আমার সব প্রেম এই শহরকে ঘিরেই
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী
বালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছেই আমার মামারবাড়ি ছিল। অসংখ্য ট্রাম তখন আসত আর যেত। ভোর থেকে গভীর রাতের সেই টুংটাং শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। ট্রামে চড়তেও খুব ভালবাসতাম। কত দিন হয়েছে ট্রামে উঠে ধর্মতলা পৌঁছে আবার সেই ট্রামেই বালিগঞ্জ ডিপোয় ফিরে এসেছি। এই যাওয়া আসার পথে কত কী যে দেখতাম! মনে মনে খুব মজা হত! আর কত রকম হকার উঠত ট্রামে। লজেন্স থেকে শান্তিপুরের গামছা। এমন মজাতেই কেটেছে শৈশব। ওই ট্রাম ডিপোর পাশেই একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। প্রতিদিন খেলতে যেতাম। তখন খেলাতেও বেশ পারদর্শী ছিলাম। আর এখন? ট্রাম নেই, সেই শৈশবও নেই। আছে কত মধুর স্মৃতি।

স্মৃতি এখনও অনেক কথাই মনে করায়। আমার দিদি ইন্দ্রানী সেনের তখন বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক বিয়েটা তখনও কিছু দিন বাকি। কিন্তু ওরা দেখা করত নিয়মিত। দিদি ও জামাইবাবু লেকে বেড়াতে যেত। আর আমি ছিলাম দু’জনের সঙ্গী। আমাকে খুশি করার জন্য দিদি বাদাম ভাজা কিনে দিত। পরে বুঝেছি ওটা আসলে ‘ঘুষ’! আমি সঙ্গে থাকলে যে দিদি বাড়ি থেকে নিশ্চিন্তে বেরোতে পারত, তাই আমাকে সব সময় খুশি রাখত ওরা। অথচ দেখুন, আমি কোনও দিন প্রেম করতে পারিনি। আসলে আমি প্রেমে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমার বন্ধুরা যারা প্রেম করত, তাদের মধ্যস্থতা করতাম আমি। প্রথম পরিচয়, প্রেমের গভীরতা, ঝগড়া এমনকী বিয়ের পিঁড়িতে বসা অবধি সব কিছুতেই বন্ধুদের প্রিয় পাত্রী ছিলাম আমি। তবুও আমার জীবনে প্রেমের ছায়া পড়ল না কোনও? আমার বাবা খুব রসিক মানুষ ছিলেন। তিনি হেসে বলতেন, মোটা হওয়ার জন্যই তোমার প্রেম হচ্ছে না।

আসলে আমার প্রেম গড়িয়াহাটের মাছ-বাজারের সঙ্গে। আমি খুব খেতে ভালবাসি। নিজে বাজার করি। ওই মাছ-বাজারে গিয়ে ঘোরাঘুরি করি। মাছওয়ালারাও চেনেন। প্রায়ই পমফ্রেট ও তেলাপিয়া মাছ কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরি। এখনও কোনও কারণে কয়েক দিন না গেলেই মাছওয়ালারা অভিমান করে নানা কথা বলতে থাকেন। একটা সময় কে কত খেতে পারবে তা নিয়ে নানা প্রতিযোগিতা হত। অনেক প্রতিযোগিতায় নিজে গিয়ে নাম লিখিয়েছিলাম। এখন একটু লজ্জা লাগে! এক জায়গায় তো ইয়া সাইজের সতেরোটি রসোগোল্লা খেয়ে পুরস্কারের ঝুলি বাগিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।

এখন যেন শহরটা কেমন বদলে যাচ্ছে। অনেক কারণে দুঃখ পাই। হকার তুলে দেওয়ার পর মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। খুব ছোটবেলা থেকেই যেন ওই সব হকারদের সঙ্গে একটা আত্মিক টান গড়ে উঠেছিল। ভাল লাগত দরদাম করে জিনিস কিনতে। একশো টাকার জিনিস যখন ত্রিশ টাকায় কিনে বাড়ি ফিরতাম, মনে হত এটা আমাদের প্রিয় কলকাতা শহরেই সম্ভব।

কাজের ফাঁকে এখনও হেঁটে হেঁটে কত দূর চলে যাই। বিবেকানন্দ পার্কের ফুচকা খাই। আর কখনও বা বাটাটা-পুরি। খাওয়ার আগে বা পরে অনেক পরিচিত-অপরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আমার গানের সুবাদেই আমায় চেনেন তাঁরা। কত কৌতূহল তাঁদের মনে। ভাবি এই শহরের মানুষ শুধু দৌড়ে বেড়ায় না, সংস্কৃতির জগতেও তাদের কত অবাধ আনাগোনা। আমাদের মতো শিল্পীদের এটাই তো অনেক পাওয়া। এই শহর আমাকে অনেক দিয়েছে। গান গাইতাম। কিন্তু দিদি ইন্দ্রানীর মতো হতে পারব এটা কখনও ভাবিনি।

সময় পেলেই এন্টালিতে লোকনাথ বাবার মন্দিরে বা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের পুরনো ধর্মস্থানে চলে যাই। নিস্তব্ধ পরিবেশে আমি সেই দেবতাকে যেন খুঁজে পেতে চাই, যাঁকে দেখতে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর তাই তো পূজা পর্যায়ের গানগুলিতে আমার আবেগ অনেকটাই বেশি কাজ করে।

কলকাতা দ্রুত বদলে গেছে। এক সময় খুব অভিমান ছিল, একটু বৃষ্টি হলেই কেন এত জল জমে এই শহরে? এখনকার ছবিটা তো অনেক বদলে গেছে। এখন আর তাই কথায় কথায় অভিমান হয় না। কলকাতাকে ভালবেসে তাই উদার কণ্ঠে গেয়ে উঠি, ‘তুমি খুশি থাকো আমার প্রাণে চেয়ে চেয়ে’।
 
 

 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.