...ও তার শীতল রূপ
খন শুনি ‘পিলিন’, ‘হেলেন’, ‘লহর’ ধেয়ে আসছে, তাই শীত পড়ছে না। আমাদের শৈশব বা কৈশরে কিন্তু এমনটা হত না। দুর্গা পুজোর সময় থেকেই বাতাসে হিমের পরশ। আর কালীপুজো-ভাইফোঁটা পার হলেই শীতের পোশাকের সঙ্গে বিছানার নীচ থেকে বেরিয়ে আসত লেপ-কম্বল। ছাদে মাদুর পেতে সে সব রোদে দেওয়া হত। গরম জামা, শাল, কোট ইত্যাদিও রোদে না দিয়ে ব্যবহার করা হত না। বাজারের ব্যাগে শীতকালীন সব্জির সঙ্গে উঁকি মারত কয়েকটি করে কমলালেবু। এই সময় আনাজের দাম কমে যেত, তাই শীতের আনাজ মানেই ব্যাগ ঠাসা সব্জি। শেষপাতে টমেটোর চাটনি হত প্রায় রোজই। দুপরে খাওয়ার শেষে একটা কমলালেবু হাতে নিয়ে ছাদে গিয়ে পিঠে রোদ লাগিয়ে আয়েস করে কমলালেবু খাওয়া— সে এক আলাদা আবেগ মাখা দিন ছিল।

আমাদের শৈশব ও কৈশোরে পুজোর ছুটি পরে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা হত। তাই শীতের ছুটিতে অফুরন্ত সময় থাকত হাতে। তাই ছাদে রোদ পোয়াতে পোয়াতে গল্পের বই পড়া ছিল অন্য এক বিলাসিতা। আশপাশের বাড়ির ছাদে বিভিন্ন বয়সী জেঠিমা, পিসিমা, কাকিমাদের দেখা যেত রোদে চুল শুকতে। এ ছাদ থেকে চেঁচিয়ে অন্যকে জিজ্ঞেস করা ‘কী গো আজ কি রান্না করলে’? এখন ফ্ল্যাটবাড়ির সৌজন্যে সে চিত্র উধাও! এখন একচিলতে বারান্দায় কয়েক মিনিটের জন্য কাউকে দাঁড়াতে দেখা গেলেও নেই সেই আন্তরিকতা-আবেগ বা সময়!

কলকাতার মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা আমার স্মৃতিতে শীত মানে দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, বাইরে কুয়াশার চাদর একটু একটু করে ভেদ করে প্রকৃতির দৃষ্টিগোচর হওয়া, লেপ-কম্বল-চাদর-কাঁথা মুড়ি দিয়ে দুপুরে শুয়ে শুয়ে রোড়িও শোনা বা ছাদে বসে রোদ পোহানো, সন্ধেবেলায় খেলা শেষে বাড়ি ফিরে ঠাকুমার সঙ্গে চাদর ভাগাভাগি করে গল্প শোনা। দুপুর হলেই বিভিন্ন ফেরিওয়ালাদের ডাক শোনা যেত— ‘বাসন চাই, বাস.......ন’ বা ‘জয়নগরের মোয়া, নলেন পাটালি গুড়’। শব্দগুলো দূর থেকে কাছে এসে আবার দূরে মিলিয়ে যেত। রোগা, লম্বা যে ছেলেটি আমাদের পাড়ায় নলেন গুড়ের মোয়া আর পাটালি বিক্রি করতে আসত, তাকেই প্রতি বছরই শীতকালে দেখতাম। খেলার ছলে নকল করতাম তার ডাক ও হাঁটার ভঙ্গি!

নলেন গুড় মানেই পায়েস আর পিঠেপুলি। খড় দিয়ে বিনুনি বেঁধে তাতে গাঁদাফুল গুঁজে তৈরি হত বাউনি। পৌষ সংক্রান্তির সন্ধার কনকনে ঠান্ডায় সেই বাউনি বাঁধতে বাঁধতে রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোঁক শব্দ ভেসে আসত। বাউনি বাঁধা হয়ে গেলে ঠাকুমা সেই গরম পিঠে ঝোলা নলেন গুড় মাখিয়ে খেতে দিতেন। রাতে খাওয়া সেরে শুতে যাওয়ার সময় দেখতাম ঠাকুমা অনেকগুলো বাড়তি পিঠে দুধে ফুটিয়ে তুলে রেখে দিচ্ছেন পরের দিনের জন্য।

শীত মানেই হরেক পার্বণ— পৌষ সংক্রান্তি, গঙ্গাসাগর, মাঘ মাসের লক্ষ্মীপুজো, নবান্ন, সরস্বতী পুজো, স্কুল ও ক্লাবের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মাঘমেলা, বইমেলা, আরও নানা মেলার ছড়াছড়ি। ময়দানের বইমেলা এখন মিলনমেলা প্রাঙ্গনে স্থানান্তরিত, তাই হাঁটু পর্যন্ত ধুলো মেখে রাত পর্যন্ত মেলায় ঘোরা আর হয়ে ওঠে না।

শীতকাল মানেই বেড়াতে যাওয়ার সময়— কাছে-দূরে যেখানেই হোক না কেন। ছোটবেলায় বাবা-মার সঙ্গে ভোর ভোর বেরিয়ে বেলঘরিয়া রথতলা থেকে ২৩০ বাসে চড়ে চলে যেতাম চিড়িয়াখানায়। এক সঙ্গে এতো পশু-পাখি দেখার আনন্দই আলাদা। তার ওপরে পপকর্ন, বিজলি গ্রিলের কাটলেট খাওয়ার। এ সময়ের অন্য এক আনন্দ চড়ুইভাতি। এখন এই কলকাতার বুকে কোথাও কোন সবুজ প্রান্তর চোখেই পড়ে না। যা মাঠ বেঁচেবর্তে আছে তা কোনও না কোনও ক্লাবের দখলে। তাই মাঠ পরিষ্কার করে মাটির উনুন বানিয়ে চড়ুইভাতির মজা এখন আর মেলে না। সারা শীতকালটা ছিল ব্যাডমিন্টন খেলার সময়। ছেলেরা ক্রিকেট খেলত। দুপুরবেলায় পাড়ায় পাড়ায় ক্রিকেট ম্যাচ হত। তখনও পর্যন্ত ক্রিকেট ছিল শীতকালেরই খেলা।

কল্লোলিনী ঘেঁষা গঙ্গার তীরবর্তি এক ছোট মফঃস্বলে শহরে আমার বেড়ে ওঠা। শীতকালে বাড়ির ছাদে রোদ অপসারিত হলে সবাই গিয়ে বসত তার পাড়ের সোপানগুলিতে— অস্তগত সূর্যের নরম আঁচ নিতে। স্রোতস্বিনীর বুকে জলে ভেসে চলা নৌকা, উল্টো পাড়ে জি টি রোড ধরে হু হু করে চলা গাড়ি, কলকারখানার কুণ্ডলি পাকান কালো ধোঁয়া, টুপ করে ডুবে যাওয়া রক্তিম সূর্য, আর আকাশে রেখে যাওয়া তার আবিরের রেখা— শেষ হয়ে যেত একটা শীতল দিন।

বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে। কলেজে আসার পর অনেক বারই প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কৃত। হবি বলতে ছবি আঁকা এবং লেখালেখি।

—নিজস্ব চিত্র
 
 

 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.