চারটে অক্ষরে নাম তার কলকাতা— অথচ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এত জাদু!
যদিও সেই জোব চার্নকের কলকাতা আজ ফেসবুক ট্যুইটারের কলকাতা, বিগ বাজার আর মাল্টিপ্লেক্সের কলকাতা। তবুও তার সেই গভীরতা, সেই ব্যাপকতা, সেই রোমান্টিকতা একটুও বদলায়নি। আমার মনে হয়, কলকাতায় থাকাকালীন এই অনুভূতি যতটা না কাজ করে, কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে গেলে তা বোধহয় এক অন্য মাত্রা পায়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।
কৈশোর এবং যৌবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে কলকাতায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি সেই সত্তরের দশকে যখন স্বামী এবং শিশু সন্তানদের হাত ধরে, চারটে সুটকেসে সমস্ত জীবনটাকে পুরে দু’চোখে উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে কলকাতা ছেড়েছিলাম, তখন কিন্তু ভাবিনি যে কলকাতা আমার রক্তে, আমার শিরায়-উপশিরায়, আমার চেতনায়, আমার অনুভূতিতে এমন করে মিশে আছে। আমেরিকায় আসার পর যখন সব কিছু দেখেই অবাক হতে শুরু করলাম, তখন থেকেই আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল একটা ব্যথা। যত দিন কাটতে লাগল তত সে ব্যথা বাড়তে থাকল। পয়সা জমিয়ে জমিয়ে টাকা হলেই প্লেনের টিকিট কেটে ছুটে আসতে শুরু করলাম কলকাতায়— আমার প্রাণের শহরে। কলকাতার রাস্তা, রাস্তার ভিড়, গড়িয়াহাটের মোড়— আলোয় ভরা দোকানবাজার, কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানের সেই গন্ধ, কফি হাউসের স্বপ্নিল ধোঁয়া, শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়, সারপেন্টাইন লেনের সেই সরু লম্বা গলি, যেখানে মানুষ আর গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে না— সব যে আমার এত নিজের, এত কাছের তা আগে এমন করে উপলব্ধি করিনি! এ এক অদ্ভুত অনুভূতি!
আমার কলকাতার একই অঙ্গে নানা রূপ। বাবাকে হারিয়ে আবার গেলাম কলকাতায়। যখন শ্বশুরবাড়ির অন্ধকার ছাদে আমি একেবারে একা, তখন কলকাতার তারা ভরা আকাশ পরম বন্ধুর মতো আমাকে বুকে টেনে নিয়ে নিয়েছিল, যেন এক অপার শান্তির আশ্রয়। কলকাতার সেই আকাশে দেখেছিলাম বাবার দু’চোখ! সে রাতে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম, নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের আলোর রোশনাই চোখ ধাঁধাতে পারে, কিন্তু তারা ভরা কলকাতার আকাশ আমাকে যে আশ্রয় দিয়েছিল তা কখনই দিতে পারে না।
সম্পূর্ণ অন্য এক অনুভূতি হয়েছিল এক বার। ধোঁয়াশা ঢাকা সে দিনের সন্ধেবেলায় কলকাতার ফুটপাতের এক ফুলওয়ালার কাছ থেকে বেল ফুলের মালা কিনে খোঁপায় লাগিয়েছিলাম। তখন সেই শহরই যেন হয়ে উঠেছিল আমার স্বপ্নের প্রেমিক। বিদেশে অনেক নামী-দামি বিদেশি ফুলের গন্ধ মাখা ফুলসাজ কোনওদিন আমার হৃদয় আপ্লুত করেনি সেই প্রেমে যা প্রেমিক কলকাতা বার বার দিয়েছে আমায়।
শহরের নানা রূপের প্রত্যেকটিই কলকাতাকে দিয়েছে এক বিরল স্বকীয়তা। আর সব থেকে আশ্চর্য, একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আমরা নিজের নিজের জায়গা থেকে অনুভব করি কলকাতাকে, সেই একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলিই মিলেমিশে একাকার হয়ে কখন কী ভাবে যে পরিণত হয় বিনিসুতোয় গাঁথা এক মালায়! নানা রঙের সমাহার সেই মালায়। সেখানেই বোধ হয় লুকিয়ে আছে এ শহরের ব্যাপকতা, কলকাতার গভীরতা। কবে কোন ছোটবেলায় ফুটপাতে শোনা কোন এক মায়ের গাওয়া ঘুমপাড়ানি গানের সুর আজও আমাকে বার বার ফিরিয়ে নিয়ে আসে এই শহরে। সেই ফুটপাতের জায়গায় আজ হয়তো তৈরি হয়েছে বিশাল ফ্ল্যাট বাড়ি বা শপিং মল— কিন্তু শুনশান মাঘের রাত্তিরের কুড়ি, পঁচিশ বা চল্লিশ বছর আগের সেই গানের সুরের অনুরনণ আমার বুকের গভীরে যে অনুভূতি জাগায় তারই আর এক নাম বোধ হয় ‘কলকাতা’! আজ থেকে আরও কুড়ি, তিরিশ বা চল্লিশ বছর পরে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অনাগত সন্তানেরাও ঠিক এমন করেই তাদের ফেসবুক-ট্যুইটার বা আরও কত্ত নতুন টেকনোলজি ভরা কলকাতার অনুভূতির কথা এমনি করেই বলবে তাদের উত্তরসূরিদের কাছে।
চুম্বক যখন লোহাকে কাছে টানে তখন সে বিচার করে না যে সেটি ভাঙা এক টুকরো লোহা না একটি পুরনো মরচে ধরা পেরেক। কলকাতার আকর্ষণী শক্তিরও নেই কোনও বাছবিচার। আপনি, আমি, আমরা— আমাদের সকলের সব চেতনা একাত্ম হয়ে মিশে যায় কলকাতার সঙ্গে।
আমার কাছে কলকাতা শুধু প্রাণের শহর, অনুভূতির শহর, প্রেমের শহরই নয়— আশার শহর, উত্তরণের শহরও। প্রত্যেক ভোরে কলকাতায় যে নতুন সূর্য ওঠে, সে নতুন আশা, নতুন আলো জাগায় প্রত্যেক হৃদয়ের গভীরে, অন্তরের অন্তঃস্থলে। সে আশার ব্যঞ্জনা একমাত্র তারাই বুঝতে পারবেন যারা জীবনের কোনও এক মুহূর্তে একাত্ম হয়েছেন কলকাতার সঙ্গে।
বহু বছর আগে আমেরিকা থেকে আমার প্রাণের শহর কলকাতায় এসে অনুভূতি প্রকাশ করেছিলাম কয়েকটা লাইনে। এ লেখা শেষ করব সেই লাইন ক’টি দিয়ে—
ধুলো বালি ঝুল কালি কাদা আর জঞ্জাল
ফুটপাতে রাঁধা ভাত, বনধ আর হরতাল।
আলু মূলো কচু ঘেঁচু চুনোমাছ অম্বল
ছেঁড়া কাঁথা ভাঙা শিল হাঁড়িকুঁড়ি সম্বল।
পাঁজরায় ঘেরা মা’র দুধহীন বুক
লিকলিকে রোগা শিশু ক্ষুধাতুর মুখ।
ফুটপাতে মাঝ রাত কোলে মরা ছেলে
মা ভাবে রাতটুকু পার হয়ে গেলে
ঠিক হয়ে যাবে সব, ঘুচে যাবে ব্যথা
ফুটপাতে আশা জাগে, জাগে কলকাতা।
লেখাই নেশা। পেশায় অ্যাকাউন্ট্যান্ট— নিউ ইয়র্কে মার্কিন সরকারের পরিবেশ বিষয়ক দফতরের অডিটর। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ ও সিটি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্কের প্রাক্তনী।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.