|
|
|
|
|
|
একশোতেও সম্রাটের সাম্রাজ্য অটুট |
আধুনিক জাদুর জনক প্রতুলচন্দ্র সরকার, যাঁর আবার ‘জাদু’ শব্দটাতেই ছিল আপত্তি। তিনি মনে করতেন এই শব্দটি বড় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ব্যবহৃত হয়। সেই ভাবনা থেকেই তাঁর মঞ্চ উপস্থাপনার নাম হয় ‘ইন্দ্রজাল’। সঙ্গে যোগ হয় বিনোদন। ছোটবেলায় দেখা পথচলতি মাদারির খেলা যে কী ভাবে মঞ্চের ম্যাজিক হল, এবং অবিভক্ত বাংলার প্রতুলই বা কী করে হয়ে গেলেন বিশ্বখ্যাত পি সি সরকার— এ মাসের সংখ্যায় বর্ণিত হল সেই গল্প। আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মশতবর্ষে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ। |
|
ব্রহ্মা মুরারিত্রিপুরান্তোকারী ভানুঃ শশী ভূমিসুতো বু্ধশ্চ
গুরুশ্চ
শুক্রঃ শনিরাহুকেতু কুর্দন্তু সর্বে মম সুপ্রভাতম্
বাবার সকাল হত এই স্তোত্র পাঠ করে, তার পর নিজের দু’হাত দেখে দিন শুরু করতেন— বললেন ইলাদেবী, জাদু-সম্রাট পি সি সরকারের জ্যেষ্ঠ কন্যা। সংস্কৃত ভাষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তিনি বলতেন, ভারতের ঐতিহ্য ও দর্শন এই ভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে, তাই সংস্কৃত ভাষা জানার প্রয়োজন খুবই। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ হেন এক জন মানুষ সংস্কৃত পণ্ডিত বা শিক্ষক না হয়ে ‘জাদু-সম্রাট’ হলেন কী করে? খুব সহজ ভাবে বলা যায়— তাঁর জন্মই হয়েছিল এই খেতাব অর্জন করার জন্য।
সমাজ তখন ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন, শ্রেণিবৈষম্যে বিভক্ত। তুকতাক, ঝাড়ফুঁক করে অসাধ্য সাধন বা মন্ত্রবলে স্বপ্নপুরণ হওয়ার পেছনে আসল রহস্য ধরে ফেলে জনৈক আত্মারাম। সহজ-সরল-নিরক্ষর মানুষকে তা বোঝাতে গেলে তাঁর প্রাণ নাশ হয় ‘মাদারি’ গোষ্ঠীর হাতে। কারণ এদের জীবনধারনের অন্যতম উপায় ছিল জাদু-বিদ্যা। উপস্থিত বুদ্ধি ও হাতের কারসাজি দিয়ে তিলকে তাল করে সাধারণ মানুষকে এক কল্পনা-জগতের ছায়া দেখাত এরা।
ছোট্ট প্রতুলের কিন্তু সেই মাদারিদের খেলা দেখতে বেশ লাগত। আগ্রহ তার এতটাই ছিল যে এক দিন তাদেরই একটা খেলা দেখিয়ে দিল সে। প্রথমে বিরক্ত হলেও, পরে তারা প্রতুলকে আরও অনেক খেলা শেখায়। এবং তখন থেকেই শুরু হয় তার জাদু-পথে পথ চলা।
|
জন্ম ও পরিবার পরিচিতি, শিক্ষা |
অধুনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার আশেকপুর গ্রাম। সেখানে ভগবানচন্দ্র সরকার ও কুসুমকামিনীদেবীর প্রথম সন্তান প্রতুলের জন্ম হয় ১৯১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। চরম দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠা প্রতুল ছিল অত্যন্ত মেধাবী। বাবার ইচ্ছা ছিল ‘বুইড়্যা’ (ছেলের আদরের ডাকনাম বুড়ো) বড় হয়ে শিক্ষকতা করবে। কিন্তু ভাগ্যের লেখনী ছিল একেবারেই আলাদা। ভাই অতুলচন্দ্র ছিলেন ষোলো বছরের ছোট। দাদার প্রথম দিকের পেশাদার জীবনের সঙ্গী ছিলেন তিনি। পরে মতান্তর হওয়ায় একাই এই শিল্প মঞ্চস্থ করতেন, আলাদা ভাবে।
স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে।
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
|
বাড়ির কাছেই শিবনাথ
হাই স্কুলে পড়াশোনার শুরু প্রতুলের। যাতায়াতের পথে একটা ঝিলের দু’পাশে ছিল মাদারিদের বাস। তাদের কাছেই হয় প্রতুলের জাদুবিদ্যার হাতেখড়ি। পারিবারিক সূত্রে জাদু ছিল তার রক্তেই। সেই আত্মারাম থেকে শুরু হয়ে, ষষ্ঠ প্রজন্মের দ্বারকানাথ সরকার, অল্প-বিস্তর সকলেই ‘ম্যাজিক’ জানতেন। সপ্তম প্রজন্মের ভগবানচন্দ্রও বাবার কাছে এই বিদ্যা চর্চা করেন। কিন্তু তখনকার সমাজ জাদুকরদের খুব একটা সুনজরে দেখত না। তাই সরকার পরিবারের কেউই প্রকাশ্যে কখনও জাদু দেখাননি। তবে প্রতুল দেখাত— স্কুলের অনুষ্ঠানে, ক্লাসের বন্ধুদের।
১৯৩৩ সালে অঙ্ক নিয়ে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে ‘মায়ার’ জগতে প্রবেশ করেন প্রতুল।
বাসন্তীদেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে পাঁচ পুত্র-কন্যাকে নিয়ে পরবর্তী কালে বসবাস শুরু করেন কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে।
|
প্রতুল থেকে পি সি সরকার |
স্কুলজীবনে বন্ধুদের সামনে জাদু দেখানো শুরু। অনেক সময় মাদারিদের সঙ্গে পথেও সেই কলার প্রদর্শনী করে হাত পাকায় প্রতুল। এর পর
আইএ পড়ার
সময় তাঁর আলাপ হয় জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীর সঙ্গে। হাতেকলমে জাদুবিদ্যা শেখা ও চর্চার আরও সুযোগ হয় তাঁর। সঙ্গে দেশি-বিদেশি বই থেকেও চলতে থাকে জ্ঞান আহরণ।
|
জাপান জয়ের পথে * |
১৯৩৪ সালে প্রথম বার বিদেশ সফর করেন। নিজের বাড়ি বন্ধক রেখে, সেই টাকাতেই বিশাল বাহিনী নিয়ে পৌঁছন হংকং। উদ্দেশ্য, বিশ্বখ্যাত জাদুকর লাইয়েল-এর সঙ্গে সম্মুখ সমর। তখন স্যুট-প্যান্ট পরেই ম্যাজিক দেখাতেন জাদুকররা। প্রতুলও তাই পরলেন। তিনি বলতেন, হিন্দু ধর্মে দেবরাজ ইন্দ্র হলেন মায়াবিদ্যার প্রতীক। সেই হিসেবে নিজের ‘শো’-এর নাম দিলেন ‘ইন্দ্রজাল’। একই দিনে দু’টি আলাদা প্রেক্ষাগৃহে দুই জাদুকরের খেলা শুরু হয়। কয়েক দিন যেতে না যেতেই, লাইয়েল বুঝলেন যে তাঁর হার নিশ্চিত। দিন এগোতে থাকে আর খালি হতে থাকে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকাসন। শেষে এক দিন বন্ধ হয়ে যায় তাঁর শো। এর পর আর থামেনি প্রতুলের জয়রথ। ফ্রান্স, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, মিশর, কেনিয়া, ইরাক, আরও কত দেশ ঘুরেছে সেই রথ!
প্রতুল তখন বিশ্ববাসীর কাছে হয়ে উঠেছেন ‘জাদু-সম্রাট পি সি সরকার’।
যোধপুরের মহারাজা হনবন্ত সিংহ ছিলেন সখের জাদুকর। এক বার তিনি ঠিক করলেন তার নিকট আত্মীয়দের নিজেই জাদু দেখাবেন। প্রস্তুতি শেষে সেই বিশেষ দিনটি এলে রাজার মনে হয় তাঁর পরিবেশনে কোথায় যেন খামতি থেকে গেছে। ডাক পড়ে বন্ধু-জাদুকরের। কিন্তু তিনি রাজপরিবারের সদস্য না হওয়ায় সমস্যা দেখা দিল। তখন মহারাজা তাঁকে রাজপোশাক ও পাগড়ি পরিয়ে পরিচয় করালেন ‘জাদু জগতের মহারাজা’ হিসেবে। পরবর্তী কালে, সেই ঝলমলে রাজার পোশাকেই চির পরিচিত হয়ে ওঠেন জাদু-সম্রাট। “আক্ষরিক অর্থে তিনিই হলেন এই পোশাকের ‘ট্রেন্ড-সেটার।”’ বললেন নবম প্রজন্মের পি সি সরকার (মাস্টার), পৌরুষ।
|
জাদুর দুনিয়া |
তখন তিরিশের দশক। বিদেশে জাদুর মঞ্চে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ই। কিন্তু ভারতে তা ছিল কল্পানাতীত। আর কলকাতার বাঙালি পরিবারের মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখাতেই ছিল নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু জাদুর মঞ্চে ঝকঝকে তরুণ-তরুণীর প্রয়োজন ছিল খুবই। তখন এই শহরে বসবাসকারী বেশ কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণীকে তাঁর দলে নেন পি সি সরকার। পরবর্তী কালে, নিজের দুই মেয়ে ও শ্যালিকাও অংশ নিয়েছিলেন তাঁর জাদুর খেলায়। সোর্ড-খেলা, এক্স-রে আইজ, ব্ল্যাক আর্ট, ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া, টেলিপ্যাথির খেলা, টেম্পল অব বেনারস, করাত দিয়ে মানুষ কাটা— তাঁর প্রদর্শিত কয়েকটি জনপ্রিয় ম্যাজিক। |
তলোয়ারের খেলা— পোস্টার * |
করাত দিয়ে মানুষ কাটা *
|
|
ছোটবেলার সেই রাস্তার সামান্য
জাদুকে মঞ্চের ম্যাজিক করার পথ খুব সহজ ছিল না। কিন্তু তাঁর উপস্থাপনার কারণে সেই প্রদর্শনী হয়ে উঠেছিল বিশ্ব বন্দিত। জমকালো রাজকীয় পোশাক, আবহ সঙ্গীত, মঞ্চসজ্জা, সর্বপরি যে দেশে ‘শো’ করতেন, সেখানকার সংস্কৃতিও মঞ্চে তুলে ধরতেন। মিশরে গিয়ে মঞ্চসজ্জায় প্রতিফলিত হয়েছিল পিরামিড, আবার কোথাও নাগাদের মতো তির-ধনুক নিয়ে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াত দলের অভিনেতারা।
স্মৃতি হাতড়ে কথাগুলো বলে গেলেন ইলাদেবী। শোনালেন সোর্ড খেলার গল্প— তাঁকে সম্মোহন করে প্রথমে তিনটি তলোয়ারের উপর শুইয়ে দিতেন জাদু-সম্রাট। তার পর একে একে দু’টি সরিয়ে নিতেন। ইলাদেবী শায়িত থাকতেন মাত্র একটি তলোয়ারের উপর। “ম্যাজিক দেখানোর সময় বাবা যখন কথা বলতেন, দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন।”—সগর্বে বললেন জাদু-সম্রাটের কন্যা।
ব্ল্যাক আর্ট— মঞ্চের আলো আঁধারিতে শূন্যে ভেসে থাকা একটি মেয়ে ‘গিলি গিলি গিলি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন ‘ভ্যানিস’ হয়ে যেত! দর্শকরা যত ক্ষণে ভাবতে আরম্ভ করত মেয়েটি কোথায়, আমি তত ক্ষণে ব্যাকস্টেজে— বললেন পি সি সরকারের ছোট মেয়ে গীতা চৌধুরী, বাবার আদরের টম। “ছোটবেলায় আমাদের স্কুলে অন্য কেউ ম্যাজিক দেখাতে আসতেন না। কারণ আমি, জাদু-সম্রাটের মেয়ে পড়তাম সেখানে।” হাসতে হাসতে বললেন গীতাদেবী। |
ওয়াটার অব ইন্ডিয়া। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ। |
‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’-র কথা অজানা নয় ‘জেনারেশন-ওয়াই’-এরও। কোনও শো-এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ছোট কমণ্ডলু থেকে অনবরত ভরে চলত গ্লাসের পর গ্লাস। “প্যারিসের ব্যস্ত রাস্তায় চোখ বেঁধে সাইকেল চালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বাবা।” বললেন প্রদীপ সরকার (পি সি সরকার-জুনিয়র)। তাও প্রায় ৬৩ বছর আগে। চোখ বেঁধে তাক লাগিয়েছিলেন তত্কালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক-কেও। তিনি মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন একটি সাদা কাগজে কিছু লিখতে। তার পর মন্ত্রী পারিষদদের বলেন ওই পাতার নীচে স্বাক্ষর করতে। সব হয়ে যাওয়ার পর পাতাটি হাতে নিয়ে হক সাহেব দেখেন সেটা তাঁর পারিষদদের ইস্তফাপত্র, এবং মুখ্যমন্ত্রী পদে নাম স্বয়ং পি সি সরকারের।
শুধু মাত্র ম্যাজিক দেখিয়েই যে তিনি তৃপ্ত ছিলেন, তা নয়। অসংখ্য বই লিখেছেন জাদুবিদ্যার উপর। কলেজে পড়াকালীন প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘হিপনোটিজম’। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি— তিনটি ভাষাতেই প্রকাশ পায় তাঁর বই।
|
‘ঘরের মানুষ’ |
অমিতাভ-অন্নপূর্ণার
সঙ্গে ম্যাজিক দাদু * |
“তখন বুঝিনি মামাবাড়ির সামনের রাস্তায় এত মানুষ কেন জড় হয়েছিল! বাড়ির উপর থেকে দেখা অসংখ্য কালো মাথা— ওইটুকুই স্মৃতিতে আছে।” আক্ষেপ করলেন
ইলাদেবীর কন্যা, অন্নপূর্ণা। তখন তিনি বছর তিনেকের। আর দাদা অমিতাভর বয়স সাতের কাছাকাছি। “আমাদের প্রজন্মের আমরা দু’জনই শুধু পেয়েছিলাম ‘ম্যাজিক দাদু’কে। ছবিও আছে।” বললেন অন্নপূর্ণা। বাকি নাতি-নাতনিদের কাছেও তিনি ‘ম্যাজিক দাদু’।
“সময়-সুযোগ পেলেই বাবা আমাদের ইংরেজি সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন গ্লোব বা নিউ এম্পায়ারে।” বললেন কনিষ্ঠ পুত্র প্রভাস সরকার (পি সি সরকার-ইয়ং)।
“বাংলা সিনেমাও দেখতে গিয়েছি কয়েক বার, কিন্তু হিন্দি সিনেমা; নৈব নৈব চ।”
কর্মসূত্রে বছরের বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকতেন জাদু-সম্রাট। কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনা ও অন্যান্য প্রয়োজনের কোনও ত্রুটি
রাখেননি কখনও। স্ত্রী বাসন্তিদেবী কলকাতায় একা থাকতেন বলে ছেলেদের ভর্তি করিয়েছিলেন বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে, জানালেন প্রভাসবাবু।
বাবা ছিলেন ভীষণ পরিশ্রমী। কখনও বসে থাকতেন না। দুপুরে কখনও ওঁকে ঘুমোতে দেখিনি— পি সি সরকারের সাফল্যের আরও এক দিকে
আলোকপাত করলেন গীতাদেবী।
তিনি ছিলেন
বড় মনের মানুষ। এক বার একটি মেয়ের বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন খুব সুন্দর একটি সোনার হার। আমাকে অবাক হতে দেখে বলেছিলেন, “ওর তো বাবা নেই!”— বললেন ইলাদেবী।
আদতে গুরুগম্ভীর মানুষটির রসবোধ ছিল ষোলো আনা। জাপানে শো করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট হোটেলেই বরাবর উঠতেন পি সি সরকার। এক বার হোটেলের জনৈক কর্মচারী ‘ইউ আর বিউটিফুল’ বাংলায় শিখিয়ে দিতে বলেন। জাদু-সম্রাট বুঝতে পারেন যে তাঁর দলের বাঙালি কোনও তরুণীর জন্যই এই ভাষা শেখার ধুম। তিনি খুব সরল ভাবে তাঁকে শিখিয়ে দিলেন, ‘তুমি খুব বিশ্রী’। পরে অবশ্য কী হয়েছিল তা আর জানা নেই!
তিনি ছিলেন পশুপ্রেমিক— ছোটবেলার দিনগুলি মনে করে বললেন ইলাদেবী। বালিগঞ্জে তাঁদের প্রথম বসতবাড়ি, ঠিকানাটা ১২/৩ এ জামির লেন। তার ছাদেই থাকত পায়রার দল, বিশাল খাঁচার ভেতরে। আর ছিল খরগোশ, হাঁস। বাড়ির পাশে একটা সরু গলিতে চৌবাচ্চা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই হাঁসগুলির জন্য। “আমরা তার নাম দিয়েছিলাম হাঁস-গলি।” শিশু সুলভ ভঙ্গিমায় বললেন তিনি। টাইগার নামে জার্মান শেফার্ডটিও ছিল জাদু সম্রাটের একান্ত অনুগত।
|
সম্মান |
আন্তর্জাতিক পুরস্কার
• ফিনিক্স অ্যাওয়ার্ড (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দু’বার, মঞ্চে ম্যাজিক পরিবেশনার জন্য)
• জার্মান গোল্ডবার • গোল্ডেন লরেল গারল্যান্ড • ডাচ ট্রিকস প্রাইজ
জাতীয় সম্মান
• ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মশ্রী
• ২০১০ সালে ভারতীয়
ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশ করা হয় ৫ টাকা মূল্যের ডাক টিকিট
• কলকাতায় অবস্থিত ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব ম্যাজিসিয়ানস অব ইউএসএ’-র শাখার নামকরণ করা হয় জাদু-সম্রাটের নামে
• তাঁর ম্যাজিকের উপর তৈরি করা হয় টেকনিকালার-এর এক চলচ্চিত্র
• ১৯৬৩ সালে
পালিত হয় তাঁর জন্মের সুবর্ণ জযন্তী বর্ষ। অল ইন্ডিয়া ম্যাজিক কনফারেন্স-এর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয় একটি ছবির অ্যালবাম। |
|
|
বিদায়বেলা |
পি সি সরকার বিদেশে সব থেকে বেশি শো করেন জাপানে— ৩৭ বার। এবং তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায় রচিত হয় ওই দেশেই। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে আরও এক বার জাপান সফরে গিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর জানুয়ারির প্রথম দিকে এক দিন তিনি মঞ্চে ‘ইন্দ্রজাল’ বিস্তারে ব্যস্ত। মুগ্ধ দর্শকদের সামনেই হঠাত্ অসুস্থ হয়ে মঞ্চ থেকে ‘অদৃশ্য’ হন, চিরকালের জন্য। তারিখ ছিল ১৯৭১ সালের ৬ জানুয়ারি। এর তিন দিন পর সে দেশ আবার জাদুর খেলা দেখে। বাবার শূন্যস্থান পূরণ করে টানা পাঁচ মাস ইন্দ্রজালের সফর অটুট রাখেন জাদু-সম্রাটের যোগ্য উত্তরসূরি পি সি সরকার-জুনিয়র।
|
স্মৃতিচারণ |
ইলা পালিত (জ্যেষ্ঠ কন্যা)
বাবার বাধ্য মেয়ে ছিলাম আমি। যখন যা বলেছেন, তাই শুনেছি। সে জন্য বোধহয় আজও খুব সুখে আছি। আমার ভগবান ছিলেন বাবা। আদ্যোপান্ত স্নেহপ্রবণ, অথচ কঠোর অনুশাসনে মোড়া একটি মানুষ।
দেশে-বিদেশে ‘শো’ করতে যেতেন তিনি। তাই বছরের অনেকটা সময় বাড়ির বাইরেই থাকতেন। ফেরার সময় নিয়ে আসতেন নানা উপহার— শাড়ি, তার সঙ্গে মানানসই ইমিটেশনের গয়না, জুতো, ব্যাগ। অবাক হত সবাই, বাবার পছন্দ দেখে! উত্সব-মেলা-পার্বণে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর অভ্যাস। মাহেশের রথ, শহরে রথের মেলা, শীতের ছুটিতে চিড়িয়াখানা— সবই উপভোগ করেছি, বাবার হাত ধরে।
অষ্টম শ্রেণি অবধি বাবার সঙ্গে স্টেজে কাজ করেছি। তার পর তাঁর নির্দেশ এল, “এ বার পড়াশোনায় মন দাও।” তিনি কখনও চাননি, আমরা, ওঁর মেয়েরা, পরবর্তী জীবনে চাকরি করি। তিনি বাবা হিসেবে রক্ষণশীল ছিলেন ঠিকই, কিন্তু গোঁড়া নন। তাঁর ইচ্ছে মতো সংস্কৃত ভাষা নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। বন্ধুরা বলেছিল, “তুই কি পুরোহিত হবি!” শুনে বাবা বলেছিলেন— ভারতের ‘দর্শন’ জানতে ও বুঝতে হলে এই ভাষা জানার প্রয়োজন আছে। বেদ-পূরাণ-উপনিষদ সবই তো সংস্কৃতে লেখা।
|
|
গীতা চৌধুরি (কনিষ্ঠ কন্যা)
ছোটবেলায় বাবাকে খুব কমই কাছে পেয়েছি আমরা। কাজের জন্য বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকতেন তিনি। কিন্তু সন্তানদের সমস্ত রকমের প্রয়োজনের দিকে নজর থাকত বাবার। বিদেশ থেকে ফিরেই এক এক করে আমাদের কাছে ডাকতেন। অধীর আগ্রহে আমরাও অপেক্ষা করতাম, কখন আসবে ‘আমার’ পালা!
স্কুলের কোনও অনুষ্ঠানে বাবা আমন্ত্রিত হলে, বন্ধুরা ভাবত তিনি আসবেন তাঁর সেই ঝলমলে রাজার পোশাকে। কিন্তু তিনি আসতেন কেবল ‘আমার বাবা’ হয়ে, জাদু-সম্রাট হয়ে নয়।
নানা দেশের নানা সুস্বাদু খাবারের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বাবা। তবে, তাঁর পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকত মায়ের হাতের আটপৌরে বাঙালি রান্না। আমারও রান্নার দিকে ঝোঁক ছিল বলে অনেক সময়ই বিভিন্ন ‘ডিশ’ সম্পর্কে বলতেন আমাকে। আমি সেটা নিজের মতো বানিয়ে বাবাকে খাওয়াতাম। প্রশংসাও পেতাম। তার মধ্যে অন্যতম ‘মহারাজা স্যালাড’। |
বাবার সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে * |
বাবা নিজে অঙ্কে খুব ভাল ছিলেন, তাই বাড়িতে থাকলে আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে অঙ্ক করাতেন। খাটের পাশে একটা বোর্ড নিয়ে চলত সেই ক্লাস। আমি বরাবর অঙ্কে কাঁচা। তাই কোনও না কোনও একটা ছুতো খুঁজে পালিয়ে বাঁচতাম। তবে আমার সৃজনশীলতাকে সব সময়ই ইন্ধন জুগিয়েছেন বাবা। উপহার পাওয়া এক বাক্স ইরানি জাফরান দিয়ে আমার তৈরি শিল্পকর্ম দেখে তিনি শুধু বলেছিলেন, “তুমি জান না এই জাফরানের কত দাম!”
|
|
মানিক সরকার (জ্যেষ্ঠ পুত্র)
ছবি আঁকার নেশা আমার ছোট থেকেই। পরবর্তী কালে আলোর সঙ্গে রঙের খেলা— এই দুই মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে বাবার ‘জাদু-জগতে’ আমার প্রবেশ। প্রথম দিকে বাবার বিভিন্ন ম্যাজিক ‘অ্যাক্ট’-এর জন্য নানা ধরনের ‘ব্যাকড্রপ’ আঁকতাম। বাবার উত্সাহে তাকে আলোর রকমফেরে আরও চিত্তাকর্ষক ও ব্যবহারযোগ্য করা হত। সেখান থেকেই আমার জীবনে আসে মায়া-বিদ্যার পাশাপাশি অন্য এক জগত্, আলোয় ভরা— লেসার প্রযুক্তি।
কর্মসূত্রে বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকলেও, আমাদের পড়াশোনার প্রতি বাবার ছিল বিশেষ নজর। তিনি কঠোর অনুশাসনে বিশ্বাস করতেন। এক বার ‘সাজাপ্রাপ্ত’ হয়ে আমাদের বাড়ির তিনতলার একটি ঘরে বন্দি ছিলাম। তখন বোধহয় সপ্তম শ্রেণিতে। ঘরে বই ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবে শাস্তির এক ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই বারান্দা থেকে নীচের ক্যানোপিতে লাফিয়ে, পাইপ বেয়ে নেমে চলে গিয়েছিলাম মাছ ধরতে। বাড়ি ফিরে বাবার কাছে ধরা পড়ে যাই। আমাকে বিশেষ কিছু না বললেও, মাকে বলেছিলেন, “এ ছেলে জাদুবিদ্যা নিয়েই জন্মেছে।”
সঠিক অর্থে জাদুর খেলা না দেখালেও, আমার পৃথিবী ভরা আলোর খেলায়। বাবার সমর্থন ও আমার উপর বিশ্বাস না থাকলে এই আমি বোধহয় আমি হতাম না। তাই বাবার শতবর্ষের জন্মদিনে আমার শ্রদ্ধার্ঘ সেই আলোর মেলাতেই।
|
|
পি সি সরকার, জুনিয়র (মধ্যম পুত্র)
আমি জাদু পরিবারের অষ্টম পুরুষ। ছোটবেলা থেকেই মনে হত আমার ‘দুই’ বাবা। এক জন, যিনি বাড়িতে সর্বদাই গম্ভীর হয়ে থাকতেন। আর ছেলেমেয়েদের শুধু পড়াশোনার কথা বলতেন। অন্য জন, সদা হাস্যময় ঝলমলে পোশাক পরা এক ব্যক্তি যিনি মজার খেলা দেখিয়ে শিশুদের আনন্দ দিতেন।
বিখ্যাত জাদুকর হ্যারি হুডিনির হাত বাঁধা বাক্সবন্দি অবস্থায় তালা খোলার ব্যর্থ চেষ্টায় এ যাবত্ প্রাণ হারিয়েছেন বারো জন, অন্তত রেকর্ড তাই বলে। বাবাকে যখন বললাম যে, আমি সেই খেলা দেখাব, তিনি কিছুতেই রাজি হননি। মাকে বলেছিলেন, এ খেলা প্রাণঘাতী, ছেলে নাও ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিজয়ী হয়ে যে দিন বাড়ি ফিরলাম, দেখলাম বাবা মালা হাতে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন।
জাপান সফর চলাকালীন তাঁর মৃত্যু হয় এবং তিন দিন ইন্দ্রজালের শো বন্ধ থাকে। চুক্তির কথা মাথায় রেখে প্রথম দু’দিন তিনটে করে শো করতে হয় আমাদের। প্রথম দিন স্টেজে নামার আগে দলের এক প্রবীণ সদস্য তিনটি আংটি দিয়েছিলেন আমার হাতে। বাবার পরিহিত সেই আংটি এখনও আছে আমার আঙুলে। বাবাও থাকবেন আমার সঙ্গে, এই পৃথিবীতে— যত দিন থাকবে এই ‘জুনিয়র’।
|
|
পি সি সরকার, ইয়ং (কনিষ্ঠ পুত্র)
তখন আমার বয়স ১৪ বা ১৫। বাবার সঙ্গে প্রথম বার মঞ্চে কাজ করি নিউ এম্পায়ার-এ। ‘শো’-এর শেষে গ্লোব সিনেমা হলের পাশে এক পাঞ্জাবি ধাবায় খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাবার বিশ্বাস ছিল যে অষ্টম প্রজন্মে জাদুবিদ্যার ধারাবাহিকতা বহন করার যোগ্যতা আমার আছে।
মঞ্চের পুরোদস্তুর পেশাদার বাবা বাড়িতে ছিলেন একেবারেই সাধারণ, এক মধ্যবিত্ত মানুষ। বাড়ির সামনে রাস্তায় হাঁটতে বেরোতেন ফতুয়া-পাজামা পরে। কখনও সঙ্গে থাকত আমাদের পুষ্যি সারমেয়টি। আর হাতে সর্বদাই থাকত একটা চামড়ার ব্যাগ। সাধারণ মানি-ব্যাগ থেকে খানিক বড় মাপের। এক দিন কোনও এক ‘বিশেষ’ ব্যক্তি সেই ব্যাগ নিয়ে পালাতে গেলে আশেপাশের লোক তাকে ধরে ফেলে। সবাই যখন গণধোলাই দিতে ব্যস্ত, বাবাও কী ভেবে এক ঘুঁষি বাগিয়ে বসলেন তাকে। সেই ঘুঁষিতে চোরের কতটা লেগেছিল জানা নেই, তবে বাবাকে দিন কয়েক হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে রাখতে হয়েছিল। এমন চোর ধরার আরও এক কীর্তিতে ধরা পড়েছিলেন আমার মা। তস্কর-হানা রোধে এক বার এক বিশেষ আয়োজন করলেন বাবা। তিন তলার ঘরের জানালার সামনের এক টেবিলের উপর অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে বেশ কিছু খালি টিনের কৌটো রেখে দিলেন, খুব সরু সুতো দিয়ে আলগোছে বেঁধে। অন্ধকারে বেকায়দায় হাত পড়লেই মাঝ রাতে ‘কাঁসর-ঘণ্টা’ বেজে উঠবে। বেশ রাতের দিকে, কোনও কারণে মা সেই টেবিলের কাছে যেতেই যত গোল বাধল। কৌটোর আওয়াজে অন্ধকারেই মাকে জাপটে ধরে ‘চোর চোর’ চিত্কারে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙিয়েছিলেন বাবা।
মায়ের হাতের রান্না তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল যে অন্যদেরও ডেকে খাওয়াতেন। ভালবাসতেন ডাব খেতে। আর মাঝে মাঝে তাঁর ঠোঁট লাল হয়ে উঠত, পাড়ার একটি দোকানের মিষ্টি পানে।
|
|
অমিতাভ পালিত (ইলাদেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র)
খুব আবছা মনে পড়ে সেই রাশভারী অথচ স্নেহপ্রবণ মানুষটিকে— আমিই যাঁর নাম দিয়েছিলাম ‘ম্যাজিক দাদু’। খাবার-টেবিলে গৃহকর্তার আসনে বসতেন তিনি। দেশ-বিদেশে ঘোরার কারণে আমাকে এনে দিতেন নানা খেলনা, যা ভারতে তখনও দুর্লভ। মনে পড়ে একটা ট্রাই-সাইকেলের কথা। সারা দিন তিনচাকায় রাজত্ব সামলেছিলাম সে বারের ছুটিতে।
আমার বাবার চাকরিসূত্রে আমরা থাকতাম শিলং-এ। গরমে আর বড়দিনের ছুটিতে কলকাতায় আসতাম বালিগঞ্জের মামারবাড়িতে। শেষ বারের জন্য তাঁকে দেখেছিলাম সেই বাড়ির বারান্দা থেকে— অগুনতি মানুষের মাঝে পুষ্প-শয্যায় শায়িত ম্যাজিক দাদু। তখন আমার বয়স খুব বেশি হলে সাত বছর হবে!
|
|
তথ্য সৌজন্য: পি সি সরকার, জুনিয়র ও পি সি সরকার, ইয়ং
* চিত্র সৌজন্য: মানিক সরকার ও পি সি সরকার (মাস্টার)
সাক্ষাত্কার: শেলী মিত্র |
|
|
|
|