‘আলো ক্রমে আসিতেছে’
চন্দনের বনে প্রবেশ করতে গেলে অনেক জঙ্গল পেরোতে হয়। সে সব পেরিয়ে গা-হাত-পা ছড়ে যাওয়ার পর যখন চন্দনের বনে প্রবেশ করা হয়, তখন সে সৌরভে মন-প্রাণ ভরে ওঠে। নিজের গদ্যকে এ ভাবেই বর্ণনা করেছিলেন তিনি। এ সময় তাঁর জন্মশতবর্ষ। সাহিত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র— একসঙ্গে তিনি শিল্পরীতির এতগুলো মাধ্যমে কাজ করেছেন আবার সেন্সাস বা শিক্ষকতার মতো কাজও করেছেন বড় যত্ন নিয়ে। বাংলার তাবড় তাবড় বিদ্বজ্জন ছিলেন তাঁর গুণগ্রাহী। এ বারের সংখ্যায় এক এবং অদ্বিতীয় সেই কমলকুমার মজুমদার। লেখা ও সাক্ষাত্কার: উজ্জ্বল চক্রবর্তী।

ত্তরের কলকাতা। ঘরোয়া এক সভায় উপস্থিত জনা পঁচিশেক অতিথি। তাঁদের মধ্যমণি বিখ্যাত ফরাসি লেখক নাতালি সারোৎ। সকলেই বাংলা বা ইংরেজিতে কথা বলছেন সেখানে। সারোৎ ইংরেজি ভালই জানেন। বাংলাটা তাঁকে ফরাসিতে অনুবাদ করে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু সভায় আগাগোড়া দু’জন ফরাসিতেই কথা বলে গেলেন। এক জন অভিনেতা পাহাড়ি সান্যাল, আর অপর জন? তাঁর পরিচয় দিতে গেলে সত্যজিৎ রায়কে উদ্ধৃত করতে হয়, ‘কমলকুমার নোজ অল দ্য আর্টস!’ কমলকুমার মজুমদার— এই নামটির জন্য কোনও একটি বিশেষণ যথেষ্ট নয়। সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক, চিত্রকলা, ভাস্কর্য— সংস্কৃতির এ সব ধাপের পাশাপাশি জীবনকে যাপন করা ও ছুঁয়ে দেখার মধ্যেও তিনি শিল্পেরই বন্দনা করেছেন। কমলকুমার সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, ‘নানান অসামান্য গুণের অধিকারী হয়েও, সেই সব গুণের বর্ণনা দিয়ে সমগ্র মানুষটাকে ফুটিয়ে তোলা যায় না।’ আসলে কমলকুমার মজুমদার বাংলা সংস্কৃতির চলে আসা ধাঁচার বাইরে বেরিয়ে এসে ‘এক্সপেরিমেন্ট’-এ বিশ্বাসী এক আদ্যোপান্ত মানুষ।

ছেলেবেলা ও পারিবারিক জীবন
১৭ নভেম্বর, ১৯১৪। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে জন্মালেন কমলকুমার মজুমদার। প্রফুল্লচন্দ্র এবং রেণুকাময়ীর সাত সন্তানের জ্যেষ্ঠ ছিলেন কমলকুমার। ভাইবোনরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজগুণে খ্যাত। তাঁদের পৈতৃক নিবাস উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত শহর টাকিতে হলেও কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে একটা ভাড়াবাড়ি ছিল। ছোটবেলাটা কমলকুমারের পারিবারিক আবহাওয়াতেই কেটেছে। বছর আটেক বয়সে বিষ্ণুপুরের ‘শিক্ষাসংঘ’ স্কুলে কমল ও তাঁর ভাই নীরদ একই শ্রেণিতে ভর্তি হন। কয়েক বছর পর সেখান থেকে কলকাতার ক্যাথিড্রাল মিশনারি স্কুল। এখানেও বেশি দিন মন টিকল না। এর পর ভবানীপুরের এক সংস্কৃত টোল। তাঁদের বোন চিত্রকর শানু লাহিড়ী স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘দাদা ও নিরুদার দারুণ ভাব। একবার দু’জনেই কালীঘাটের কোথায় এক টোলে পড়বে বলে হঠাত্ ন্যাড়া হয়ে টিকি রেখে বাড়ি ফিরল। বাড়ির সবাই অবাক।’ সেখানে কিছু দিন সংস্কৃত শিক্ষার পর লেখাপড়ার পাটই গেল চুকে। সেই অর্থে প্রথাগত শিক্ষার কোনও গণ্ডিই কমলকুমার পেরোননি। শানু লিখছেন, ‘স্কুলের পড়া কক্ষনো করেননি। আবোলতাবোল পড়াশুনা।’ তবে হৈ-হৈ করেই তাঁদের ছোটবেলাটা কেটেছে। এই সময়ে সেতার বাজানো ও ফরাসি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি কমলকুমার ছবি আঁকাও শুরু করেন।

১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ। কমলকুমারের সঙ্গে বিয়ে হল দয়াময়ীদেবীর। ঘোরতর সংসারী হয়ে উঠলেন কমলকুমার। কাজ, লেখা, পড়া, ছবি আঁকা এবং সংসার— এতেই মজে ছিলেন তিনি। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে কমলকুমার প্রায় ১৪ বার বাড়ি বদল করেছিলেন। ৯৪ বছরের দয়াময়ীদেবী এখনও মনে করতে পারেন সেই সব দিন। পাতিপুকুরের কাছে একটা বাংলো টাইপের বাড়িতে থাকার সময় কমলকুমার নাকি ফুল-সব্জির বাগানও করেছিলেন। পরিচর্যা করতেন নিজের হাতে। অনেক বাড়ি বদলের পর শেষমেশ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে হাজরা রোডের এক তিনতলার ফ্ল্যাটে মজুমদার দম্পতি চলে আসেন। এখনও পরিপাটি সেই ফ্ল্যাটেই থাকেন দয়াময়ীদেবী। চারদিকে কমলকুমারের নানা স্মৃতি নিয়ে দয়াময়ীদেবী বললেন, “তিনতলায় আসাটা আমাদের পক্ষে বেশ অসুবিধার হয়েছিল। বিশেষ করে ওঁর এতটা সিঁড়ি ভাঙতে খুব কষ্ট হত।”

লেখক
১৯৩৭ সালে কমলকুমারের প্রথম গল্প ‘লালজুতো’ প্রকাশিত হয় ‘উষ্ণীষ’ পত্রিকায়। ওই একই বছরে ‘প্রিনসেস’ ও ‘মধু’ নামের আরও দু’টি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। তার পর একের পর এক লেখা। ১৯৫৭-৫৮ সাল, দেশ পত্রিকায় বেরোয় ‘মতিলাল পাদরী’ ও ‘তাহাদের কথা’। ১৯৫৯ সালে ‘নহবত্’ নামের একটি পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় কমলকুমারের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়: অন্তর্জলী যাত্রা। এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের মানচিত্রে কমলকুমার মজুমদারের নাম স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে। দুর্বোধ্য এবং অপাঠ্য আখ্যার পাশাপাশি কমলকুমার বহু জনের সমীহও আদায় করে নিয়েছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো তাঁকে ‘লেখকদের লেখক’ বলেই দাবি করেছিলেন। সুনীলবাবু এক স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, “আমি কমলকুমার মজুমদারকে আমার একটি বই উত্সর্গ করেছি। সেই বইয়ের এক কপি তাঁকে দিতে গিয়ে বলেছিলাম, কমলদা, আপনার বাড়ির কোনও খাট বা টেবিলের পায়া যদি ঠকঠক করে তখন সেই পায়ার নীচে গুঁজে দেওয়ার জন্য বইটা রেখে গেলাম।” আবার ‘এক্ষণ’ পত্রিকা শুরুর সময়ে সম্পাদক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে লেখক তালিকার প্রস্তুতি পর্বে সত্যজিত্ রায় পরামর্শ দিয়েছিলেন কমলকুমারের লেখা নেওয়ার জন্য।

‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র নাট্য রূপান্তর
কমলকুমারের গদ্য ঠিক কেমন? সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর গদ্য ভাস্কর্যের মতো। তিনি বললেন, “শব্দের গায়ের অধিকন্তু অংশকে বর্জন করে সাহিত্যের একটা মূর্তি গড়ে তুলেছিলেন কমলবাবু। সে বাক্-মূর্তি হাসে, গায়, কথা বলে, আপন মননে মজে থাকে।” কমলকুমারের গদ্য নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ শুভ মুখোপাধ্যায় লেখকেরই একটি বাক্য শোনালেন, ‘তীর সম্মুখ গতি যাইবার নিমিত্তে পিছু হটে, সর্পও দংশন করিবার পূর্বে আপনাকে পিছন পানে টানিয়া লয়’। তিনি বলছিলেন, “দুর্বোধ্য নয়, আসলে কমলকুমার বাংলা ভাষায় লালিত্য আনার চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্কিমের পর এবং রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলাভাষার যে রূপটা হওয়া উচিত ছিল, কমলদা সেটারই চর্চা করেছেন।” সাহিত্য জগতের মানুষরা কমলকুমারের গদ্যের ভক্ত হবেন, এতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু শিল্পের অন্য মাধ্যমের কৃতীরা কী বলছেন?

চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের কথায়: “শব্দ ও বাক্যের পরীক্ষামূলক বিন্যাসে তিনি আসলে পাঠকদের লেখক ছিলেন। বাংলা গদ্য সাহিত্যে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের একটা প্রভাব চিরকাল ছিল, আছেও। কমলকুমার এই ধারার বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর লেখার মধ্যে আমি ফরাসি ভাষার একটা প্রচ্ছন্ন প্রভাব দেখতে পাই। বাংলা গদ্যে উনি যে রচনাশৈলী সৃষ্টি করেছিলেন তা এক কথায় ‘ইউনিক’। আর এই শৈলীই তাঁকে নিজস্ব আসন দিয়েছে। ওঁর লেখার মধ্যে অনেক স্তর আছে। অনেকে তাঁর লেখাকে ‘দুর্বোধ্য’ বলেন, আচ্ছা সবাইকে কি সহজপাঠ্য হতে হবে! পপুলিজম-এর শৃঙ্খলের বাইরে বেরোতে চেয়েছিলেন কমলকুমার।” কমলকুমারের গদ্যকে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন গোবরডাঙা শিল্পায়ন নাট্যদলের আশিস চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে আধুনিক বাংলা ভাষার জন্ম হলেও তার যৌবনপ্রাপ্তি হয় রবীন্দ্রনাথের হাতে। কিন্তু সেই ধারার বাইরে গিয়ে কমলকুমারের রচনা একটা বিশিষ্টতা পায়। তাঁর লেখনী নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু কমলকুমারের সৃষ্ট গদ্য অনবদ্য। কবিতায় যেমন শব্দের একটা চিত্রকল্প থাকে কমলকুমারের গদ্যের পরতে পরতে তেমনই।” অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কমলকুমারের গদ্যকে এক শব্দে ‘অনবদ্য’ বলে জানালেন, “ওঁর মতো এক্সপেরিমেন্ট আজ পর্যন্ত বাংলা গদ্যে কেউ করেননি।”

মোশন মাস্টার
স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে কমলকুমার মঞ্চস্থ করেন ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। নাটক শেষ হওয়ার পর পরিচালকের কাছে এসে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন উত্পল দত্ত। এমনিতে তিনি কখনই কাউকে এ ভাবে প্রণাম করতেন না। কমলকুমারকে তিনি বলেছিলেন, “আমি বীভত্স রসের পূজারী, আপনি সুন্দর রসের। তাই আপনাকে প্রণাম না করে পারলাম না।”

কমলকুমার সমগ্র নাট্যনির্মাণের সঙ্গেই নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। মঞ্চ, পোশাক, কোরিওগ্রাফি, নির্দেশনা— সবেতেই তিনি। নিজেকে কখনও নির্দেশক বলতেন না, তিনি ছিলেন ‘মোশন মাস্টার’। স্কুলের ছাত্রদের পাশাপাশি বস্তির বাচ্চাদের নিয়েও তিনি নাটকে মেতে ওঠেন। পরের দিকে গড়ে তোলেন ‘ক্যালকাটা চিল্ড্রেনস অপেরা’। এর আগে ১৯৫৩ সালে ‘হযবরল’ নামে একটি নাটকের দলে তিনি ছিলেন পরিচালক। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত। এ দলের প্রথম প্রযোজনা ছিল সুকুমার রায়ের ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। পরের নাটক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তধারা’। দলের সদস্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন, ‘কমলদার নির্দেশনা আমাদের কাছে সব অর্থে নতুন। মেঝেতে খড়ির দাগ কেটে প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করা তো ছিলই। এ ছাড়া তিনি আমাদের প্রত্যেককে পুরো নাটকটি সব গান সমেত মুখস্থ করিয়ে ছেড়েছিলেন।’ নাটকীয় দৃশ্যকে কমলকুমার ছবির অনুষঙ্গে নির্মাণ করতেন। তাঁর প্রতিটি নাটকের শুরুতেই সমবেত ভাবে গাওয়া হত, হরি হরায়ে নম কৃষ্ণ...

সাউথ পয়েন্ট স্কুলের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে অভিনীত নাটকের প্রাকমুহূর্তে মহলাকক্ষে কমলকুমার ও জনৈক ছাত্রী।
এক বার ঠিক করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষকে নিয়ে থিয়েটারের দল করবেন। কিন্তু নানা কারণে সে আর হয়ে ওঠেনি। শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয় শিক্ষার শুরুটা কিন্তু কমলকুমারের কাছেই। ‘আলমগীর’ নাটকে শর্মিলাদেবীকে উদিপুরির ভূমিকায় কমলবাবু ভেবেছিলেন। কিন্তু সে নাটক আর মঞ্চস্থ হয়নি।

‘ক্যালকাটা চিল্ড্রেনস অপেরা’ কমলকুমারের বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করে বিভিন্ন জায়গায়। বাংলা নাটকে তাঁর অবস্থান ঠিক কোথায়? সেটা জানা যায় অভিনেতা রবি ঘোষের এক স্মৃতিকথায়। সেখানে রবিবাবু লিখছেন, “এক বার মানিকদাকে (সত্যজিত্ রায়) জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলা রঙ্গমঞ্চে কাদেরকে খুব ক্ষমতাশালী বলে মনে হয়? মানিকদা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘কমলবাবু কিছু করলে তাঁর ধারে কাছে কেউ আসবে না।’”

চলচ্চিত্র
পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘স্বপ্ন নিয়ে’ সিনেমাটি হল থেকে উঠে যাওয়ার পর অরোরা স্টুডিওয় যে তিন জনের জন্য বিশেষ ভাবে ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল কমলকুমার মজুমদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল বিস্তর। সত্যজিত্ রায় লিখেছিলেন, কমলবাবু ফিল্মের ব্যাপারে শুধু উত্সাহী নন, যথেষ্ট ওয়াকিবহালও বটে। তাঁর নিজের ছবি বানানোর ইচ্ছে ছিল। ‘অভাগীর স্বর্গ’ এবং ‘দেবতার গ্রাস’ নিয়ে প্রচুর ফ্রেম স্কেচ করেছিলেন। প্রায় প্রতি শনিবার সত্যজিত্ রায় এবং কমলকুমার সিনেমা দেখতে যেতেন। সত্যজিতবাবুর কথায়, ‘ছবি সম্বন্ধে কমলবাবুর মতামত ছিল গতানুগতিকের বাইরে।’

গৌতম ঘোষের মনে পড়ল, “আমার প্রথম তথ্যচিত্র ‘নিউ আর্থ’-এর বিষয় ছিল কংসাবতী নদী। কমলদা ছবিটা দেখার পর বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার লোকজীবন, তার ইতিহাস নিয়ে নানা গল্প শুনিয়েছিলেন আমায়। এতটাই গভীর ভাবে জানতেন ওই জায়গা সম্পর্কে।” সত্যজিত্ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’র প্রস্তুতিকালে যথেষ্ট উত্সাহ নিয়ে কমলকুমার সে কাজে মেতে ওঠেন। পরে যদিও সরে আসেন।

তিনি যখন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়াতেন তখন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি ফিল্ম ক্লাব তৈরি করেছিলেন। প্রতি রবিবার স্কুলের একটি হলে ছোটদের সিনেমা দেখানো হত।

চিত্রকলা এবং ভাস্কর্য
কাঠখোদাই জল রং
বাড়িতে বা অন্যত্র আড্ডা দিচ্ছেন কমলকুমার। হাতের ফাঁকে একটি ছোট কাঠের টুকরো আর নরুণের মতো একটি যন্ত্র। আড্ডার ফাঁকেই আস্তে আস্তে খোদাই করে তিনি গড়ে তুলছেন এক ভাস্কর্য। এমন দৃশ্য কমলকুমার মজুমদারের ঘনিষ্ঠ অনেকেই দেখেছেন।

ছবি আঁকার বিষয়েও তিনি ছিলেন ভীষণই পারদর্শী। ছোট ছোট রেখাচিত্র বা জলরঙে আঁকা কমলকুমারের ছবি আজও এক বিস্ময়। তাঁর ভাই নীরদ মজুমদার এবং বোন শানু লাহিড়ী ছিলেন বিখ্যাত চিত্রী। কখনও নিজের ছবির প্রদর্শনী করেননি কমলকুমার। ক্যালিগ্রাফির পাশাপাশি তিনি কাঠে খোদাই করে পানকৌড়ি, ঈশ্বরগুপ্ত-র ছড়া ও ছবি প্রচ্ছদ করে এবং আইকম বাইকম-এর ইলাস্ট্রেসন করে বই প্রকাশ করেন।
‘ক্রিসমাস ক্যারল’-এর ভারতীয় সংস্করণে তাঁর ইলাস্ট্রেসনের কাজ ছিল।

আড্ডার ফাঁকে
১৯৩৮ সালের মাঝামাঝি কমলকুমার ব্যবসা শুরু করলেন। মাছের ভেড়ি, জাহাজে আমদানি-রফতানি— অনেক ব্যবসা থেকেই তাঁর রোজগারপাতি। সে যুগে কমলবাবুর বেশভূষা ছিল পুরোপুরি সাহেবি কেতায় বাধা। পরনে দামি স্যুট, সার্ট, টাই, পায়ে চিনে দোকানের দামি জুতো। ভাল ফরাসি পারফিউমও ব্যবহার করতেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৭-এর পর থেকে এমন নিখুঁত সাহেবি পোশাকে কমলকুমারকে আর দেখা যায়নি। পুরোপুরি বাঙালিবাবু— ধুতি-পাঞ্জাবি আর চটি। এমন সাহেবি-চাল কেন ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, সে প্রসঙ্গে মজা করে বলতেন, এক দিন চৌরঙ্গি পাড়ায় ট্যাক্সির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাত্ এক মুটে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বাবু কিতনা বাজা হ্যায়?’ এই বাবু ডাকে তাঁর মোহভঙ্গ হয়। বিলিতি স্যুট, দামি ঘড়ি, আংটি, চিনে জুতো পরিহিত কমলকুমারকে ‘সাহেব’ বলে না ডেকে ‘বাবু’! তাই নাকি সাহেবি কেতা পরিহার। এমনই মজার মানুষ ছিলেন তিনি। পঞ্চাশের দশকে সেন্সাসের কাজও করেছিলেন কমলকুমার। এর কিছু কাল পরে তিনি কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিল্পকলার শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এবং কলেজ স্ট্রিট, দু’ জায়গার কফি হাউসেই কমলকুমারের যাতায়াত ছিল। হইহই করে ঝোড়ো কথাবার্তা দিয়ে মানুষকে মাতিয়ে রাখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। লেখার ভাষার সঙ্গে তিনি তাঁর কথ্য-বাংলাকে কখনওই মিলিয়ে ফেলেননি। বরং দুইয়ের ভিতরে আকাশ-জমিনের ফারাক ছিল। কমলকুমার ছাড়া এই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন সত্যজিত্ রায়, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ নিয়োগী, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষাল প্রমুখ। দুপুরের সেই আড্ডায় নানা বিষয়ে আলোচনা হত। চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়া ‘দ্য রিভার’ ছবির কাজে কলকাতায় এসে কয়েক বার কফি হাউসের এই আড্ডায় অংশ নিয়েছিলেন। শোনা যায়, রেনোয়া নাকি কমলকুমার বলতে অজ্ঞান ছিলেন। ‘কোমাল’ বলে ডাকতেন তাঁকে। তবে কমলকুমারের এই ‘গভীর আড্ডা’ শুধুই দু’একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না। সত্যজিত্ রায় এক স্মরণ-কথনে লিখেছিলেন, ‘আমি তখন থাকি রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে ত্রিকোণ পার্কের দক্ষিণে। আর কমলবাবু থাকেন পার্কের উল্টো দিকে সিডলি হাউসের এক তলায়। হেঁটে যাতায়াতে লাগে দু’মিনিট। প্রায় সন্ধ্যায় আসতেন আড্ডা দিতে। একপেশে আড্ডা, কমলবাবু বক্তা, আমি শ্রোতা।’

চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের আবার এই আড্ডা প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় ১৯৬৮-’৬৯ সালের কথা, “তখন আমি ১৮-১৯-এর সদ্য যুবা। গড়চা রোডে আমার বাবার ইংরেজি শেখানোর একটা টিউটোরিয়াল ছিল, সেই সময়ে। সেখানে একটা ঘরে বন্ধুরা মিলে সন্ধেবেলা সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বসা হত। ‘ভাল কাজ’ নিয়ে থাকতে বাবা ঘরটা আমাদের দিয়েছিলেন। ‘দুঃসাহস’ নিয়ে সবে তখন কমলকুমার মজুমদার পড়ার চেষ্টা করছি। কমলদা তখন সাউথ পয়েন্টে পড়াতেন। আর ওই রাস্তা দিয়ে হাজরা রোডের বাড়িতে ফিরতেন। এক দিন তাঁকে ধরে বললাম, ‘আমরা আপনার লেখার খুব ভক্ত। আমাদের এই সান্ধ্য বৈঠকে আপনি যদি আসতেন!’ শুনে উনি বললেন, ‘আমার লেখা পড়?’ তার পর থেকে উনি মাঝে মাঝেই আসতেন আমাদের ওই ঘরে।” আড্ডা শব্দটি বৃহত্ অর্থেই কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে যেত।

শেষের সে দিন
শেষ জীবন কমলকুমারের খুবই কষ্টে কেটেছে। প্রধানত অর্থকষ্ট। তবে শ্বাসকষ্টেও ভুগছিলেন তিনি। সেই অর্থে কখনও ডাক্তার দেখাতেন না। এক বার সত্যজিত্ রায় তাঁকে ‘চিকিত্সা করান না’ জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন, ‘না! সাফারিং-এর মধ্যে একটা গ্রাঞ্জর আছে।’ একই বিষয়ে তিনি অন্য এক জনকে বলেছিলেন, ‘ছেলেপুলে নেই তো, বৃদ্ধ বয়সে কিছু নিয়ে তো একটা থাকতে হবে! তাই এই শ্বাসকষ্টকে নিয়েই আছি।’ ১৯৭৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাজরা রোডের ওই বাড়িতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আপাদমস্তক প্রচারবিমুখ কমলকুমারের মৃত্যু হয়। নিঃসন্তান কমলকুমার রেখে গিয়েছিলেন স্ত্রী দয়াময়ী-সহ তাঁর অসংখ্য অনুরাগীকে।

স্মৃতিচারণ
দয়াময়ী মজুমদার (স্ত্রী)
ব্যক্তি কমলকুমার ঘোরতর সংসারী ছিলেন। ভালর ভাল, কিন্তু রেগে গেলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতেন। গুরুপাক রান্না খেতে খুব ভালবাসতেন। নিজেও অপূর্ব রান্না করতেন। দেশি হোক বা মোগলাই, সবেতেই তাঁর রান্নার হাত ছিল অসামান্য। তবে কম খেতেন। বাড়িতে যত ক্ষণ থাকতেন, শুধুই লেখাপড়া নয়তো ছবি আঁকা। বিয়ের আগে শুনেছি খুব সাহেবি কেতায় চলতেন। তবে আমি তাঁকে সারা জীবন পাজামা-পাঞ্জাবিতেই দেখেছি। ঘরে আগে লুঙ্গি পরতেন। আমি সেটা ছাড়িয়ে পাজামা ধরাই। আর বাইরে গেলে, ধুতি-পাঞ্জাবি।
শেষের দিকে বলতেন, ‘আমার কিছু হল না। বুঝলে, ত্যাগ না করলে কিছু হয়ও না।’ আমি বলতাম, ‘ত্যাগ! সে আর তুমি করলে কোথায়! যা ত্যাগ করার সে তো আমি-ই করলাম।’
এক বার দুবরাজপুর থেকে ঘুরে এসে আমার ভ্রমণ কাহিনি লেখার খুব ইচ্ছে হল। লিখেওছিলাম কিছুটা। ওঁকে সে কথা বলায় বললেন, ‘লেখার দরকার নেই। লোকে তো আর বুঝবে না তুমি লিখেছ! বলবে, বাজার ধরতে কমলকুমার এ বার বৌ-এর নামে লিখছে।’
নিজের সম্পর্কে ভীষণই প্রচার বিমুখ ছিলেন। তাঁকে নিয়ে খুব হইচই হোক এটা তিনি চাইতেন না।


সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (অভিনেতা ও পত্রিকা সম্পাদক)
‘এক্ষণ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা তখন প্রস্তুতির মুখে। পত্রিকা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে প্রায়ই আলোচনা করতাম। লেখক তালিকা কী হবে সে প্রসঙ্গে মানিকদা এক দিন বললেন, ‘তোমরা কমলকুমার মজুমদারের লেখা চাও না?’ আমি তখন কমলকুমারের লেখার সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নই। ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তাঁর ‘কয়েদখানা’ গল্পটি পড়েছি শুধু। আমি কমলকুমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় মানিকদা বলেছিলেন, এখনও কানে বাজে, ‘কমলকুমার নোজ অল দ্য আর্টস!’ মানিকদা যাঁর সম্পর্কে এমন কথা বলেন, তিনি আসলে কোন মাত্রায় বাধা, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি সে দিন। এর পর কমলকুমার তাঁর ‘গোলাপ সুন্দরী’ আমাদের প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন। সেই শুরু। এর পর কলেজ স্ট্রিটে, সুবর্ণরেখার দফতরে তাঁর সঙ্গে বহু কথা হয়েছে। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ পড়ার পর মুগ্ধ হয়েছিলাম এমন, এখনও তার রেশ আছে।
তাঁর নাটক দেখতে আরম্ভ করলাম। ‘হযবরল’ নাটকে কাকেশ্বর কুচকুচের হাঁটাচলা, তিড়িংবিড়িং করে লাফানো দেখে বোঝা গিয়েছিল, প্রাণিজগৎ সম্পর্কে কী পর্যবেক্ষণ ছিল কমলকুমারের। ‘আলমগীর’ নাটকেও তিনি অনবদ্য কাজ করেছিলেন। নাটকটা শুরু হয়েছিল মুঘল মিনিয়েচরের কতকগুলি স্থিরচিত্র দিয়ে। অভিনেতারা ছবির ফ্রেমে সেখানে চিত্রার্পিত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরদা সরতেই আমরা দেখতে পাই। এর পর সেই ছবি থেকে চরিত্রেরা বেরিয়ে এসে প্রাণ পেয়ে যেন অভিনয় শুরু করেন।
অভিনেতা রবি ঘোষ ও আমাকে নিয়ে কমলবাবু একটা দল করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিছু দিন গিয়েওছিলাম। কিন্তু শেষমেশ উনি বললেন, ‘তোমরা অত মুজরো খাটলে বাবু, থিয়েটার করা চলবে না।’ রবি ও আমি তখন সাধারণ রঙ্গালয় নিয়ে ভীষণই ব্যস্ত। সে প্রসঙ্গেই উনি কথাটা বলেছিলেন।
সাহিত্যিক হিসাবে ওঁর গুণপনার কথা আজ সবাই জানেন। বাংলা ভাষায় আজ পর্যন্ত কমলকুমারের মতো এক্সপেরিমেন্ট কেউ করেননি। অসম্ভব ভাল ছবি আঁকতেন। আর অত উঁচু দরের ছবি আঁকিয়ে আমি খুব কমই দেখেছি।


গৌতম ঘোষ (চলচ্চিত্র পরিচালক)
১৯৮৭ সালে আমি যখন কমলকুমারের উপন্যাস ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নিয়ে চলচ্চিত্র করব বলে ঘোষণা করি, অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘পার’-এর মতো এমন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ছবি করার পর কেন ঊনবিংশ শতাব্দিতে ফিরে যাচ্ছি? ১৮২৯ সালে সতীদাহ প্রথা আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে সংস্কার, কুসংস্কার, দ্বেষ, ভালবাসা, হিংসা সবেরই বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। এই সব চরিত্র উপন্যাসে রয়েছে। যে সময়ে ছবিটা করব ভাবছি, তখন খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই পণ না দেওয়ার কারণে বধূ পোড়ানোর সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তাই আমার মনে হয়েছিল, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় সতীদাহের প্রেক্ষাপটটি তখনও খুব প্রাসঙ্গিক। কমলকুমারের লেখাকে সিনেমায় কোনও ভাবেই অনুবাদ করা যায় না। তাই আমার কাছে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ছিল একটা সিনেম্যাটিক চ্যালেঞ্জ। মানিকদা শুনে বলেছিলেন, ‘তোমার তো খুব সাহস। কমলকুমারের লেখা নিয়ে ছবি করছ! ভাল করে করো।’ সাহিত্যের সঙ্গে চলচ্চিত্রের চিত্রকল্পের বিস্তর ফারাক। কিন্তু কমলদার লেখায় এতগুলি স্তর থাকে, সেটাই ফিল্মের ভাষায় বলার চেষ্টা করেছি। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র তখন সম্পাদনার কাজ চলছে। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭। রাজস্থানে রূপ কানোয়ার স্বেচ্ছায় সতী হলেন। আমি তো অবাক! তখন সবে নন্দন হয়েছে। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র একটা বিশেষ শো-এর আয়োজন করা হয়। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, অসিত সেন-সহ খ্যাতনামা সাংবাদিক ও বিদ্বজ্জনেরা এসেছিলেন। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবিটা আটকে দিল। রূপ কানোয়ারের ঘটনার পর এমন একটা সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে বোর্ড উদ্বীগ্ন হয়েই আটকে দেয় ছবিটি। সত্যজিৎ রায় প্রথম খবরটা দিয়েছিলেন আমাকে। কিন্তু এ ঘটনায় কলকাতার বিদ্বজ্জনেরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। সংবাদপত্রে প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা বেরোয়। আসলে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ নিয়ে তখন সবার মনেই একটা উত্তেজনা। যদিও এর মাসখানেকের মধ্যেই একটু ‘রিভাইজ’ করে ছবিটা মুক্তি পায়। আমার সত্যিই দুর্ভাগ্য কমলদা ছবিটা দেখে যেতে পারেননি। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ রিলিজ করার পর সুবর্ণরেখার ইন্দ্রনাথ মজুমদার মজা করে আমায় বলেছিলেন, “তুমি একটা কাজের কাজ করেছ গৌতম। আমাকে আবার ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে হচ্ছে।” ‘ফৌজি বন্দুক’ এবং ‘কয়েদখানা’ কমলদার এই দু’টি লেখা আমি স্ক্রিপ্ট করেছি। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ছবি দু’টো এখনও বানাতে পারিনি।
শতবর্ষে তাঁকে নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত।


অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত (কবি)
ব্যক্তি কমলকুমারকে আবিষ্কার করার সুযোগ আমার প্রথম ঘটেছিল রিখিয়ায়। তখন ছিল সাঁওতাল পরগনা, এখন রিখিয়া ঝাড়খণ্ডের মধ্যে পড়ে। সেই সান্নিধ্যের পটভূমি ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা, যার অভিঘাত কলকাতাতে এসে পড়েছিল। জাপানিরা বোমা ফেলতে পারে, এই আশঙ্কায় আমার বাবা, মাকে ও আমাকে রিখিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার ঠাকুরদাদা প্রধান শিক্ষক হিসাবে অবসর নেওয়ার পর সেখানেই থাকতেন। আপৎকালীন সেই অবস্থায় স্বভূমি ছেড়ে যাওয়ার একটা আবহাওয়া চারদিকে। যুদ্ধের সেই পর্বে অনেক বঙ্গবাসী তখন সাঁওতাল পরগনায় পুনর্বাসনের স্বপ্নে মিলিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে একটি শহুরে পরিবার, যার প্রত্যেক সদস্যই শিল্পী নীরদ মজুমদার, কমল মজুমদার, শানু লাহিড়ী (মজুমদার) সমবায়ী শিল্পের গরজে এঁরা সেই অনাহুত প্রাণপল্লিতে নান্দনিক এষণায় মেতে উঠেছিলেন। আমার মা নীহারিকা দাশগুপ্ত ছিলেন এঁদের সর্বজনীন মামণি। কমলদারও। মা নজরুলের ছাত্রী ছিলেন।
সেই সুবাদে রিখিয়ায় কমলদাকে খুব কাছ থেকে দেখবার অকুল অবকাশ আমার মিলেছিল। তাঁর স্টুডিও তখন সমগ্র নিস্বর্গ। কখনও তিনি অবন ঠাকুরের ভঙ্গিতে গাছগাছালি থেকে কাঠের টুকরো জড়ো করছেন, কখনও আঁকছেন, কখনও বা সাঁওতালদের সঙ্গে ওতপ্রোত মিশে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছ থেকে লোকগীতি সংগ্রহ করছেন। অনেকেরই ধারণা যে তিনি নব্য-হিন্দু সংস্কারকদের ভূমিকায় সারা জীবন বৃত থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আদি রচনার দু’লাইনের ভিতরে যে অবকাশ সেটা খনন করে নিলে বোঝা যায় যে, তাঁর মৌল প্রেরণা ছিল কৌমতা। অর্থাৎ এক ধরনের ‘এথনিসিটি’। একটু বিশদ করে বলতে গেলে বলা যায়, সাঁওতালদের জীবনযাপন এবং শিল্পায়নের এক একটি দৌল তিনি আহরণ করে নিচ্ছিলেন এবং বিশেষত তাঁদের গান তাঁকে মাতিয়ে রেখেছিল। সেই সব গানের মধ্যে উদযাপনের আড়ালে একটা মহৎ ট্র্যাজিক চেতনা লুকিয়ে ছিল হয়তো। আমার মনে হয় যে, কমলকুমারের সৃষ্টির অন্তঃশীল বিষাদান্ত চৈতন্য ওই ইভ্যাকুয়েশন বা পুনর্বাসনের পর্যায়ে সাঁওতালদের মধ্য থেকে পাওয়া। শানুদির অথবা মীরা মুখোপাধ্যায়ের ভাস্কর্যে যে দৃপ্ত জীবনবাদ মূর্ত হতে পেরেছিল, কমলকুমারের শব্দ বীক্ষায় সে রকম ঘটেনি। বরং সেখানে নিখিল মানুষের নিয়তিবাদ জায়মান ছিল। নির্মীয়মাণ সেই বোধ পরবর্তী কালে একটি অধ্যাত্ম বিষাদে অনূদিত হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
এর পর যখন কলকাতায় ফিরলেন, তখন থেকে তিনি পরিশীলিত নাগরিকতার প্রতিষ্ঠিত ঘরানা থেকে সরে এলেন। বস্তুত তাঁর চর্যা ও শিল্পে একটা দূরদেশি এক রাখাল ছেলের আলেখ্য আমাদের কাছে ধরা পড়ত। এই বিদ্রোহময়তা আমার সমকালে সুনীল-শক্তি তথা কৃত্তিবাসের মধ্যে প্রতিভাত হয়েছিল। কালক্রমে তাঁর অর্জিত প্রতিষ্ঠান বিমুখতা তাঁকেই করে তুলল অনাশ্রিতদের প্রতিষ্ঠান, এবং আশ্রয়স্থল।
আমি সেই কমলকুমারকেই নন্দিত করি যিনি আমৃত্যু স্ববিবেকে থেকে গিয়েছিলেন। আজকের তরুণ লেখকদের কাছে এই উৎকেন্দ্রীক সময়ে এইটাই হতে পারে মূল্যবোধের যথার্থ ঠিকানা।


আশিস চট্টোপাধ্যায় (নাট্য পরিচালক)
কমলকুমারের গদ্যের প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার একটা আগ্রহ ছিল। এক শিক্ষক দাদা একবার আমায় কমলকুমারের ‘মতিলাল পাদরী’ পড়তে দিয়েছিলেন। পড়ার পর আমার ভিতরে একটা ছবি জন্ম নেয়। আমি কালি-কলমে সেই ছবিটিকে এঁকে বইটির মলাটে প্রচ্ছদ হিসাবে ব্যবহার করে দাদাকে ফেরত দিয়েছিলাম।
আমি তখন থিয়েটারের কাজ করছি চুটিয়ে। গৌতম ঘোষের ছবি ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ দেখলাম। অনেক কৌতূহল ছিল, কমলকুমারের গদ্যকে আদৌ কি সেলুলয়েডে রূপান্তরিত করা যায়? কিন্তু ছবিটি দেখে মুগ্ধ হলাম। ফিল্ম ও থিয়েটারের আলাদা অথচ নিজস্ব ভাষা আছে। গৌতম যদি ফিল্মের ভাষায় তাঁকে পড়তে পারেন, তবে থিয়েটার কেন পারবে না? মাথার ভিতর পোকাটা নড়ে উঠল। এর পর ২০০৫ সালে হাচ-অডিয়ন নাট্য উৎসবে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র নাট্যরূপ প্রকল্প হিসাবে জমা দিলাম। প্রকল্প নিয়ে পরিচালকের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আমার উল্টো দিকে তখন মনোজ মিত্র-শমীক বন্দ্যোপাধ্যাযে়রা। মনোজবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটাই কেন করতে চাইছেন? পারবেন তো?’ আমার মাথায় তখনও ডিজাইনটা স্পষ্ট নয়, বললাম, ‘আমি আর যাই করি না কেন কমলকুমারের গদ্যের নির্যাস আমার থিয়েটারে ধরা পড়বে।’ তাঁরা আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন। আমার কাছে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। কমলকুমারকে থিয়েটারের ভাষায় ফুটিয়ে তোলা খুবই দুরূহ। কিন্তু অনেক যত্ন নিয়ে কাজটা করেছিলাম। একটু সংযোজনও করতে হয়েছিল আমাকে। তবে তাঁর চিত্রকল্প এবং ভাষার যাদু দু’টোই আমি দর্শকদের সামনে হাজির করতে পেরেছিলাম সম্ভবত। প্রথম অভিনয় শেষে আমার হাতে ফুল তুলে দিয়েছিলেন অভিনেত্রী কঙ্কণা সেনশর্মা। বলেছিলেন, ‘অসাধারণ!’ বহু দর্শক তাঁদের ভাল লাগা জানিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম এক্সপেরিমেন্টটা উতরে গিয়েছে। এ বছর কমলকুমারের জন্ম শতবর্ষ। এমন সর্ব অর্থে শিল্পী বোধহয় আর কারওকেই বলা যায় না। ইচ্ছে আছে তাঁর ‘মতিলাল পাদরী’ মঞ্চে উপস্থাপন করব।


ছন্দা বসু (দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও কমলকুমারের ছাত্রী)
আমি তখন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে পড়ি। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত কমলকুমার মজুমদার ছিলেন আমাদের শিল্প শিক্ষক। স্যর সব সময় পান খেতেন। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে স্কুলে আসতেন হাসিখুশি এই মানুষটি। তবে ক্লাসে ঢুকলেই এক্কেবারে সিরিয়াস। একটুও হাসতেন না তখন। ক্যালিগ্রাফি, ছাঁচে ফেলে প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তি গড়া, চামড়ার উপরে মোটিফ তৈরি করতে হয় কী ভাবে, সবই স্যর শিখিয়েছিলেন। আর ছিল নাটক। ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ করিয়েছিলেন শুধুমাত্র ছাত্রদের দিয়ে। স্ত্রী ভূমিকা বর্জিত বলে আমরা মেয়েরা তাতে অংশ নিতে পারিনি, কিন্তু নাটকের মহড়া থেকে অভিনয়, সবেতেই আমাদের চূড়ান্ত উৎসাহ ছিল। নাটকটি সাফল্য পেয়েছিল।
আমার ডাক নাম কিটি। কমলবাবু আমাকে ওই নামেই ডাকতেন। একটা ঘটনা মনে আছে এখনও। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণি। এক দিন তিনি স্কুলে আমায় ডেকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে চল।’ আমি তো বেজায় খুশি। স্যর সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন, সেই আনন্দে একেবারে মশগুল। বেঙ্গল ল্যাম্পের কাছাকাছি একটা বাড়িতে গেলাম আমরা। ওখানে আমার কণ্ঠস্বর রেকর্ডিং করলেন স্যর। ‘ভিরসা অ্যান্ড দ্য ম্যাজিক ডল’ নামের একটি তথ্যচিত্রে পুতুলের চরিত্রের ডাবিং আমায় দিয়ে করানো হয়েছিল। পরে এই তথ্যচিত্রটি কলকাতার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হয়। রেকর্ডিং শেষ হয় রাত আটটা নাগাদ। আমরা তখন থাকতাম যাদবপুরের শ্রীপুরে। বাড়িতে কেউ কিছু জানে না আমি কোথায় গিয়েছি। ষাটের দশকে তো আর টেলিফোনের এমন রমরমা ছিল না। তাই খবর দেওয়া হয়নি। আর স্যরের সঙ্গে আছি বলে নিশ্চিন্তেই ছিলাম। রাতে স্যরের সঙ্গে বাড়ি ফিরতেই মা তাঁকে ভীষণ বকেছিলেন, আমার এখনও স্যরের কাচুমাচু মুখটা মনে পড়ে। তখন বুঝতাম না স্যর কত্ত বড় লেখক ছিলেন! ওই ডাবিং-এর জন্য স্যর আমায় খুব সুন্দর একটা কলম দিয়েছিলেন।


শুভ মুখোপাধ্যায় (প্রাক্তন শিক্ষক ও কমলকুমারের সহযোগী নাট্যশিল্পী)
সহকর্মী হিসাবে কখনও কমলদাকে দেখিনি। ব্যক্তিগত সম্পর্কটাই বেশি গাঢ় ছিল ওঁর সঙ্গে। তিনি কখনও স্টাফরুমে বসতেন না। সমসাময়িক সবাই— উৎপল দত্ত, বরুণ চন্দ, শেখর চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ স্টাফরুমে বসতেন। কিন্তু কমলদা হয় সিঁড়িতে ছাত্রছাত্রী পরিবৃত হয়ে বসে থাকতেন অথবা লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করতেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের গল্পে মাতিয়ে রাখতেন। এখনও স্কুলের লাইব্রেরিতে বেশ কিছু বইতে কমলদার ‘নোট’ লেখা দেখতে পাওয়া যাবে।
ওঁর সঙ্গে কখনও কারও বিবাদ দেখিনি। খুব একটা কাছেও ঘেঁষতে দিতেন না। নিতান্ত যাঁরা নাছোড়বান্দা তাঁরা ছাড়া প্রায় সকলকেই উনি একটু দূরে রাখতেন। মনে আছে, স্কুলে কমলদা মাঝেমাঝেই একটা কৌটো থেকে কিছু নিয়ে খেতেন। সবাই জানত ওটা আফিম। এক দিন বললাম, ‘ওটা কী কমলদা?’ উনি বললেন, ‘আফিম।’ আমি বললাম, ‘দিন তো দেখি খেয়ে কেমন নেশা হয়!’ কিছুতেই দেবেন না, শেষমেশ বললেন, ‘তুমি তো আচ্ছা নাছোড়বান্দা! শোনো, এটা মশলা। আমার অত পয়সা নেই যে, রোজ রোজ লোককে খাওয়াবো। কাউকে বলবে না।’ আমায় দিয়েছিলেন সেই মশলা, এখনও তার স্বাদ আমার মুখে লেগে আছে।
ছাত্রদের ক্রাফ্ট-এর কাজ শেখাতেন। এমনও দেখেছি, সেলাইয়ের ক্লাস ছেড়ে ছাত্রীরা তাঁর ক্লাসে এসে বসছে। কাগজ, চামড়া, ক্যালিগ্রাফি, প্লাস্টার অফ প্যারিস এ সবেরই কাজ শেখাতেন তিনি। সাধারণত কমলদা ছাত্রদের বকাবকি করতেন না। কেউ খুব বদমায়েশি করলে, তিনি প্রথমে বলতেন, ‘আমাকে বাধ্য করো না, কোনও খারাপ কাজ করতে।’ তার পরও কিছু করলে তিনি সেই ছাত্রটিকে ডেকে একটা চড় মারতেন। ছাত্রদের কাছে এই চড় খাওয়া ছিল খুবই মজার। কেন না, যে ছাত্র যে দিন চড় খাবে সে দিন গড়িয়াহাটের কোয়ালিটিতে তার জন্য বরাদ্দ ছিল অফুরন্ত আইসক্রিম। শেষে উনি চড় মারা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এত চড় মারলে আমার মাইনের টাকা সব ফতুর হয়ে যাবে।’
কমলকুমারের ছাত্ররা সারা বিশ্বে এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাঁরা কমলদা সম্পর্কে এখনও যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।


অনিরুদ্ধ লাহিড়ী (প্রাক্তন শিক্ষক এবং প্রাবন্ধিক)
পরিচিত মহলে কমলকুমার তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সুভাষিতাবলির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। অধিকাংশ সময়ে সেগুলো হত চিত্রল। শুনে, দর্শকের ভূমিকায় উত্তীর্ণ শ্রোতারা তাকিয়ে যেন চোখে দেখে বুঝতে পারতেন বক্তব্য; ধ্যান ধারণাগুলো বিমূর্ত হলেও বোধগম্য হত সহজেই। এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক একটি খুচরো সদুক্তি দিয়ে শুরু করা যাক।
পত্রিকা থেকে নির্দেশ এল যাতে এই রচনাটির সঙ্গে আমার শ্রীমুখের ছবিও একটি তৈরি থাকে। জানতে চাইলাম যে রকম স্থির চিত্রকে কমলবাবু দু’কান দেখানো, সে রকম কি? জানানো হল, হ্যাঁ। দু’কান দেখানো ছবি নয়— মদীয় মুখাবয়ব নিয়ে কী এত আলোচনা?— কথা হচ্ছে কমলকুমারকে নিয়ে। তাঁর চরিত্র বৈশিষ্ট্যের গুরুত্বপূর্ণ দু-একটিকে যতটুকু যা বুঝেছি, রচনার পরিসর তো ছোট, সে সব আঁকড়েই, ব্যক্তিত্বের প্রকাশভঙ্গিকে সাহিত্য-আদর্শের সঙ্গে জুড়ে, বোঝার উদ্যোগ নিতে হচ্ছে।
দু’কান দেখানোর অমৃতবাণীটি ওখানেই শেষ নয় কিন্তু। ‘আর দেখো অনিরুদ্ধ’ কমলবাবু উবাচ, ‘কী রকম আশ্চর্যের ব্যাপার— কান-কাটাদেরও কান দেখা যায় ওসব ছবিতে।’ ছবিয়ালাদের চিত্র কৌশলে এই অঘটন ঘটন পটুত্বে বেশ বিস্মিতই যেন দেখাল ওঁকে। মর্মাহতও কি?
আলগা মজা করার মতো পল্লবগ্রাহী ব্যাপার নয়, ছবি ফুটিয়ে কথা বলার ধরনটির মূল কিন্তু তাঁর ব্যক্তি-চরিত্র এবং সেই সুবাদে সাহিত্য ও শিল্প-সংবিদের গভীরে প্রোথিত। এ জন্য প্রাথমিক ভাবে যা দরকার তা হল দেখবার চোখ, শোনবার কানও আবার একই সঙ্গে। ইন্দ্রিয় বলতে চোখ ও কানকে এ ভাবে জুড়ে যদি এগোনো সম্ভব হয়, কমলকুমারের ক্ষেত্রে যা সবিশেষ সত্যি, ইন্দ্রিয়গ্রামের সার্বিক তত্পরতায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে প্রত্যক্ষণের শক্তিসত্তা। গপ্পোগাছার চালেই যে হেতু আলাপচারিতা চলছে, গল্পেই থাকা যাক না হয়!
বছর চল্লিশ আগেকার কথা, আড্ডা চলছে সন্দীপনের সঙ্গে। সন্দীপন বলতে চটি ফটফট চ্যাটার্জিদের একজনা। কী একটা সূত্রে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’-র কথা উঠেছে। জানতে পারলাম কার সঙ্গে যেন একযোগে উপন্যাসটিকে চিত্রনাট্যে রূপায়িত করায় উদ্যোগী হয়েছিলেন এক সময়ে। অমৃতোপম যখন, শ্রীভাষ্যই শোনানো যাক সাধ্যমতো।
‘চিত্রনাট্য লিকব কী, ভাই, লেকাই তো আচে দেকলাম। ক্যামেরার চোক দিয়ে দেকেই তো উপন্যাসটি বুনেচেন কমলদা। আগাগোড়া লং শট, ক্লোজ আপ— স-ও-ব! অর্দশিকিও সে ভাব আমাকে, টের কি পাই না? তা বলে ঘটে বুদ্দি যে কম নেই, মানবে নিশ্চয়?’ মানতে বাধ্য হয়েছিলাম। মুখ ফুটে যা বলিনি, পরচিত্তের অন্ধকারে ডুব দিয়ে তা টের তো পেয়েছিলেন মহাপুরুষটি।
সন্দীপন নয়, হচ্ছে কমলবাবুর কথা। চোখ তো নয় শুধু, কানও একই সঙ্গে। ভাষা ব্যবহারের সাহসিকতার দিকে অভ্রান্ত মনোযোগের সাক্ষ্য ভিন্ন ভিন্ন গল্পে বলা যায় উত্কীর্ণ থেকে গিয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। তার সঙ্গে জুড়ছেন সাহিত্যবস্তু নির্বাচনে স্রোতের বিপরীতে হাঁটবার সাহসিকতা, ভাষা নিয়ে ক্লান্তিহীন পরীক্ষণের নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি, দূরে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে মনোনীত পাঠক-পাঠিকার জন্য অপেক্ষা করবার অবিচল অভিমানী জেদ। সাহিত্য নিয়ে তিনি কী করেছেন তাকে তাই ভেবে দেখতে বাধ্য হই মানুষটি কী রকম ছিলেন, শেষ বিচারে, সে বিবেচনার বিনীত আলোকে।


ঋণ: কমলকুমার সৃষ্টি বৈচিত্রের খোঁজে, সম্পাদনা, শুভ মুখোপাধ্যায়
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.