সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে, কলকাতার বুকের উপর বাংলার নিজস্ব শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে ভারতীয় শিল্পের নানা নিদর্শনসমৃদ্ধ সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছিল গত শতকের গোড়াতেই। কিন্তু বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মূল পরিচিতি গ্রন্থাগার হিসেবে, তাই রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো প্রত্নতত্ত্ব-অনুরাগী মানুষের অবর্তমানে সে সংগ্রহশালা পরবর্তী কালে খুব বেশি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার সুযোগ পায়নি। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের আর্থিক আনুকূল্যে পরিষৎ সংগ্রহশালা নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু তার মূল সংগ্রহের চরিত্র নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকের মধ্যেই, আধুনিক সংযোজন শুধু লোকায়ত শিল্পের নিদর্শনগুলি। অন্য দিকে এই শহরে ১৮১৪ থেকেই রয়েছে ভারতীয় সংগ্রহালয়, এশিয়াটিক সোসাইটির ছত্রছায়ায় যার বীজ রোপিত হয়েছিল। সরকারি এই সংগ্রহশালার বিপুল, বিচিত্র সংগ্রহে বাংলার শিল্পকলার আলাদা করে গুরুত্ব পাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। অর্থাৎ অভাব একটা থেকেই যাচ্ছিল। এ দিকে ১৯০৬-১৯১৪ এবং ১৯২১-১৯২৩ যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, সেই ‘বাংলার বাঘ’ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই ভারতশিল্প ও প্রত্নতত্ত্ব সহ ভারতবিদ্যার চর্চা শুরু হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর নামেই, ভারতের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহশালা (সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত) স্থাপিত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সালটা ১৯৩৭। আশুতোষ মিউজিয়ম অব ইন্ডিয়ান আর্ট-এর উদ্দেশ্যই ছিল ভারতশিল্পের, বিশেষত পূর্ব ভারতীয় শিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন।
জায়গা বদলাতে হয়েছে সংগ্রহশালাকে...
প্রাচীন সেনেট হলে
শতবার্ষিকী ভবনে
১৪ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে
সূচনা হয়েছিল মাত্র পাঁচটি নমুনা দিয়ে। সংগ্রহশালার প্রথম কিউরেটর দেবপ্রসাদ ঘোষের বিপুল উদ্যমে, বহু জনের নিঃস্বার্থ পরিশ্রমে ও দানে তিন দশকের মধ্যে সংগ্রহ দাঁড়ায় ২৫ হাজারে। আজ তার পরিমাণ ৩০ হাজারেরও বেশি। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, টেরাকোটা, পাথর ও ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য, চিত্রকলা, মুদ্রা, কাঠখোদাই, বস্ত্রশিল্প ও লোকায়ত শিল্পের নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে উপমহাদেশের নানা প্রান্ত থেকে। আশুতোষ সংগ্রহশালার গুরুত্ব লোকায়ত শিল্প, বাংলার টেরাকোটা এবং পূর্ব ভারতীয় ভাস্কর্যকলার নিদর্শনে। আজ তার অবস্থান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে শতবার্ষিকী ভবনের পিছন দিকে একতলা এবং দোতলায়। তবে প্রথম থেকে বেশ কয়েক বার জায়গা বদলাতে হয়েছে সংগ্রহশালাকে। শুরুতে প্রাচীন সেনেট হল-এর পিছনের অংশে ছিল এর অবস্থান। পরে ১৯৪২-এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় বোমা পড়ার ভয়ে স্থানান্তরযোগ্য নিদর্শনগুলি সরিয়ে দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদের ইমামবাড়ায়, ভারী পাথরের মূর্তিগুলি মাটির তলায় চাপা দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই। পাঁচ বছর পর সব কিছু স্বস্থানে ফিরে এলেও ১৯৬০-এ সেনেট হল ভেঙে নতুন ভবন তৈরির জন্য আবার ঠাঁইনাড়া হতে হয় সংগ্রহটিকে। ১৪ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিট আশুতোষ সংগ্রহশালার ঠিকানা হয় পরবর্তী সাত বছরের জন্য। সে বাড়িটিও কম দর্শনীয় ছিল না। ১৯৬৭-এ শতবার্ষিকী ভবনে ফিরে এল সংগ্রহ, তার পর থেকে তা সেখানেই। এখানেই পূর্ণ হল সংগ্রহশালার ৭৫ বছর। ইতিমধ্যে ১৯৫৯-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে মিউজিয়োলজি-র স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রম, যেখানে আশুতোষ সংগ্রহশালা হয়ে ওঠে ছাত্রছাত্রীদের ‘গবেষণাগার’। পরে এই পাঠ্যক্রম ডিগ্রিস্তরে উন্নীত হয়। বর্তমানে অবশ্য এর পঠনপাঠন স্থানান্তরিত হয়েছে জাতীয় গ্রন্থাগারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসে। আজও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়-সংগ্রহশালাগুলির মধ্যে আশুতোষ সংগ্রহশালা প্রথম সারিতে, জাতীয় স্তরেও তার গুরুত্ব স্বীকৃত।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেমন বহু নিদর্শন সংগৃহীত হয়েছে, তেমনই আশুতোষ সংগ্রহশালার সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও উৎখননে। ১৯২২-১৯২৩-এ, সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার আগেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের কারমাইকেল অধ্যাপক দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকরের নেতৃত্বে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রাজশাহি-র পাহাড়পুরে উৎখনন হয়। এই উৎখননে পাওয়া যায় সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসাবশেষ। বিহারের অন্তর্গত মন্দির থেকে পাওয়া খোদিত ইট এবং টেরাকোটা-ফলক সংগ্রহশালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগ্রহ।
১৯৩৭-এ, প্রতিষ্ঠার বছরেই দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে উৎখনন শুরু হয় সংগ্রহশালার তরফ থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সূর্যের মূর্তি
সংস্কৃতের অধ্যাপক কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামীর নেতৃত্বে উৎখনন চলে ১৯৩৮-১৯৪১ কালপর্বে। প্রাচীন মৃৎপাত্র, রৌপ্যমুদ্রা, টেরাকোটা ফলক, সিলমোহর, পুতি ইত্যাদি উদ্ধার হয় এই উৎখননে। ১৯৪৬-এ কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী বীরভূমের নানুর-এ চণ্ডীদাস ঢিবিতে উৎখনন চালান। ১৯৫৪-১৯৫৫-য় মেদিনীপুরের তিলদা-র চাঁদপুর ঢিবিতে উৎখনন করেন তিনিই। তবে আশুতোষ সংগ্রহশালার সব থেকে বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন বোধহয় উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপায়, চন্দ্রকেতুর গড় আর খনা-মিহিরের ঢিবিতে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত চলেছিল এই অনুসন্ধান। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ শতকের গোড়াতেই এই অঞ্চলের প্রাচীনত্ব ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, বস্তুত তাঁর সফর থেকে সংগৃহীত কিছু নিদর্শন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংগ্রহশালাতেও রক্ষিত আছে। কিন্তু আশুতোষ সংগ্রহশালা হাত দেওয়ার আগে সরকারি উদ্যোগ এ দিকে প্রসারিত হয়নি। এই উৎখনন থেকেই বাংলার ইতিহাসের গোড়ার দিক সম্পর্কে বহু অজানা তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এখান থেকে সংগৃহীত বিপুল নিদর্শন রক্ষিত আছে আশুতোষ সংগ্রহশালাতেই। চন্দ্রকেতুগড় থেকে পাওয়া একটি ছোট্ট বুদ্ধমূর্তিকেই বাংলায় পাওয়া সব থেকে পুরনো বুদ্ধমূর্তি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সব উৎখনন ছাড়া ভাগীরথী বদ্বীপের অনেকগুলি আদি-ঐতিহাসিক প্রত্নক্ষেত্রেও অনুসন্ধান চালানো হয়, যেমন হরিনারায়ণপুর, বোড়াল, আটঘরা, মাহিনগর ও হরিহরপুর (দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা), আর মেদিনীপুরের তমলুক ও পান্না।
পাথরের ভাস্কর্য সংগ্রহে আশুতোষ সংগ্রহশালার গুরুত্ব পরিস্ফুট বিশেষ কয়েকটি মূর্তিতে, পূর্ব ভারতীয় শিল্পকলার যে কোনও আলোচনায় যে সব মূর্তির কথা ঘুরেফিরে আসে। এর অন্যতম হল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাশীপুর থেকে পাওয়া কালো পাথরের একটি সপ্তাশ্ববাহিত সূর্যের
শিব-লোকেশ্বর
মূর্তি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূর্তিটি ষষ্ঠ বা সপ্তম শতকে নির্মিত, এবং গুপ্তযুগের শিল্পশৈলীর বিশিষ্ট নিদর্শন। এ ছাড়া নবম-দশম শতকের একটি নারীমূর্তির মুখ (পশ্চিম দিনাজপুরের অগ্রদিগুন থেকে পাওয়া), দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সরিষাদহের সুদর্শন চক্রের মধ্যে গরুড়ের উপর নৃত্যরত বিষ্ণুর মূর্তি রাজশাহি কলিগ্রামের কার্তিকের মূর্তি, ভাঙর থেকে পাওয়া মঞ্জুশ্রী, বরিশালের হবিবপুর থেকে পাওয়া ব্রোঞ্জের শিব-লোকেশ্বর ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ। তা ছাড়া দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাংলার শিল্পকলার অসাধারণ বহু নিদর্শন এখানে রক্ষিত আছে।
মূর্তির পাশাপাশি চিত্রিত পুথি ও পুথির পাটার সংগ্রহও খুবই উল্লেখযোগ্য। দ্বাদশ শতকে লেখা নেপালের একটি ‘পঞ্চরক্ষা’ পুথিতে বুদ্ধের জীবনকাহিনি অঙ্কিত রয়েছে আটটি চিত্রে। পালযুগের চিত্রকলার দুর্লভ নিদর্শনগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। পশ্চিম ভারতের জৈন চিত্রিত পুথিও এখানে আছে। মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে পাওয়া ‘রামচরিতমানস’-এর বিখ্যাত পুথিটি বিপুল চিত্রশোভিত।
পঞ্চরক্ষা
মূর্তির পাশাপাশি চিত্রিত পুথি ও পুথির পাটার সংগ্রহও খুবই উল্লেখযোগ্য
রামচরিতমানস
লোকশিল্পের সংগ্রহের ক্ষেত্রেও এই সংগ্রহশালার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। গুরুসদয় দত্ত যে পর্বে বঙ্গীয় লোকশিল্পের নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন, তার পর এই শিল্পধারার গতিপ্রকৃতি বুঝতে হলে আশুতোষ সংগ্রহ ছাড়া গত্যন্তর নেই। সব মিলিয়ে এই সংগ্রহশালা বাংলার অতীত ঐতিহ্যকে সযত্নে ধরে রেখেছে, প্রকাশ করেছে তার নানা বইপত্র ও পুস্তিকার মাধ্যমেও।
সংগ্রহশালার সৌজন্যে প্রাপ্ত ও নিজস্ব চিত্র।
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.