|
|
|
|
|
ঐতিহ্য |
বেঙ্গল থিয়েটার |
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ অভিনয় দিয়ে ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর সূচনা হয়েছিল তথাকথিত বাংলা পেশাদারি থিয়েটারের। নাম ছিল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। প্রথম পেশাদারি থিয়েটার হলেও নিজস্ব রঙ্গমঞ্চ ছিল না ওই দলের। মধুসূদন সান্যালের ৩৬৫ আপার চিৎপুর রোডের বাড়ির একতলা ভাড়া নিয়ে খোলা হয়েছিল ওই থিয়েটার। এর ঠিক পরের বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঠনঠনে কালীবাড়ি অঞ্চলে কৃষ্ণচন্দ্র দেবের বাড়িতে গড়ে ওঠে ‘ওরিয়েন্টাল থিয়েটার’। আবার ওই বছরেই এপ্রিল মাসে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ ভেঙে তৈরি হয় ‘হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার’। সেই দলের অভিনয় হত লিন্ডসে স্ট্রিটের অপেরা হাউস ভাড়া করে। এগুলি সবই পেশাদার থিয়েটার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও, এদের কারও নিজস্ব ভবন বা রঙ্গমঞ্চ (Proscenium) ছিল না। অন্যের বাড়ি বা ঠাকুরদালান ভাড়া নিয়েই গড়ে উঠেছিল থিয়েটারের দলগুলি। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে প্রথম নিজস্ব ভবনে থিয়েটার মঞ্চস্থ করে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’। কলকাতার আর পাঁচটা পুরনো রঙ্গমঞ্চের মতো ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ আজ আর না থাকলেও ওই ভবনেই রয়েছে আজকের বিডন স্ট্রিট ডাকঘর।
‘ন্যাশনাল থিয়েটার’-এর সাফল্যে উত্সাহিত হয়ে সে যুগের বিখ্যাত ধনী ছাতুবাবুর (আশুতোষ দেব) দৌহিত্র শরত্চন্দ্র ঘোষ নামের এক নাট্যপ্রেমী পেশাদার থিয়েটার গড়তে আগ্রহী হলেন। রঙ্গালয় পরিচালন বিষয়ে তিনি একটি কমিটি গড়লেন, যার সদস্য হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত, সত্যব্রত সাম্যধ্যায়ী প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি। বিডন স্ট্রিটে রামদুলাল সরকারের ঠাকুরবাড়ির বিপরীতে ফাঁকা মাঠে নির্মিত হল নতুন রঙ্গমঞ্চ। মঞ্চটি প্রথমে ছিল খোলার চালের, পরে পাকা গাঁথনি হয়। লিউইসের লাইসিয়াম থিয়েটারের আদলে গড়ে উঠল বাংলার প্রথম নিজস্ব ভবন-সহ স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’। ঠিকানা, ৯ বিডন স্ট্রিট। উত্তর কলকাতার যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ ও বিডন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ছিল ওই রঙ্গমঞ্চ।
নিজস্ব ভবন ছাড়াও বাংলা নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ আরও দু’টি কারণে বিখ্যাত। প্রথমত, বেঙ্গল থিয়েটারই বাংলার প্রথম পেশাদার ‘থিয়েটার হল’ যা নির্মিত হয়েছিল জনসাধারণের শেয়ারের টাকায়। ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনের সূত্রে জানা যায়, আঠারো জন লগ্নিকারী এক হাজার টাকা করে শেয়ার কেনার ফলে মোট আঠারো হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। সেই টাকাতেই তৈরি হয় থিয়েটারটি। দ্বিতীয়ত, বাংলা পেশাদারি থিয়েটারে স্ত্রী-চরিত্রে মহিলা শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করানো। এর আগে লেবেদেভ ‘দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার’ কিংবা নবীনচন্দ্র বসুর বাড়ির ‘শ্যামবাজার থিয়েটার’-এ মহিলারা অভিনয় করলেও সেগুলির কোনওটাই পেশাদার রঙ্গমঞ্চ ছিল না। তার পরেও, কি পেশাদার থিয়েটার, কি সখের থিয়েটার— কোনও জায়গাতেই মহিলা শিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করানো হয়নি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম থেকেই বাংলা রঙ্গমঞ্চে নারী চরিত্রগুলিতে নারীদের দিয়ে অভিনয় করানোর পক্ষে সওয়াল করে এলেও সমাজপতিদের রোষের ভয়ে কেউই তা করতে সাহস পাননি। কিন্তু নিজে সে যুগের এক জন অন্যতম সমাজপতি হওয়ায় ঝুঁকিটা নিতে পেরেছিলেন শরত্চন্দ্র। অথচ প্রগতিশীল হওয়া সত্ত্বেও এটি মানতে পারেননি বিদ্যাসাগর। ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি রঙ্গালয় পরিচালন কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।
প্রস্তুতি পর্বের মাঝপথে এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে গেল। ২৯ জুন, ১৮৭৩, কপর্দকহীন অবস্থায় মারা গেলেন ‘বেঙ্গল থিয়েটার’-এর অন্যতম উপদেষ্টা মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাই স্থির হল, মধুসূদনের লেখা ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়েই সূচনা হবে নাট্যালয়ের এবং টিকিট বিক্রির লভ্যাংশ ব্যয় করা হবে মাইকেলের সহায়সম্বলহীন পুত্রকন্যাদের সাহায্যার্থে। ‘শর্মিষ্ঠা’ মধুসূদন দত্তের লেখা প্রথম নাটক। বাংলা নাটকের দুরাবস্থা দেখে তিনি নিজেই কলম ধরেছিলেন মৌলিক নাটক লেখার জন্য। তারই প্রথম ফসল এই নাটক।
অবশেষে ১৬ অগস্ট, ১৮৭৩ বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চে প্রথম স্ত্রী-চরিত্রে মহিলা শিল্পী-সহ মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের অভিনয় দিয়ে দ্বারোদ্ঘাটন হয় বেঙ্গল থিয়েটারের। বাংলা পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের প্রথম সেই চার অভিনেত্রী হলেন— শ্যামা, জগত্তারিণী, এলোকেশী ও গোলাপ। সে যুগের ‘রীতি’ অনুসারে ওই চার অভিনেত্রীই অবশ্য এসেছিলেন তথাকথিত নিষিদ্ধ পল্লি থেকে।
কলকাতার নাট্যমঞ্চের ইতিহাসে ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। প্রায় আঠাশ বছরের স্থায়িত্ব কালে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক— সব ধরনের নাটকই মঞ্চস্থ হয়েছে এখানে। প্রথম পেশাদারি থিয়েটার দল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ যেমন অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে বার বার ভেঙেছে, নাম বদল হয়েছে, বেঙ্গল থিয়েটারের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। নামে সামান্য পরিবর্তন অবশ্য এক বার ঘটেছিল। ১৮৯০ সালের জানুয়ারিতে রানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টরের সংবর্ধনা উপলক্ষে ‘শকুন্তলা’ নাটকের অভিনয় প্রদর্শন করে ‘রয়্যাল’ উপাধি লাভ করে বেঙ্গল থিয়েটার। এবং তার পর থেকে দলের নাম হয় ‘রয়্যাল বেঙ্গল থিয়েটার’। দীর্ঘ আঠাশ বছর বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে নেতৃত্ব দেয় এই দল। কিন্তু শরত্চন্দ্র ঘোষ ও তার পরে বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পর বেঙ্গল থিয়েটারের হাল ধরার আর কেউ রইল না। অবশেষে (শেষ অভিনয় ১৭ মার্চ ১৯০১) নাট্যদলটি বন্ধ হয়ে যায়।
বেঙ্গল থিয়েটারের সেই বাড়িতে এখন বিডন স্ট্রিট ডাকঘর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বার বার পরিবর্তিত হলেও ডাকঘরের বিশাল হলটির ছাদের কড়ি-বরগা, স্কাই-লাইট কিংবা বাইরের ঢালাই লোহার জাফরি কাজ করা গেট এখনও পুরনো স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করে চলেছে। কিন্তু সামনে বিশাল বটগাছ থাকায় বাড়িটির সৌন্দর্য বাইরে থেকে দেখা যায় না। ডাকঘরের কাউন্টার, চেয়ার, টেবিলের মধ্যে কান পাতলে আজও হয়তো শোনা যাবে সে যুগের নাটকের সংলাপ।
|
তথ্য ও ছবি: গৌতম বসুমল্লিক |
|
|
|
|