বৃষ্টির জলে থইথই, পায়ের
গোড়ায় ল্যাটা মাছের ছোটাছুটি

অভিনেতা ও নাট্য-নির্দেশক
খুব ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এখনও খুব মনে পড়ে। স্মৃতিও বলতে পারেন। আমি স্কুলের ব্যাগ নিয়ে ফুটপাথের এক ধার দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি। মা দরজার গোড়ায় তখনও দাঁড়িয়ে। মোড় ঘুরলেই আমার স্কুল ঋষি জগদীশ। আমি তখন ইনফ্যান্টে। ওয়ানের আগের ক্লাস। মোড় পর্যন্ত মা আমাকে দেখতে পেত। স্কুলে ঢুকেই একটি মেয়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া হয়েছিল। ক্লাসের বেঞ্চে বসা নিয়েই ঝগড়া। রেগে গিয়ে সেই মেয়েটির চুল ধরে টেনেছিলাম। সে কী কাণ্ড! বিনুনি সুদ্ধ চলে এসেছিল আমার হাতে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছিলাম। চুলের গোড়ায় যে ফলস লাগানো যায়, জানতাম না।

কলকাতার কিছু কিছু এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটু পর্যন্ত জল দাঁড়িয়ে যায়। এই ছবিটা আগে যা ছিল, এখনও তা আছে। মানিকতলার রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিটে তখন অবশ্য আরও বেশি জল জমত। কখনও কখনও কোমর ছাপিয়ে যেত বড়দেরও। মনে আছে তেমন এক বৃষ্টির সময় মা চৌকিতে উনুন তুলে পরোটা ভাজছে। আমরা বসে আছি খাব বলে। মেঝেতে থই থই এক হাঁটু জল। পায়ের গোড়ায় ল্যাটা মাছের ছোটাছুটি। ঘরের বাইরে কেউ কেউ গামছা পেতে মাছ ধরতেও বসে গিয়েছে। এক দিকে এমন দুর্দশা, অন্য দিকে টাটকা মজা। কিন্তু বাড়ির বাইরে বেরোনো বারণ। অবশ্য এর পরেই আমরা চলে এসেছিলাম মামারবাড়ি থাকতে, পাইকপাড়ায়।
বাবার ছিল বদলির চাকরি। মাকে ও ভাইদের সঙ্গে নিয়ে তিনি উত্তরবঙ্গে চলে গেলেন। আমি পড়ে রইলাম কলকাতায়। সেই সময় পাইকপাড়ার রাজা মণীন্দ্র রোড পাকা হয়নি। পেছনের ধান কলের মাঠে বিশাল জঙ্গল আর বড় বড় বিষাক্ত সাপ। তাই গামবুট পরে ঢুকত কর্পোরেশনের লোক। ওখান থেকে দমদম স্টেশন দেখা যেত। রাতে শেয়াল ডাকত। পুজোয় হত যাত্রা। স্থানীয় দড়ির কলের মালিক বোধ হয় এই বিনোদনের পয়সা জোগাতেন। তিনি বসতেন সোফাতে, আমরা মাটিতে। পর পর চার দিন। একাদশী থেকে লক্ষ্মী পুজো। ওখানেই দেখেছি ‘সোনাই দীঘি’, ‘বাঙালি’, ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ ইত্যাদি। পাড়ায় মাঝেমধ্যেই চৌকি পেতে মঞ্চ বাঁধা হত। সেখানে পাড়ার দাদারা গান গাইতেন, কবিতা পড়তেন। দিদিরা নাচতেন। আর হত নাটক। সে নাটকে পাড়ার বড়রা অভিনয় করতেন। শুধু ‘ফিমেল আর্টিস্ট’ আসত বাইরে থেকে। আর ছিল পাড়ায় পাড়ায় চাইল্ড অর্গানাইজেশন— সব পেয়েছির আসর, মণিমেলা, জাতীয় ক্রীড়া শক্তি সংঘ ইত্যাদি। যেখানে পাড়ার ছোটরা বিকেলে জড়ো হত। শিখত ড্রিল, প্যারেড, ব্রতচারী নৃত্য সঙ্গে গান, নাচ অভিনয় ইত্যাদি। এতে শরীর যেমন তৈরি হত, মনটাও সজীব থাকত। শৃঙ্খলাবোধ, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা— এ সব শিক্ষা এখান থেকে পাওয়া যেত। দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধও জাগিয়ে তোলা হত এই সব সংস্থার কর্মসূচিতে— যেমন, স্বাধীনতা দিবস, নেতাজির জন্মদিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস ইত্যাদি উদযাপন মারফত। শোভাযাত্রাও বের হত। ছোটরাই ব্যান্ড বাজাত, বাঁশি বাজাত, লেজিম ও ডাম্বল নিয়ে শামিল হত। কালক্রমে এই সব সংস্থার ট্রেনার হয়ে উঠত ছোটরা। একটু বড় হয়ে যেমন আমি হয়েছিলাম। ছোট বয়সে আমরা একটু ভীতু প্রকৃতিরই ছিলাম। পাড়ার ল্যাম্পপোস্টে সন্ধের আগেই আলো জ্বালিয়ে যেত কর্পোরেশনের লোকেরা। অফিস ফেরত পাড়ার যে কোনও বয়স্ক মানুষ খেলায় মত্ত আমাদের সেই লাইটের দিকে আঙুল তুলে দেখাতেন অর্থাৎ সন্ধে হয়ে গিয়েছে। আমরাও বিনা প্রতিবাদে সুড়সুড় করে যে যার বাড়ি ফিরে যেতাম। মনে আছে, এক বার ছুটিতে বাবা কলকাতায় এসেছেন। দোলের দিন। বাবা বসে তাস খেলছেন সবার সঙ্গে। আমি রং মেখে ভূত। বাবা একটা পাঁউরুটি আনতে বললেন দোকান থেকে। বড় রাস্তায় রং মেখে গেলে পুলিশ ধরবে এই ভয়ে আমি কিছুতেই যাব না। বাবা রেগে গিয়ে আমার পিঠে একটা চড় মেরে বললেন, “ভীতু ছেলে কোথাকার।” বাবার হাতে সেই প্রথম আর শেষ চড় খাওয়া। অনেক দিন আগেই বাবা চলে গিয়েছেন। হারিয়ে গিয়েছে কলকাতা, সেই পাড়া, সেই ছোটবেলা, সেই মণিমেলা, সেই যাত্রা দেখা। রাস্তার আলো জ্বললে সুড়সুড় করে বাড়ি ফেরা।

কেমন যেন সব কিছুই বদলে গেল। হারিয়ে গেল। কিন্তু মন থেকে মুছল না কিছুই।
 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.