১৪১ বছরের পুরনো একটি ক্লাবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে এ বারের সংখ্যা।
তথ্য সংগ্রহে রজত কর্মকার।
দৃশ্য ১: ১৯৫৮ সাল। কোচ বাঘা সোমের তত্ত্বাবধানে মাঠে দাপিয়ে অনুশীলন করছেন পি কে, নিখিল নন্দী, প্রদ্যোৎ বর্মন প্রমুখ দিকপাল ফুটবলাররা। সেই একই বছরে কলকাতার সমস্ত বড় ক্লাবকে হারিয়ে ঘরোয়া লিগ জয়।
দৃশ্য ২: ২০১৩ সাল। কোচ শঙ্কর মৈত্র, ক্লাবের কমর্কর্তা এবং সর্বোপরি সব খেলোয়াড়ের দাঁতে দাঁত চেপে কলকাতা লিগের প্রিমিয়ার ডিভিশনে টিকে থাকার লড়াই। নেই কোনও বড় নাম, নামী বিদেশি। অফিস দল হওয়ার পরও নেই কোনও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা। রয়েছে শুধু লড়াই, লড়াই আর লড়াই।
এটাই ইস্টার্ন রেলওয়ে ফুটবল দলের বিগত কয়েক দশকের চিত্র। কোচ বদল হয়েছে, কিছু খেলোয়াড়ও অবসর নিয়েছেন। এসেছেন একগুচ্ছ নতুন প্রতিভা। কিন্তু লড়াই চলছে। লড়াই একটু ভাল পরিকাঠামোর জন্য, প্রিমিয়ার ডিভিশনে টিকে থাকার জন্য। লড়াই একটু ভাল মানের বিদেশি ফুটবলার নিয়োগের জন্য। লড়াই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা নতুন খেলোয়াড়দের একটা চাকরি বা একটু ভাল পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য। এমন আরও কত শত লড়াই নিত্যদিন লড়ে প্রিমিয়ার ডিভিশনে টিকে রয়েছে ইস্টার্ন রেল। অথচ এই ক্লাবটিই এক সময়ে ময়দানে যথেষ্ট সমাদৃত ছিল। তথাকথিত বড় দলের বিরুদ্ধে এর পারফরম্যান্সও ছিল রীতিমতো চমকপ্রদ। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বেশ কিছু ট্রফি জেতার সুবাদে ভারতের ফুটবল মানচিত্রে এই ক্লাবের অবস্থান ছিল উপরের দিকেই। তবে কেন এই পটপরিবর্তন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে একরাশ হতাশা আর বঞ্চনার সাক্ষী থাকতে হল।
ক্লাবের একেবারে শুরুর দিকের ইতিহাস—
১৮৮২ সালে ইস্টার্ন রেলওয়ে স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়। এখন কলকাতা ময়দানে যে ক্লাবগুলি তিন প্রধান হিসাবে সমাদৃত, তার মধ্যে একটিও তখন বাস্তবের মুখ দেখেনি। সাহেবদের হাতে তৈরি এই ক্লাবটিতে ‘নেটিভ ইন্ডিয়ান’দের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। মূলত, তত্কালীন রেল অফিসারদের বিনোদনের জন্যই তৈরি করা হয় ক্লাবটি। পরে ধীরে ধীরে ভারতের ফুটবল জগতে সামনের সারিতে জায়গা করে নেয় ইস্টার্ন রেলওয়ে ক্লাব। ১৮৯০-এর দশকে দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলা শুরু করে। ১৯১০ সালে তৎকালীন শক্তিশালী দল মোহনবাগানকে আইএফএ শিল্ডের প্রথম রাউন্ডে হারিয়ে ‘ডার্ক হর্স’ হিসাবে কলকাতা ময়দানে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১৩ সালে, অর্থাৎ মাত্র দু’দশকের মধ্যে প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয়। আশ্চর্যের বিষয়, ক্লাবে তখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ‘সাদা চামড়া’র লোকদেরই খেলার অধিকার ছিল। চার্চিল, ডি’সিলভা, জো গ্যালব্রেইথ, কার্ভি ভ্রাতৃদ্বয় প্রভৃতি ইউরোপীয় ফুটবলারদের দাপটে ইস্টার্ন রেল কলকাতা ময়দান-সহ ভারতীয় ফুটবলে পরিচিত হতে থাকে।
১৯৪৪ সালে আইএফএ শিল্ড জয়ী দল
১৯২০-র দশকের মাঝের সময় থেকে ক্লাবে ভারতীয়রা খেলার সুযোগ পায়। ক্লাবের এই ভারতীয়করণ করার ক্ষেত্রে বাঘা সোমের বিশেষ ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁকে ইস্টার্ন রেল ক্লাবের অবিশংবাদী ‘হিরো’ বলা যায়। মূলত তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইস্টার্ন রেল ক্লাব ভারতের ফুটবল জগতে পরিচিত ও স্বীকৃত হয়। এ ক্ষেত্রে তিনি ‘মেন্টর’ হিসাবে পেয়েছিলেন ক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কে কে দাসকে। এঁদের যুগলবন্দি তো ছিলই, সঙ্গে ছিলেন যামিনী বন্দ্যোপাধ্যায়, বেচু দত্ত, পাখি সেন, তুলসি দাস, মোহিনী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরে সাহু মেওয়ালাল, সন্তোষ নন্দী, অজিত নন্দী, নিলু মুখোপাধ্যায়, করুণা মজুমদার প্রমুখ এক ঝাঁক প্রতীভাবান ফুটবলার। খেলার মানকে এঁরা এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এঁদের খেলার সুবাদেই ১৯২৭ সালে ডুরান্ড কাপের ফাইনালে ওঠে ইস্টার্ন রেল। আজ ডুরান্ডের মতো টুর্নামেন্ট ভারতীয় ফুটবলে মর্যাদা হারালেও, সেই সময় কিন্তু সমস্ত বড় বড় দল এতে অংশগ্রহণ করত। ফলে, সর্বভারতীয় ফুটবলের আঙিনায় ডুরান্ড কাপের ফাইনালে ওঠাটাই ক্লাবের খেলার সূচককে ঊর্ধমুখী করেছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
স্বাধীনতার তিন বছর আগে ফের এক বড় ঘটনা। ১৯৪৪ সালে আইএফএ শিল্ড জেতে ইস্টার্ন রেল। সর্বভারতীয় ফুটবলে তখন এত ঘন ঘন প্রতিযোগিতামূলক খেলা হতো না। ছিল না এত দলও। ফলে সময়টা আপাতপক্ষে বেশি মনে হতে পারে। তার মানে এই নয় যে এই সময়ের মধ্যে ইস্টার্ন রেলের নাম আলোচিত হয়নি। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে বেশ কিছু খেলোয়াড় এই ক্লাবকে ফুটবলের আঙিনায় তুলে ধরেছেন ততদিনে। যেমন ১৯৩৯ সালে এন মজুমদার, ১৯৪৩ ও ’৪৪ সালে বিমল কর, ১৯৪৯, ’৫১ ও ’৫৪ সালে সাহু মেওয়ালাল আইএফএ ফার্স্ট ডিভিশন লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। ১৯২০-র দশকে যে ভারতীয়করণ শুরু হয়েছিল, তার ফল পেতে শুরু করেছিল ক্লাব। প্রত্যেক বছর নতুন ফসলের মতো নতুন খেলোয়াড়েরা সঠিক পরিবেশ, সঠিক দিশা পেতে লাগল। তখনও এখনকার মতো ফুটবল এত বিদেশি নির্ভর হয়ে যায়নি। প্রত্যেকটি আঞ্চলিক ক্লাবের মতো ইস্টার্ন রেল ক্লাবেও ‘সান অফ সয়েল’দের দায়বদ্ধতা ও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যই ছিল দলের আসল সম্পদ। অত্যাধুনিক জিম, জাকুজি, সুইমিং পুল তো তখন অলীক কল্পনা। এত কিছুর অভাবকে যা ঢেকে দিত তা ছিল খেলোয়াড়দের মনোবল, ভাল কিছু করার তাগিদ।
১৯৫৮ সালের কলকাতা লিগ জয়ী দল (দাঁড়িয়ে) অসীম সোম, এস রায়, তাপস সোম, বুনো ঘোষ, অমল সেনগুপ্ত, কুশারি,
তাপস বসু
(চেয়ারে) সুধির রায়, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, পি আর বসু (অধিনায়ক),
নিখিল নন্দী, সুহাস চট্টোপাধ্যায়, দীনু দাস
(মাটিতে) কে মণ্ডল, ভূপতি মিত্র,
প্রদ্যোত্ বর্মন, অনিল চৌধুরি, সুনীল নন্দী, প্রশান্ত সিংহ।
১৯৫০-এর দশকে তেমনই কিছু প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলার ইস্টার্ন রেল ফুটবল ক্লাবকে এক উচ্চতায় নিয়ে যান। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়— শুধু ইস্টার্ন রেল নয়, যিনি ভারতীয় ফুটবলকেও গৌরবান্বিত করেছেন। তাঁর সঙ্গে ছিল বুনো ঘোষ, প্রদ্যোত্ বর্মন, নিখিল নন্দী, পি আর বসু, অসীম সোম-এর মতো দিকপাল ফুটবলাররা। ১৯৫৮ সালে পি আর বসুর নেতৃত্বে এই তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে গড়া দলটি ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে কলকতা লিগ জেতে। এর পরেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু ট্রফি জেতে ইস্টার্ন রেল। যেমন বরদলৈ ট্রফি, মধ্যপ্রদেশ গোল্ড কাপ, কলিঙ্গ কাপ, কুমার মঙ্গলম চ্যালেঞ্জ ট্রফি ইত্যাদি। এ ছড়াও বেশ কয়েকবার ইন্টার রেল প্রতিযোগিতায় ও সন্তোষ ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এই ক্লাব। এখনেই শেষ নয়। কলকাতা ময়দানে দাপটের সঙ্গে খেলা অনেক খেলোয়াড়ই এক সময় এই ক্লাব থেকেই নিজেদের ফুটবল জীবন শুরু করেছিলেন। যেমন তুষার রক্ষিত, দেবাশিষ হাজরা, রঞ্জন দে এবং আরও অনেকে।
সাত-আট দশকে ভারতীয় ফুটবলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় ফাইনালে ওঠা এবং কয়েকটিতে জয়লাভ— উপরের পরিসংখ্যান তাইই বলছে। এই সময়ে দলের খেলায় একটা ধারাবাহিকতা ছিল। বিশেষত, বড় দলের বিরুদ্ধে পারফরম্যান্সের নিরিখে এটা বলাই যায়। কিন্তু তার পর থেকে অনেক ওঠাপড়া গিয়েছে। এখান থেকেই শুরু হয় ছন্দপতন। কলকাতা প্রিমিয়ার ডিভিশন থেকে এক বার অবনমনও হয়েছে। এর কারণ সম্পর্কে সকলে যে কথাটা এক বাক্যে উল্লেখ করেছেন তা হল পরিকাঠামো এবং টাকার অভাব। এ সম্পর্কে ক্লাবের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জবানবন্দি দেওয়া হল।
শঙ্কর মৈত্র, প্রশিক্ষক
আজকে ফুটবল এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যেখানে টাকাকে আর হিসেবের বাইরে রাখা যাচ্ছে না। সুতরাং ভাল স্পনসর না থাকাটা প্রত্যেক দলের পক্ষে একটা ‘সেট ব্যাক’। এটা অজানা নয়, বেশির ভাগ ফুটবলার নিম্ন বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। সুতরাং যেখানে বেশি টাকা রয়েছে, তাঁরা সেখানেই যাবেন এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া খেপ খেলে প্রচুর রোজগারের হাতছানিও তাঁদের পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। আমি এনআইএস ডিগ্রি নেওয়ার পর ১৯৮৭ সাল থেকে ফুটবল প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমার ফুটবল জীবনের নব্বই শতাংশ ফুটবল আমি ইস্টার্ন রেলে খেলেছি। বহু খেলোয়াড় দেখেছি। এখন যুগ পাল্টেছে। আগের মতো শুধুমাত্র ভাল সম্পর্কের জন্য ফুটবলাররা খেলেন না। আর খেলা সম্ভবও নয়।
স্পনসর না পেলে ভাল ক্লাবও নিজেদের মান ধরে রাখতে পারে না। ইউনাইটেড স্পোর্টসকেই দেখুন। অত ভাল ক্লাব। জাতীয় লিগ খেলছে। তবু স্পনসর পাচ্ছে না। তা ছাড়া অভাব রয়েছে ভাল মাঠের। এ জন্যই আজ ফুটবল রাজধানী বাংলা থেকে গোয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। দু’টো নতুন ভাল মাঠ তৈরি হলে আটটা দল সকাল বিকেল অনুশীলন করতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারও একটু উদ্যোগী হলে ভাল।
পরিকাঠামো উন্নত হলে এই ইস্টার্ন রেল দলই অন্য রকম ফুটবল খেলবে। কলকাতা ময়দানে বেশ কিছু ক্লাব শুধুমাত্র পরিকাঠামো, টাকার অভাবে অবনমনের কবলে পড়েছে। সেখানে আমরা কিন্তু কলকাতা লিগে একটা মান বজায় রেখেছি। কখনও পঞ্চম হয়েছি, কখনও সপ্তম। এ ছাড়া সন্তোষ ট্রফি ও ইন্টার রেলেও ভাল ফল করেছি। ভাল প্রচার ও স্পনসর পেলে আমরা আরও ভাল খেলার অনুপ্রেরণা পাব। আরও অনেক ভাল দল গড়তে পারব।
দলের অনুশীলন
তরুণ ব্রিগেড
জয়দীপ বসু, অধিনায়ক
মাঠে নামলে নিজেকে এবং দলকে একশো শতাংশ দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। কলকাতা লিগে অবনমন হওয়ার পর জেদ চেপে গিয়েছিল। যে করেই হোক প্রিমিয়ার ডিভিশনে উঠতেই হবে। উঠেছি। কিন্তু সেই দল থেকে অনেকে অবসর নিয়েছে। বেশ কিছু খেলোয়াড়ের বয়স বেড়েছে। ফলে চার-পাঁচ বছর আগেকার পারফরম্যান্স দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। তবু সকলেই চেষ্টা করে। আমাদের মধ্যে থেকে কিছু খেলোয়াড় অন্য বড় ক্লাবেও চলে গিয়েছে। দল তাতে ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে। যা আছে, তাই নিয়েই লড়াই করি।
পরিকাঠামো বা ভাল খেলোয়াড়ের অভাব তো রয়েইছে। ভাল মানের নতুন খেলোয়াড়ও সে ভাবে উঠে আসছে না। তবে স্পনসর আসার পর থেকে আমরা বেশ খানিকটা উন্নতি করতে পেরেছি। আরও কিছু স্পনসর পেলে আমরা আরও ভাল দল গড়তে পারি।
উত্তমকুমার বিশ্বাস, ফুটবল সেক্রেটারি
আমাদের অর্থনৈতিক ভিত যদি মজবুত থাকত, তবে অতীতের সেই উচ্চতায় উঠতে না পারলেও আমাদের মানসিকতা দিয়ে অন্তত তার কাছাকাছি যেতে পারতাম। তার পরে আরও একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে। অতীতে পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহু মেওয়ালাল, অলোক মুখার্জি প্রমুখ ফুটবলাররা খেলতেন, তাঁদের মতো খেলোয়াড় পাওয়া খুবই মুশকিল। সে রকম দক্ষতার খেলোয়াড় সবাই বড় ক্লাবে খেলেন। এখন খেলোয়াড়দের মানসিকতার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। আগে কোনও খেলোয়াড় টাকা নিয়ে খেলতেন না। তাঁরা মাঠে গিয়ে ক্লাবকে ভাল কিছু দেওয়া বা ক্লাবের জন্য ভাল কিছু করার মানসিকতা নিয়ে খেলতেন। যেটা এখন খুব একটা দেখা যায় না।
ফুটবলারদেরই বা দোষ দিই কী করে! এটা সবারই জানা যে বেশির ভাগ ফুটবলার খুবই সাধারণ ঘর থেকে খেলতে আসেন। ফলে খেলার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক দিকটা তাঁরা উপেক্ষা করতে পারেন না। এ জন্য এখন খেলোয়াড়দের মধ্যে খেপ খেলার প্রবণতা বেশি। দিনে চারটে খেপের ম্যাচ খেললে শরীরে কিছু থাকে না। ফলে ক্লাবের হয়ে মাঠে গিয়ে তাঁদের একশো শতাংশ দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটার পিছনেও আমাদের কিছুটা ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা যদি তাঁদের একটু ভাল টাকা
বাবলু মণ্ডল
দিতে পারতাম বা একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারতাম, তবে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। কিন্তু কিছু করার নেই। দ্বিতীয় ডিভিশন জাতীয় লিগ খেলার জন্য সব রকম চেষ্টা করেছিলাম। তবে পর্যাপ্ত টাকা এবং আরও অন্যান্য কিছু কারণে তা হয়ে ওঠেনি। আমাদের জায়গায় ময়দানের অন্য একটি প্রভাবশালী ক্লাব (পড়ুন ভবানীপুর) এ বার জাতীয় লিগের দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলেছে। আমাদের না খেলার পিছনে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। খেলার মধ্যে রাজনীতির প্রবেশ আখেরে খেলার ক্ষতিই করছে বলে আমার মনে হয়।
বর্তমানে ইস্টার্ন রেল নিয়ে কথা বলতে গেলে এক জনের নাম বলতেই হব, সে হচ্ছে বাবলু। ও আমাদের ক্লাবের ‘শঙ্কর মালি’। ক্লাবের ‘অল ইন ওয়ান’। ও ক্লাবের সঙ্গে এতটাই একাত্ম, যে চাকরি ছেড়ে ক্লাবের সঙ্গে পড়ে আছে। এদের মতো ছেলেরা রয়েছে বলেই এখনও ভাল কিছু করার স্বপ্ন দেখি।
ক্লাব তাঁবুতে রাখা নানা ট্রফি
স্বপন মোহান্তি, ফুটবল সাব-কমিটি সদস্য
এক বছর আগে পর্যন্ত আমাদের কোনও স্পনসর ছিল না। আমরা যাঁরা ক্লাবের সদস্য রয়েছি বেশির ভাগই প্রায় রিটায়ার্ড। মূলত তাঁরাই কিছু কিছু করে টাকা দিয়ে দলটা তৈরি করতাম। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই ছিল না। সৌভাগ্যবশত, আমাদের ক্লাবে একটি স্পনসর রয়েছে। সেখান থেকে আমরা কিছুটা উপকৃত হয়েছি। তবে অফিস দল হওয়া সত্ত্বেও অফিসের তরফ থেকে আমরা বিশেষ কোনও সাহায্য পাই না।
বাঘা সোমের নামে আমাদের একটি নার্সারি ফুটবল দলও আছে। গত বছর জাতীয় নার্সারি লিগে আমরা রানার্স হয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেও আমাদের কোনও ‘সাপ্লাই লাইন’ নেই। বেশির ভাগ ভাল খেলোয়াড় বিভিন্ন অ্যাকাডেমি বা ক্লাবে চলে যাচ্ছে।
কিছু সিনিয়ার খেলোয়াড় ছাড়া বাকি দল আমরা ধরে রাখতে পারি না। রেলের অন্য একটি ফুটবল দলও রয়েছে— রেলওয়ে এফসি। সেটি মূলত রেলের অফিসারদের ক্লাব। আমাদের মতো স্বাধীনসত্ত্বা ক্লাব নয়। তারা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, আমরা তার কিছুই পাই না। গত মরসুমে তাদের ক্লাবে ন’জন খেলোয়াড় ‘রিক্রুট’ করা হয়েছিল, সেখানে আমাদের ক্লাবে হয়েছে মাত্র এক জন। এমনই আরও অনেক বৈষম্য সহ্য করে আমরা টিকে রয়েছি।
আমরা প্রচার থেকে বরাবর দূরেই থেকেছি। আজকের দিনে প্রচারটা খুবই দরকার সেটাও জানি। গত বছর নার্সারি জাতীয় লিগে রানার্স হয়েছি তা কত জন জানেন? এটা প্রচার না থাকার জন্যই হয়েছে। এ বার থেকে এ দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।
অজিত বিশ্বাস, সহকারী জেনারেল সেক্রেটারি
কী দেখেছিলাম, আর কী দেখছি! আমার দীর্ঘ জীবনে আমি বহু ওঠাপড়া দেখেছি। কিন্তু এখানে শুধু পড়াটাই দেখছি। উত্তরণ কবে হবে জানি না। এঁদের যে চেষ্টা নেই তা নয়, তবে আজকের দিনে শুধু চেষ্টাটা যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে ভাল খেলোয়াড়, মূলধন আর পরিকাঠামো লাগে। আমার বিশ্বাস, এঁরা সঠিক পরিকাঠামো পেলে নিজেরাই উত্তরণের পথ তৈরি করতে পারবে। অনেক বছর আগে বিভিন্ন গ্রন্থাগার ঘেঁটে ক্লাব সম্বন্ধে কিছু তথ্য নিয়ে ক্লাবের সৌজন্যেই একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলাম। আমাদের ক্লাবের বেশির ভাগ ইতাহাসই দুষ্প্রাপ্য। তাই যা পেয়েছিলাম সেটুকু ওর মধ্যে ধরানোর চেষ্টা করেছি। এ ছাড়া ১৪১ বছরের ক্লাবের বিশেষ কোনও ইতিহাস পাওয়া যায়নি।
গোপেশ মজুমদার, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, কজাম এনালিটিক্স লিমিটেড (স্পনসর)
ফুটবলটা আমার ‘প্যাসন’। নিজেও এক সময় খেলেছি। আমি চাই বাংলার ফুটবলের উন্নতি হোক। তাছাড়া আমার সংস্থার ব্র্যান্ডিংও হচ্ছে।
ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডান বা ইউনাইটেড স্পোর্টস থাকতে হঠাত্ ইস্টার্ন রেল কেন? প্রথমত, এই ক্লাবগুলোতে স্পনসরশিপটা খুব ব্যায়বহুল। দ্বিতীয়ত, ইস্টার্ন রেল ক্লাবের কর্মকর্তারা যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, আমি তাঁদের ব্যবহারে দেখে অভিভূত হয়ে যাই। তাঁরা সকলেই ক্লাবের প্রতি খুবই আন্তরিক। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁরা ক্লাবের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। ক্লাবের জন্য ভাল কিছু করার ইচ্ছে রয়েছে। তাছাড়া ১৪১ বছরের পুরনো ক্লাব। এই ক্লাবের একটা সোনালী ইতিহাস রয়েছে। ইস্টার্ন রেল আবার পুরনো গৌরব ফিরে পেলে খুশি হব।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.