কত দ্রুত বদলে গেল আমার সাধের শহর সুতপা তালুকদার (নৃত্যশিল্পী)
বড় হয়েছি বা জীবনের এই শেষ অধ্যায়ে এসেও বাকি অধ্যায়ের ঘানি টেনে চলেছি এই কলকাতা শহরে বসেই। দক্ষিণ কলকাতাতে আমার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সবার ঝোঁক ছিল আমার দিকে। নাচ, সাঁতার, ওয়াটার ব্যালে, সাইক্লিং, গান আরও কত কী। বই-খাতা, ঘুঙুর, নাচের পোশাক, হারমোনিয়াম নিয়ে সদা ব্যস্ত আমি, তখন থেকেই হতে চেষ্টা করছি বাবার ইচ্ছের মুম্বইয়ের আশা পারেখ হতে। চাপ যতই থাক ছোটবেলা থেকেই আমার ‘নো টেনশন’। শুধু সরস্বতী পুজোয় দু’ একটা প্রেমপত্র পেলে মাঝে-মধ্যে রাতে ঘুম আসত না।
ওয়াটার ব্যালে
আমার পরিবারে আমি ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ হারমোনিয়াম বাজায়নি। নাচ তো দূর অস্ত। আর আমি? মাত্র তিন বছর বয়সেই স্টেজ প্রোগ্রাম। একটি দৈনিকে তো লেখাই হল, ‘নাচতে অনেকেই পারে কিন্তু এমন নাচ ক’জন পারে? স্টেজটাকে মনে হয় শান্তির ঘরবাড়ি।’ সত্যি বলছি, এখনও মনে পড়ে কত মুখ, তাদের উৎসাহ। দিনের পর দিন প্রোগ্রামের ডাক। একই সঙ্গে পড়াশোনার লড়াই। প্রি-টেস্ট তো দিতেই পারলাম না। হেডমিস্ট্রেস রেগে বললেন, ‘টেস্টে হাই ডিভিশন মার্কস না পেলে হায়ার সেকেন্ডারি বাদ।’ উনি যতই রাগ করুন, আমি লেডি ব্রাবোর্ন-এ হাই ফার্স্ট ডিভিশনই পেলাম। জানেন তো, এখনও মনে পড়ে গীতবিতানের নাচের মাস্টারমশাই-এর কানমলা খাওয়া। এই স্নেহ ছিল বলেই তিনি সব নৃত্যনাট্যে আমাকেই নিতেন— খুদে নায়িকা। কত যে বিষয়! ময়মনসিংহ গীতিকা, উত্তরবঙ্গ গীতিকা, বিভুতিভূষণ, তারাশঙ্কর থেকে রবীন্দ্রনাথ। সেই কানমলা খাওয়ার যে এত গুণ তা বুঝলাম পরে। কিন্তু জানেন তো, সেই মাস্টারমশাই যখন কলকাতার অখ্যাত এক হাসপাতালে মারা গেলেন তখন তাঁকে দেখতে অন্যরা কেউ আসেনি। খুব কেঁদেছিলাম। মনে হয়েছিল আমার ঈশ্বর আজ আমার মাথা থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন।
যত পরিণত হচ্ছি ততই অভিজ্ঞতা বাড়ছে। এক সময়ে হেমন্তদা, জর্জদা, মোহরদি, ধীরেন বসু আমাদের রিহার্সালে এসে প্রচুর সময় দিতেন। লাইভ শো-এর জন্য। একবার জর্জদা রিহার্সালে গাইছেন ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, সঙ্গে নাচছে এগারো বছরের এই খুদে শিল্পী। তালে গণ্ডগোল হলেই মাস্টারমশাই বকতেন। সঙ্গে সঙ্গে জর্জদা বলে উঠতেন, ‘বারবার এমন কইর্যা বকেন ক্যান? পোলাপান না?’ এখন বুঝি আমার প্রতি এঁদের স্নেহ কত গভীর ছিল। হেমন্তদা কী বলতেন মনে পড়লে হাসি পায় এখনও। ‘কিরে, আমার ছেলেকে বিয়ে করবি নাকি?’ বুঝতাম তাঁর গানের সঙ্গে আমার নাচটা খুব ভাল হয়েছে।
ছোট থেকেই সব ব্যাপারেই আমার খুব আগ্রহ ছিল। এক বার চণ্ডালিকা করতে গিয়ে জানতে চাইলাম ‘ক্ষুধার্ত প্রেম যার নাই দয়া তার...’ কথাটার মানে কী? প্রচণ্ড ধমক খেলাম সবার কাছে। তখনকার তিন মহারথী কেলুচরণ, ভি বালসারা ও তাপস সেনের সঙ্গে মেগা প্রজেক্ট ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ করতে গিয়ে কত না অভিজ্ঞতা হয়েছিল বলতে পারব না।
নানা মুহূর্ত...
বারো বছর বয়সে চণ্ডালিকার সাজে
ক্রমে নাচ-পাগল আমি ‘পদাতিক’ সেন্টারের শ্যামদাদা (শ্যামানন্দ জালান) এর উদ্যোগে লাভ করলাম বিশ্ববিখ্যাত গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের দীর্ঘ শিক্ষা, সান্নিধ্য ও স্নেহ। তাঁর অবদানেই বিশ্ব দরবারে পা রাখতে পেরেছিল আজকের এই সুতপা। যখনই বিদেশে অনুষ্ঠানের জন্য দীর্ঘদিন থাকতে হত তখনই সেই সব মানুষের কথা এত বেশি মনে পড়ত যাঁরা নিঃস্বার্থ ভাবে আমাকে একজন পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মনে পড়ত আমার এই শহরটার কথাও। বিদেশের কৌলিন্য ভুলেও মনে পড়ত দক্ষিণ কলকাতার সেই সব অলি-গলির কথা। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে যেখানে আড্ডা মারতাম। আসলে আমাদের মনে এই শহরটা এমন ভাবে গেঁথে আছে যাকে কয়েক দিন না দেখলেই মন বড় খারাপ হয়ে যায়।
ইদানীং মন খারাপ হয় অন্য কারণে। কলকাতায় আর সে ভাবে শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রতি কারও আগ্রহ নেই। দু’ একজন যে ভাবে উঠে আসছেন সেখানে তাঁদের আগ্রহ দেখাবার যেন কেউ নেই। নতুন প্রজন্ম তা হলে কী পাবে?
আর যাই হোক, কলকাতা যেন দ্রুত বদলে গেছে। শপিং মল তো নয়, যেন বিদেশের কোনও বড় শহরে দাঁড়িয়ে আছি। হাতের মুঠোয় সব। আহা এমন তো আমরা ছোটবেলায় দেখিনি কখনও। ইদানীং শহরের বীভৎস জ্যাম আমাকে বড় যন্ত্রণা দেয়। সব পাওয়ার মাঝেও একটা কষ্ট মনের মধ্যে সব সময় ঘোরাঘুরি করে। পুরনো কলকাতা, পুরনো শহর, পুরনো মানুষগুলো কত দ্রুত হারিয়ে গেল জীবন থেকে।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.