প্রিয় বন্ধু আমার
প্রায় দশ বছর হতে চলল, আমি আমার প্রিয় শহরের বাইরে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে, এক দিনের জন্যেও তাকে ভুলতে পারিনি। প্রতি বছর অন্তত এক বার হলেও ছুটে গিয়েছি নিজের শহরে— রান্নার গন্ধমাখা মায়ের আঁচল আমাকে ডেকেছে; বাবার সঙ্গে কাদা প্যাচপ্যাচে টবিন রোডের বাজারে ভাল ইলিশ মাছের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবার মজা আমায় টেনেছে; তথাকথিত কিছু ‘বখে যাওয়া’ বন্ধুদের সঙ্গে গোপন ঠেকে বসে ‘নিষিদ্ধ’ আড্ডা আমায় হাতছানি দিয়েছে; এ রকম কত অসংখ্য টান যে আমাকে কলকাতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, তা গুছিয়ে বলতে গেলে আস্ত একটা উপন্যাস হয়ে যাবে!

পুরো ছোটোবেলাটাই কেটেছে উত্তর কলকাতার গলিঘুঁজিতে দৌরাত্ম্য করে। চুটিয়ে পাড়ার ক্রিকেট তো ছিলই, তার সঙ্গে দল বেধে নিজেদের নতুন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়াও ছিল। সন্ধেবেলা লোডশেডিং হলেই, পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে, ছাদে উঠে এ ছাদ ও ছাদ চলত গানের লড়াই। পুজোর ছুটিতে তুমুল আনন্দের সঙ্গে জুড়ে থাকত আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীটা একেবারেই হাতছাড়া না করার রোমাঞ্চ। তার মাঝেই পাড়ার নাটকের মহড়ায় দাদা-দিদিদের প্রেমে পড়ার সাক্ষী হওয়া। এক বার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম বাবা-কাকাদের সিগারেট খাওয়া নকল করতে গিয়ে। আর এই সব করতে করতেই এ শহর দেখল, একটা ডানপিটে ছেলে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে।

হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হতেই রকে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া শুরু হল। মুখে গাম্ভীর্য আনার জন্য উত্সাহ দিতে চাইল হাল্কা একটা গোঁফের রেখা। লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দের বইগুলো গোগ্রাসে গিলতাম। আনন্দমেলা সরে গিয়ে হাতে উঠল দেশ পত্রিকা। সত্যজিৎ থেকে আপ্লুত হলাম সুনীলে। দুপুরবেলা মা ঘুমিয়ে পড়ার পরেই পাশের বাড়িতে গিয়ে সদ্যজাত কেবল চ্যানেলে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা দেখার একটা নেশা তৈরি হল। যদিও আমার জন্যই তখন বাড়িতে কেবল লাইন নেওয়া হয়নি। ও বাড়িতে কিছুই বাছাই করতাম না— কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, আর কোনটাই বা ভালমন্দের মাঝামাঝি জানতেও চাইতাম না। টিভিতে যা দেখাতো, দেখতাম। স্কুল কেটে লুকিয়ে লুকিয়ে কাছাকাছির সিনেমা হলে বসে ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’ দেখে মাধুরীর প্রেমে ওই কিশোর বয়সে আমার কী ভীষণ চিত্তচাঞ্চল্য! আর এক বার বিশ্বকর্মাপুজোয় বাড়িতে মিথ্যে বলে বন্ধুদের সঙ্গে মেট্রোতে দেখেছিলাম দমবন্ধ করে দেখা ‘বেসিক ইনস্টিক্ট’! তত দিনে সিগারেটে সুখটান দেওয়া হয়ে গিয়েছে। ভয়ে ভয়ে করেছি মদ্যপান। আর এক বিষণ্ণ দশমীর রাত্রে সিদ্ধি খেয়ে পাশের পাড়ার মিষ্টি মেয়ে সৌমশ্রীকে করে ফেলেছি ‘প্রোপোজ’ও।

কলেজ জীবনের তিন বছর, এই ‘এঁচোড়ে পাকা আমি’র সব থেকে প্রিয় বন্ধু ছিল কলকাতা। ইউরোপ-আমেরিকার তাবড় তাবড় শহরগুলোর কথা মাথায় রেখে বলতে পারি, পার্ক স্ট্রিট পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজপথ। মেট্রো থেকে নেমে সেই রাজপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হত এই শহর আমায় গ্রাস করছে। এক বার পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এক মুহূর্তও না ভেবে বন্ধুদের নিয়ে চলে গেছিলাম সিরাজ-এ। চোখ বুজে ধোঁয়া ওঠা আলু আর ডিম দেওয়া সেই বিফ বিরিয়ানির স্বাদ পৃথিবীর আর কোথায় পাব! কলেজ থেকে ফেরার পথে অনেক দিন হটকাঠির মটনরোলে কামড় না বসিয়ে শান্তি ছিল না, সঙ্গে ধর্মতলা চত্বরে ঘোরা। গ্লোব সিনেমার সামনে থেকে দইবড়া খাওয়া আর তার পর পরম আয়েসে একটা ‘নেভি কাট’ জ্বালিয়ে লাইট হাউসের দিকে হেঁটে যাওয়া— সবচেয়ে সস্তার টিকিটে একদম উপরে সিনেমা দেখতে। জায়গাটা সে সময়ে ‘খাঁচা’ বলে খ্যাত ছিল।

কলেজের সুন্দরী মেয়েরা বুক তোলপাড় করে দিত! নন্দন চত্বরে প্রেম আর আঁতলামি মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। এ সবের মধ্যে কখনও সদ্য উদ্বোধন হওয়া মিউজিক ওয়ার্ল্ডে গান শুনতে যাওয়া, কখনও ইডেন গার্ডেন্সে হঠাৎ করে ফ্রিতে পাওয়া টিকিটে লক্ষ্মণের শক্তিশেল (ডবল সেঞ্চুরি) দেখা। বইমেলায় আনন্দ পাবলিসার্সের স্টলে কোনও রকমে ঢুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তসলিমা নাসরিনের বই প্রায় শেষ করে ফেলা আর বাইরে বেরিয়ে প্রচণ্ড খিদের মুখে বেনফিসের স্টল থেকে গরম ফিসফ্রাইয়ে একটা বিশাল কামড় দিয়ে কিছু ক্ষণের জন্য কথা বলা বন্ধ। কোনও কোনও দিন কলেজের ক্লাস কেটে অলিপাব-এ বসে বিয়ার সহযোগে আড্ডা, আর সন্ধে হলেই একগুচ্ছ পুদিনহারা চিবিয়ে বিকৃত মুখ নিয়ে বাড়ি ফেরার মেট্রো ধরা। এই শহর এ ভাবেই আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমি কলকাতাকে বুকে নিয়েই বড় হয়েছি, কলকাতা তার চোখ দিয়েই আমাকে সারা পৃথিবী চিনিয়েছে, হাতে ধরে শিখিয়েছে সহ নাগরিকদের প্রতি সহমর্মিতা বোধ। কলকাতাই আমার কানে কানে ফিসিফিসিয়ে বলেছে— চরৈবেতী, চরৈবেতী, চরৈবেতী।

আজও যখন সময় করে আমার প্রিয় বন্ধুর কাছে ছুটে যাই, তখন, এই সব পুরনো, স্মৃতিমেদুর জায়গাগুলোতে আবার হানা দিই। অবাক হয়ে দেখি চারপাশের ‘পরিবর্তন’। কিন্তু শহরের ‘স্পিরিট’টা একই আছে। দেখি আমার মতন কত ‘অকালপক্ক’ ছেলে রবীন্দ্রনাথের ‘পাগলা হাওয়া...’য় একটু রাম খেয়ে কোমর দোলাবে বলে ‘তন্ত্র’য় ভিড় করে— তন্বী, ব্যাকলেস চোলি আর কালো শাড়ির গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে— যাদের কালো হরিণ চোখে বিদিষার নেশা লেগে আছে। মনে হয়, যাই, ওদের সঙ্গে আমিও পা মেলাই। পিছনে ফিরে দেখি আমার প্রিয় বন্ধুটি মিটিমিটি হাসছে।

প্রিয় বন্ধুই আমাকে আর বাবাকে এক সঙ্গে টেনে আনে নন্দনে। সেখানে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘মহানগর@কলকাতা’ দেখেই দৌড়ে বাবাকে নিয়ে ঢুকে যাই অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, ব্রাত্যজনের ‘রুদ্ধসঙ্গীত’ নাটক দেখতে। বিরতিতে বাবা সিগারেট খাওয়ার জন্য ছটফট করলেও, তাঁকে ধমকে বসিয়ে নিজে বাইরে বেরিয়ে টুক করে ফুঁকে, ভেজিটেবল চপ নিয়ে বাবার হাতে ধরাই। ফের পর্দা খুলতেই দেবশঙ্কর হালদারের অসামান্য অভিনয়ের পাশাপাশি ঐতিহাসিক সব বিখ্যাত চরিত্রগুলোতে হারিয়ে যাই আমি, বাবা, প্রেক্ষাগৃহের বাকি সব দর্শক আর আমার প্রিয় বন্ধু কলকাতা।

সপ্তমীর সন্ধে। মুম্বই বিমানবন্দর থেকে আমি উড়লাম কলকাতার উদ্দেশে, বাড়িতে ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ দেব বলে! রাত ন'টা নাগাদ প্লেন নীচে নামতে লাগল। জানলা দিয়ে দেখলাম সারা শহর জুড়ে আলোর মালা— সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। সাঙ্ঘাতিক এক উত্তেজনায় ল্যাপটপটা খুলে জোরে চালিয়ে দিলাম একটা গান। বিমানের ভিতর সকলে তো তাজ্জব! স্পিকারে পাইলটের গলা ভেসে আসছে ‘ওয়েলকাম টু কলকাতা...’ আর সব ছাপিয়ে সুমন তার দৃপ্ত কণ্ঠে গেয়ে চলেছেন—
‘... তোমাকে দেখছি উল্টোডাঙায় সোজা
তোমাকে দেখছি ফুটবল স্টেডিয়ামে
দমদম ছোঁয়া বোয়িং বিমানগুলো
আসলে কিন্তু তোমার জন্য নামে
নামলে বিমান রানওয়ের মসৃণে
বোয়িং কিম্বা রুশ কি ইলিউশিন
ককপিট থেকে পাইলট বুঝে নেন
এসে গেল তার তোমাকে দেখার দিন...’

কলকাতাতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পরিসংখ্যান-এ স্নাতক। তার পর ২০০২ সালে প্রিয় বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে পুণে যাত্রা। পাঁচ বছর সেখানে কাটিয়ে বিদেশে পাড়ি। এখন গেইন্সভিল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল রিসার্চ ও শিক্ষকতা করার পাশাপাশি চুটিয়ে সাহিত্য চর্চা, বিভিন্ন দেশের সিনেমা দেখা, গান শোনা, কবিতা-প্রবন্ধ পাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংযোজনা ও সুযোগ পেলেই নাটকে অভিনয়। বাঙালির চিরন্তন আড্ডা মারা ও ঘুরে বেড়ানো তো লেগেই আছে।
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.