নীলিমায় উদ্ভাসিত রবীন্দ্র গান
তখনও আম্রকুঞ্জে বসন্তোত্সব হয়। সে বারের অনুষ্ঠানে খুব ভিড় হয়েছিল। বাঁধানো বেদীতে বসে মেয়েরা সবাই গান গাইছে। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কিছু বহিরাগত ছেলে একেবারে মঞ্চের কাছাকাছি চলে এসে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছিল। আবির ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল মেয়েদের দিকে। তিনি ছিলেন মেয়েদের পিছন দিকেই। হঠাত্ কোথা থেকে একটা আমগাছের ছোট ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে রীতিমতো ছেলেদের দিকে এগিয়ে গেলেন ধমক দিতে দিতে। নরম ও উদাসীন মনের মানুষটির এমন রণমূর্তি দেখে তো সবাই অবাক! মিত ও মিষ্টভাষী সেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নীলিমা সেন এ বার অতীতের তাঁরায়।
“বাচ্চু গান গাইতে বসলে ও নিজেই একটা গান হয়ে যেত!” সুচিত্রা মিত্র বাচ্চু সম্বোধনে যাঁর গান গাওয়া নিয়ে এমন ঐশ্বরিক আবেশের কথা বলেছেন তিনি শান্তিনিকেতনের আনন্দ পাঠশালা থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন অতি প্রিয় ‘বাচ্চুদি’। ৬ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রথম যাওয়া। সেখানকার পাঠভবনে পড়ার সময় নাচ, গান ও খেলায় সকলের নজর কেড়ে নেওয়া মেয়েটিই ভবিষ্যতের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী নীলিমা সেন। তবে আজীবন তাঁর ‘বাচ্চু’ নামটি কাছের মানুষদের আন্তরিক স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়নি মোটেই। সে নামেই তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন রবীন্দ্র মহলে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নাটকের হাতেখড়ি হয়েছিল নীলিমার। ‘ডাকঘর’-এ অমলের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিলেন গুরুদেব নীলিমাকে। তিনি নিজে ঠাকুরদার চরিত্রে অভিনয় করবেন। এমনই কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কবি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা আর মঞ্চস্থ হয়নি। তবে নাটক না হোক, রবীন্দ্র গান নিয়ে বাচ্চুর বহমান সঙ্গীত-জীবন ছিল বর্ণময়। ১৯৪১-এ অসুস্থ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হচ্ছে শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে। মায়ের কাছে প্রথম শেখা গান, ‘কী গাব আমি কী শোনাব’র ‘দ্বিধা’ কাটিয়ে বালিকা নীলিমা সেখানে গাইল ‘গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝেরবেলায় এলে’। সেটাই ছিল কবির বেঁচে থাকাকালীন শেষ জন্মদিনের উত্সব।


ছোটবেলা ও শান্তিনিকেতন
ললিতমোহন গুপ্ত ও পঙ্কজিনীদেবীর মেয়ে নীলিমার জন্ম ১৯২৮ সালের ২৮ এপ্রিল। কলকাতা শহরে জন্ম হলেও তাঁর ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে যায় কবিগুরুর স্বপ্নস্থান শান্তিনিকেতন। সে জায়গা নীলিমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তাঁর অনুভূতিমাখা কথায়, “তখন এত ছোট যে কোনও কিছু অনুভব করার ক্ষমতাই জন্মায়নি। তবু এইটুকুর জন্য ভগবানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে আমার চেতনার জাগরণ হয়েছে শান্তিনিকেতনের মুক্ত প্রকৃতির পটভূমিকায়। যে দিকে দু’চোখ যেত দেখতাম সবুজ গাছপালা, নীল আকাশ, নানা রঙের ফুল, কৃষ্ণচূড়া, বেল, যূঁই, লালমাটি সব মিলিয়ে একটা স্বপ্নময়তা। অথচ এই স্বপ্নের দেশই আমাদের প্রতিদিনের জীবনের একাধারে আশ্রয়, কর্মক্ষেত্র— ধ্যানধ্যারণার পীঠস্থান সবই। যে সব বিষয় নিয়ে মানুষ কাব্য করে, যে সব বস্তুকে মানুষ অবাস্তব বলে মনে করে, আমাদের জীবনে সে সব ছিল অতিবাস্তব, অতি-স্বাভাবিক।” শান্তিনিকেতনে নীলিমা সেন থাকতেন পূর্বপল্লির সোনাঝুরিতে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সে বাড়ির ছিল অবারিত দ্বার। তাঁর ছাত্রী রেজওয়ানা যেমন মনে করতে পারেন, “বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীরা বিদেশ থেকে শান্তিনিকেতন গিয়ে থাকার জায়গার সমস্যায় পড়তেন। তবে সমস্যা না মিটে যাওয়া পর্যন্ত বাচ্চুদির বাড়িই হয়ে উঠত তাঁদের সাময়িক ঠিকানা। তিনিও আপনজনের মতোই শেষ পর্যন্ত তাঁদের পাশে থাকতেন।”

সঙ্গীতময় নীলিমা
ছোটবেলা থেকেই নীলিমার গীতবিতান থেকে গান মুখস্থ করার অভ্যেস ছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে পাঠভবন থেকে সঙ্গীতভবনে গেলেন। ওখানে চার বছরের কোর্স সম্পূর্ণ করে আবার পাঠভবনে ফেরা। সেখান থেকেই ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিক, তার পর একে একে আইএ ও বিএ পাশ করেন। ম্যাট্রিক দেওয়ার দু’বছর আগে অর্থাত্ ১৯৪৪-এ তাঁর প্রথম রেকর্ড— ভারত কোম্পানি থেকে ‘বুঝি বেলা বয়ে যায়’ এবং ‘আমার দোসর যে জন ওগো তারে কে জানে’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে ১৯৭২ সালে প্রথমে লেকচারার-এর পদে নিযুক্ত হন, ক্রমে সেখানেই বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যক্ষ হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ তে সঙ্গীতভবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন নীলিমা সেন।

গান শিখেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, ইন্দিরা দেবীচৌধুরানি (বিবিদি), কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (মোহরদি), ইন্দুলেখা ঘোষ ও অমিতা ঠাকুরের কাছে। অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এস্রাজ, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভিভি ওয়াঝেলওয়ারের কাছে শিখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নীলিমার সঙ্গে এস্রাজ বাজিয়েছেন শান্তিদেব ঘোষ ও অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সুরঙ্গমা’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। অল্প কয়েকদিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নীলিমা যুক্ত ছিলেন। শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁকে প্রথম নিয়ে যান আকাশবাণীতে। কলকাতার আকাশবাণীতে নীলিমা সেন সঙ্গীতশিক্ষার আসরও করেছেন। দুঃখের এবং বিষাদের গানে তাঁর কণ্ঠ ছিল অতুলনীয়। মজার কথা, দীর্ঘ দিন ‘বড় বিস্ময় লাগে’ গানটি বাচ্চুদির গান বলেই জানত আশ্রমের ছেলেমেয়েরা।

পরিণীতা নীলিমা
১৯৫০ সালে শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক ও রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিয়কুমার সেনের সঙ্গে নীলিমা গুপ্তের বিবাহ হয়। তাঁদের কন্যার নাম নীলাঞ্জনা। বিয়ের পরের বছরই স্বামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান নীলিমা। সেখানে নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোশ্যাল সায়েন্স ও রেড ক্রস আয়োজিত ফাস্ট এইড-এ সার্টিফিকেট পান। ভয়েস অফ আমেরিকা ও বিবিসি থেকে তখন সঙ্গীত সম্প্রচার হত। বিদেশে স্বামী অমিয়কুমার সেনের অনুরোধে ‘এসো শরতের অমল মহিমা’ সুরপ্রধান গানটি গেয়ে শুধু আমেরিকা নয়, লন্ডন, ফ্রান্স, জার্মানির বহু শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছিলেন। অমিয়বাবু বুঝেছিলেন বিদেশে ছন্দের দোলা প্রতিনিয়ত। তাই ওখানে ছন্দের গানের থেকে সুরপ্রধান গান মানুষের মন ছুঁয়ে যাবে বেশি। ঘটলও তাই। পরে নীলিমা সেন স্বামীর সঙ্গে যৌথ ভাবে লেখেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ ‘সুরের গুরু’।

নীলিমা কণ্ঠে রবীন্দ্র গান
রবীন্দ্রনাথের গানের একনিষ্ঠ পূজারী ছিলেন নীলিমা। ১৯৪৪-এ প্রথম রেকর্ডের পর ১৯৪৭-এ কলম্বিয়া থেকে তাঁর গান ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ ও ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে’ প্রকাশ পায়। এর পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে ‘গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে’ ও ‘বাজাও রে মোহন বাঁশি’। মে মাসে ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে কে যায়’ ও ‘না বলে যায় পাছে সে’। সেপ্টেম্বরে ‘ওই শুনি যেন চরণধ্বনি রে’ ও ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে’— মোট ৬টি গান বের হয়। প্রথম যুগে তাঁর জনপ্রিয় রবীন্দ্র গান— ‘শ্যামল ছায়া নাই বা গেলে’ ও ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, সেটা ১৯৫০ সাল। শৈলজারঞ্জনের তত্ত্বাবধানে মেগাফোন, হিন্দুস্থান, এইচএমভি থেকেও রেকর্ড বের হতে থাকে।

শান্তিনিকেতনের সাহিত্যসভায় ‘অন্ধজনে দেহো আলো’, ‘আমার যা আছে আমি সকল দিতে পারিনি’, গানগুলি গাওয়ার পরে শ্রীআবু সৈয়দ আয়ুবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তাঁর সঙ্গীতজীবনে প্রেরণা জুগিয়েছে। আবু সৈয়দ আয়ুব তাঁর বিখ্যাত ‘রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান’ প্রবন্ধের শিরোনামে ‘কল্যাণীয়া নীলিমা সেন’কে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন।

গাঁধীজি তখন শেষ বারের মতো শান্তিনিকেতনে এসেছেন। কবিগুরু এক বার যে গানটি শুনিয়ে গাঁধিজীর অনশন ভাঙিয়েছিলেন নীলিমা তাঁকে শোনালেন সেই গান— ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’।

রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে দেশে বিদেশে
প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পুনর্মিলন উত্সবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছবির আবরণ উন্মোচনের জন্য নীলিমা সেন, আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদার-সহ অনেকে আমন্ত্রিত। অনুষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেখানে দ্বৈত কণ্ঠে নীলিমা সেন ও তাঁর শৈলজাদা গেয়েছিলেন ‘তুমি কি কেবলই ছবি’।

আবার, শুভ গুহঠাকুরতা তখন ‘দক্ষিণী’ প্রতিষ্ঠার পরে ফান্ড করার জন্য টাকা তুলছেন। আর সে উদ্দেশ্যেই নিউ এম্পায়ারে ‘মায়ার খেলা’ নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিলেন তিনি। অমলের চরিত্রে যাঁকে ভেবেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সেই নীলিমাই এ বার তাতে অমরের চরিত্রে অভিনয় করলেন।

১৯৬১ সালে রেঙ্গুন সরকারের আয়োজনে কন্যা নীলাঞ্জনা ও শৈলজদা-সহ নীলিমা ও শান্তিনিকেতনের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী ওখানে ‘চিত্রাঙ্গদা’ পরিবেশন করেন। ১৯৭৪-এ বাংলাদেশে ‘সৎ সঙ্গীত প্রসার সমিতি’র আয়োজনে পরিবারের সকলে ও শৈলজারঞ্জন বাংলাদেশে যান। এর প্রায় দশ বছর পর ১৯৮৪ সালে ফের বাংলাদেশ গিয়েছিলেন নীলিমা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারে প্রধান অতিথি হয়ে। সেখানকার রবীন্দ্রমেলাতে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ ও সঙ্গীত’ বিষয়ে পেপারও পড়েছিলেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মশতবর্ষে বিশ্বভারতীর একটি প্রতিনিধিমূলক সাংস্কৃতিক দলের নেত্রী হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর, জাকার্তা-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় নানা অনুষ্ঠান করেন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের আমন্ত্রণে ‘ছায়ানট’ আয়োজিত একটি কর্মশালায় যোগ দিতে যাওয়া ছিল তাঁর কাছে এক অনন্য অনুভূতি। সে কথা শিল্পী নিজেই জানিয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ মহলে।

শেষের সে দিন
শান্তিনিকেতনে সেই সময় মাছ পাওয়া যেত না। কখনও কখনও বোলপুরের হাট থেকে কিনে আনতে হত। প্রচণ্ড গরমের দুপুরে গুরুপল্লির লালমাটির রাস্তায় দেখা যেত রোগা একটি বালিকা একপাল কুকুর-বিড়াল সঙ্গী করে চলেছে। খোঁজ চলত কারওর বাড়িতে মাছ রান্না হলে তার কাঁটাগুলো ওদের খাওয়াবে। এমনই অপরিমেয় মমতা নীলিমার আমৃত্যু ছিল। ১৯৯৫ সালের ১৩ মে রবীন্দ্রসদনে তাঁর পরিচালনায় ‘চিত্রাঙ্গদা’ নীলিমার শেষ অনুষ্ঠান। কেন না ঠিক তার পরের বছর অর্থাত্ ১৯৯৬ সালের ২৮ জুন নীলিমা সেন তাঁর চিরপরিচিত রবীন্দ্রজগত্ ছেড়ে চলে যাবেন অমৃতলোকের আহ্বানে।

স্মৃতিচারণ
নীলাঞ্জনা সেন (কন্যা ও সঙ্গীতশিল্পী)
সংসারকে অবহেলা করে মাকে কখনও গান গাইতে দেখিনি অথচ গানই ছিল মায়ের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। আমার বাবা মায়ের বিবাহবন্ধনের প্রকৃত সূত্রটি ছিল আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত। মায়ের গলায় যে গান বাবা এক বার শুনেছেন, সে গান অন্য কারও গলায় তাঁর পছন্দ হত না। তাঁর রবীন্দ্রসাহিত্য বিষয়ক কোনও বক্তৃতা মায়ের গান ছাড়া বাবা মনে করতেন রসোত্তীর্ণ হল না। আমার ছোটবেলায় অনেক দিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখেছি— প্রায়ান্ধকার ঘরে মা বাবাকে তাঁর প্রিয় কোনও গান শোনাচ্ছেন।

কলকাতায় লেকভিউ রোডের বাড়িতে বিশাল যৌথ পরিবারে মাকে দেখেছি ছোট বউ হিসেবে আমার জ্যেঠিমার সঙ্গে সংসারের সমস্ত কাজ ভাগ করে নিতে। এ সবের মধ্যে শনি রবিবার ছিল ‘সুরঙ্গমা’য় গান শেখানো আর নানা অনুষ্ঠান। মাঝে মাঝে আসতেন শৈলজাদাদু, মাকে অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ কোনও গান শেখাতে।

নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন মা। পৌষ মাসের ৭ তারিখে ভোর বেলায় এক কড়াই চিড়ের পোলাও বানিয়ে, টি-পটে চা রেখে গান গাইতে যেতেন মা। ঠাকুমার বিশেষ পুজোর দিনে নানা রকম ভোগ রান্নাও করে দিতেন তিনি; নিজে কিন্তু পুজো করতেন না কখনও। রবীন্দ্রসঙ্গীতই ছিল মায়ের পুজো।

আমার সব ফ্রক ছোটবেলায় মা নিজে সেলাই করতেন। খুব ভাল বাটিকের কাজ করতেন তিনি। সামান্য সামান্য সব জিনিস দিয়ে খুব সুন্দর করে ঘর সাজাতেন। পূর্বপল্লীতে আমাদের বাড়ির বাগানের পরিকল্পনা ছিল তাঁরই।


দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় (সঙ্গীতশিল্পী)
শান্তিনিকেতনে গেলে দেখা করতাম। আশ্চর্য লাগে ওই রকম মাপের এক জন শিল্পী কী ভাবে প্রচারের আড়ালে থেকে গেলেন! আসলে বরাবরই নীলিমা সেন ছিলেন প্রচারবিমুখ। সেই সময়ে আশ্রমে তিন কন্যা কণিকা-সুচিত্রা-নীলিমা গড়ে উঠছিলেন। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিরাট জায়গা জুড়ে। অথচ অমন গায়কী! আমার বেশ মনে পড়ছে এক বার শান্তিনিকেতনে ‘কালমৃগয়া’য় আমি অন্ধমুনির চরিত্রে গান গেয়েছিলাম। ওঁর তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। রবীন্দ্রসদন কমিটিতে ছিলেন নীলিমা সেন। তাই এখানেও দেখা হত। অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন। সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন একশো ভাগ খাঁটি। এক বার আসানসোলের দিকে আমরা একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি; সেখানে ওঁর সঙ্গে হারমোনিয়াম বাজানোর মতো কেউ ছিলেন না। আমি বাজিয়েছিলাম। আজ মনে হয় আমি ধন্য!


সুপূর্ণা ঠাকুর (সঙ্গীতশিল্পী)
নীলিমা সেনকে ছোটবেলা থেকে বাচ্চুদি বলেই জানি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা ও আমাদের চার ভাইবোনকে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। আমরা উত্তরায়ণে থাকতাম। পড়তাম পাঠভবনে। এক দিন আমার ভাই সুপ্রিয়র খুব জ্বর হয়েছে। ও বায়না ধরল বাচ্চুদির গান শুনবে। মা লোক দিয়ে বাচ্চুদিকে ডেকে পাঠালেন। উনি এসে গান শোনালেন। এমনই ছিল আমাদের পারিবারিক হৃদ্যতা। আমাদের পরিবারেই থাকতেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরানি। সুতরাং একটা সাঙ্গীতিক পরিবেশ সব সময়ই থাকত। আমার স্বামী সুভাষ চৌধুরী সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান ‘ইন্দিরা’র জন্য কলকাতায় যখনই ডেকেছেন উনি তখনই গান গেয়ে এসেছেন। মনে আছে, নিউ এম্পায়ারে ক্ষিতিমোহন সেনের ছেলে ক্ষেমেন্দ্রনাথ সেনের পরিচালনায় ‘মায়ার খেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অমরের চরিত্রে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমোদা বাচ্চুদি ও আমি শান্তার চরিত্রে গান গেয়েছিলাম। বাচ্চুদি অসাধারণ পূজা পর্যায়ের গান করতেন।


পূর্বা দাম (সঙ্গীতশিল্পী)
আমি সুচিত্রাদির ছাত্রী ছিলাম বটে, কিন্তু যখনই কোনও দরকারে নীলিমা সেনের কাছে ছুটে গিয়েছি শান্তিনিকেতনে, বিমুখ করেননি কখনও। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন সকলের। স্নেহপ্রবণ, মিষ্ট ও মিতভাষী মানুষটি আমাকে খুব ভালবাসতেন। শুধু একা নন, ওঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই খুব আপনার ছিলেন। আমার মেয়ে তখন খুবই ছোট। শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম, সে কি ব্যস্ততা তাঁর! নিজের হাতে দুধ গরম করে দেওয়া, বাচ্চাকে দেখাশোনা করা, ভাবলেই অবাক লাগে! ওই রকম বড় একজন শিল্পী, শত কাজ ফেলে আমাদের যে ভাবে সময় দিয়েছিলেন কোনও দিন ভুলব না। এক জন সঙ্গীতশিল্পীর গানের কথা তো অনেকেই বলেন কিন্তু একবারে ঘরোয়া কথাগুলোও একটু বলা দরকার।


চিত্রলেখা চৌধুরী (সঙ্গীতশিল্পী)
তখন শান্তিনিকেতনে প্রিন্সিপাল ছিলেন শৈলজদা। ওঁর পরিচালনায় সব অনুষ্ঠান হত। একক গানের মধ্যে মোহরদি, বাচ্চুদি ও আমার একটা গান থাকতই। তখনই দেখেছি বাচ্চুদি শান্ত, ধীর, স্থির, নম্র এক মানুষ। গান যখন গাইতেন তখন একবারে ডুবে যেতেন। বেশির ভাগ পূজা পর্যায়ের গান গাইতেন। ওঁর গান পরিবেশন যেন দেবতার পায়ে ফুল নিবেদন। গুরুপল্লিতে আমার মা, মোহরদি, বাচ্চুদিরা খড়ের চালের মাটির বাড়িতে বড় হয়েছেন। সেই সময় জীবনযাত্রা খুব সাধারণ ছিল, তাতে সরলতার ছাপ স্পষ্ট। সুতরাং সেই কম কথা বলার মানুষটিকে নিয়ে কোনও গল্পকথা নেই। তবে ওঁকে নিয়ে বলতে গেলে ওঁর স্বামী অমিয়দাকে বাদ দিলে চলবে না। একবার নববর্ষের সন্ধ্যায় ‘প্রখর তপন তাপে’ গানটি গেয়ে নেমে এসেছি। অমিয়দা আমাদের পড়াতেন। এক ছুটে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। এতটাই প্রাণচঞ্চল ছিলেন। পাশাপাশি, অত্যন্ত স্নেহময়ী বাচ্চুদির মধ্যে ওই উচ্ছ্বাস দেখিনি।


রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা (সঙ্গীতশিল্পী)
১৯৭৫ সালে ছাত্রী হিসাবে বাংলাদেশ থেকে শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে প্রথমবর্ষে ভর্তি হলাম। তখন তিন দিন করে মোহরদি ও বাচ্চুদি ক্লাস নিতেন। আর উত্সব, অনুষ্ঠান ও মন্দিরের গান তৈরি করানোর দায়িত্ব ছিল বাচ্চুদির। শান্তিনিকেতনে আমার প্রথম বা দ্বিতীয় দিনেই বাচ্চুদির সঙ্গে পরিচয় হয়। আমি তখন সদ্য বাড়ি ছেড়ে এত দূরে পড়তে গিয়েছি। কাজেই খুব নিঃসঙ্গ এবং মন খারাপ লাগত। ক্লাসের সবাই এক দিন হাঁটতে হাঁটতে পূর্বপল্লির সোনাঝুরিতে ওঁর বাড়ি গেলাম, বিকেলবেলা। খুব যত্ন করে বসালেন, চা খাওয়ালেন, গল্প করলেন— সে দিন ব্যক্তি নীলিমা সেনের স্নেহময় মনের পরিচয় পেয়েছিলাম।

বহু বছর পর আবার শান্তিনিকেতনে গান শিখতে গেলাম ১৯৯১ সালে। দুপুরে খাওয়ার পরে সারা আশ্রম যখন অলস বিশ্রামে মগ্ন, আমি মোহরদির বাড়ি থেকে সাইকেল চালিয়ে দুপুরের একাকী নির্জনতাকে মনে মেখে পূর্বপল্লিতে বাচ্চুদির বাড়ি পৌঁছতাম। বাচ্চুদি হয়তো খেয়ে উঠে সবে তখন বিশ্রাম নিচ্ছেন, কিন্তু আমি গিয়ে জানালায় টোকা দিতেই— ‘কে?’ বলে উঠে এসে দরজা খুলে দিয়ে আবার বিছানায় যেতেন। আমিও পিছন পিছন যেতাম। আধশোয়া হয়ে আধো ঘুমে, একটু আধটু গল্পে আর বৈকালিক চায়ের সঙ্গে চলত আমার গান শেখা।

অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল বাচ্চুদির। শৈলজাদা, বিবিদি বা ইন্দুদির কাছে উনি যে সব গান শিখেছেন— সেগুলি শেখাবার সময় স্মরণশক্তিই ছিল ওঁর একমাত্র ভরসা। অনেক গানই শেখাবার সময় বলে দিতেন, “এগুলো কিন্তু স্বরলিপির সঙ্গে মিলবে না। শৈলজাদা এ রকম শিখিয়েছেন।” বা “বিবিদি এ রকম করিয়েছেন।” ক্লাসেও সাধারণত কোনও স্বরলিপির বই বা হারমোনিয়াম তানপুরার প্রয়োজন হত না বাচ্চুদির।


প্রমিতা মল্লিক (সঙ্গীতশিল্পী)
নীলিমা সেন আমার অতি প্রিয় ‘বাচ্চুমাসি’। পিসির বন্ধু ছিলেন, সর্বোপরি তিনি আমাদের পরিবারের এক পরম আত্মীয়। আমাদের বাড়ি কিংবা ওঁর বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে আমরা উভয়েই নিমন্ত্রিত হতাম। আমি যখন শান্তিনিকেতনে পাঠভবনের ছাত্রী তখন ওঁর স্বামী অমিয়কুমার সেন আমাদের পড়াতেন। আমি অমিয়বাবুকে দাদা বলতাম কিন্তু বাচ্চুমাসিকে ওই নামেই ডাকতাম।

নানা গান শেখানোর আবদার নিয়ে যখন গিয়েছি শত ব্যস্ততার মধ্যেও কখনও কোনও দিন নিরাশ করেননি বাচ্চুমাসি। ‘কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও’, ‘লক্ষ্মী যখন আসবে’-সহ বহু জনপ্রিয় গান শিখেছি। এক বার আমি ঠিক বর্ষামঙ্গলের আগের দিন শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। উনি খুব যত্ন নিয়ে আমাকে ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গানটি গলায় বসিয়ে পরের দিন অনুষ্ঠানে গাইয়েছিলেন। খুব ভাল নাচতেন ও নাটক করতেন বাচ্চুমাসি। ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ নাটকটি আমাদের দিয়ে করিয়েছিলেন। আমরা যখন গান শিখতে যেতাম তখন শরবতের সঙ্গে কিছু না কিছু খাবার খেতে দিতেন। সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও রকম বাহুল্য পছন্দ করতেন না। সে শিক্ষা পেয়েছি আমিও।

দুঃখের গান গাইবার যোগ্যতম মানুষ ছিলেন তিনি। ‘দুঃখরাতে, হে নাথ, কে ডাকিলে,’, ‘আজ কিছুতেই যায় না, যায় না, যায় না মনের ভার’ ইত্যাদি গান আমার মনে আজও বাজে।

তথ্য ও সাক্ষাৎকার: পাপিয়া মিত্র
সুপূর্ণা ঠাকুরের ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
নিজস্ব চিত্র
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.