পার্সি হয়েও ভরপুর বাঙালি
‘‘জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শিল্প এবং সেই কারণেই সঙ্গীত চিরস্থায়ী। প্রকৃত শিল্পের কোনও মৃত্যু নেই এবং সেটা সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও সত্যি।’’ এই অসামান্য উক্তিটি করেছিলেন এক সঙ্গীত আয়োজক, পরিচালক ও বাদক। তাঁর নাম ভিয়েস্তাপ আর্দেশির বালসারা। শুধু বাঙালি নয়, সঙ্গীত-দুনিয়ার কাছে ভি বালসারা নামে পরিচিত সুরের এই নাবিকের জন্ম মুম্বইতে, ২২ জুন, ১৯২২। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ভি বালসারার সঙ্গীত শিক্ষা তাঁর মায়ের কাছে। মা লঘুসঙ্গীত গাইতেন। আর বাবার ছিল টিউটোরিয়াল স্কুল। সেখানে ফ্রেঞ্চ, পার্সি, জার্মান-সহ সায়েন্স ও মিউজিকের ক্লাস হত। এই স্কুলেই ভায়োলিন, ম্যান্ডোলিন, পিয়ানো শেখানোর জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক আসতেন। প্রত্যেক ক্লাসে ছেলেকে পাঠিয়ে দিতেন ভিয়েস্তাপের মা। ছোট্ট বালসারা সেখানে বসে বসে বাজনা শুনত। এ ভাবে শুনতে শুনতেই ইন্সট্রুমেন্টের প্রতি একটা অনুরাগ জন্মায়। আস্তে আস্তে বিভিন্ন রকমের গ্লাস, শিশি, পাথর, ঘণ্টা, সাইকেলের বেল, টাইপরাইটারে তাল রাখা থেকে শুরু করে চাবি আছে এমন যে কোনও বাজনায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন ভি বালসারা। ছ’ বছর বয়সে মঞ্চে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন ছোট্ট ভিয়েস্তাপ। তবে, প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজিয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে, সেটাও মঞ্চে। গানটি ছিল ‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে’। এই গানটি তাঁর অতি প্রিয় গান, তাই কোনও সম্মাননা পেলেই গানটি বাজাতেন। বালসারা পশ্চিমী সঙ্গীতে প্রভাবিত হয়েছিলেন ভীষণ ভাবে। জার্মানির সঙ্গীতবিশারদ হিলদাফিল্ডের কাছে শিখেছিলেন পিয়ানো বাদন।

পনেরো বছর বয়সে বাড়ি থেকে কাজের জন্য পালিয়ে গিয়েছিলেন পুণেতে। সারা দিন কাজের চেষ্টায় ঘোরাঘুরির পরে রাতে ঘুমোতেন রেলের প্লাটফর্মে। সেখান থেকে কখনও পুলিশ এসে তাড়িয়ে দিলে কার্কি স্টেশনের শেডে রাখা কোনও ট্রেনের কাঠের বেঞ্চই হয়ে উঠত সে রাতের আশ্রয়। হঠাত্, এক দিন সকালে মাথায় এল, স্টেশনের কাছে মিলিটারি ক্যাম্পে গেলে হয়তো কাজ পাওয়া যেতে পারে। ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করলেন। প্রত্যাশা মতো পেলেন ঘোড়াকে স্নান করানোর কাজ। কিন্তু এ সব বেশি দিন চলল না। ফের বাড়ি ফিরে গিয়ে পার্সি বিয়েবাড়িতে জ্যাজ সঙ্গীত বাজানো শুরু করলেন।

একত্রিশ বছর বয়সে কলকাতায় চলে এলেন ভিয়েস্তাপ বালসারা। মুম্বইতে যে সব শিল্পীর গান শুনে ‘ইন্সট্রুমেন্ট’ বাজাতেন, তাঁরা সকলেই কলকাতার শিল্পী। তখনকার দিনে ‘নিউ থিয়েটার্স’ ছিল শীর্ষস্থানে। আর এখানে সেই শিল্পীরাও ছিলেন উপরের সারিতে— পঙ্কজকুমার মল্লিক, যূথিকা রায়, কাননদেবী, সুরকার কমল দাশগুপ্ত। ১৯৫৩ সালে অনিল বিশ্বাস একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে কলকাতায় এনেছিলেন বালসারাজিকে। সে অনুষ্ঠানে এই শিল্পীরাও উপস্থিত ছিলেন। সবাইকে দেখে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলেন বালসারাজি। তার পরই তিনি কলকাতায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কলকাতায় আসার সময় তাঁর বন্ধুরা ‘উপদেশ’ দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যাচ্ছ যাও! ওখানে কিন্তু বাঙালিরা তোমাকে টিকতে দেবে না।’’ স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরে বালসারাজি জানিয়েছিলেন, ‘‘ঠিক আছে। টিকতে না দিলে চলে আসব। কিন্তু আমি যাব।’’

সময়টা ১৯৫৪। কলকাতায় এসে প্রথমে স্যুইন হো স্ট্রিটে থাকতেন তিনি। পরে ১৬ নম্বর অক্রূর দত্ত লেনের বাঁ-হাতি বাড়ির ছোট্ট ঘরটিই হয়ে উঠল এক সাধনার মন্দির। পিয়ানো ও বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে যিনি ছিলেন সেই মন্দিরের একাকী দেবতা, তিনিই মেলোডিকা ও ইউনিভক্সের উদ্ভাবক— ভি বালসারা। তাঁর আগে এই ঘরে থাকতেন আরও এক সুরের গুরু পঙ্কজকুমার মল্লিক। এই মন্দিরে প্রবেশ করে তিনি রোজ গাইতেন, ‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও’। আর রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে গাইতেন ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’। আরও এক সঙ্গীত প্রতিভায় বালসারাজি অনুরক্ত ছিলেন, তিনি সলিল চৌধুরী। প্রতি দিন একটি ছোট্ট রুমাল দিয়ে সলিল চৌধুরীর ফটো মুছে নিজের কপালে সেই রুমাল বুলিয়ে বলতেন, ‘‘তোমার সব গুণ আমায় দাও।’’ ঘনিষ্ঠ মহলে বালসারাজি সলিলবাবু সম্বন্ধে বলেছিলেন, এত বড় কম্পোজার আর হবে না। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রায় ৪৫ বছর ধরে চিনতেন বালসারাজি। ওঁর চারটে হিন্দি ভজনের সুর বালসারাজিকে করতে বলা হয়েছিল। প্রচলিত কথার সুর। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শিখিয়েছিলেন বালসারাজি। হিন্দি উচ্চারণ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না তার জন্য বার বার তিনি শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আসতেন।

ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রায় বাজাতে ঢুকেছেন ভি বালসারা। সেখানে তখন পিয়ানো বাজাতেন কুমুদ ভট্টাচার্য। উনি ‘‘বালসারা বাজাবে’’ বলে পিয়ানো ছেড়ে দিয়ে নিজে এসে বসলেন অর্গ্যানে। আর অর্গ্যানে যিনি ছিলেন তিনি গিয়ে বসলেন গিটারে। এ এক মস্ত বড় ‘স্যাক্রিফাইস’! ওঁরা জায়গা না ছেড়ে দিলে বালসারাজি তো ‘ইন্সট্রুমেন্ট’ টাচ করতেই পারতেন না! তবে ‘ইন্সট্রুমেন্ট জগত’-এ যাঁদের কাজ মুগ্ধ করেছিল বালসারাজিকে তাঁরা হলেন— কাজি অনিরুদ্ধ, সুজিত নাথ, বটুক নন্দী, রজত নন্দী ও অজিত ঘোষ।

রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি আকৃষ্ঠ হলেন কী ভাবে?

তখন সবে বাংলা পড়তে শিখেছেন বালসারাজি। কিন্তু মানে ভাল বুঝতে পারেন না। সে সময়ে বোম্বের (মুম্বই) এইচএমভি থেকে পঙ্কজবাবুর একটি রবি ঠাকুরের গানের হিন্দি রেকর্ড বেরিয়েছিল। এক পিঠে ছিল ‘প্রাণ চাহে নয়ন নে না চাহে’, অপর দিকে ছিল ‘ইয়াদ আয়ে কি না আয়ে তুমাহ রে’। এক ইতালিয়ান সঙ্গীত আয়োজক ‘সিম্ফনি’র মতো করে ‘অর্কেস্ট্রেশন’ করেছিলেন। সেই সুরেই প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলেন বালসারাজি। পরে জেনেছিলেন মূল রবীন্দ্রসঙ্গীত দু’টি— ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ আর ‘মনে রবে কি না রবে আমারে’।

রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার হল শুরু’ গানটি রেকর্ড করা হবে। বালসারাজিকে বাজাতে বলা হল। গানটি গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকর। বালসারাজি ‘প্রাণ চায় চক্ষু না চায়’ গানটির সুর-ছন্দ মনে রেখে সে ভাবেই বাজাচ্ছেন। বাজনা শুনেই হেমন্তবাবু ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘‘নোটেশনে যা লেখা রয়েছে সেই মতো বাজাও। এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। অন্য সুর বাজালে জেলে দেওয়া হবে।’’ সে দিন মনটা খুব ভেঙে গিয়েছিল, রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি বালসারাজির সমস্ত আকর্ষণ যেন চলে গিয়েছিল। ঠিক করেছিলেন আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে কাজ করবেন না কোনও দিন।

কিন্তু শেষমেশ আবার রবীন্দ্র সঙ্গীতে ফিরে আসতে হল তাঁকে। তখন তিনি ল্যান্সডাউন রোডে থাকেন। সেই বাড়ির উপর তলায় থাকতেন এক মরাঠি দম্পতি। তাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন শুনে বালসারাজি তো ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্টা করলেন। ওই দম্পতি তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করে বললেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের গান ভাল করে শুনুন, তার পর নোটেশন লিখুন।’’ তাঁদের কথা মতো ধীরে ধীরে বাজাতে শুরু করলেন বালসারাজি। তাঁর মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। আরও মন দিলেন। কিন্তু মন ভরছে না কিছুতেই। সব সময় মনে হচ্ছে, ‘সামথিং ইজ মিসিং’। তাঁর সঙ্গে যে সব বাদ্যযন্ত্রীরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। আস্তে আস্তে তিনি বাংলা ভাষাও পড়তে শিখলেন। তার পর থেকেই বালসারাজি হৃদয়ঙ্গম করলেন রবীন্দ্রনাথের কথা ও সুরের বাঁধনময় চলন। তাঁর বাজানো উল্লেখযোগ্য রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি— এসো এসো আমার ঘরে এসো, সর্ব খর্ব তারে দহে, মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়, খরবায়ু বয় বেগে, যদি তোর ডাক শুনে ইত্যাদি।

ভি বালসারার সঙ্গীত জীবন
হিন্দি ছবি
সঙ্গীত পরিচালনা
মুম্বই— পঞ্ছি, রংমহল, মদ্মস্ত, তালাশ (১৯৪৩-১৯৫৩)।
কলকাতা— চারদোস্ত, বিদ্যাপতি, প্যার, দেবঋষি নারদ (মুক্তি পায়নি), যোগি আউর জওয়ানি, মধুশ্রাবণী, জয়বাবা বৈদ্যনাথ (১৯৫৬-১৯৭৮)।
আবহ সঙ্গীত পরিচালনা— মুম্বই মজাক, জিনা শিকো, প্যার কী বাতে (১৯৪৬-৫৪)
সহকারি সঙ্গীত পরিচালক— সার্কাস গার্ল, বাদল, কুলজুগ, কিসকি বিবি, লায়লা মজনু, শামা-সহ প্রায় ৩৫টি ছবি (১৯৪২-১৯৬৯)।

বাংলা সিনেমা
সঙ্গীত পরিচালক
মা, চলাচল, পঞ্চতপা, পথে হলো দেখা, কাঞ্চন কন্যা, শুভা ও দেবতার গ্রাস-সহ প্রায় ৩২টি ছবি (১৯৫৬-১৯৮৭)
সঙ্গীত আয়োজক— জয়দেব, চিরকুমার সভা, হাঁসুলিবাঁকের উপকথা, পলাতক, হাসপাতাল, ধন্যিমেয়ে, সন্ন্যাসী রাজা-সহ ১১২টি ছবি।
আবহ সঙ্গীত পরিচালনা— শত্রু, আব্বাজান, ইন্দ্রজিৎ-সহ ১৬টি ছবি।

যাত্রা, নাটক ও অন্যান্য
আবহ সঙ্গীত পরিচালনা— কঙ্কাল কথা কও (যাত্রা), কাচের পুতুল (নাটক), মুচিরাম গুড় (নাটক), আগন্তুক (নাটক), সোনালি আগুন (নাটক), মধুসূদন দত্ত (নাটক), খোঁজ (হিন্দি নাটক), গোদাম্বা (হিন্দি নৃত্যনাট্য), সম্ভবামি যুগে যুগে (নৃত্যনাট্য), চৈতন্য মহাপ্রভু (নৃত্যনাট্য), সীতা (পুতুল নাচ)।

যে সব শিল্পীর সান্নিধ্যে কাজ করেছেন
পারুল বিশ্বাস, আমীরবাঈ কর্নাটকী, রাজকুমারী, খান মস্তানা, জি এম দুরানী, নূরজাহান, লতা, আশা, শচীন দেববর্মণ, হেমন্তকুমার, পাহাড়ী সান্যাল, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

যে সব সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন
উস্তাদ ঝন্ডে খান, মীর সাহেব, রফিক গজনভী, বসন্ত দেশাই, অনিল বিশ্বাস, কে দত্ত, বসন্ত নাইডু, এস এন ত্রিপাঠী, রাম গঙ্গোপাধ্যায়, সি রামচন্দ্র, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, জ্ঞানপ্রকাশ প্রমুখ।

সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে বিদেশ ভ্রমণ
ইরাক, ইরান ইজিপ্ট (১৯৪০)-এ গিয়েছেন ১৮ বছর বয়সে। বিশ্ব যুব উৎসবে হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড), রাশিয়া, তাসখণ্ডে। ‘কনসেপ্ট ট্যুরে’ গিয়েছেন হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, সাউথ আমেরিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জাপান।

সম্মান
অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন, আলাউদ্দিন খান পুরস্কার, এশিয়ান পেন্টস শিরোমণি, সায়ক পুরস্কার, ইন্দিরা গাঁধী পুরস্কার, রাজীব গাঁধী পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় স্মৃতি স্মারক হিউম্যানিটি মিশন পুরস্কার, কমলাদেবী রাই পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, দেশিকোত্তম ও মোহর।

ঋণ: ‘জেগে থাকি সপ্তসুরে’
তথ্য: পাপিয়া মিত্র, নিজস্ব চিত্র
 
 

 
 
 
 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.