাকমা আমায় কোলে করে মেলায় নিয়ে যেতেন। কিনে দিতেন মাটির পুতুল, লোহার তৈরি খেলনাবাটি।
বার কয়েক আবার বাবার সঙ্গেও বেলঘরিয়ায় রথের মেলায় গেছি। ওখান থেকে কেনা মাটির কৃষ্ণঠাকুর আজও আছে আমাদের বাড়িতে।
কখনও রথের দিনে বাসে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে যানজটে আটকে গেছি, বিরক্ত হয়েছি। আবার যখন বাসে বসেই দেখেছি সিঁথির মোড়ে সাজানো রথের দড়ি টানা হচ্ছে, টবিন রোডের মেলায় শিশুরা বড়দের হাত ধরে বায়না করছে কিছু কিনে দেওয়ার জন্য, বেলঘরিয়ার মেলা থেকে মানুষ ফুল-ফলের চারা গাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে— তখন মনটা কেমন ভাল হয়ে গিয়েছে, শরীরের ক্লান্তি ভুলে আমিও মেতে উঠেছি উত্সবের আনন্দে। মনে পড়ে— ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি, হাসেন অন্তর্জামী!’
বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে। কলেজে আসার পর অনেক বারই প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত। হবি বলতে ছবি আঁকা এবং লেখালেখি।
—নিজস্ব চিত্র
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.