|
|
|
|
|
|
খ্যাপার শহর |
কৌস্তভ ভট্টাচার্য
(চেন্নাই থেকে) |
টানেলের মধ্যে ট্রেন ঢুকলে, আমার খুব মজা লাগে— সেই ছোটবেলা থেকে। একটা আস্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস ছেড়ে হঠাত্ করে জনমানবহীন ত্রিসীমানায় এক আঁধার-অভিজ্ঞতা! কিন্তু সে বার সিমলা যাওয়ার পথে প্রত্যক্ষ করলাম থুড়ি হাতেনাতে টের পেলাম ‘রাতের চেয়ে অন্ধকার’-এর মতো বড় বড় কথাবার্তা দু’এক মিনিটেরই। তার পরই আলো... আলো... করে ছুকছুকানিটা বুকের মধ্যে যেন ধুকপুক ধুকপুক করতে থাকে।
ধান ভানতে বসে শিবের সঙ্গীতচর্চা আমার চির কালের বদ অভ্যাস। এত টানেল-ফানেল দিয়ে যেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলাম, সেটা হচ্ছে, অনেক দিন পর ‘কলকাতা দর্শন’ ঠিক টানেল থেকে বেরিয়ে দেখা আলোর মতো দীর্ঘস্থায়ী না হলেও মেট্রোর ‘পরবর্তী স্টেশন রবীন্দ্রসদন... প্ল্যাটফর্ম ডান দিকে’-এর মতো এক টুকরো আলোর ক্ষণস্থায়ী উপস্থিতি। সেটাই বা কম কিসে!
এ বারের কলকাতা মানে— মায়ের হাতের অনেক রান্না, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হাতছাড়া হয়ে বেহালাতে এই প্রথম ‘কলকাতা পুলিশ’ দর্শন আর নিজের নতুন কামের কাঁধে শহর আঁচড়ে বেড়ানো!
না, এই লেখাটার উদ্দেশ্য ঠিক কলকাতার রূপ-বন্দনা করে ফ্রাস্টুপ্রীতিকে ‘প্যাম্পার’ করা নয়! বরং একটা শহরে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে জিনিসগুলো খুব নিশ্চিত্ ও প্রবল ভাবে জুড়ে যায় নিজের সঙ্গে, সেগুলোকে জীবনে প্রথম বার প্রবাসী চোখে একটু তোল্লাই দেওয়ার প্রচেষ্টা।
পুজোর আগে হঠাত্ কয়েক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেল আমার শরীর, শপিং মলের চৌহদ্দি, ট্যাক্সির জানলার কাচ...। এখানে এই ঝুপ করে মেঘ নেমে আসা এবং কারণে অকারণে মন খারাপ-ভাল-খারাপ— এই বৃষ্টি বৃষ্টি খেলা— আমার শহরের চেয়ে ভাল করে আর কেই বা জানে!
একটা সিনেমাও দেখা হল না, এ বার! শুধু বাড়িতে বসে ভিসিডি চালিয়ে রঞ্জনা-র (অঞ্জন দত্তের ছবি রঞ্জনা আমি আর আসব না) মধ্যে ছোটবেলা খুঁজলাম। জীবনে প্রথম বার মুগ্ধ করতে করতেও পুরোটা করতে পারল না ‘পুরনো গিটার’! ‘খাদের ধারের রেলিং’— আমার কি বয়েস বাড়ছে?
এক দিন কালীঘাট গিয়েছিলাম। না, পুজো দিতে না। নেহাতই মন্দির চত্বরে ছবি তুলতে যাওয়া! ওসামা বিন লাদেন আফগান মুলুকে কী ভাবে মনে রয়েছেন জানা নেই, কিন্তু কলকাতাতে ঠাকুরমার দোকানে রুমালে রুমালে তার অবাধ বিচরণ! আমার কলকাতা জঙ্গিপনাকে পকেটস্থ করতে চাইছে কি?
আমার শহরে ট্রাম আস্তে আস্তে ব্যাগ গুছিয়ে হাঁটা দিচ্ছে মিউজিয়ামের দিকে! এক শহর আলোর মধ্যে পার্ক সার্কাস আর টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো দু’টিই মূর্তিমান অন্ধকার হয়ে পড়ে আছে! এদের ছবিতে ভেঙে যাওয়া কয়েকটা সুখস্বপ্ন বাদে আরও কিছু ‘ক্যাপশন’ লাগানো যায় কি?
একটা আস্ত পার্ক স্ট্রিট এখনও ঋজু ভাবে দম্ভ ধরে রেখেছে। সেক্টর ফাইভ এখনও আভিজাত্যে ভরপুর, যোগেশ মাইমের গলি একই রকম অপরিষ্কার হয়েও একই রকম সজীব! একশো জীবন এখনও একসঙ্গে সিগন্যাল দেখছে, রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়ছে পাশ ফিরে, হাতড়ে বেড়াচ্ছে, বেরোতে চাইছে, জায়গা মাঝে মাঝে পাচ্ছে, আবার কখনও রাস্তা ভুল করছে। একটা রাস্তা খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রতি মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে টর্চ জ্বলছে সবার। আমার শহরকে অন্ধ করে দেয়, সে সাধ্য কার?
‘আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই’!
|
কর্মসূত্রে আপাতত চেন্নাইয়ে বসবাস।
বছর তিনেক আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ। প্রায় আড়াই বছর একটি নামী কোম্পানিতে কাজ করার পর এখন চেন্নাইতে ম্যানেজমেন্ট কোর্সে পাঠরত। লেখালিখিটা প্যাশন। একটি বাংলা লিটল্ ম্যাগাজিনের লেখক এবং অন্যতম সম্পাদক। তবে
ইচ্ছে চিত্র পরিচালক হওয়ার। চারটি স্বল্প দৈর্ঘের ছবি পরিচালনাও করেছেন ইতিমধ্যে। |
|
|
|
|
|
|