: সংগ্রহশালা
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল
লকাতার বয়েস ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত শহরের তুলনায় কিছুই না। কিন্তু আঠেরো-উনিশ শতক জুড়ে ব্রিটিশ ভারতের এই রাজধানী ভারতে বসবাসকারী ব্রিটিশদের কাছে ‘লিটল লন্ডন’ বলেই পরিচিত ছিল। সেটাই হয়তো স্বাভাবিক, কারণ মুঘল ঐতিহ্যের দিল্লি বা নবাবি ঐতিহ্যের লখনউ-এর মতো শহরকে একাত্ম করে নেওয়া ব্রিটিশদের পক্ষে কখনও সম্ভব ছিল না। কলকাতা সাবর্ণ রায়চৌধুরী জমিদারদের অধীন গণ্ডগ্রাম ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল, তাকে আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা অনেকটা নিজেদের ছাঁচে তৈরি করে নিল। পুরোপুরি অবশ্যই পারেনি, জয়পুর বা আগরতলার মতো পুরোপুরি পূর্ব-পরিকল্পিত শহর না-হলে তা বোধহয় সম্ভবও নয়। তবু ফিভার হসপিটাল কমিটি থেকে লটারি কমিটি, একের পর এক উন্নয়নের উদ্যোগে শহরের চেহারা, এমনকী নেটিভ টাউনের চেহারাও অনেকটাই বদলে গিয়েছিল। এই অবস্থায়, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবোজ্জ্বল দিনে, জানুয়ারি ১৯০১-এ প্রয়াত হলেন সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া। বড়লাট তখন কার্জন, ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিরক্ষায় তিনি যে স্মারক তৈরির প্রস্তাব করলেন তা যে কলকাতাতেই হবে এতে দ্বিমতের বিশেষ অবকাশ ছিল না। কার্জনের পক্ষে অবশ্য অনুমান করা সম্ভব ছিল না, আর এক দশকের মধ্যে কলকাতা রাজধানীর গৌরব হারাবে।
ঠিক হল, ময়দানের দক্ষিণ প্রান্তে প্রেসিডেন্সি জেলের জায়গায় তৈরি হবে স্মৃতিসৌধ। সরিয়ে নেওয়া হল প্রেসিডেন্সি জেল। কেমন স্মৃতিসৌধ চেয়েছিলেন কার্জন? তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, এর নকশা ভারতীয় স্থাপত্যের অনুসারী হবে না, ধ্রুপদী বা রেনেশাঁস শৈলীর ভবন হওয়া জরুরি। আর পুরোটাই হবে মার্বেলের, যে মার্বেল আনতে হবে মাকরানা থেকে, যে মাকরানা থেকেই তাজমহলের মার্বেল পাথর সংগৃহীত হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, সৌধটিকে স্থাপন করতে হবে চমৎকার উদ্যানের মধ্যে। অর্থাৎ মুখে যা-ই বলুন, কোথাও কি তাঁর মনের গোপনে তাজমহলের মতো কালাতিক্রমী স্মারক-স্থাপত্যের অনুরণন ছিল না? সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত নকশা তৈরি করলেন রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস-এর প্রেসিডেন্ট, বিখ্যাত স্থপতি উইলিয়াম এমার্সন। এমার্সন তখন বৃদ্ধ, চল্লিশ বছর আগে ভারতে এসে তিনি মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেট, ইলাহাবাদের অল সেন্টস ক্যাথিড্রাল, এবং ভারতে ইন্দো-ইসলামি শৈলীর অন্যতম প্রথম সৌধ ইলাহাবাদের মিওর কলেজ (১৮৭৩), পরে গুজরাতের ভাওনগরে প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণ করে খ্যাতি অর্জন করেন। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ক্ষেত্রে এমার্সনকে সাহায্য করেন ভিনসেন্ট এশ, যিনি ১৯০৩-এ দিল্লি দরবারের অস্থায়ী প্রদর্শনী কক্ষ তৈরি করে কার্জনের আস্থা অর্জন করেন, আর কলকাতায় ভিক্টোরিয়ার আগে বেঙ্গল ক্লাব, গার্ডেনরিচে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দফতর তৈরি করে যথেষ্ট পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরে তিনি হায়দরাবাদের নিজামের অধীনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবনের পরিকল্পনা করেছিলেন।

এমার্সন পরিকল্পিত এবং এশ-এর তত্ত্বাবধানে নির্মিত স্মৃতিসৌধ সম্পূর্ণ হতে অনেক সময় লেগে যায়। ১৯০১-এ পরিকল্পনা হলেও খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয় ১৯০৪-এ, ১৯০৬-এর ৪ জানুয়ারি তখন প্রিন্স অব ওয়েল্স, পরে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি নির্মাণকাজের দায়িত্ব পায়। ১৯১২-র সফরে পঞ্চম জর্জ কাজের অগ্রগতি দেখে গিয়েছিলেন। তার আগেই রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। শেষে ১৯২১-এর ২৮ ডিসেম্বর পরবর্তী প্রিন্স অব ওয়েল্স ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল উদ্বোধন করেন। তত দিনে নতুন দিল্লি শনৈঃ শনৈঃ গড়ে উঠছে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই, এক বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে অন্য বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোতে থাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গৌরবরবিও অস্তাচলগামী। কার্জনের মহা-পরিকল্পনা তাই, শেষ পর্যন্ত সময়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল।

ভিক্টোরিয়ার ভাস্কর্য নিদর্শনের একাংশ

ভিক্টোরিয়ার মূর্তি

কেন্দ্রীয় গম্বুজ

পরির মূর্তি

সপ্তম এডোয়ার্ড

তা বলে কি এত বড় উদ্যোগ সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়েছিল? না, তা নয়। প্রথমত, কলকাতা পেল ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। ভবন তৈরির মোট এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা খরচের সবটাই রানির ভারতীয় প্রজাদের চাঁদা থেকে উঠেছিল। ৬৪ একর জমির উপর বাগানের মধ্যে স্থাপিত ভবনটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ৩৩৮ x ২২৮ ফিট। কেন্দ্রীয় গম্বুজের উচ্চতা ১৮৪ ফিট, তার উপর সেই ইতালি থেকে তৈরি করে আনা তিন টন ওজনের বিখ্যাত পরির মূর্তি (আসলে ভিক্টরি-র মূর্তি) আরও ১৬ ফিট। খেয়াল রাখা দরকার, ১৯২১-এ সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল ছিল ২০৫ ফিট উঁচু, হাই কোর্ট ১৭৬ এবং অক্টারলোনি মনুমেন্ট ১৫২ ফিট। নির্মাণের সময় এই গম্বুজটি আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম গম্বুজ ছিল। বাগানে সপ্তম এডোয়ার্ডের অশ্বারোহী মূর্তি-সহ স্মারক-তোরণ, পোমরয়-এর করা কার্জনের মূর্তি, জর্জ ফ্রাম্পটনের তৈরি ভিক্টোরিয়ার ব্রোঞ্জমূর্তি, বেন্টিঙ্ক, রিপন, রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি, হলের ভিতরে টমাস ব্রক-এর মার্বেলের ভিক্টোরিয়ার মূর্তি ছাড়াও আছে হেস্টিংস, কর্নওয়ালিস, ক্লাইভ, ওয়েলেসলি, ডালহাউসি এবং আরও অনেকের মূর্তি। কেন্দ্রীয় কক্ষে আঁকা আছে রানির জীবনকাহিনি (ফ্রাঙ্ক সালিসবারি)। কিন্তু এ সব স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলা ছাড়া আসলে গুরুত্বপূর্ণ হল ভারতে ব্রিটিশ রাজ সংক্রান্ত এক অসাধারণ সংগ্রহশালা, কার্জন আদকে যা চেয়েছিলেন, আর এখনও যা দেশের মধ্যে তার সেই গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেছে। চেন্নাইয়ের ফোর্ট সেন্ট জর্জ সংগ্রহশালা ছাড়া এ ধরনের সংগ্রহ আর নেই।

বিপুল সংখ্যক ছবির (চিত্রকলা, আলোকচিত্র, ছাপাই ছবি ইত্যাদি) সংগ্রহ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল-এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন গ্যালারিতে এই সব ছবি প্রদর্শিত। যেমন রয়্যাল গ্যালারিতে আছে ভিক্টোরিয়ার জীবনের নানা দৃশ্য অভিষেক, বিয়ে, প্রিন্স অব ওয়েল্স ও প্রিন্সেস আলেকজান্দ্রা-র বিয়ে, ১৮৮৭-র জুবিলি অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এগুলি সবই ব্রিটেনের রাজকীয় সংগ্রহের নানা ছবির প্রতিলিপি। ছোটবেলায় ভিক্টোরিয়া যে পিয়ানো বাজাতেন, কিংবা

ভিক্টোরিয়ার সামনে লর্ড
কার্জনের নাতি জেমস কার্জন।
পরে নিয়মিত উইন্ডসর দুর্গে যে চেয়ার ও রাইটিং ডেস্ক ব্যবহার করতেন, রক্ষিত আছে তা-ও। বস্তুত সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এই পিয়ানোটি আবার দর্শকদের চোখের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। একটি কক্ষের পুরো দেওয়াল জুড়ে রাখা ভেরেশাগিন-এর আঁকা প্রিন্স অব ওয়েল্স-এর ১৮৭৬-এ জয়পুর প্রবেশের তৈলচিত্রটি ভারতের বৃহত্তম তৈলচিত্র।

আবার ড্যানিয়েল খুড়ো-ভাইপোর আঁকা সব থেকে বেশি সংখ্যক ছবি আছে ভিক্টোরিয়াতেই। ১৭৮৫-তে যখন দেশ ছাড়েন, তখন টমাস ড্যানিয়েল-এর বয়স ৩৬, আর ভাইপো উইলিয়াম ড্যানিয়েল মাত্রই ১৬। পরের বছর তাঁরা চিন হয়ে কলকাতা পৌঁছন। কলকাতার সব থেকে পুরনো বেশ কিছু দৃশ্য আমরা দেখতে পেয়েছি এই ড্যানিয়েলদের দৌলতেই। প্রাচ্যে আট বছর কাটিয়ে তাঁরা যে অজস্র ছবি এঁকেছিলেন, আজও তা রাজ-নস্টালজিয়া জাগিয়ে তোলে। ভিক্টোরিয়ায় তাঁদের নামাঙ্কিত আলাদা গ্যালারি রয়েছে।

ড্যানিয়েলদের ছবি ছাড়াও এখানে আছে উইিলয়াম হজেস, জোহান জোফানি, টিলি কেট্ল, স্যামুয়েল ডেভিস ও ফ্রেজারের মতো শিল্পীর আঁকা ছবি।

কলকাতা সংক্রান্ত ছবির খুবই বড় সংগ্রহ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। কার্জন গোড়াতেই এর জন্য আলাদা প্রদর্শকক্ষের কথা ভেবেছিলেন। ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ নুরুল হাসান আবার এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন। ১৯৮৬-তে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হয়ে আসেন। রাজ্যপাল পদাধিকার বলে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অছিপরিষদের সভাপতি। এ দিকে কলকাতার তিন শতক পূর্তিও তখন এগিয়ে আসছে (যদিও বর্তমানে মহামান্য আদালতের নির্দেশে কলকাতার ‘জন্মদিন’ পালন আইনানুগ নয়)। নুরুল হাসানের উদ্যোগেই ঐতিহাসিক অশীন দাশগুপ্ত ও বরুণ দে-র পরিকল্পনায় ভিক্টোরিয়ায় স্থাপিত হল কলকাতা-গ্যালারি, ভারতে প্রথম কোনও শহরকে নিয়ে এমন গ্যালারি হল। এখানে জোব চার্নকের আগমন থেকে ১৯১১-য় রাজধানী স্থানান্তর পর্যন্ত কলকাতার ইতিহাস ছবি, মডেল, ডায়োরামা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে।

ভিক্টোরিয়ায় অস্ত্রশস্ত্রের সংগ্রহও খুব ভাল। পলাশির প্রান্তর থেকে ১৭৫৭-য় ক্লাইভের দখল করা দু’টি ফরাসি কামান, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কামান ছাড়াও আছে টিপু সুলতান ও হায়দর আলির অস্ত্র,ওয়ারেন হেস্টিং ও ফিলিপ ফ্রান্সিসের ডুয়েলের পিস্তল, ইত্যাদি।

বঙ্কিমচন্দ্রের
লেখার টেবিল

কালীঘাট পটের এক দুর্লভ সংগ্রহ

ভিক্টোরিয়ার পিয়ানো
আলোকচিত্রের দুর্লভ সংগ্রহ ছাড়াও এখানে আছে দুর্মূল্য বইপত্র, আর অজস্র নথি। আছে মিরজাফরের সঙ্গে ক্লাইভের চুক্তির মতো নথির সঙ্গে হাইকোর্ট বা পুরসভার আদি পর্বের নানা নথি। কলকাতা নিয়ে গবেষণা করতে হলে যেমন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যেতেই হবে, তেমনই কলকাতা বা ব্রিটিশ রাজকে চাক্ষুষ করতে হলেও ভিক্টোরিয়া ছাড়া গতি নেই। বিদেশের নানা সংগ্রহশালার সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ভিক্টোরিয়া, যেমন গত বছরেই লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ম থেকে কালীঘাট পটের এক দুর্লভ সংগ্রহ প্রদর্শিত হল এখানে। এ ছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার টেবিল আনুষ্ঠানিক ভাবে দর্শকদের কাছে প্রদর্শন করা, রয়্যাল গ্যালারির উপরের অংশের ছবি দর্শকদের দেখার ব্যবস্থা করা, কিংবা ভিক্টোরিয়ার পিয়ানো আবার প্রদর্শনএ সবই সাম্প্রতিক নানা উদ্যোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আছে ছাত্রছাত্রী বা সাধারণ দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার মতো নানা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি গম্ভীর অ্যাকাডেমিক আলোচনার ব্যবস্থাও। কলকাতায় এমন পরিবেশে এমন সংগ্রহশালার সত্যিই জুড়ি নেই।

—নিজস্ব চিত্র্র
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.